নবী করীম (সা:) এর সম্মুখে উচ্চস্বরে কথা বলা অপরাধ

        কখনো কোনো একজন সাহাবীও নবী করীম (সা:) এর সম্মুখে বেয়াদবী করেছেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং প্রত্যেক সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর রাসূলের জন্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে সকল সময় প্রস্তুত থাকতেন। নিজের সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজন এমনকি নিজের প্রাণের তুলনায় নবী করীম (সা:) কে তাঁরা অধিক ভালোবাসতেন। সুতরাং আকাশের নীচে যমীনের বুকে সর্বাধিক প্রিয় এ মানুষটির সাথে যেনো নিজের অজান্তেও বেয়াদবি না ঘটে এ ব্যাপারে তাঁরা সর্বোচ্চ সচেতনতা অবলম্বন করার চেষ্টা করতেন।

        হুদাইবিয়ার সন্ধিকালে মক্কার ইসলাম বিরোধী শক্তি উরওয়া ইবনে মাসউদ সাকাফীকে আলোচক হিসাবে প্রেরণ করলো। এ লোকটি নবী করীম (সা:) এর সাথে মুখোমুখি বসে সন্ধির শর্ত নিয়ে আলোচনা শুরু করলো এবং চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলো। আল্লাহর রাসূলের পিছনে শাণিত তরবারী হাতে মক্কার আলোচকের দিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হযরত মুগিরা ইবনে শু'বা (রা:) দাঁড়িয়ে ছিলেন। আরবের চিরন্তন প্রথানুযায়ী উরওয়া আলোচনা চলাকালে ডান হাত দিয়ে নবী করীম (সা:) এর পবিত্র দাড়ি স্পর্শ করছিলো। বিষয়টি মর্যাদাহানীকরও ছিলো না এবং সামাজিক প্রথা হিসাবে আল্লাহর রাসূলও এতে আপত্তি জানাননি। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম বিষয়টি সহ্য করলেন না। হযরত মুগিরা ইবনে শু'বা (রা:) আহত সিংহের মতোই গর্জন করে উঠলেন, 'উরওয়া, তোমার হাত সরিয়ে নাও! আর একবার যদি তোমার হাত আল্লাহর রাসূলের দাড়ি স্পর্শ করতে এগিয়ে আসে তাহলে আমার তরবারী তোমার হাতকে ফিরিয়ে দিবে'।

        মুসলমানদের সংখ্যা তখন নিতান্তই অল্প, নারী-পুরুষসহ দুই হাজারেও উন্নীত হয়নি। সারা দুনিয়া তাঁদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর রাসূল (সা:) এর মর্যাদা রক্ষায় সিংহের মতো গর্জন করেছেন। একজন অমুসলিম আরবের আবহমান প্রথা অনুসরণ করছে মাত্র, এটাও তাঁরা বরদাস্ত করেননি। বর্তমানে দেড়শত কোটির ওপরে মুসলমানদের সংখ্যা, প্রতিদিন পৃথিবীর কোথাও না কোথাও একজন হলেও অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করে এবং মুসলিম নারীর গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়ে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধিই হচ্ছে। এ পৃথিবীতে অনেকগুলো বিশালায়তন রাষ্ট্রের অধিকারী মুসলিমরা। অঢেল অর্থ-সম্পদের মালিক তাঁরা। অগণিত বনজ, খনিজ, মৃত্তিকা, জলজ সম্পদের মালিক এবং অসংখ্য কর্মীর হাত রয়েছে মুসলমানদের। আণবিক অস্ত্রসহ বহু ধরনের অস্ত্র রয়েছে এদের হাতে।

        এরপরেও প্রায় দিনই নবী করীম (সা:) এর মর্যাদার প্রতি আঘাত আসছে। পত্র-পত্রিকা ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে নবী করীম (সা:) এর ব্যঙ্গ চিত্র প্রকাশসহ তাঁর প্রতি কটুক্তি করা হচ্ছে। তাঁর প্রতি মর্যাদাহানীকর বিষয় সম্বলিত অগণিত প্রকাশনা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ দেড়শত কোটির অধিক মুসলমান নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। এর স্বাভাবিক পরিণতির কারণেই মুসলমানরা বর্তমান পৃথিবীতে সবথেকে লাঞ্ছিত, ঘৃণিত, অবহেলিত ও নির্যাতিত হচ্ছে। একটি চতুষ্পদ প্রাণী বা পিপিলীকার প্রাণের যে মূল্য দেয়া হচ্ছে তা মুসলমানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হচ্ছে না।

        মক্কার আলোচক উরওয়া ইবনে মাসউদ সাকাফী নিজেদের লোকজনের কাছে ফিরে গিয়ে নিজের চোখে দেখা বিস্ময় গোপন করতে পারেনি। হুদাইবিয়া নামক স্থানে নবী করীম (সা:) এর প্রতি সাহাবায়ে কেরামের অন্তর ঢেলে দেওয়া শ্রদ্ধা আর তুলনাহীন অনুপম ভালোবাসার বাস্তব দৃষ্টান্ত দেখে উরওয়া হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলো। মানুষ যে আরেকজন মানুষকে এতটা অকৃত্রিম ও অসীম ভক্তি, শ্রদ্ধা করতে পারে তা ছিলো উরওয়ার কল্পনারও অতীত। প্রেরকদের কাছে ফিরে এসে সে বিস্মিত কণ্ঠে বলেছিলো, 'আমি পারস্য সম্রাটের দরবারে গিয়েছি, রোম সম্রাট ও নাজ্জাশীর দরবারেও গিয়েছি। সম্রাট ও রাজার প্রতি রাজ সভাসদদের আচরণ দেখেছি। মুহাম্মাদ (সা:) এর সাথীগণ তাঁর সাথে যে আচরণ করে তার তুলনা কোথাও দেখিনি। কোনো একজন মানুষকে তাঁর অনুসারীরা যে হৃদয় দিয়ে এমনভাবে ভক্তি শ্রদ্ধা করতে পারে, তাঁর আদেশ পালন করার জন্যে অকৃত্রিমভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারে, তাঁর প্রতি যে এভাবে আনুগত্যের মাথানত করে দিতে পারে, তা আমি কোথাও দেখিনি। আমি দেখলাম, তাঁর মুখ থেকে কোনো আদেশ বের হবার সাথে সাথেই তাঁর সাথীরা তা পালন করার জন্যে প্রতিযোগিতা শুরু করে। তিনি অজু করেন কিন্তু অজুর পানি মৃত্তিকা স্পর্শ করার পূর্বেই তাঁর সাথীরা দু'হাতে নিয়ে নিজেদের দেহ সিক্ত করতে থাকে। তিনি থুথু বা কফ নিক্ষেপের প্রস্তুতি নিতেই অগণিত হাত এসে তাঁর মুখগহ্বরের সম্মুখে তালু বিছিয়ে দেয়। নিক্ষিপ্ত কফ বা থুথু সকলে একটু একটু করে নিয়ে গভীর মমতায় নিজ দেহে সুগন্ধির মতোই ব্যবহার করে। এমন দৃশ্য আমি কোথাও দেখিনি। পৃথিবীর কোনো কিছুর বিনিময়ে তাঁর সাথীরা তাঁকে ছেড়ে কোথাও যেতে আগ্রহী হবে না'।

        এটাই ছিলো নবী করীম (সা:) এর প্রতি সাহাবায়ে কেরামের মায়া-মমতা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসার বাস্তব প্রতিফলন। একবার দরবারে নববীতে সাহাবায়ে কেরাম বসে কথা বলছিলেন, তাঁদের পরস্পরের মধ্যের আলোচনা বোধহয় কিছুটা গুঞ্জন সৃষ্টি করেছিলো। রাসূলের কর্ণকুহরে অন্যের উচ্চকণ্ঠ প্রবেশ করবে বা রাসূলের কণ্ঠের তুলনায় অন্যের কণ্ঠ তাঁর সম্মুখে উচ্চ হবে, মহান আল্লাহ এটা বুরদাস্ত করলেন না। তৎক্ষণাত আয়াত অবতীর্ণ করে নির্দেশ দিলেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيَّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَنْ تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ

        হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, কখনো নিজেদের আওয়াজ নবীর আওয়াজের ওপর উঁচু করো না এবং নিজেরা যেভাবে একে অপরের সাথে উঁচু কণ্ঠে আওয়াজ করো, নবীর সামনে কখনো সে ধরনের উঁচু আওয়াজে কথা বলো না, এমন যেনো, কখনো না হয় যে, তোমাদের সব কাজকর্ম এ কারণেই বরবাদ হয়ে যাবে এবং তোমরা তা জানতেও পারবে না। (সূরা হুজুরাত-২)

        কল্পনাতীত উচ্চে নবী করীম (সা:) এর মর্যাদা, যাঁর সামনে উচ্চ কণ্ঠে কথা বলাও আল্লাহ তা'য়ালা পছন্দ করেননি। সতর্ক করে দেয়া হলো, কেউ যদি নবী করীম (সা:) এর সামনে উঁচু আওয়াজে কথা বলে তাহলে তাঁর জীবনের সকল কাজকর্ম বরবাদ হয়ে যাবে। এ আদেশের মাধ্যমে উপস্থিত এবং অনুপস্থিত কিয়ামত পর্যন্ত সকল মুসলিম মিল্লাতকে জানিয়ে দেয়া হলো তাঁরা যে নবী-রাসূলের অনুসারী, তাঁর মর্যাদা কতটা বিশাল এবং উচ্চতার কোন্ উচ্চ শিখরে। সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী নবীর অনুসারী হবার কারণে তাঁদের মর্যাদাও মহান আল্লাহর দৃষ্টিতে কতটা উচ্চে পরোক্ষভাবে এ কথাও উক্ত নির্দেশের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

        উপস্থিত ঐ মানুষগুলোকেই সতর্ক করা হয়েছিলো, যারা নবী করীম (সা:) এর ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল কিছু উৎসর্গ করার জন্যে সব সময় প্রস্তুত থাকতেন। আর অনুপস্থিত লোকজন যদি নবী ও তাঁর আদর্শের মর্যাদা রক্ষার জন্যে ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত না হয়, তাহলে তাদের মর্যাদা বলতে পৃথিবীতে কোনো কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, এ বিষয়টিও জানিয়ে দেয়া হয়েছে এ কথার মাধ্যমে, 'তোমাদের সব কাজকর্ম এ কারণেই বরবাদ হয়ে যাবে এবং তোমরা তা জানতেও পারবে না'। বর্তমান বিশ্বে মুসলিম মিল্লাতের কোনো কর্মেরই ন্যূনতম মূল্য নেই এবং মর্যাদা বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই শুধুমাত্র এ কারণে যে, মুসলিম মিল্লাত নবী করীম (সা:) ও তাঁর আদর্শের প্রতি অমার্জনীয় অবহেলা প্রদর্শন করছে।

        নবী করীম (সা:) এর জীবদ্দশায় যাঁরা তাঁর সান্নিধ্য অর্জনে ধন্য হয়েছিলেন, দরবারে রেসালাতের প্রতি কিভাবে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে, কিভাবে রাসূলের সাথে কথা বলতে হবে, কথা বলার সময় কোন্ শব্দ চয়ন করে কথা বলতে হবে এবং কতটা উন্নত শিষ্টাচার প্রদর্শন করতে হবে, তা যেমন শিক্ষা দেয়া হলো তেমনি একথাও তাঁদেরকে জানিয়ে দেয়া হলো- তাঁরা যেনো ক্ষণিকের জন্যেও ভুলে না যায় যে, কোন্ ব্যক্তির সম্মুখে তাঁরা কথা বলছেন। তাঁরা সাধারণ কোনো মানুষের সাথে কথা বলছেন না, পৃথিবীর কোনো রাজা-বাদশাহ বা সম্রাটের সাথেও কথা বলছেন না। সকল সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এবং মহান আল্লাহ কর্তৃক সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত নবী-রাসূল (সা:) এর সাথে কথা বলছেন।

        মহান আল্লাহর এ নির্দেশ শুধুমাত্র উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামের জন্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং কিয়ামত পর্যন্ত সকল মুসলমানের জন্যেই প্রযোজ্য। যদিও বর্তমানে দৈহিকভাবে নবী করীম (সা:) অনুপস্থিত। কিন্তু তাঁর প্রতি মহান আল্লাহ তা'য়ালা যে কুরআন অবতীর্ণ করেছেন, সে কুরআন অবিকৃত অবস্থায় উপস্থিত। তাঁর মর্যাদাবান আদেশ, নিষেধ ও উপদেশ উপস্থিত এবং তিনি যে আদর্শ সহকারে প্রেরিত হয়েছিলেন সেই 'ইসলাম' সার্বক্ষণিকভাবে উপস্থিত। জীবিত থাকা অবস্থায় নবী করীম (সা:) এর প্রতি সাহাবায়ে কেরাম সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন, বিনিময়ে মহান আল্লাহ তা'য়ালা পৃথিবীর নেতৃত্ব তাঁদের পদতলে এনে দিয়েছিলেন। সকল সমস্যা সমাধানের সুত্রের আশায় সমগ্র পৃথিবী তাঁদেরই দিকে চাতক পাখির মতোই তাকিয়ে থাকতো। তাঁদের প্রবর্তিত সভ্যতা-সংস্কৃতিই পৃথিবীতে বিজয়ীর আসনে আসীন হয়েছিলো। মহান আল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত তাদেরকে মুক্তিকামী মানুষের আদর্শ ও অনুসরণীয় নেতা বানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহর রাসূলের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শনের নগদ বিনিময় আল্লাহ তা'য়ালা পৃথিবীতে বাস্ত বে প্রদর্শন করেছেন।

        মুসলিম মিল্লাতকে এ কথা স্মরণে রাখতে হবে, পৃথিবীতে তাদের উন্নতি, প্রগতি, মর্যাদা সকল কিছুই নবী করীম (সা:), কুরআন তথা তাঁর আনীত আদর্শের সাথে জড়িত। মুসলিম মিল্লাত যতদিন রাসূল (সা:), কুরআন ও তাঁর আনীত আদর্শের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন করেছে, ততদিনই তাঁরা মর্যাদার আসনে আসীন থেকেছে। আর যখনই তাঁরা এসবের প্রতি উদাসীন্য ও অবহেলা প্রদর্শন করেছে, তখনই তাঁরা ঘৃণা ও লাঞ্ছনার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হয়েছে। সুতরাং নবী করীম (সা:) এর প্রতি অবতীর্ণকৃত কুরআন-হাদীস তথা ইসলামের আদেশ-নিষেধ শোনামাত্র যদি তাঁরা মর্যাদা প্রদর্শন ও আনুগত্যের মাথানত করে দেয়, তাহলে পুনরায় তাঁরা তাদের হারানো মর্যাদা ফিরে পাবে ইনশাআল্লাহ।

        যে মুসলমানের হৃদয়ে সামান্য পরিমাণ ঈমানের গন্ধ রয়েছে, সেই মুসলমানও যখন নবী করীম (সা:) এর নাম বা তাঁর পবিত্র বিষয়সমূহ অথবা মদীনার প্রসঙ্গ শোনে, তখন তাঁর মনে ভিন্ন এক আবেগের ঢেউ খেলে যায়। মনে আক্ষেপ জাগে, একটিবার- মাত্র একটি বারও যদি আল্লাহর রাসূল (সা:) এর ঐ অপূর্ব সুন্দর চেহারা দেখতে পেতাম! যদি আমি সাহাবায়ে কেরামের একজন হতাম। স্বপ্নের মধ্যেও যদি সবথেকে ঐ সুন্দর মানুষটিকে পলকের জন্যেও দেখতে পেতাম! ক্ষণিকের জন্যেও যদি তাঁর পবিত্র সান্নিধ্য অনুভব করতে পারতাম।

        নবী করীম (সাঃ) এর প্রসঙ্গ শুনলে এ ধরনের অনেক কল্পনাই মনের জগতে উঁকি দেয়। এর কারণ হলো, ইসলামী চিন্তা-চেতনাবোধ যাদের মধ্যে রয়েছে, অজান্তেই তাঁরা নবী করীম (সা:) এর প্রতি নিজ প্রাণের থেকেও বেশি আকর্ষণ অনুভব করে থাকেন। আর এই আকর্ষণের বাস্তব প্রকাশ হলো, নবী করীম (সা:) এর প্রতি কেউ সামান্য কটাক্ষ করলেও তাঁরা সহ্য করতে পারেন না। ঈমানের অন্যতম দাবী হলো, একজন মুসলমান আল্লাহর রাসূল (সা:) কে নিজ প্রাণের তুলনায় অধিক ভালোবাসবে। আর এই ভালোবাসার প্রমাণ সে দিবে নবী করীম (সা:) এর আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে। শুধুমাত্র মুখে নবীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করলে সে ভালোবাসার সামান্যতম মূল্যও দেয়া হবে না। যে ব্যক্তি আল্লাহর নবী (সা:) এর আদর্শ অনুসরণ করার জন্যে ব্যাকুল থাকে এবং সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, বুঝতে হবে সেই ব্যক্তিই তাঁকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে।

        সাহাবায়ে কেরাম নবী করীম (সা:) কে নিজ চোখে দেখে ধন্য হয়েছেন, তাঁর পবিত্র সান্নিধ্য অনুভব করেছেন, তাঁর সাথে প্রাণভরে কথা বলার দুর্লভ সুযোগ পেয়েছেন, একত্রে তাঁর সাথে চলাফেরা ও আহার করারও সুযোগ পেয়েছেন। সাহাবায়ে কেরামের একজন আল্লাহর রাসূল (সা:) কে যেভাবে ভালোবাসতেন, তাঁর সেই ভালোবাসা যদি দাড়ি পাল্লার একদিকে রাখা হয় আর সারা দুনিয়ার মুসলমানদের ভালোবাসা আরেক পাল্লায় রাখা হয়, তবুও সেই সাহাবার ভালোবাসার ওজনই বেশি হবে। বুখারী হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে আল্লাহর রাসূল (সা:) বলেছেন, 'তোমরা আমার সাহাবায়ে কেরামকে মন্দ বলো না, আমার সাহাবায়ে কেরামের এক মুষ্ঠি দানের যে মূল্য সারা দুনিয়ার মুসলমানদের দানের সে মূল্য হবে না'।

        ইতিহাস অভিজ্ঞ ব্যক্তি মাত্রই জানেন যে বদর, ওহূদ, খন্দকসহ অধিকাংশ যুদ্ধ যাদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিলো তারা ছিলেন পরস্পর ঘনিষ্ঠজন। পিতা একদিকে পুত্র আরেক দিকে, এক ভাই একদিকে অপর ভাই অন্য দিকে এবং মা এক দিকে আর সন্তান আরেক দিকে। এভাবে একান্ত আপনজনদের মধ্যেই ঐ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধসমূহ সংঘটিত হয়েছিলো। এর একমাত্র কারণ ছিলো নবী করীম (সা:) এর প্রতি তাঁদের প্রাণ উৎসর্গীকৃত ভালোবাসা। আল্লাহর রাসূল (সা:) যে আদর্শের ভিত্তিতে তাঁদেরকে প্রশিক্ষণ দিলেন, সেই আদর্শ এবং স্বয়ং নবীর প্রতি অসীম ভালোবাসাই পিতাকে বাধ্য করেছে সন্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র পরিচালনা করতে। সন্তান বাধ্য হয়েছে গর্ভধারিণী মায়ের কথা অমান্য করতে। স্ত্রী বাধ্য হয়েছে প্রিয়তম স্বামীকে পরিত্যাগ করতে।

        হৃদয়ের আকর্ষণ ও ভালোবাসা কোন্ সীমা অতিক্রম করলে পিতা-মাতা জেনে বুঝে সচেতনভাবে নিজের কলিজার টুকরা, নাড়ি ছেঁড়া ধন, নয়নের পুত্তলি সন্তানকে মৃত্যুর মুখে নিক্ষেপ করতে পারেন তা কল্পনা করা যায়।

        সে যুগের শ্রেষ্ঠ মহিলা কবি হযরত খানসা (রা:) মহিলা সাহাবী ছিলেন। এখন পর্যন্ত তাঁর কাব্যগ্রন্থ দুনিয়ার বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়ে দেশে দেশে পঠিত হচ্ছে। তিনি নবী করীম (সা:) ও তাঁর আদর্শকে কেমন ভালোবাসতেন ইতিহাসে ফিরে তাকাই। কাদেশিয়ার যুদ্ধে তিনি তাঁর অবলম্বন চারজন সুদর্শন যুবক সন্তানকে সাথে নিয়ে অংশগ্রহণ করলেন। যুদ্ধের সূচনাতেই তিনি সন্তানদের ডেকে বললেন, 'আমার কলিজার টুকরা সন্তান, অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে আমি তোমাদেরকে বড় করেছি। তোমরা পিছু হটবে না। আল্লাহর রাসূল (সা:) এর আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রয়োজনে শেষ পর্যন্ত নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিবে। যদি তোমরা সকলেই শাহাদাতবরণ করতে পারো, তাহলে আমি শহীদের মা হিসেবে গর্ববোধ করবো'।

        হযরত খানসা (রা:) এর কাছে যুদ্ধের ময়দান থেকে একের পর এক সংবাদ আসতে থাকলো, 'তোমার অমুক সন্তান শহীদ হয়ে গেলো'। এভাবে একের পর এক তাঁর সকল সন্তানের শাহাদাতের সংবাদ আসে আর মা মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে আল্লাহর শোকর আদায় করেন। এভাবে একে একে তাঁর চার সন্তানই শাহাদাতের পেয়ালা পান করলেন। তবুও শ্রেষ্ঠা এই নারীর মধ্যে যেনো অপূর্ণতা রয়ে গেলো। তাঁর যেনো মনে হলো, তাঁর আরো সন্তান থাকলে তাদেরকেও তিনি আল্লাহর রাসূল (সা:) এর প্রেমে সিক্ত হয়ে কুরবান করে দিতেন।

        ওহুদের ময়দান থেকে যখন মদীনায় সংবাদ পৌঁছলো, আল্লাহর রাসূল (সা:) আর নেই। দুশমনদের হাতে তিনি শাহাদাতবরণ করেছেন। এই সংবাদ পৌঁছার সাথে সাথে শোকের মাতম মদীনার সর্বত্র আছড়ে পড়লো। কে কাকে সান্ত্বনা দেয়। নারী- পুরুষ, শিশু-কিশোর, তরুণ-যুবক সকলেই শোকে পাগলপারা। সকলেই ছুটছে ওহুদের ময়দানের দিকে। বনী দীনার গোত্রের একজন নারী ওহুদের ময়দানের দিকে শোকে আলুথালু বেশে ছুটে আসছিলো। এই নারীর পিতা, ভাই, স্বামী-সন্ত ানরা ইসলামের পক্ষে ওহুদের ময়দানে যুদ্ধে এসেছিলো। পথে একজন তাঁকে প্রশ্ন করলো, 'কোথায় যাচ্ছো'?

        জবাবে উক্ত নারী জানালো, 'ওহুদের ময়দানের দিকে যাচ্ছি'।

        প্রশ্নকারী উক্ত নারীকে জানালো, 'তোমার স্বামী এ যুদ্ধে এসেছিলো, সে শাহাদাতবরণ করেছে'।

        সে নারী ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলো, 'কে শহীদ হয়েছে জানতে চাই না। বলো আল্লাহর রাসূল (সা:) কেমন আছেন'?

        এভাবে পথে একের পর এক তাঁকে জানানো হলো, তোমার স্বামী, ভাই, পিতা ও সন্তান শাহাদাতবরণ করেছে। প্রত্যেক বারই উক্ত নারী ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলো, 'কে শহীদ হয়েছে জানতে চাই না। বলো আল্লাহর রাসূল (সা:) কেমন আছে'?

        এরপর ওহুদের ময়দানে উপস্থিত হয়ে সে নারী সাহাবায়ে কেরামের কাছে আল্লাহর রাসূল (সা:) সম্পর্কে জানতে চাইলে তাঁরা তাঁকে জানালেন, 'তিনি ভালো আছেন, তুমি যেমন কামনা করো আল্লাহর রাসূল (সা:) তেমনি আছেন'।

        উক্ত নারী সাহাবায়ে কেরামের কথা যেনো অন্তর দিয়ে গ্রহণ করতে পারলেন না। ব্যাকুল কন্ঠে আবেদন জানালেন, 'আমি আল্লাহর রাসূল (সা:) কে শুধুমাত্র একটি বার দেখতে চাই, আমাকে একটু দেখার সুযোগ দাও'।

        সাহাবায়ে কেরাম সে নারীকে ঐ স্থানে নিয়ে গেলেন যেখানে সাহাবায়ে কেরাম কর্তৃক পরিবেষ্টিত আল্লাহর রাসূল (সা:) আহত অবস্থায় অবস্থান করছিলেন। তাঁর পবিত্র চেহারার দিকে তাঁকিয়ে উক্ত নারী কেঁদে কেঁদে বললেন, 'হে আল্লাহর রাসূল (সা:)! আমার স্বামী, সন্তান, পিতা ও ভাই শাহাদাতবরণ করেছে, আমার কোনো যন্ত্রণা নেই। আপনি জীবিত আছেন এটাই আমার জীবনের সবথেকে বড় সান্ত্বনা'।

        আল্লাহর রাসূল (সা:) কে উক্ত নারী যে কি পরিমাণ ভালোবাসতেন তা কোনো কিছু দিয়ে পরিমাপ বা তুলনা করা যাবে না। প্রত্যেকটি পুরুষ ও মহিলা সাহাবা, তা তাঁরা যে বয়সেরই ছিলেন না কেনো, সকলের কাছেই আল্লাহর রাসূল (সা:) এবং তাঁর মর্যাদা তাঁদের প্রাণ ও পৃথিবীর সকল কিছুর তুলনায় অনেক অনেক বেশী ছিলো। নবী করীম (সা:) এর সাথে কথার বলার ক্ষেত্রে সতর্কবাণী অবতীর্ণ হবার পর থেকে সাহাবায়ে কেরাম তাঁর সাথে এমনভাবে কথা বলতেন, যেনো মনে হতো যে তাঁরা নীরবে চুপিসারে কথা বলছেন। তিনি যখন ইন্তেকাল করলেন, তখন সকল সাহাবায়ে কেরামের কাছেই বিষয়টি যেনো অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিলো। হযরত উমার (রা:) তো মেনে নিতেই পারছিলেন না যে, আল্লাহর রাসূল (সা:) ইন্তেকাল করতে পারেন। তিনি শাণিত তরবারী হাতে উচ্চকণ্ঠে বলেছিলেন, 'যে ব্যক্তি বলবে যে আল্লাহর রাসূল (সা:) ইন্তেকাল করেছেন সে ব্যক্তির মাথা দেহের সাথে থাকবে না'।

        হযরত আবু বকর (রা:) এসে যখন ঘোষণা করলেন, 'যাঁরা মুহাম্মাদ (সা:) এর দাসত্ব করতো তাঁরা যেনো জেনে রাখে যে, তিনি ইন্তেকাল করেছেন। আর যাঁরা মহান আল্লাহর দাসত্ব করে তাঁরা যেনো জেনে রাখে, আল্লাহ তা'য়ালা চিরঞ্জীব এবং চির অক্ষয়'।

        একজন মুসলমানকে অবশ্যই নিজ প্রাণের তুলনায় আল্লাহর রাসূল (সা:) ও তাঁর আদর্শকে ভালোবাসতে হবে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বারবার তাগিদ দেয়া হয়েছে। রাসূল (সা:) বলেছেন, 'যতক্ষণ আমি তোমাদের কাছে তোমাদের সকল কিছুর তুলনায় প্রিয় না হবো, আমার উপস্থাপিত' আদর্শ প্রিয় না হলে তোমরা কেউ-ই মুমিন হতে পারবে না'।

        মুমিনদের প্রাণপ্রিয় মদীনা- মক্কা অপেক্ষা সমতল ভূমি এবং কৃষিকাজের উপযোগী ভূমি এখানে রয়েছে। মদীনার মাটি খুবই সজীব এবং উর্বর। এখানে নানা ধরনের ফসল উৎপন্ন হয়ে থাকে। মদীনার অদূরেই ইতিহাস বিখ্যাত সেই ওহুদ পাহাড় আর স্বয়ং রাসূল (সা:) ও সাহাবায়ে কেরামের রক্তে রঞ্জিত ওহূদ প্রান্তর। মদীনার প্রশস্ত ও গলি পথ, পাহাড়-পর্বত, ঝর্ণা, প্রান্তর, উর্বর ভূমি, বৃক্ষ, তরুলতা, পায়ের নীচের ঘাসসহ সবকিছুই আল্লাহর রাসূল (সা:) ও সাহাবায়ে কেরামের স্মৃতি ধারণ করে রয়েছে। সর্বত্রই এক সময় এসব স্থান আল্লাহর নবী আর সাহাবায়ে কেরামের পদচারণায় স্পন্দিত হতো। এখন আর তাঁদের পবিত্র পদচারণা শোনা যায় না, সবকিছুতেই সীমাহীন নীরবতা। এখানে বাতাসে শুধু ভেসে বেড়ায় মুমিনের নীরব কান্না। সতর্কতার সাথে নিজের কানকে সজাগ না করলে সে কান্নাও শোনা যায় না। কেউ-ই এখানে শব্দ করে কাঁদেন না। শব্দ করে কাঁদলে যদি আল্লাহর রাসূলের সাথে বেয়াদবি হয়ে যায়!

        আল্লাহর পক্ষ থেকে কুরআনে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে, 'আমার রাসূলের সামনে কন্ঠ উঁচু করো না'। কুরআনের এই আয়াতটি রাসূল (সা:) এর রওজা মোবারকের সম্মুখেই উৎকীর্ণ করা রয়েছে। সুতরাং এখানে কেউ-ই কোনোরূপ শব্দ করেন না। নবী করীম (সা:) এর রওজা মুবারকের সামনে কোনো মুমিন যাবে আর তাঁর চোখ শুক্কো থাকবে অথবা বুকের মধ্য থেকে বোবা কান্না তোলপাড় করে কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে আসতে চাইবে না, এমনটি কখনো হতে পারে না। তবুও আল্লাহ তা'য়ালার নিষেধের কারণে কেউই শব্দ করে কাঁদেন না। নীরবে শুধু চোখের পানি ঝরে বুক ভিজিয়ে দেয়। কারণ পৃথিবীতে অবস্থানকালে আল্লাহর হাবীব মর্যাদার যে উচ্চ আসনে আসীন ছিলেন, ইন্তেকালের পরও তিনি সেই আসনেই আসীন রয়েছেন। সুতরাং তাঁর প্রতি কোনো ধরনের বেয়াদবি হয় এমন আচরণ করা হারাম।

Post a Comment

0 Comments