মহানবী (সঃ) এর আকাশের দিকে গমন

        অতঃপর মহানবী (সঃ) হযরত জিব্রাইল (আঃ) ও অন্যান্য উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ফেরেশতাদের সাথে আকাশের দিকে ভ্রমণ শুরু করলেন। কোন কোন বর্ণনা থেকে বুঝা যায়। যে, মহানবী (সঃ) পূর্বের ন্যায় বোরাকে আরোহণ করেই আকাশের দিকে ভ্রমণ করেছিলেন। আবার কোন কোন বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, তিনি মসজিদে আকসা থেকে বের হওয়ার পর যমরদ ও যবরজদ পাথরের তৈরি সিঁড়ির মাধ্যমে আকাশের দিকে আরোহণ করেছিলেন। আর সিঁড়ির উভয় পার্শ্বে ফেরেশতাগণ উপবেশন করে সিঁড়ির উভয় পাশ্বে ফিরিশতাগণ উপবেশন করে সিঁড়ির শোভাবর্ধন করেছিলেন। বিখ্যাত সীরাত বিশারদ ইবনে ইসহাক বলেন, নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীগণ আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলতেন- আমি নিজ কণে শুনেছি, রাসূল (সঃ) বলেছেন-আমি বাইতুল মোকাদ্দাসের ভিতর বিভিন্ন কার্য সমাপ্ত করে যখন বাহিরে বেরিয়ে এলাম তখন আমার জন্য একটি সিঁড়ি আনয়ন করা হল। আমি এত সুন্দর ও উত্তম সিঁড়ি আর কখনো দেখি নাই। এ সিঁড়ি ছাই মানুষের রূহ, রূহের জগতে নিয়ে যাওয়া হয়। মৃত্যুর সময় মানুষ এর দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে। আমার ভ্রমণ সঙ্গী হযরত জিব্রাইল (আঃ) আমাকে উক্ত সিঁড়িতে আরোহণ করালেন। চলতে চলতে আমি আকাশের এক দ্বার পর্যন্ত পৌঁছলাম।

যমিন থেকে আকাশের দূরত্ব

        মহানবী (সঃ) বলেন- "যমীন থেকে আসমানের দূরত্ব পাঁচশ বছরের পথ। প্রতিটি আসমানের পুরত্বও অনুরূপ অর্থাৎ পাঁচশ বছরের পথ।"

        এখানে পাঁচশ বলতে ওলামায়ে কেরাম এ ধরনের হিসাব করেন যে, শরীয়ত মোতাবেক তিন দিনের পথ চলার নিয়তে কেউ ঘর থেকে বের হলে তাকে মুসাফির বলে, আর প্রতি দিনের পথ হবে ষোল মাইল। প্রতি মাইলে সতরশো ষাট গজ এবং প্রতি গজে দু'হাত।

        যেহেতু কোন মানুষ সারাদিন অবিশ্রাম হাঁটতে পারে না। কারণ এরই মধ্যে খাওয়া, নামায পড়া, পায়খানা-প্রশ্রাব এবং আরাম করা ইত্যাদিরও প্রয়োজন আছে। তাই একজন মানুষ প্রয়োজনীয় কাজ সেরে ষোল মাইলের অধিক হাঁটতে পারে না। সুতরাং তিন দিনে আটচল্লিশ মাইল হয়। এ হিসাবে দেখা যায় এক মাসের পথ হবে চারশ আশি মাইল। এক বছরে হবে পাঁচ হাজার সাতশ ঘাট মাইল। একশ বছরের পথ হবে পাঁচ লক্ষ ছিয়াত্ত্বর হাজার মাইল এবং পাঁচশ বছরের পথ দাঁড়ায় আটাশ লক্ষ আশি হাজার মাইল। সুতরাং যমীন থেকে আসমানের দূরত্ব পাঁচশ বছরের পথ মানে আটাশ লক্ষ আশি হাজার মাইল। প্রতিটি আসমানের পুরুত্বও অনুরূপ।

বেহেশতের হুরদের অভ্যর্থনা

        মহানবী (সঃ) মসজিদে আকসায় অনুষ্ঠিত নবী-রাসূলদের জলসায় তার অমূল্য খুতবা পেশ করলেন। অতঃপর তার প্রশংসা ধ্বনি চারদিক মুখরিত করলো। তিনি এখানেও বিভিন্ন পদবীতে ভূষিত হলেন। এরপর তিনি মসজিদ হতে বাইরে বেরিয়ে আসলেন। তিনি দেখলেন যে, অসংখ্য বেহেশতী হুর তার শুভ দর্শনের জন্যে বাইরে ভীড় জমিয়েছে এবং তারা সবাই সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা নবীকে প্রথম দর্শন করেই মুগ্ধ হলো এবং তাকে সালাম করে বলল- "হে আল্লাহর প্রিয় রাসূল ও আমাদের শ্রদ্ধেয় সম্মানিত জন। আপনাকে আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে গভীর অভিবাদন জানাচ্ছি। আপনি জেনে খুশী হবেন যে, যারা পৃথিবীতে আল্লাহ ও আপনার প্রতি দর্শন আনয়ন করবে, সৎ কাজ করবে, জগতে ফেতনা-ফ্যাসাদ ছড়াবে না, ধীর স্থির হয়ে চলবে, সদগুণে গুনান্বিত হবে, অধীর ও অস্থির হবে না, মানবতাবোধ অন্তরের জাগরুক থাকবে, আল্লাহ রাসূলের কথানুযায়ী চলবে, আমরা তাদের প্রতিক্ষায় আছি। বেহেশতে তারা আমাদের স্বামী হবে আর আমরা হবো তাদের স্ত্রী। তাদের আমরা হাসি মুখে বরণ করে নেব।"

বেহেশতী নূর দর্শন

        এই সময় তিনি এক প্রকার নূর দেখতে পেলেন। এটা বিশাল এলাকা জুড়ে অবস্থান করছে। ভূমি হতে আকাশ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এ জ্যোতি স্বর্গীয় আভায় চকচক করছে। এর বিমল আলো চারদিকে ঠিকরে পড়ছে। আলোর বানকে আকাশ পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হযরত জিব্রাইল (আঃ) হযরত (সঃ)-কে ঐ বেহেশতী জ্যোতির সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন এবং তাকে বিনম্রভাবে বললেন- "হে সর্বশ্রেষ্ঠ নবীবর। আপনার অনুসারীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আপনাকে বিশ্বাস করবে এবং তদনুযায়ী আমল করবে, সৎ কাজ করবে, অসৎ কাজ হতে বিরত থাকবে, তারাই মুমিন। যখন তাদের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসবে, তখন তাদের শিয়রে এ স্বর্গীয় জ্যোতি নেমে আসবে। মৃত্যু পথযাত্রী মুমিন এ জ্যোতি দেখতে পাবে এবং তার রূহ ঐ পথে উর্ধ্বাকাশে চলে যাবে।"

বেহেশতী সিংহাসনে আরোহণ

        মহানবী (সঃ) প্রথম আকাশের দিকে আরোহণকালে পর্যায়ক্রমে যখন বিভিন্ন ঘটনা প্রত্যক্ষ পূর্বক বিভিন্ন নূরের সোপান পার করতে লাগলেন। এক সময় এক স্থানে গিয়ে মাহনবী (স) খাঁটি স্বর্ণের এমন সুশোভিত এক সিংহাসন দেখতে পেলেন যা বেহেশতের চমকদার বিভিন্ন রকমের হীরা ও জাওহার দ্বারা কারুকার্য খচিত। তিনি আরো দেখলেন যে, উক্ত সিংহাসনের পায়াগুলো বেহেশতের লাল হীরাকুত এবং যবরদ দ্বারা তৈরি। যার চারপাশে হাজারো নূরানী ফেরেশেতা মহান আল্লাহর তাসবীহ ও তাহলীলে লিপ্ত। এ সিংহাসন থেকে আওয়াজ আসছিল- "হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)। আপনি আপনার অনাড়ম্বর জাকজমকপূর্ণ উপবেশন দ্বারা আমাকে সম্মানিত করুন।"

        তখন হযরত জিব্রাইল (আঃ) আরজ করলেন- "হেদ আল্লাহর নবী (সঃ)। এ তখতে ফেরদৌসী বেহেশতী সিংহাসন মহান আল্লাহ আপনার জন্য প্রেরণ করেছেন। সুতরাং আপনি তার উপর উপবেশন পূর্বক মালায়ে আলা সফর করুন।

        অবশেষে মহানবী (সঃ) ঐ বেহেশতী সিংহাসনের উপর উপবেশন করলেন। তারপর ঐ সিংহাসন মহানবীকে নিয়ে মালায়ে আলার দিকে চললো।

উম্মতের কল্যাণকামী ফেরেশতা দর্শন

        বেহেশতী ফলকে চড়ে নবী (সঃ) সামনে এগিয়ে চলেছেন। পথিমধ্যে তিনি একজন বিরাটাকার ফেরেশতা দেখতে পেলেন। তার নূরানী চেহারায় সারা আকাশ উজ্জ্বল-প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সে আল্লাহর দরবারে তার দু'হাত তুলে মুনাজাত করছে- "হে রহমানের রাহীম আল্লাহ। তোমার দয়ার কোন অন্ত নেই। তুমি মেহেরবান, তুমি মহাশক্তিশালী, মুমিন বান্দার চিরদিনই তোমার অপার করুণা ও দয়ার চির সুখে অবস্থান করবে। তুমি তাদের প্রতি সুপ্রসন্ন, তারাও তোমার প্রতি অতি প্রসন্ন। হে মাবুদ আল্লাহ। হে দয়ালু আল্লাহ! তুমি আমার প্রার্থনা কবুল করো। তুমি হযরত (সঃ)-এর উম্মতের পাপরাশি ক্ষমা করো। তুমি ক্ষমাকারী, মার্জনাকারী, তোমার মার্জনার অন্ত নেই। অতএব হে পরওয়ার দিগার আল্লাহ। তুমি আামর প্রার্থনা কবুল করো। তোমাতে আমি নিবেদিত প্রাণ।

Post a Comment

0 Comments