প্রথম আকাশের দর্শনীয় বস্তুসমূহ কী

        এখান থেকে জিব্রাইল (আঃ) হযরত মুহাম্মদর (সঃ)-কে সাথে নিয়ে উর্ধ্ব আকাশ পানে উধাও হয়ে চললেন। মুহূর্ত মধ্যে তারা প্রথম আসমানের প্রবেশ দ্বারে এসে উপনীত হলেন। এটি ছিল একটি বিশেষ দরজা, যে দরজায় কেবলমাত্র মহানবী (সঃ)-এর জন্য নির্ধারিত ছিল। অন্য কারো জন্য এ দরজা দিয়ে প্রবেশ অধিকার ছিল না। উক্ত বিশেষ দরজার কাছে গিয়ে হযরত জিব্রাইল মহানবী (সঃ)-কে নিয়ে পৌঁছলেন। তখন দ্বার রক্ষীর সাথে যে কথপোকথন হয়েছিল তা মহানবী (সঃ) বর্ণনা করেন এভাবে-

قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَانْطَلَقَ حَتَّى السَّمَاةَ الدُّنْيَا فَاسْتَفْتَعَ قبْلَ مَنْ هَذَا قَالَ جِبْرِيلُ قِيلَ وَمَنْ مَعَكَ قَالَ مُحَمَّدٌ قَالَ أَوْ قَدْ أَرْسَلَ اللَّهُ نَعَمْ .

        অর্থাৎ ও "মহানবী (সঃ) ইরশাদ করেন- যখন যহরত জিব্রাইল (আঃ) আমাকে নিয়ে প্রথম আসমানের ঐ বিশেষ দরজার কাছে গিয়ে পৌঁছলেন তখন তিনি ঐ দরজায় নক করলেন। ভিতর থেকে আসমানের দ্বার রক্ষক ফেরেশতা হযরত ইসমাইল সারা দিলেন- "আপনি কে?"

        জবাবে হযরত জিব্রাইল (আঃ) বললেন- "আমি জিব্রাইল।"

        তারপর উক্ত ফেরেশতা আবার জিজ্ঞেস করলেন- "আপনার সাথে আর কে আছেন?"

        জবাবে জিব্রাইল (আঃ) বললেন- "আমার সাথে আছেন আখেরি জামানার নবী মুহাম্মদ (সঃ)।"

        এরপর উক্ত ফেরেশতা আবার জিজ্ঞেস করলেন- "আপনাকে কি তার কাছে প্রেরণ করা হয়েছে?

        জবাবে জিব্রাইল (আঃ) বললেন- "হ্যাঁ আমাকে তার কাছে প্রেরণ করা হয়েছে।" একথা শ্রবণ মাত্র উক্ত ফেরেশেতা উচ্চস্বরে মারহালা ধানি দিয়ে দরজা খুলে দিলেন।

"পয়লা তবক আসমানেতে" বাবা হাফাছা দ্বার 

বন্ধ কপাট এই বিনে নাই পন্থ আর,

 পৌঁছিল সেই বোরাক আইয়া কশনি ধরেন জিন

 ডাইক্যা বলেন, "দুয়ার খোল" জিব্রাইল আমীন,

 হইলো ছওয়াল- কে আপনি, সঙ্গী কে অপর? 

হইয়াছে কি আল্লাহ তায়ালার ওহী তাহার পর?"

 জিব্রাইল কন, জিব্রিল আমি, সঙ্গী মুহাম্মদ 

আল্লাহ তায়ালা গাইল নিজে যার তারিফির হদ।

 অমনি কপাট গেল খুলি হইল না আর গোল

"মারহাবা ছাদ মারহাবা ইয়া "উঠল খুশির রোল।"

প্রথম আকাশে অবস্থানঃ

        মহানবী (সঃ) ইরশাদ করেন- প্রথম দরজার রক্ষী এমন এক মহা সম্মানিত ফেরেশতা, যিনি এমন আরো সত্তর হাজার ফেরেশতার নেতৃত্ব প্রদান করেছেন। যাদের প্রত্যেকের অধীনে আরও দ্বার রক্ষী হযরত ইসমাইল ফেরেশতা এবং তার অধীনস্থ বাকী সকল ফেরেশতা এমন সত্তুর হাজার করে ফেরেশতা রয়েছে। বর্ণিত আছে যে, মহানবী (সঃ)-এর জনন্মকালে থেকে অদ্য পর্যন্ত তার সাক্ষাৎ লাভের আকাঙ্খী ছিলেন। তাই এ খবর পাওয়ার সাথে সাথে হুজুর (সঃ)-এর চারিদিকে পরওয়ানার ন্যায় উপরোক্ত লক্ষ লক্ষ ফেরেশতা তাকে ঘিরে ফেললেন এবং বড় আদর ও তা'লীমের সাথে তারা হুজুর (সঃ)-এর দর্শন লাভে ধন্য হলেন।

        অতঃপর তারা মহানবী (সঃ)-কে একটি মূল্যবান রেশমী পোশাক উপহার দিলেন। তা মণি-মুক্তা খচিত ছিল। হযরত (সঃ) তা সাদরে গ্রহণ করলেন এবং গায়ে পরেও দেখলেন।

হযরত আদম (আঃ)-এর সাক্ষাত লাভঃ

        মহানবী (সঃ) ইরশাদ করেন- আমি দেখতে পেলাম প্রথম আকাশে এক জায়গায় এক বিরাটাকায় সুদর্শন এক ব্যক্তি সিংহাসনের উপর উপবিষ্ট আছেন। যার ডান দিক থেকে মন। মাতানো এক প্রকার সুগন্ধী ভেসে আসতেছে। সেদিকে যতদূর চোখ পড়ে ছোট ছোট সাদা সাদা বর্ণের মানুষের আকৃতি বিশিষ্ট নোখসা দেখা যাচ্ছে। আর অনুরূপ তার বাম দিক থেকে খুব দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। সেদিকেও যতদূর চোখ পড়ে ছোট ছোট কালো কালো মানুষের চেহারা বিশিষ্ট নোখসা দেখা যাচ্ছে।

        আর আমি আরো দেখলাম যে, ঐ বুজুর্গ যখন তার ডান দিকে তাকান তখন তিনি খুশিতে হাসতেন। আর যখন বাম দিকে তাকান তখন কালো কালো নোসমাগুলো দেখে কাঁদতেন। এ অত্যাআশ্চর্য ঘটনা দেখার পর আমি জিব্রাইল (আঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম- "ভাই জিব্রাইল। এ সম্মানিত বুজুর্গ ব্যক্তি কে?" আর কেনই বা তিনি বাম দিকে নজর করে কাঁদতেছেন ডান দিকে দৃষ্টি করে হাসতেছেন।

        উত্তরে হযরত জিব্রাইল (আঃ) বললেন- "হে আল্লার নবী। এ মহান সম্মানিত বুজুর্ণ বাড়ি হলেন আপনার আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) আর তার ডান দিকে আপনি যে ছোট ছোট আকৃতিগুলো দেখতেছেন সেগুলো হল তারই সন্তানসমূহের আত্তা, যারা হলেন বেহেশতী। আর তার বাম দিকে আপনি ক্ষুদ্রাকৃতি আকৃতিগুলো দেখতেছেন, সেগুলো হলো তারই সন্তানসমূহের আত্মা যারা হলো দোজখী। সুতরাং তিনি যখন ডান দিকে তাকান তখন বেহেশতীদের চেহারা দেখে হাসেন আর যখন বাম দিকে তাকান তখন দোজখীদের চেহারা দেখে কেঁদে ফেলেন।"

        অতঃপর জিব্রাইল (আঃ) আমাকে বললেন- "হে আল্লাহর নবী। আপনি তাকে সালাম অভিবাদন করুন।" সুতরাং আমি তাই করলাম। তাকে সালাম করলাম। তিনি খুব সম্মান ও ইজ্জতের সাথে আমার সালামের জবাব দিয়ে বললেন-

مرحاً بالنير الصالح والامن الصالح . 

        "নেককার নবী ও নেককার সন্তানের জন্য মারহাবা।" এ বলে তিনি দোয়া করলেন।

প্রথম আকাশের দর্শনীয় বস্তুসমূহঃ

        মহানবী (সঃ) ইরশাদ করেন- আমি মেরাজ যাত্রা পথে প্রথম আকাশের নিকটে গিয়ে একটি গভীর সমুদ্র আকশের সাথে ঝুলানো অবস্থায় দেখতে পাই যার নাম 'কায়া'। এ সমুদ্রের পানিগুলো হলো গভীর নীল বর্ণের। যার এক ফোটা পানিও নিচের দিকে পড়ছে না। আর এ কারণেই প্রথম আকাশকে নীল বর্ণ দেখাচ্ছে। আমি এ সমুদ্র পথ সারি দিয়ে যখন বাতাস কেন্দ্রে পৌছে যাই সেখানে আমি আর একটি সমুদ্র দেখতে পাই। যা প্রথম আকাশের সাথে ঝুলানো। এ সমুদ্রটির এক প্রান্ত ভূমি জগতের সাথে মিলিত। সে সমুদ্রের বিভিন্ন কক্ষে নক্ষত্ররাজী ঘূর্ণায়ন অবস্থাতে দেখতে পাই।

        অন্যত্র একদল নূরানী ফেরেশতা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে শির নত করে আদনের সাথে এই তাসবীহ পাঠ করতে শুনলাম-

. سرح قدوس ربنا وربالمليكة والروح 

        এ প্রসঙ্গে মহানবী (সঃ) জিব্রাইলকে ফেরেশতাদের ইবাদতের ধরন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারলাম যে, যখন থেকে আসমান-যমিন সৃষ্টি হয়েছে তখন থেকেই ফেরেশতাগণ দাঁড়িয়ে এরূপ প্রক্রিয়ায় ইবাদত করে আসছেন।

        আরো একটু অগ্রসর হলে মহানবী (সঃ) নূরানী আকৃতির একটি বিশেষ ধরনের সাদা মোরগ দেখতে পান। যার নাম "তাউসুল মালায়িকা"। যার এক ডানা পূর্ব কিনারা পর্যন্ত বিস্তৃত এবং অপর ডানা পশ্চিম কিনারা পর্যন্ত বিস্তৃত এবং তার মাথা উপর দিকে এবং তার পা নিম্ন দিকে বিস্তৃত। সে সর্বদা মহান আল্লাহ হামদ ও সানায় লিপ্ত। রাসূলে আকরাম (সঃ) হযরত জিব্রাইল (আঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন- "তার নাম কি? এবং তার কাজ কি?"

        জবাবে জিব্রাইল (আঃ) বললেন- "এর নাম তাউসুল মালাইকা" এবং এর কাজ হলো রাত শেষে নামাজের সময় এ পাখি আকৃতির ফেরেশতাটি যখন আওয়াজ দেয় তখন তার সাথে দুনিয়ার সকল মোরগগুলো গেয়ে উঠে-

الصلوة خير من النوم .

        তারপর মহানবী (সঃ) দেখতে পেলেন কতিপয় মানব সত্তা। যাদেরকে ফেরেশতারা পাথর দিয়ে তাদের মাথায় আঘাত করছেন। আঘাতের চোটে তাদের মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। পুনরায় তাদেরকে জীবিত করা হলে আবার পূর্বের ন্যায় শাস্তি দেয়া হয়। তাদের এ অবস্থা দেখে মহানবী (সঃ) হযরত জিব্রাইল (আঃ)-কে জিজেস করলেন- "এদের এ অবস্থা কেন?"

        জবাবে জিব্রাইল (আঃ) বললেন- "এরা দুনিয়াতে যাকাত আদায় করেনি। ফকির মিসকিনদের উপর রহম করেনি। ছদকা খয়রাত ও কুরবানী দেয়নি। বরং গরীবের হক অন্যায়ভাবে নিজেরা ভোগ করতো।"

        মহানবী (সঃ) এবার কতিপয় মহিলাকে দেখতে পেলেন। যাদেরকে ফেরেশতাগণ শাস্তি দিতেছেন। তারা হলো-

    * বদমেজাজী, গালি-গালাজকারী মহিলা,

    * অপরের শিশুকে স্বামীর অনুমতি ছাড়া দুখ খাওয়ান।

    * স্বামীর অনুমতি ছাড়া যে মহিলা সংসারের মাল খরচ করে।

    * স্বামীর হুকুম ছাড়া অপর পুরুষের ঘরে যে যাতায়াত করে।

        এরপর মহানবী (সঃ) এমন কিছু পুরুষ নারীকে দেখতে পেলেন। যাদেরকে ফেরেশতারা কোড়া দিয়ে প্রহার করছে। আর তাদের প্রহারে তারা চিৎকার করে কান্না-কাটি করছে। এদের শাস্তির কারণ জিজ্ঞেস করলে হযরত জিব্রাইল (আঃ) বললেন- "এরা হলো ঐ সকল পুরুষ, যারা নিজের স্ত্রীর প্রতি খেয়াল না করে অপরের স্ত্রীর প্রতি আকৃষ্ট হতো। অনুরূপভাবে এরা হলো ঐ সব নারী যারা নিজের স্বামীকে বাদ দিয়ে অন্য পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। তাই তাদেরকে এভাবে নির্মম শাস্তি দেয়া হচ্ছে।"

        প্রথম আকাশে মহানবী (সঃ) আরো একদল নারীকে দেখতে পেলেন, যাদের মুখ-মণ্ডল কালো এবং তাদেরকে আগুনের পোশাক পরিয়ে আগুনের গুরুজ দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে আর তারা কুকুর ও শুকরের মত চিৎকার করছে। মহানবী (সঃ) জিব্রাইল (আঃ)-কে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাবে বলেন- "এরা হলো ঐসব নারী, যারা তাদের স্বামীকে কষ্ট দিত। তাদের কথা মত চলতো না এবং বেপর্দা ও বেহায়াপনা অবস্থায় চলাফেরা করত।

        মহানবী (সঃ) এরপর আরো অগ্রগামী হলে তিনি আশ্চর্য ধরনের এক ফেরেশতাকে দেখতে পান। যার শরীরের অর্ধেক অংশ আগুনের আর অর্ধেক অংশ বরফের। তার সম্পর্কে মহানবী (সঃ) হযরত জিব্রাইল (আঃ)-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন- "এ আশ্চর্য ধরনের ফেরেশতাকে আগুন, পানি, বাতাস ও মাটির সংমিশ্রণে সৃষ্টি করা হয়েছে। এর নাম হল রা'আদ। এর কাজ হল এ ফেরেশেতা সর্বদা মেঘমালা পরিচালনা করেন। তার নির্দেশেই আকাশে মেঘমালা পরিচালিত হয়।

Post a Comment

0 Comments