প্রত্যেক নবী-রাসূলকে মহান আল্লাহ তা'য়ালা নাম ধরে সম্বোধন করেছেন কিন্তু সর্বোচ্চ মর্যাদার কারণে নবী করীম (সা:) কে আল্লাহ তা'য়ালা নাম ধরে সম্বোধন করেননি। কিন্তু প্রাসঙ্গিকভাবে পবিত্র কুরআনে চার স্থানে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের একশত চৌদ্দটি সূরার মধ্যে চারটি সূরায় নবী করীম (সা:) এর নাম প্রাসঙ্গিক কারণে 'মুহাম্মাদ' (সা:) উল্লেখ করা হলেও এটি সম্বোধনগত কারণে উল্লেখ করা হয়নি। যেমন-
وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ جِ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ طَ أَفَإِنْ مَّاتَ أَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ ط وَمَنْ يَنْقَلِبْ عَلَى عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَضُرَّ اللَّهَ شَيْئًا ط وَسَيَجْزِي اللَّهُ الشَّاكِرِينَ
মুহাম্মাদ (সা:) একজন রাসূল ছাড়া (অতিরিক্তি) কিছুই নয়, তার পূর্বেও বহু রাসূল গত হয়ে গেছে (তারা সবাই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে), তাই তিনি যদি (আজ) মরে যান অথবা তাকে যদি কেউ মেরে ফেলে, তাহলে তোমরা কি (তাঁর আনীত জীবন বিধান থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিবে? আর যে ব্যক্তিই (এ থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে কখনো আল্লাহর (দ্বীনের) কোনোরকম ক্ষতিসাধন করতে পারবে না, আল্লাহ তা'য়ালা অচিরেই কৃতজ্ঞ বান্দাদের প্রতিফল দান করবেন। (সূরা আলে ইমরান-১৪৪)
নবী করীম (সা:) এর পবিত্র নাম মুবারক সম্বলিত এ আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট হলো, ওহুদ যুদ্ধের এক পর্যায়ে ইসলামের দুশমনরা যখন নবী করীম (সা:) এর প্রতি আঘাত করার লক্ষ্যে এগিয়ে আসছিলো সে মুহূর্তে প্রাণ উৎসর্গকারী কতিপয় সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের দেহকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে সকল আঘাত প্রতিহত করছিলেন, যেনো আল্লাহর রাসূলের দেহ মুবারকে আঘাত না লাগে। ধনীর সন্তান তরুণ সাহাবী হযরত সাইয়্যেদ মুসাইয়্যেব (রা:) সেদিন যুদ্ধের ময়দানে মুসলিম বাহিনীর পতাকা বহন করছিলেন। তিনি প্রতিপক্ষের আঘাত থেকে আল্লাহর রাসূল (সা:) কে রক্ষা করতে গিয়ে নিজের ডান হাতে এমনভাবে আঘাত পেলেন যে, তাঁর ডান হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। তিনি বাম হাতে ইসলামের পতাকা তুলে ধরলেন। ইসলামের দুশমনরা তাঁর বাম হাতেও আঘাত করলো। বাম হাতও তাঁর দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। তিনি শাহাদাতবরণ করা পর্যন্ত নিজের মুখ দিয়ে ইসলামের পতাকা কামড়ে ধরে উচ্চে তুলে ধরেছিলেন। ওহুদ যুদ্ধের ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিপক্ষ তাঁকে যত বার আঘাত করেছিলো প্রত্যেক আঘাতের জবাবে তিনি বলছিলেন-
وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ جِ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ ط
মুহাম্মাদ (সা:) একজন রাসূল ছাড়া (অতিরিক্তি) কিছুই নয়, তার পূর্বেও বহু রাসূল গত হয়ে গেছে (তারা সবাই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে)। (সূরা আলে ইমরান-১৪৪)
হযরত সাইয়্যেদ মুসাইয়্যেব (রা:) এ কথাই ইসলামের দুশমনদের জানিয়ে দিচ্ছিলেন, 'মুহাম্মাদ (সা:) মহান আল্লাহর একজন রাসূল মাত্র, অতীতের নবী-রাসূলও মৃত্যুবরণ করেছেন। মুহাম্মাদ (সাঃ)ও তো একদিন মৃত্যুবরণ করবেন, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়েই ইসলাম নিঃশেষ হবে না। ইসলাম ব্যক্তি মুহাম্মাদ (সা:) এর সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। এ আদর্শ চিরন্তন- কালজয়ী। কিয়ামত পর্যন্ত অটুট থাকার জন্যেই পৃথিবীতে ইসলামের আগমন ঘটেছে। তোমরা ব্যক্তি মুহাম্মাদ (সা:) কে হত্যা করে ইসলামকে হত্যা করতে পারবে না'।
উল্লেখ্য, তখন পর্যন্ত এ কথাগুলো কুরআনের আয়াত হিসাবে অবতীর্ণ হয়নি। পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সেই চরম মুহূর্তে হযরত সাইয়্যেদ মুসাইয়্যেব (রা:) এর বলা কথাগুলো মহান আল্লাহর এতই পছন্দ হয়েছিলো যে, পরবর্তীতে তিনি হুব-হু সে কথাগুলো পবিত্র কুরআনের আয়াত হিসাবে অবতীর্ণ করলেন।
ওহূদের ময়দানে উদ্ভুত পরিস্থিতির এক পর্যায়ে ইসলামের দুশমনরা প্রচার করলো যে, মুহাম্মাদ (সা:) নিহত হয়েছেন। এ সংবাদে মুনাফিক শ্রেণীর লোকজন বলাবলি শুরু করলো, 'মুহাম্মাদ (সা:) যদি সত্যই আল্লাহর রাসূল হয়ে থাকবেন, তাহলে তিনি মারা পড়লেন কিভাবে? আমাদের উচিত এখন ইসলামী জীবন বিধান ত্যাগ করে পূর্বপুরুষের আদর্শে ফিরে যাওয়া'।
তাঁদের এ ধরনের কথা ও মনোভাবের প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা'য়ালা জানিয়ে দিলেন, 'নবী- রাসূলগণ মৃত্যুবরণ করবেন এটাই তো স্বাভাবিক, কেননা তাঁরাও তো মানুষ। মুহাম্মাদ (সা:) ও একজন মানুষ, তিনিও মারা যাবেন। তাঁর মৃত্যুর কারণে কেউ যদি ইসলামী জীবন বিধান ত্যাগ করে তাহলে ইসলামের কোনো ক্ষতি হবে না। যে ব্যক্তি ইসলাম ত্যাগ করবে ক্ষতি তারই হবে'। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নবী করীম (সা:) এর নাম উল্লেখপূর্বক উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিলো। এ আয়াতে নবী করীম (সা:) কে নাম ধরে ডাকা হয়নি। নবী করীম (সা:) এর নাম মুবারক পবিত্র কুরআনের সূরা আহযাব-এ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিপক্ষের সমালোচনার জবাবে আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন-
مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِّنْ رِّجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَّسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّنَ طَ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا عَ
হে মানুষ (তোমরা জেনে রেখো), মুহাম্মাদ (সা:) তোমাদের কোনো পুরুষের পিতা নন, বরং তিনি হচ্ছেন আল্লাহর রাসূল এবং নবীদের সীল (মোহর), আল্লাহ তা'য়ালা সর্ববিষয়ে অবগত রয়েছেন।
(সূরা আহযাব-৪০)
এ আয়াতে নবী করীম (সা:) এর নাম মুবারক উল্লেখ করার এক বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিষয়টি নবী করীম (সা:) এর নবুয়্যাত পূর্ববর্তী জীবনের সাথে জড়িত। সে সময় আরবে পালক পুত্রকে গর্ভজাত সন্তান হিসাবেই বিবেচনা করা হতো এবং পালক সন্তানও নিজ সন্তানের মতোই সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করতো। হযরত জায়েদ বিন হারেসা (রা:) নামক নবী করীম (সা:) এর একজন উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবী ছিলেন এবং তিনিই সেই সৌভাগ্যবান সাহাবী যাঁর নাম মহান আল্লাহ তা'য়ালা পবিত্র কুরআনে সূরা আহযাবের ৩৭ নং আয়াতে উল্লেখ করেছেন। হযরত জায়েদ (রা:) ছিলেন কালব গোত্রের হারেসা ইবনে শারাহীল নামক এক ব্যক্তির সন্তান। তাঁর গর্ভধারিণী মা সু'দা বিনতে সা'লাবা ছিলেন তাঈ গোত্রের বনী মা'ন শাখার মেয়ে। তিনি আট বছর বয়সী সন্তান জায়েদকে নিয়ে নিজ পিতার বাড়িতে এলে বনী কাইন ইবনে জাস্ত্র এর লোকজন সেখানে আক্রমণ করে লুটপাটের পাশাপাশি বেশ কিছু মানুষকেও গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। গ্রেফতারকৃত মানুষদের মধ্যে আট বছরের শিশু জায়েদও ছিলেন।
তায়েফ এলাকার কাছাকাছি সে সময় উকাযের মেলা হতো। এই মেলায় শিশু জায়েদকে দাস হিসেবে বিক্রি করা হয় এবং তাঁকে কিনে নেন হযরত খাদিজা (রা:) এর ভাতিজা হাকিম ইবনে হিযাম। তিনি মক্কায় এসে নিজ ফুফু হযরত খাদিজা (রা:) কে উপহার হিসেবে হযরত জায়েদকে দিয়ে দেন। বিয়ের পরে নবী করীম (সা:) কিশোর জায়েদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখে মুগ্ধ হয়ে হযরত খাদিজা (রা:) এর কাছ থেকে তাঁকে নিজের তত্ত্বাবধানে নিয়ে নেন। এভাবে কিশোর ছেলেটি সৃষ্টির সেরা এমন এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসেন যাঁকে মাত্র কয়েক বছর পরেই মহান আল্লাহ তা'য়ালা শ্রেষ্ঠ নবী-রাসূলের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে যাচ্ছিলেন। হযরত জায়েদ (রা:) এর বয়স তখন পনের, এ সময় তাঁর পিতা হারেসা ইবনে শারাহীল ও চাচা হারিয়ে যাওয়া সন্তানের সন্ধান পেয়ে নবী করীম (সা:) এর কাছে এসে প্রস্তাব দেন, 'আপনি মুক্তিপণ হিসাবে যা চান তাই দিবো, আপনি আমার সন্তানকে আমাদের কাছে ফেরৎ দিন'।
নবী করীম (সা:) বললেন, 'আপনার ছেলেকে ডেকে আনছি এবং বিষয়টি সম্পূর্ণ তাঁর ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। সে যদি আপনাদের সাথে যেতে চায় তাহলে তাঁর ইচ্ছা সে যেতে পারে। আর যদি সে চায় তাহলে আমার কাছেও থাকতে পারে। আপনাদের সাথে যেতে চাইলে আমি মুক্তিপণ হিসাবে কোনো অর্থ নিবো না, এমনিতেই দিয়ে দিবো। আর যদি সে আমার কাছেই থাকতে চায় তাহলে আমার নীতি এটা নয় যে, কেউ আমার কাছে থাকতে চাইবে আর আমি তাকে তাড়িয়ে দিবো'।
এ কথা শুনে হযরত জায়েদ (রা:) এর পিতা ও চাচা বিনয়ে বিগলিত হয়ে বললেন, 'আপনি যা বললেন তা ইনসাফেরও অতিরিক্ত, অনুগ্রহ করে আপনি আমাদের সন্ত ানকে এখানে নিয়ে আসুন'।
নবী করীম (সা:) হযরত জায়েদ (রা:) কে ডেকে এনে উপস্থিত লোক দু'জনকে দেখিয়ে বললেন, 'তুমি কি এ লোক দু'জনকে চিনো?'
হযরত জায়িদ (রা:) নিজ পিতা ও চাচার সান্নিধ্যে গিয়ে বললেন, 'জ্বি, এ দুজনের একজন আমার পিতা ও অন্যজন আমার চাচা'।
নবী করীম (সা:) হযরত জায়েদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মধুর স্বরে বললেন, 'তুমি তোমার পিতা ও চাচাকেও চিনো এবং আমাকেও চিনো। এখন তুমি ইচ্ছে করলে তাদের সাথে চলে যেতে পারো আর মন চাইলে আমার সাথেও থাকতে পারো। এ ব্যাপারে তোমার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে'।
হযরত জায়েদ (রা:) নিজ পিতা ও চাচার মমতার সান্নিধ্য থেকে সরে গিয়ে নবী করীম (সা:) এর পরম স্নেহের সান্নিধ্যে দাঁড়িয়ে বললেন, 'আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না'।
বিস্ময়ে বিমূঢ় সন্তান বুভুক্ষ পিতা ও চাচা অবাক দৃষ্টিতে নিজ সন্তানের প্রতি তাকিয়ে রইলেন। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বাকরুদ্ধ কণ্ঠে পিতা সন্তানকে বললেন, 'বাবা, স্বাধীন জীবনের তুলনায় তুমি দাসত্বের জীবনকে প্রাধান্য দিচ্ছো? নিজের পিতা-মাতা, ভাই- বোন ও আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে অনাত্মীয় একজনের কাছে দাস হিসাবে থাকতে চাচ্ছো?'
হযরত জায়েদ হাতের ইশারায় নবী করীম (সা:) কে দেখিয়ে পিতার বিস্মিত চেহারার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলেন, 'এই মানুষটির মধ্যে আমি যেসব গুণ-বৈশিষ্ট দেখেছি, এরপর আর পৃথিবীর অন্য কোনো মানুষকে এই মানুষটির ওপর প্রাধান্য দিতে পারি না'।
নিজ সন্তানের মুখে এ ধরনের কথা শুনে পিতা ও চাচা অত্যন্ত খুশী হয়ে নবী করীম (সা:) এর পবিত্র সান্নিধ্যে সন্তানকে রেখে চলে যান। এরপরই নবী করীম (সা:) হযরত জায়েদকে স্বাধীন করে দিয়ে আল্লাহর ঘর বাইতুল্লাহর ছায়াতলে গিয়ে কুরাইশদের সমাবেশে ঘোষণা দেন, 'আপনারা সাক্ষী থাকুন, আজ থেকে জায়েদ আমার সন্তান, সে আমার উত্তরাধিকারী হবে এবং আমি তাঁর উত্তরাধিকারী হবো'।
এভাবে তখনকার সমাজে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী নবী করীম (সা:) হযরত জায়েদ (রা:) কে নিজের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিলে লোকজন তাঁকে জায়েদ ইবনে মুহাম্মাদ বলে সম্বোধন করতে থাকে। এরপর নবী করীম (সা:) নবুয়্যাতের সুউচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবার পরে সর্বপ্রথম যে চারজন কোনো প্রকার প্রশ্ন ব্যতীতই তাঁর প্রতি ঈমান এনে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন, তাঁদের মধ্যে প্রথমজন হযরত খাদিজা (রা:), দ্বিতীয়জন হযরত জায়েদ (রা:), তৃতীয়জন হযরত আলী (রা:) ও চতুর্থজন হযরত আবু বকর (রা:)। পরবর্তীতে চতুর্থ হিজরীতে নবী করীম (সা:) নিজের ফুফাতো বোন হযরত যয়নব (রা:) এর সাথে হযরত জায়েদ (রা:) এর বিয়ে দেন। কিন্তু তাদের বিয়ে দেড় বছরও টিকেনি, দাম্পত্য জীবনে তিক্ততা দেখা দেয় এবং পরিশেষে তালাক পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। অপরদিকে ইনসাফের বিপরীত যুক্তিহীন একটি প্রথাকে দু'পায়ে দলিত মথিত করার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ তা'য়ালা হযরত যয়নবকে বিয়ে করার জন্যে নবী করীম (সা:) কে আদেশ দেন।
নবী করীম (সা:) মহান আল্লাহ তা'য়ালার নির্দেশে হযরত যয়নবকে বিয়ে করলে ইসলামের দুশমনরা প্রচার করতে থাকে যে, 'মুহাম্মাদ (সা:) নিজ পুত্রবধূকে বিয়ে করেছেন, অথচ তিনি যে আদর্শ প্রচার করছেন সে আদর্শেও নিজ পুত্রবধূকে বিয়ে করা হারাম'। তাদের এই অপপ্রচারের জবাব দেয়া হলো সূরা আহযাবের ৪০ নং আয়াতে।
বলা হলো, 'মুহাম্মাদ (সা:) এর কোনো পুত্র সন্তানই নেই। জায়েদ তাঁর সন্তান নয়, সুতরাং তিনি নিজ পুত্রবধূকে বিয়ে করে হারাম কাজ করলেন কিভাবে? তোমরা নিজেরাই তো জানো, তাঁর কোনো পুত্র সন্তানই নেই, তাহলে তাঁর প্রতি এই অপবাদ কেনো দিচ্ছে? তোমরা সমাজে যে অবৈধ রীতি প্রচলিত করেছো, তা ভেঙ্গে দেয়ার জন্যেই তো রাসূল প্রেরণ করা হয়েছে। তোমরা যে হালাল বিষয়টি হারাম করে রেখেছো, তা হালাল করে দেয়াই রাসূলের দায়িত্ব। তিনি যদি এই হারাম বিষয়টি ভেঙ্গে না দেন, তাহলে তাঁর পরে আর কোনো নবী-রাসূলকে প্রেরণ করা হবে না, যিনি এ প্রথা ভাঙ্গবেন। কারণ তিনিই শেষ নবী ও রাসূল। তাঁর পরে কিয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নবী-রাসূল প্রেরিত হবে না'। এই কথাগুলোই মানুষকে জানানোর প্রয়োজনে উক্ত আয়াতে নবী করীম (সা:) এর নাম মুবারক উল্লেখ করা হয়েছে।
মুহাম্মাদ (সা:) কে নবী ও রাসূল হিসাবে প্রেরণ করার পরে কোনো মানুষ যদি অতীতের গত হয়ে যাওয়া নবী-রাসূলের আনীত আদর্শ, যা কিনা মানুষ বিকৃত করেছে। সেসব বিকৃত আদর্শ কেউ যদি অনুসরণ করে তাহলে তারা যেমন সরল সঠিক পথে চলতে পারবে না এবং আল্লাহর আদালতেও মুক্তি পাবে না। অভ্রান্ত পথে চলতে ইচ্ছুক হলে, পৃথিবীতে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন ও প্রগতির পথে চলতে চাইলে এবং পরকালে আল্লাহর আদালতে মুক্তি পেতে ইচ্ছুক হলে তাদেরকে অবশ্যই সেই আদর্শ অনুসরণ করতে হবে, যা মুহাম্মাদ (আঃ) এর ওপর অবতীর্ণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যেই নবী করীম (সা:) এর নাম মুবারক উল্লেখ করে আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন-
وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَآمَنُوا بِمَا نُزِّلَ عَلَى مُحَمَّدٍ وَهُوَ الْحَقُّ مِنْ رَّبِّهِمْ لا كَفَرَ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَأَصْلَحَ بَالَهُمْ
যারা আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছে এবং ভালো কাজ করেছে, মুহাম্মাদ-এর ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে তার ওপরও ঈমান এনেছে, যা একান্ত ভাবে তাদের মালিকের পক্ষ থেকে আসা সত্য, আল্লাহ তাদের জীবনের সব গোনাহ ক্ষমা করে দিবেন এবং তাদের অবস্থা শুধরে দিবেন। (সূরা মুহাম্মাদ-২)
নবী করীম (সা:), সাহাবায়ে কেরাম এবং তাঁর প্রকৃত অনুসারীগণ ইসলামের বিপরীত কোনো মতাদর্শ বা আদর্শের সাথে কখনো আপোষ করেন না এবং তাঁদেরকে ইসলাম বিরোধী শক্তির সম্মুখে মাথানত করানো কখনো সম্ভব নয়, এ কথাগুলো স্পষ্ট করতে গিয়ে আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর প্রিয় হাবিবের নাম এভাবে উল্লেখ করেছেন-
মুহাম্মাদ (সা:) আল্লাহ তা'য়ালার রাসূল, অন্য যেসব লোক তার সাথে আছে তারা (নীতির প্রশ্নে) কাফিরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর, (আবার তারা) নিজেদের মধ্যে একান্ত সহানুভূতিশীল, তুমি (যখনই) তাদের দেখবে, তারা রুকু ও সিজদাবনত অবস্থায় রয়েছে, আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করছে, তাদের (বাহ্যিক) চেহারায়ও (এ আনুগত্য ও) সিজদার চিহ্ন রয়েছে; তাদের উদাহরণ যেমন (বর্ণিত রয়েছে) তাওরাতে, (তেমনি) তাদের উদাহরণ রয়েছে ইঞ্জিলেও (আর তা হচ্ছে), যেমন একটি বীজ- যা থেকে বেরিয়ে আসে (ছোট্ট) কিশলয়, অতপর তা দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে যায়, (চারা গাছটির এ অবস্থা তখন) চাষীর মনকে খুশীতে উৎফুল্ল করে তোলে, (এভাবে একটি মুমিন সম্প্রদায়ের পরিশীলনের ঘটনা দ্বারা) আল্লাহ তা'য়ালা কাফিরদের মনে (হিংসা ও) জ্বালা সৃষ্টি করেন; (আবার) এদের মাঝে যারা (আল্লাহ তা'য়ালা ও তাঁর রাসূলের ওপর) ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে, আল্লাহ তা'য়ালা তাদের জন্যে তাঁর ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। (সূরা ফাতাহ-২৯)
এ কথার অর্থ এটা নয় যে, সাহাবায়ে কেরাম বা রাসূল (সা:)-এর অনুসারীগণ ইসলামের বিপরীত আদর্শের লোকদের সাথে খুবই রূঢ়, কর্কশ ও নির্দয় আচরণ করে থাকেন। বরং এর অর্থ হলো, সাহাবায়ে কেরাম ও প্রকৃত মুসলিমরা ঈমানের পরিপক্কতা, নীতি আদর্শের প্রতি দৃঢ়তা, অবিচলতা, চরিত্রের বলিষ্ঠতা এবং ঈমানী দূরদৃষ্টির কারণে ইসলামের বিপরীত আদর্শের লোকদের সম্মুখে দুর্জয় ও অনমনীয় এবং হিমাচলের মতোই অনড় হয়ে আছেন। তাঁরা কর্দমাক্ত মাটি বা মোমের মতো নয় যে, যেদিকে খুশী সেদিকেই তাদেরকে ঘুরানো সম্ভব। তাদের ঈমান এত দুর্বল নয় যে, ইসলাম বিরোধী শক্তির রক্তচক্ষু দেখে তাঁরা মাথানত করবেন, ফাসির মঞ্চে গিয়েও তাঁরা নীতি আদর্শের প্রশ্নে অটল থাকবেন।
কোনো লোভ-লালসা দেখিয়েও তাদেরকে তাদের নীতি থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত করা সম্ভব নয়। এসব লোক অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হয় না। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পদের লোভেও এরা আদর্শ ত্যাগ করে না। পবিত্র কুরআনের যে আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাঁরা ময়দানে সংগ্রাম করছে, সে সংগ্রাম থেকে মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁরা বিরতি দেন না। অবিরাম তাঁরা আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সম্মুখপানে উল্কার বেগে ছুটতেই থাকেন। বাতিল শক্তির নির্যাতন, শোষণ, নিপীড়ন, জেল-জুলুম কোনো কিছুই তাঁদের চলার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না।
ইসলামী আদর্শ যারা এই যমীন থেকে উৎখাত করতে চায়, এ লক্ষ্যেই যারা তৎপর, তাদের বিরুদ্ধে এসব লোক অনমনীয় ও কঠোর। ইসলামের দুশমন নয়, অথবা যারা ইসলাম বুঝে না, তাদের প্রতি এসব লোক অত্যন্ত সহানুভূতিশীল, নমনীয়, ভদ্র, নম্র, দয়াবান, স্নেহময় ও তাদের হৃদয় ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। তাঁরা নিজেরাও পরস্পরের প্রতি অত্যন্ত মমতাবান। তাদের মধ্যে আদর্শিক বন্ধনের কারণে তাঁরা একে অপরের প্রতি অত্যন্ত দায়িত্বশীল। অন্যের বিপদকে এরা নিজের বিপদ মনে করে একে অপরের পাশে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
উক্ত আয়াতে বাহ্যিক চেহারায় সিজদার চিহ্ন রয়েছে বলতে নামাজ আদায় করার কারণে যেসব লোকের কপালে বা দেহের অন্য কোনো স্থানে যেসব চিহ্নের সৃষ্টি হয়, এ আয়াতে ঐসব চিহ্নের কথা বলা হয়নি। উক্ত আয়াতের অর্থ হলো, আল্লাহভীতি, উন্নত নৈতিকতা, নম্রতা, বিনয়, ভদ্রতা, মানসিক ঔদার্য, সহৃদয়তা, শালীনতা ও হৃদয়ের পরিচ্ছন্নতার সেই সকল নিদর্শন যা সার্বিকভাবে মহান আল্লাহর আনুগত্যমূলক জীবন যাপনের কারণে ব্যক্তির সমগ্র মুখাবয়বে, দৃষ্টির চাহনীতে, চাল চলনে, কথার ধরনে, ওঠা বসায় ভাস্বর ও প্রতিভাত হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে মানুষের মুখমণ্ডল এমন একটি উন্মুক্ত গ্রন্থ যার প্রত্যেক ছত্রে ব্যক্তির মন-মানসিকতা স্পষ্ট লেখা রয়েছে।
একজন বিনয়ী, নম্র, ভদ্র, শালীন ও নির্বিরোধী লোকের মুখমন্ডল একজন দাম্ভিক, অহঙ্কারী, কলহপ্রিয় ও কঠোর প্রকৃতির লোকের মুখমন্ডল থেকে মৌলিকভাবে ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। পুত, পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন স্বভাবের লোকদের মুখাবয়ব চরিত্রহারা লোকদের মুখাবয়ব থেকে পৃথক হয়। ভদ্র, নির্মল ও উন্নত নৈতিক চরিত্রবান লোকদের আকৃতি প্রকৃতি পাপাচারে নিমজ্জিত চরিত্রহীন লোকদের আকৃতি প্রকৃতির থেকে ভিন্ন ধরনের হয়। উক্ত আয়াতে এ কথাগুলোই বলা হয়েছে যে, মুহাম্মাদ (সা:), তাঁর সাহাবায়ে কেরাম ও তাঁর আদর্শের যথাযথ অনুসারীদের দেখলেই তাদেরকে সর্বোত্তম মানুষ বলে বিবেচিত হয়। কারণ তাদের সমগ্র মুখমন্ডলে মহান আল্লাহর আনুগত্যের জ্যোতির্ময় কিরণচ্ছটা দ্যূতি বিকিরণ করতে থাকে। আর এ কথাগুলোই বলতে গিয়ে মহান আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর প্রিয় হাবিবের নাম উক্ত আয়াতে উল্লেখ করেছেন। এভাবে পবিত্র কুরআনে মাত্র চার স্থানে নবী করীম (সা:) এর নাম মুবারক আল্লাহ তা'য়ালা প্রাসঙ্গিক কারণে উল্লেখ করেছেন।
0 Comments