বিশ্বনবীর মর্যাদাগত কারণে আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর নবীর জীবনের শপথ করেছেন

        নবী করীম (সা:) এর পূর্বে প্রেরিত কোনো নবী-রাসূল এবং তাঁরা যে এলাকায় বসবাস করতেন সেই এলাকার নাম উল্লেখ পূর্বক অথবা উক্ত নবী-রাসূলদের জীবনের শপথ আল্লাহ তা'য়ালা করেছেন, এমন দৃষ্টান্ত পবিত্র কুরআনে কোথাও সন্ধান করে পাওয়া যাবে না। কিন্তু নবী করীম (সা:) এর মর্যাদা মহান আল্লাহ তা'য়ালা এতই উচ্চ করেছেন যে, স্বয়ং আরশে আযীমের মালিক- সমগ্র সৃষ্টিজগত ও সৃষ্টির মালিক আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর প্রিয় হাবীবের জীবনের শপথ করেছেন-

لَعَمْرُكَ إِنَّهُمْ لَفِي سَكْرَتِهِمْ يَعْمَهُونَ

        (আল্লাহ তা'য়ালা বললেন, হে নবী,) আপনার জীবনের শপথ (করে বলছি, সেদিন) এরা নিদারুণ এক নেশায় বিভোর হয়ে পড়েছিলো (আল্লাহর গযবের কোনো কথাই এরা বিশ্বাস করলো না)। 

(সূরা হিজর-৭২)

        যে নগরীতে জন্ম গ্রহণ করলেন, যে স্থান তাঁর শৈশব, কৈশর, তারুণ্য ও যৌবনের চারণভূমি সেই পবিত্র মক্কা নগীরও শপথ করেছেন-

لا أُقْسِمُ بِهَذَا الْبَلَدِ لَا وَأَنْتَ حِلْمٍ بِهَذَا الْبَلَدِ لا 

        আমি শপথ করছি এ (পবিত্র) নগরীর, এ নগরীতে আপনি (সম্পূর্ণ) স্বাধীন। (সূরা বালাদ-১-২)

        পবিত্র মক্কা নগরী সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। এখানে সকল প্রাণী নিরাপত্তা লাভসহ স্বস্তি ও শান্তি লাভ করে। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় পবিত্র কুরআনের গবেষকগণ বলেছেন, 'নবী করীম (সা:) মক্কা নগরীতে প্রবাসী কোনো ব্যক্তি নন, তিনি ভিন্ন কোনো এলাকা থেকে এসেও এখানে বসতি স্থাপন করেননি। তিনি এই নগরীতেই জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁর শৈশব, কৈশর ও যৌবনের চারণভূমি এই নগরী। এখানেই তিনি নবুয়্যাত লাভ করেছেন এবং তিনি এখানে অবস্থান করছেন। এসব কারণে এই নগরীর মর্যাদা ও গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি করা হয়েছে'।

        আল্লাহ তা'য়ালা সূরা বালাদের উক্ত আয়াতে বলছেন, 'এটা আপনার আপন এলাকা, আপনার পবিত্র জন্মভূমি। যেখানে আপনি সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং যে কোনো স্থানে গমন ও বিচরণ করার ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আপনার রয়েছে। অথচ এই নগরীর পরিবেশ আপনার জন্যে এক শ্বাসরুদ্ধকর করে তুলেছে ইসলাম বিরোধী গোষ্ঠী। আপনার প্রিয় স্মৃতি বিজড়িত মাতৃভূমি- আপনার চারণভূমিকে আপনারই জন্যে কন্টকাকীর্ণ করে তুলেছে মিথ্যার অন্ধ পুজারীরা। যে নগরীর প্রত্যেক ধূলিকণা আপনার জন্যে প্রশান্তি দায়ক, সেই নগরীর প্রতি ধূলিকণাকে আপনার জন্যে শাণিত অস্ত্রের রূপ দেয়া হয়েছে'।

        যেখানে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রাতি একটি প্রাণীকেও নিরাপত্তা দিচ্ছে সত্যের শত্রুরা, পরম আপনজনের হত্যাকারীকেও যে এলাকায় নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে। সেই পবিত্র এলাকায় আল্লাহ তা'য়ালার রাসূল (সা:) এর এবং তাঁর কোনো অনুসারীর নিরাপত্তা নেই। সেই মহাপবিত্র এলাকায় বিশ্বনবী (সা:) এর পূত পবিত্র দেহের রক্ত ঝরানো বৈধ করা হয়েছে। হালাল করা হয়েছে তাঁদের রক্ত, যারা মহান আল্লাহর অনুগত বান্দাহ্। পবিত্র হারাম শরীফে আল্লাহর রাসূল মহান আল্লাহকে সিজদা দিচ্ছেন, সমগ্র সৃষ্টিজগতের রব-এর উদ্দেশ্যে সিজদায় লুটিয়ে পড়েছেন, এই অবস্থায় তাঁর মাথার ওপরে উটের পচা দুর্গন্ধযুক্ত নাড়িভূড়ি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

        তাঁর পবিত্র কন্ঠনালীতে কাপড় পেঁচিয়ে দু'দিক থেকে এমনভাবে টেনে ধরা হয়েছে, আল্লাহর রাসূলের শ্বাস বন্ধ হয়ে তাঁর চোখ মোবারক কোঠর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছে। আল্লাহর অনুগত বান্দাহ্ মুসলমানদেরকে এই পবিত্র স্থানে রক্তাক্ত করা হয়েছে। যে কোনো প্রাণী, উদ্ভিদ এবং চরম শত্রুর জন্যেও যে এলাকায় বৈধ অবৈধের সীমা অনুসরণ করা হয়েছে, সেই সীমা অনুসরণ করা হয় নি শুধু আল্লাহর রাসূল (সা:) ও তাঁর অনুসারীদের ক্ষেত্রে।


        তাঁর অপরাধ (!) একটিই, তিনি মানুষকে মহাসত্যের দিকে আহ্বান জানাচ্ছেন। মানুষকে শোষণ, বঞ্চনা, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, অন্যায়-অত্যাচার থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে আন্দোলন করছেন। তাঁর অনুগত লোকদের অপরাধ (1) তাঁরা একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো গোলামী করতে রাজী হয়নি। এদের একমাত্র অপরাধ হলো, এরা মহা প্রশংসিত মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে। এই অপরাধেই মক্কার জাহিল লোকগুলো তাদের সহায়-সম্পদ, দেহের রক্ত ও প্রাণ পবিত্র এলাকায় বৈধ করে নিয়েছে। মক্কার লোকগুলোও যেমন কা'বা এলাকায় ক্ষুদ্র একটি মশাকে হত্যা করাও অপরাধ মনে করতো, কিন্তু সেই একই এলাকায় কোনো মুসলমানকে হত্যা করা অপরাধ মনে করতো না। অর্থাৎ এদের কাছে ক্ষুদ্র একটি প্রাণীর প্রাণের যে মূল্য ও মর্যাদা ছিল, একজন মুসলমানের প্রাণের সে মূল্য ছিল না।

        বর্তমানে অমুসলিম শক্তির কাছেও মুসলমানদের প্রাণের কোনো মূল্য নেই। বনের হিংস্র প্রাণীর মূল্য তাদের কাছে অনেক বেশি এবং এসব প্রাণী সংরক্ষণের জন্যে তারা অকাতরে অর্থ ব্যয় করছে। হিংস্র পশুর চারণভূমি গ্রীষ্মের মৌসুমে প্রায় পানি শূন্য হয়ে পড়ে। অমুসলিম রাষ্ট্রসমূহ সম্মিলিতভাবে মুসলমানদের কাছ থেকে শোষণকৃত অর্থ ব্যয় করে ঐসব এলাকায় জলাধার নির্মাণ করে দিচ্ছে, যেন কোনো পশু পানি সঙ্কটে না পড়ে। বাঘ, সিংহ, শৃগাল, কুকুর, শুকর থেকে শুরু করে সামান্য একটি টিকটিকির মতো প্রাণীকেও তারা আধুনিক চিকিৎসা উপকরণে সজ্জিত ক্লিনিকে অত্যন্ত যত্নের সাথে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলে।

        একবার আটলান্টিক মহাসাগরে বেশ কয়েকটি তিমি বরফে আটকা পড়লো। ইউরোপ- আমেরিকার কয়েকটি দেশ তড়িঘড়ি করে সেখানে 'আইস কাটার' বরফ কাটা জাহাজ প্রেরণ করে তিমিগুলো উদ্ধার করে সাগরে ছেড়ে দিল। এভাবে বরফে আল্কা পড়া তিমিকে উদ্ধার করে এবং এসব দৃশ্য প্রচার মাধ্যমে বার বার প্রচার করে তারা বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে থাকে, প্রাণীর প্রতি তারা কতটা দরদী।

        দরদ নেই শুধু মুসলমানদের ক্ষেত্রে। সে যুগের মক্কার জাহিলদের অনুকরণে আধুনিক জাহিলরাও মুসলমানদের প্রাণের কোনো মূল্য দিচ্ছে না। এক আল্লাহ তা'য়ালাকে তারা বিশ্বাস করে, কুরআনকে তারা মহান আল্লাহর বাণী হিসেবে বিশ্বাস করে, শুধুমাত্র এই অপরাধে (!) মুসলিম নারীদের ইজ্জত-আব্রু হালাল করে নেয়া হয়েছে। মুসলিম শিশু, কিশোর, তরুণ-যুবকদেরকে পাখির মতো গুলী করে হত্যা করা হচ্ছে। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হচ্ছে। বন্দী মুসলমানদেরকে পেছনের দিকে হাত দু'টো বেঁধে খাঁচায় আবদ্ধ করে রাখা হচ্ছে। গর্ভবর্তী মুসলিম নারীর পেট চিরে গর্ভের শিশুকেও হত্যা করা হচ্ছে। মাতা-পিতার শান্তির কোল থেকে শিশু ছিনিয়ে নিয়ে পাথরে আছড়ে হত্যা করা হচ্ছে। সামান্য একটি পিঁড়ার যে মূল্য রয়েছে, বর্তমান পৃথিবীতে অমুসলিমদের কাছে মুসলমানের সেই মূল্য নেই। বর্তমান জাহিলদের পূর্বসূরী আরব জাহিলদের চরিত্রে যে গুণ ও বৈশিষ্ট ছিল, সেই একই গুণ ও বৈশিষ্ট বহন করছে আধুনিক জাহিলরা। আল্লাহ তা'য়ালার বিধানের শত্রুদের চারিত্রিক মান, গুণ ও বৈশিষ্ট প্রত্যেক যুগে একই রকম ছিল, এদের চরিত্র অপরিবর্তনীয়।

        ইসলামের দুশমনরা নবী করীম (সা:) এর মর্যাদাক্ষুণ্ণকর কর্মকাণ্ড করছে আর মুসলিম নামধারী অগণিত জনগোষ্ঠী নীরবে দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। মহান আল্লাহ তা'য়ালা নির্দেশ দিচ্ছেন-

لتُؤْمِنُوا بِاللهِ وَرَسُوْله وَتُعَزِّرُوهُ وَتُوَقِّرُوهُ طَ وَتُسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلاً -

         যাতে করে তোমরা (একমাত্র) আল্লাহর ওপর এবং তাঁর নবীর ওপর (সর্বোতভাবে) ঈমান আনো, (দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে) তাঁকে সাহায্য করো, (আল্লাহর নবী হিসাবে) তাঁকে সম্মান করো; (সর্বোপরি) সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহ তা'য়ালার মাহাত্ম্য ঘোষণা করো। (সূরা আল ফাতাহ-৯)

        ইতোপূর্বে প্রেরিত নবী-রাসূলদের সাথে বিদ্রোহ করার অপরাধে মহান আল্লাহ তা'য়ালা সেসব এলাকায় বিদ্রোহী জাতির ওপর আযাব অবতীর্ণ করে জনপদ নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। মক্কা নগরীর ইসলাম বিরোধিদের ওপর আযাব অবতীর্ণ করে তাদের নিশ্চিহ্ন করেননি শুধু মাত্র নবী করীম (সা:) এর মর্যাদার খাতিরে। যে পবিত্র নগরীতে তাঁর প্রিয় হাবীব এবং সবথেকে বেশি মর্যাদাবান নবী জন্মগ্রহণ করেছেন, সেই নগরীর ওপর তিনি আযাব অবতীর্ণ করেননি। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

وَمَا كَانَ اللهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيهِمْ ط وَمَا كَانَ اللَّهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ -

        আল্লাহ তা'য়ালা এমন নন যে, তিনি তাদের কোনো আযাব দিবেন, অথচ আপনি (এখনো) তাদের মধ্যে (বর্তমান) রয়েছেন; আর আল্লাহ তা'য়ালা এমনও নন যে, কোনো (জাতির) মানুষদের তিনি শাস্তি দিবেন, অথচ তারা (কিছু লোক) তখনও আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছে। (সূরা আনফাল-৩৩)

Post a Comment

0 Comments