নামাযে কী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়?

        ইতোপূর্বে আমি উল্লেখ করেছি, এই পৃথিবীতে নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে মুসলমানদের ওপর। নেতৃত্ব দিতে হলে নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জন করতে হয়। নেতৃত্বের মৌলিক গুণাবলী অর্জন করতে সক্ষম না হলে, সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধ- এই দায়িত্ব পালন করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। নামায মানুষের মধ্যে নেতৃত্বের গুণ-বৈশিষ্ট্য অর্জনে সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিশ্বমানবতার মুক্তির লক্ষ্যে যে জীবন বিধান অবতীর্ণ করেছেন, সেই জীবন বিধান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যারা নেতৃত্ব দিবেন, তাদের প্রথম কাজ হলো, নিজেরা যাবতীয় সৎ গুণাবলীর অধিকারী হবেন। ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় নেতৃত্বের সর্বপ্রথম গুণ-বৈশিষ্ট্য হলো মহান আল্লাহ তা'য়ালাকে ভয় করা। নামায মানুষের মধ্যে মহান আল্লাহ তা'য়ালার ভয় সৃষ্টি করে দেয়।

        ইতোপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি, নামায আদায়ের পূর্ব শর্ত হলো পবিত্রতা অর্জন করা। একজন মানুষ যখন নামায আদায়ের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে বা নামায আদায়ের জন্য মসজিদে যায়, তখন কেউ তাকে এ প্রশ্ন করে না যে, আপনার শরীর ও পোষাক পবিত্র কিনা বা আপনি অযু করেছেন কিনা।

        কারণ যিনি নামায আদায়ের জন্য মসজিদে গিয়েছেন, তিনি শারীরিক পবিত্রতা অর্জন করেছেন, পবিত্র বস্ত্র পরিধান করেছেন এবং অযু করেই মসজিদে প্রবেশ করেছেন। অপবিত্র শরীর ও বস্ত্রে বা অযু ব্যতীতই একজন মানুষ মসজিদে নামাযে দাঁড়াতে পারে। এ ব্যাপারে তাকে প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হবে না। তবুও কেনো সে পবিত্রতা অর্জন করলো? কারণ এ কথা তার মনে সক্রিয় রয়েছে যে, অপবিত্র অবস্থায় বা অযু ব্যতীত নামায আদায় করলে সে নামায আল্লাহ তা'য়ালা গ্রহণ করবেন না এবং আদালতে আখিরাতে তাকে গ্রেফতার করা হবে। এই ভয় তার মধ্যে জাগ্রত ছিলো বলেই সে পবিত্রতা অর্জন করেছে। এভাবে নামায মানুষের মনে মহান আল্লাহর ভয় সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।

        যারা একনিষ্ঠভাবে নামায আদায় করে, তারা যে কোনো অবস্থায়ই থাক না কেনো- জ্ঞান থাকা অবস্থায় তারা নামায ত্যাগ করেন না। তাদের জীবনে এমন অবস্থা হয় না যে, নির্জনে তারা একাকী রয়েছেন, এখন নামায আদায় না করলে কোনো মানুষ দেখবে না। কিন্তু এরপরও তারা একমাত্র মহান আল্লাহর ভয়ে নামায আদায় করে থাকেন। নামাযে দাঁড়িয়ে নীরবে কে কোন্ সূরা পাঠ করছে, নামায শেষে এ জন্য তাকে কারো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় না। কেউ ইচ্ছে করলে নামাযে সূরা বা অন্যান্য তসবীহ্ পাঠ না করে অন্য কিছুও পাঠ করতে পারে।

        কিন্তু কেউ না শুনলেও মহান আল্লাহ সমস্ত কিছুই শুনছেন, এই ভয় মনে জাগরুক থাকার কারণে নামাযে যেখানে যা পাঠ করতে হবে, মানুষ তাই পাঠ করে। এভাবে নামায মানুষের মধ্যে এই প্রবণতা সৃষ্টি করে যে, নির্জনে একাকী অবস্থায় মানুষের দৃষ্টির আড়ালে যে কাজ করা হবে, তা মহান আল্লাহ দেখবেন এবং এই কাজের হিসাব আল্লাহর দরবারে তাকে দিতে হবে। এভাবেই নামায মানুষের মধ্যে মহান আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করে, মানুষকে সৎ ও চরিত্রবান মানুষে পরিণত করে।

        মহাগ্রন্থ আল কোরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ তা'য়ালা ঘোষণা করেছেন, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। একটি বিষয়ে এভাবে বার বার তাগিদ দেয়ার একমাত্র কারণই হলো, যার মনে মহান আল্লাহর ভয় জাগরুক থাকে, সে ব্যক্তির পক্ষে কোনোক্রমেই অসৎ কোনো কাজে নিজেকে জড়িত করা সম্ভব নয়। তার পক্ষে মিথ্যা কথা বলা, আমানতের খেয়ানত করা, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা, দায়িত্বে অবহেলা করা বা দেশ ও জাতির ক্ষতি হয় এমন ভূমিকা পালন করা সম্ভব নয়। মহান আল্লাহর ভয় মুসলমানদের মধ্যে সময়ের প্রত্যেক মুহূর্তে জাগরুক রাখার লক্ষ্যেই তাদের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ করে দেয়া হয়েছে। মুসলমান নামায আদায়ের মাধমে আল্লাহ তা'য়ালাকে ভয় করে জীবন পরিচালনার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবে। আল্লাহকে ভয় করার দুর্লভ গুণ মুসলমান যেন আয়ত্ব করতে পারে, এর জন্য যেমন নামায ফরজ করা হয়েছে, তেমনি পবিত্র কোরআনে বার বার তাগিদ দেয়া হয়েছে, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। মহান আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

يأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقتِهِ

        হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো যতটা ভয় তাঁকে করা উচিত। (সূরা ইমরান-১০২)

        সময়ের প্রত্যেক মুহূর্তে মুসলমান যেন মহান আল্লাহ তা'য়ালাকে স্মরণে রাখে, এই ব্যবস্থা করা হয়েছে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের মাধ্যমে। পৃথিবীতে নেতৃত্ব দেয়ার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যাঁর পক্ষ থেকে মুসলমানদের প্রতি অর্পণ করা হয়েছে, সেই আল্লাহ তা'য়ালাকে মুসলমান প্রত্যেক কাজে যেন স্মরণে রাখে, এই প্রশিক্ষণ নামাযের মাধ্যমে দেয়া হয়ে থাকে। মুসলমানের চব্বিশ ঘন্টার জীবন নামায দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। অর্থাৎ নামায যেমন মহান আল্লাহর আদেশ অনুসারে তাঁরই নির্দেশিত পদ্ধতিতে আদায় করা হয়ে থাকে, অনুরূপভাবে নামাযের বাইরের জীবনও যেন তাঁকে স্মরণে রেখে তাঁরই আদেশ অনুসারে পরিচালিত করা হয়, তার প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে নামাযের মাধ্যমে। প্রত্যেক দিন এই প্রশিক্ষণ শুরু হয় দিনের যখন সূচনা হয় তখন থেকেই আর শেষ হয় দিনের শেষে রাতের প্রথম প্রহরে। অর্থাৎ ফজরের নামায দিয়ে শুরু এবং এশার নামাযে এই প্রশিক্ষণ শেষ হয়।

        সারা দিনের মধ্যে আরো তিনবার অর্থাৎ যোহর, আসর ও মাগরিবের নামাযে আল্লাহ তা'য়ালাকে স্মরণে রাখার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ফজরের নামাযে মুসলমানকে প্রথম প্রশিক্ষণ দেয়া হলো, তোমাকে এই পৃথিবীতে নেতৃত্বের আসনে আসীন করা হয়েছে। তুমি নিজেকে আল্লাহর বিধানের অধীনে পরিচালিত করবে এবং এই বিধান পৃথিবীতে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে প্রাণান্তকর চেষ্টা-সংগ্রাম করবে। তুমি মুক্ত-স্বাধীন নও, তোমার সকল কাজের হিসাব ঐ আল্লাহর দরবারে দিতে হবে, যে আল্লাহকে তুমি দিনের সূচনায় সমস্ত কাজের পূর্বে প্রথমে সিজদা দিলে। পৃথিবীর অন্যান্য কাজ শুরু করার পূর্বে তুমি সর্বপ্রথমে তোমার যে রক্-কে সিজদা দিলে, সেই রব-এর আদেশ অনুসারেই তুমি সারা দিন পৃথিবীর অন্যান্য কাজ-কর্ম করবে।

        ফজরের নামাযের পরে একজন মুসলমান জাগতিক কাজে নিজেকে নিয়েজিত করবে। এসব কাজের মধ্যে সে নিজেকে যেন বিলীন করে না দেয় এবং নিজেকে যেন স্বাধীন সত্তা বলে বিবেচনা না করে, এই কথাটি তাকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যই যোহরের নামাযের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুনিয়ার সমস্ত কাজ-কর্ম স্থগিত রেখে যোহরের সময় পুনরায় তাকে মহান আল্লাহর দরবারে হাজিরা দেয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে।

        অর্থাৎ ফজরের নামাযে তাকে যে চেতনার প্রশিক্ষণ দেয়া হলো, দুনিয়ার ঝামেলায় নিমজ্জিত হয়ে সেই চেতনা কিছুটা শিথিল হয়ে পড়ে। চেতনা অনেকাংশে ঝিমিয়ে পড়ে। এই চেতনাকে পুনরায় যোহরের সময় শাণিত করা হয়। ফজরের সময় যে প্রশিক্ষণ দিয়ে দুনিয়ার দুর্গম স্থানে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো, যোহর, আসর ও মাগরিবের সময় সেই চেতনাকে শাণিত করার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সবশেষে সারা দিনের কর্মক্লান্ত দেহ যখন সে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে ঘুমের রাজ্যে প্রবেশ করতে যাবে, তখনও তাকে সেই একই চেতনার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেই ঘুমের রাজ্যে প্রবেশ করতে হয়। নামায এভাবেই মুসলমানের চব্বিশ ঘন্টার জীবনে মহান আল্লাহর স্মরণের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

وَأَقِمِ الصَّلوةَ لِذِكْرِي

        আমাকে স্মরণে রাখার জন্য নামায প্রতিষ্ঠা করো। (সূরা ত্ব-হা-১৪)

        পৃথিবীর নেতৃত্বের দায়িত্ব যাদের প্রতি অর্পণ করা হলো, তাদের প্রতি আল্লাহ তা'য়ালা নামায বাধ্যতামূলক করে দিয়ে তাঁকে প্রত্যেক মুহূর্তে স্মরণে রাখার ব্যবস্থা এ জন্যই করেছেন যে, তারা কোনো কাজই যেন নিজের মর্জি মতো না করে। প্রত্যেক কাজেই যেন মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি অনুসন্ধান করে। রাব্বুল আলামীনের যাবতীয় অসন্তুষ্টিমূলক কাজ থেকে সে নিজেকে বিরত রাখবে। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করতে গিয়ে অর্থাৎ নেতৃত্ব দিতে গিয়ে সে যেন সীমালংঘন না করে, এ জন্যই নামাযের মাধ্যমে মহান আল্লাহকে স্মরণে রাখার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

Post a Comment

0 Comments