তৃতীয় ক্রুসেডের কথা

        বিজয়ের আনন্দ হিল্লোলে উড়ছে তখন ইসলামের চাঁদ-তাঁরা খচিত নিশান, আর খৃষ্টানদের ক্রস-চিহ্নিত পতাকা পরাজয়ের গ্লানিতে লাঞ্চিত। ১১৮৭ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর। খৃষ্টান শাসিত জেরুযালেম নগরীর সম্মুখে শিবির স্থাপন করেছেন সিংহ-বিক্রম অধিনায়ক গাজী সালাহউদ্দীন। জেরুযালেম নগরীর উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দেয়ালের দিকে মুসলিম বাহিনী আক্রমণ করছে।

একমাস পর।

        ১১৮৭ সালের ২০ শে অক্টোবর। সমগ্র নগরী তখন গাজী সালাহউদ্দীনের দয়ার উপর নির্ভরশীল। আত্মসমর্পণের শর্ত স্থির করার জন্য জেরুযালেমের খৃষ্টান-দূত বানিয়ান নিজেই গিয়ে হাজির হলো সালাহউদ্দীনের তাঁবুতে। গাজী সালাউদ্দীন বানিয়ানকে জানিয়ে দিলেন, তরবারির সাহায্যেই অত্যাচারী খৃষ্টানদের হাত থেকে জেরুযালেম দখলের শপথ তিনি করেছিলেন। কাজেই শর্তহীন আত্মসমর্পণই তাঁকে মুক্ত করতে পারে সেই শপথ থেকে। ১০৯৯ সালে খৃষ্টান বাহিনী কর্তৃক জেরুযালেমের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কথাও তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন বানিয়ানকে। নীরব বানিয়ান। শেষে শর্তহীন আত্মসমর্পণের শর্তই স্বীকার করে ফিলে গেলো খৃষ্টান দূত বানিয়ান।

        সেদিন শুক্রবার, ২৭শে রজব, শবে-মেরাজ। গাজী সালাহউদ্দীন প্রবেশ করলেন জেরুযালেমে। অত্যাচারী খৃষ্টানগণ ভয়কম্পিত হৃদয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষামান। কিন্তু মহানুভবতা প্রদর্শন করলেন সিংহ-বিক্রম বিজয়ী বীর গাজী সালাহউদ্দীন। খৃষ্টানদের উপর মুসলমানদের বিজয় হয়ে উঠলো মানবিকতার আলোয় উজ্জ্বল। ৮৮ বছর পূর্বে খৃষ্টানরা যেখানে জেরুযালেম নগরীর রাস্তা-পথ মুসলমানদের লাশের পাহাড় আর রক্তের নদী পার হয়ে এগিয়ে গিয়েছিলো হোলি সেপালকার গির্জায়, সেখানে ৮৮ বছর পর মুসলমানদের বিজয়ের দিনে লুণ্ঠিত হলো না খৃষ্টানদের একটি বাড়ি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। স্পর্শ করা হলো না একটি খৃষ্টান গির্জাকেও, আহত হল না একটি মানুষও। গাজী সালাহউদ্দীনের আদেশে মুসলমান সৈনিকরা পাহারা দিলো সারা নগরীর রাস্তা-পথ।

        নামেমাত্র মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্ত করে দেওয়া হল সকল খৃষ্টান বন্দীকে। যারা সামান্য মুক্তিপণও দিতে পারলো না, পণ ছাড়াই তাদেরকে মুক্তি দেওয়া হলো। গাজী সালাহউদ্দীন নিজেই ঘোষণা করলেন এই সিদ্ধান্ত। বিনাপণেই মুক্তি দিলেন প্রত্যেক বয়স্ক নর ও নারী বন্দীকে। খৃষ্টান নারীরা যখন অশ্রুসিক্ত চোখে এসে দাঁড়ালো সালাউদ্দীনের সম্মুখে, জিজ্ঞোসা করলো কোথায় তারা যাবে, তাদের স্বামী বা পিতা যুদ্ধে হয় নিহত হয়েছে নয় তো বন্দী হয়েছে। তখন সালাহউদ্দীন তাদের আশ্বাস দিয়ে বললেন, প্রতিটি বন্দীদের তিনি মুক্ত করে দিচ্ছেন আর প্রত্যেক বিধবা ও ইয়াতিমকে দিচ্ছেন তাদের প্রয়োজন ও মর্যাদা অনুযায়ী জীবন-যাপনের উপরকণ।

        গাজী সালাহউদ্দীনের এই মহানুভবতা ও অনুগ্রহের বিপরীতে মনে পড়ে ১০৯৯ সালে প্রথম ক্রুসেডের সময় খৃষ্টান বিজয়ীদের নির্মমতম হত্যাকাণ্ডের কথা। বিজয়ের ক্ষণে এই-ই হচ্ছে ইসলামের শিক্ষা। সারা দুনিয়া এই শিক্ষার প্রকাশ দেখেছিল ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা বিজয়ের সময়। (ক্রুসেডের বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে History of Crusades, Vol. I &II, Cambridge University Press, London)

        ইসলামের ইতিহাসে এমন একটি ঘটনাও নেই যে, ইসলাম প্রচার বা প্রতিষ্ঠার জন্য কোথাও রক্তপাত করা হয়েছে বা কারো প্রতি শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে। অথবা বিজয়ী মুসলিম বাহিনী অমুসলিমদের প্রতি কোথাও সামান্যতম অত্যাচার করেছে। কিন্তু খৃষ্টানদের ইতিহাস মসী লিপ্ত। তারা বিজিত এলাকায় প্রবেশ করেছেই রক্তপাত করতে করতে। পাশ্চাত্যের বিখ্যাত খৃষ্টান ঐতিহাসিক ডোযি বলেছেন- This appears at first a striking mystery especially when we know that the new religion of Isalm was not imposed on an any body.

        অর্থাৎ প্রথমেই দৃষ্টি-আকর্ষণকারী এক রহস্য হিসেবে ধরা পড়ে যে, ইসলামের নতুন ধর্ম কারও উপর জোর করে আরোপ করা হয়নি।

        ইসলাম পৃথিবীতে আগমনই করেছে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, কারো প্রতি জোর-জবরদস্তি করার জন্য নয়। ইসলাম জোর-জবরদস্তির বিপক্ষেই অবস্থান গ্রহণ করেছে। ইসলামই পৃথিবীতে একমাত্র আদর্শ, যে আদর্শ অন্যান্য মতবাদ-মতাদর্শ এবং অন্যান্য জাতি বা সম্প্রদায়ের প্রতি সহনশীল এবং মুসলিমরাই হলো সবথেকে পরমত সহিষ্ণু জাতি। খৃষ্টান ঐতিহাসিক ডোযি তাঁর 'মুসলমান কর্তৃক স্পেন বিজয়ের বিবরণী'তে উচ্চ প্রশংসা করেছেন ইসলামের এই সহনশীলতার। তিনি বলেছেন-

The state of the Christians under Islam was not the cause of much discontent if compared with the first. The Muslims were very tolerant, they did not harass any body in matters of religion. For this the Christians were grateful to the Muslims, they praised the tolereance and justice of the Muslim conquerers and preferred the Muslim rule to that of the Germans and Frances.

        অর্থাৎ অতীতের সঙ্গে তুলনায় ইসলামের অধীনে খৃষ্টানদের অবস্থায় খুব একটা অসন্তুষ্টির কারণ ছিল না। মুসলমানরা ছিল খুবই সহনশীল, ধর্মের ব্যাপারে তারা কাউকেই হয়রানি করেনি। এর জন্য খৃষ্টানরা মুসলমানদের প্রতি ছিল কৃতজ্ঞ, তারা প্রশংসা করেছে মুসলিম বিজয়ীদের সহনশীলতা ও সুবিচারের এবং জার্মান ও ফ্রান্সদের শাসনের চাইতে অধিকতর পছন্দ করেছে তারা মুসলিম শাসনকে।

        প্রত্যেক নবী-রাসূলের ইতিহাসই এ কথা প্রমাণ করে যে, তাঁরা ইসলামের সহনশীলতার নীতির মাধ্যমেই আদর্শের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছেন। সকল নবী-রাসূলের ওপরই অত্যাচার করা হয়েছে। কিন্তু তাঁরা কখনোই অসহিষ্ণু পন্থা অবলম্বন করেননি। একই ধারাবাহিকতায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ইসলামী আদর্শের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছেন এবং মুসলমানদেরকেও সেই সহনশীলতার নীতিই শিক্ষা দিয়েছেন। ইসলাম ও মুসলমানদের এই সহনশীলতা, মানবতা, পরমত সহিষ্ণুতা ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের রূপই বিশাল রোম এবং পারস্য সাম্রাজ্য মুসলিমদের পদতলে আনতে সবথেকে বেশী সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলো।

        ধর্মের ইতিহাসে অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রে যে মানবতা বিরোধী নৃশংসতা ও নির্মমতা দেখা যায়, ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনার গন্ধও পাওয়া যাবে না। ধর্মের নামে যেসব লোমহর্ষক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং ধর্মের নামেই হত্যাযজ্ঞ, নির্মম নিষ্ঠুর দন্ড, শক্তি প্রয়োগ করে শাসন, সম্পদ দখল, নরবলি, কন্যা সন্তান হত্যাসহ যা কিছু অমানবিক কর্ম অনুষ্ঠিত হয়েছে, এসবের কোনো একটি কর্মও ইসলাম অনুমোদন করেনা এবং ইসলাম তার অনুসারীদেরকে এসব কর্ম থেকে কঠিনভাবে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। শক্তি প্রয়োগ করে কাউকে ধর্মান্তরিত করার ব্যাপারে ইসলাম কঠিনভাবে নির্দেশ দিয়ে বলেছে-

لا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ قف قد تَّبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ

        দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই, প্রকৃত সত্য ও নির্ভুল কথা সুস্পষ্ট এবং ভুল চিন্তাধারা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে গিয়েছে। (সূরা আল-বাকারা-২৫৬)

        পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ রাব্বুল আরো বলেছেন-

وَقَاتِلُوا هُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلَّهِ فَانِ انْتَهَوْا فَلَا عُدْوَانَ إِلَّا عَلَى الظَّلِمِينَ

        তোমরা তাদের সাথে লড়াই করতে থাকো, যতক্ষণ না ফিতনা চূড়ান্তভাবে শেষ হয়ে যায় ও দ্বীন কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট হয়। এরপর যদি তারা বিরত হয় তবে বুঝে নাও যে, কেবলমাত্র জালিমদের ছাড়া আর কারো প্রতি হাত প্রসারিত করা সঙ্গত নয়। (সূরা আল বাকারা-১৯০)

        উল্লেখ যে সব ক'টি যুদ্ধেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন। আত্মরক্ষামূলক ভূমিকায়, তিনি যুদ্ধ করেছিলেন আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে যারা দূরদেশ থেকে এসে মুসলমানদের নির্মূল করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পবিত্র কোরআন থেকে অনেক দৃষ্টান্তই দেওয়া যায় যে, নিজ মত বা আদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার জন্য কারও বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করতে মুসলমানদেরকে নিষেধ করা হয়েছে। প্রবল অসহনশীলতার সে যুগে গড়ে উঠেছিল পারস্য ও রোমক সাম্রাজ্যের ভিত্তি ও কাঠামো। সেই যুগে পবিত্র কোরআনের সহনশীলতার নির্দেশাবলী ছিল নিঃসন্দেহে বিস্ময় উৎপাদনকারী। আল্লাহর কোরআন ও নষী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নীতিমালা কর্তৃক নির্দেশিত মুসলমানরা রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে উপলব্ধি করেছিলেন সহনশীলতা ও উদারতার মূল্য এবং তাতে করে সমর্থ হয়েছিলেন বিজিত মানুষ ও সমাজের বিশ্বাস এবং সহানুভূতি অর্জন করা। যিজিত জাতিকে মুসলমানরা দেখিয়ে ছিলেন সহনশীলতা ও দিয়েছিলেন ধর্মীয় স্বাধীনতা।

        মুসলমানদের বিশ্বজনীন সহনশীলতার নীতি বিজিত জাতির মনে বন্ধুত্বপূর্ণ ধারণা সৃষ্টিতে পুরোপুরি সফল হয়েছিল এবং তাতে তারা স্বধর্মীদের শাসনের তুলনায় অধিকতর পছন্দ করেছিল মুসলিম শাসনকে। মুসলিম সেনাবাহিনীর অধিনায়ক আবু ওবায়দা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু যখন সিরিয়ার এক নগরীর বাইরে শিবির স্থাপন করেছিলেন, তখন নগরীর খৃষ্টান অধিবাসীরা মুসলিম সেনাধিনায়কের কাছে আবেদন জানিয়েছিল, 'হে মুসলিমগণ। বাইজেন্টিয়ানরা যদিও আমাদের স্বধর্মী, তবুও তাদের তুলনায় আপনাদেরকে আমরা অধিক পছন্দ করি এজন্য যে, আপনারা আমাদের সঙ্গে উত্তম শর্ত রক্ষা করে চলেন। আপনারা অধিকতর দয়াশীল ও আমাদের উপর আপনাদের শাসন তাদের তুলনায় উত্তম। কারণ তারা আমাদের সহায়-সম্পদ ও নারীদের সম্মান-মর্যাদা লুণ্ঠন করেছে।'

        ইয়ারমুকের সেই বিখ্যাত যুদ্ধের পূর্বে মুসলিম বাহিনী যখন এমেসা নামক এলাকা ত্যাগ করে, তখন এমেসার খৃষ্টান অধিবাসীরা স্বধর্মী হেরাক্লিয়াসের বাহিনী যে নগরীতে প্রবেশ করতে না পারে, এ জন্য তারা নগরীর দরজাসমূহ বন্ধ করে দিয়ে মুসলিম বাহিনীকে বলেছিলো, এমেসাবাসীরা তাদের স্বধর্মীদের অবিচার ও অত্যাচারের তুলনায় অধিকতর পছন্দ করে মুসলমানদের সরকার ও তাঁদের সুবিচারকে।

        ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু জেরুযালেম বিজয়ের পর দিয়েছিলেন স্বাধীনতার এক সনদ যাতে উল্লেখ করা হয়েছিল এই ঐতিহাসিক কয়েকটি ধারা। সে সনদে উল্লেখ করা হয়েছিলো, আল্লাহর সেবক, আমিরুল মুমিনীন ওমর নিরাপত্তা দান করেছেন মানুষকে-দান করেছেন তাদের জীবনের নিরাপত্তা, তাদের সহায়-সম্পত্তি, তাদের গির্জাসমূহ, তাদের ক্রুস ও তদসংক্রান্ত তাদের সমস্ত ধর্মের নিরাপত্তা। তাদের গির্জাসমূহ বাসগৃহে পরিণত করা হবে না বা হবে না ধ্বংসপ্রাপ্ত।

        খলীফা আল-মুতাসিমের রাজত্বকালে একজন ইমাম ও মুয়াজ্জিন ধ্বংস করে দিয়েছিলেন ইয়াহুদীদের এক মন্দির এবং সেখানে নির্মাণ করেছিলেন একটি মসজিদ। খলীফার কাছে অভিয়োগ উত্থাপিত হলে তিনি সে-মন্দিরের ধ্বংস করার জন্য ওই ইমাম ও মুয়াজ্জিনকে বেত্রাঘাতের শাস্তি দিয়েছিলেন।

        অপরাজেয় মুসলিম সেনাপতি আমর ইবনুল আ'স ধ্বংস করে দিয়েছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ায় খৃষ্টানদের সম্মিলিত শক্তি। বিজয়ী সেনাপতি এরপর নিজে গ্রহণ করলেন বিজিত অঞ্চলের শাসনভার। তিনি ধর্মীয় ব্যাপারে খৃষ্টান প্রজাদেরকে পূর্ণতম স্বাধীনতা দিলেন।

        একদিন সকালে নগরীর খৃষ্টান অধ্যুষিত অঞ্চলে দেখা দিল তীব্র উত্তেজনা। আর্চবিশপের নেতৃত্বে স্থানীয় খৃষ্টানদের প্রতিনিধি দল উপস্থিত হলেন এসে শাসক হযরত আমরের বাড়িতে। তিনি অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার সাথে খৃষ্টান প্রতিনিধি দলকে অভ্যর্থনা জানালেন। আর্যবিশপ অভিযোগ করে বললেন, বাজারে স্থাপিত ছিলো যীশুখৃষ্টের মার্বেল পাথরে নির্মিত এক মূর্তি এবং রাতে কেউ ভেঙ্গে দিয়েছে সে মূর্তির নাক। আমাদের বিশ্বাস যীশুখৃষ্টের মূর্তির নাক ভেঙ্গেছে কোনো মুসলমান। হযরত আমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু দুঃখভারাক্রান্ত কণ্ঠে আর্চবিশপকে বললেন, যা ঘটেছে তার জন্য আমি গভীরভাবে বেদনাহত ও লজ্জিত। এ কথা সত্য যে ইসলাম অমুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মের ক্ষতি সাধন করার অনুমতি দেয় না। মেহেরবাণী করে আপনারা মূর্তিটি মেরামত করে নিন এবং আমি তার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করব।' আর্চবিশপ উত্তর দিলেন যে, ওটা মেরামত করা অসম্ভব, কারণ ওতে একটি নতুন নাক সংযোজন করা যাবে না।' হযরত আমর বললেন, তাহলে তৈরি করুন সম্পূর্ণ নতুন এক মূর্তি এবং তার পুরো খরচ দেব আমি।

        আর্চবিশপ জানালেন, এটাও সম্ভব নয়। আপনি জানেন, যীশুখৃষ্টকে আমরা গডের পুত্র হিসেবে বিশ্বাস করি, তাই তাঁর মূর্তি তৈরির জন্য হীন মুসলমানের অর্থ আমরা গ্রহণ করতে পারি না। এর একটিমাত্র ক্ষতিপূরণ করা যেতে পারে; আমরা আপনাদের নবীর মূর্তি বানিয়ে তাঁর নাক ভেঙ্গে দেব।

        এ কথা শোনার সাথে সাথে লাল হয়ে উঠল সেনাপতি আমরের সমস্ত মুখমণ্ডল। বার বার তাঁর হাত স্পর্শ করলো নিজ তলোয়ারের হাতল এবং তিনি অস্ত্র থেকে সরিয়ে আনলেন নিজের হাত। বিশপকে বললেন, আপনি প্রস্তাব করেছেন সেই মহান নবীর মূর্তি স্থাপন করে তাঁর নাক ভেঙ্গে দিবেন। অসীম সংগ্রামের পর যিনি উৎখাত করেছিলেন মূর্তিপূজা। আর আপনারা চান আমাদেরই চোখের সম্মুখে সেই নবীর মূর্তি নির্মাণ করে তাঁর নাক ভাঙ্গতে। তার পূর্বে আমাদের সকলের ধ্বংস হয়ে যাওয়াও উত্তম। বিশপ, মেহেরবাণী করে অন্য কোন প্রস্তাব করুন। আপনাদের মূর্তির নাকের বদলে আমাদের যে কারও নাক কেটে আপনাদের হাতে দেওয়ার জন্যও আমি প্রস্তুত।

        এ প্রস্তাব গ্রহণ করলেন আর্চবিশপ। পরদিন ভোরে খৃষ্টান ও মুসলিমগণ ময়দানে সমবেত হলো এই দৃশ্য দেখার জন্য। সমবেত জনমণ্ডলীকে উদ্দেশ্য করে হযরত 'আমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার বিবরণ শোনালেন। তারপর তিনি আর্চবিশপকে ডেকে বললেন, আপনি খৃষ্টানদের প্রধান আর এখানে আমি মুসলিম সেনাবাহিনীর প্রধান। এই দেশ শাসন করার দায়িত্ব আমার। আমার প্রশাসনের দুর্বলতার জন্য আপনার ধর্মের প্রতি যে অবমাননা করা হয়েছে তার শাস্তি গ্রহণ করতে হবে আমাকেই। গ্রহণ করুন এই তরবারি আর আমারই নাক কেটে নিন।

        এ কথা বলে তিনি নিজের তরবারি বিপশকে এগিয়ে দিলেন। তরবারি হাতে নিলেন আর্চবিশপ, পরীক্ষা করতে লাগলেন তরবারীর ধার। গভীর বিস্ময়ে অগণিত জনতা নিরব নিস্তব্ধ। চারদিকে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ। সহসা নীরবতা ভঙ্গ করে দৌড়ে এলো এক মুসলিম সৈন্য। সে চিৎকার করে বললো, থামুন বিশপ থামুন। এই আপনাদের যীশুর মূর্তির নাক এবং আমিই সেই ব্যক্তি, যে অপরাধ করেছে। শাস্তি আমারই প্রাপ্য। মুসলিম সেনাধিনায়ক সম্পূর্ণ নির্দোষ।

        সেই সৈনিক এগিয়ে এলো বিশপের সম্মুখে এবং তরবারির সম্মুখে বাড়িয়ে দিলো নিজের নাক। বিস্ময়-বিমূঢ় জমতা অবাক বিস্ময়ে দেখলো এই দৃশ্য। আর্চবিশপ দূরে নিক্ষেপ করলেন তীক্ষ্ণধার তরবারি এবং বললেন, ভাগ্যবান এই সৈনিক আর ভাগ্যবান এই সেনাধিনায়ক। আর সবার উপরে ভাগ্যবান সে মহান নবী- যাঁর আদর্শে গড়ে উঠেছে এঁদের মতো মানুষ। কোন সন্দেহ নেই যে অন্যায় করা হয়েছে প্রতিমূর্তি ভেঙ্গে, কিন্তু তার চাইতেও বড় অন্যায় হবে যদি মূর্তির নাকের বিনিময়ে কেটে নেওয়া হয় জীবিত মানুষের নাক।

        পৃথিবীতে মুসলিম শাসনের সুদীর্ঘকালে অমুসলিম জনসাধারণকে জোর করে ইসলাম গ্রহণ করানোর জন্য কোন সংগঠিত বা রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা ছিল না এবং খৃষ্ট ও অন্যান্য ধর্মকে উৎপাটিত করার জন্য ছিল না কোন উৎপীড়ন-নিগ্রহ। মুসলিম খলীফা ও সুলতানগণ যদি ইচ্ছা করতেন, তাহলে তারা হয়তো অতি সহজেই পারতেন খৃষ্টধর্ম, হিন্দুধর্ম এবং অন্যান্য ধর্মকে নির্মূল করে দিতে, যেমন সহজেই রাজা ফার্ডিনান্ড ও রাণী ইসাবেলা ইসলামকে উৎখাত করতে চেয়েছিলেন স্পেন থেকে। রাজা চতুর্দশ লুই ফ্রান্সে প্রোটেষ্টান্ট ধর্মাবলম্বীদের করেছিলেন শাস্তিযোগ্য এবং ইয়াহুদীদেরকে ইংল্যান্ডের বাইরে রেখেছিলেন ৩৫০ বছর। এশিয়া, স্পেন ও দক্ষিন ফ্রান্সসহ বলকানে খৃষ্টীয় গির্জাসমূহের অক্ষত অবস্থায় টিকে থাকা এবং ভারতে হিন্দু মন্দিরসমূহের টিকে থাকাই অমুসলিম প্রজার প্রতি মুসলিম সরকারসমূহের সহনশীল মন-মানসিকতার সবথেকে বড় প্রমান।

Post a Comment

0 Comments