আল কোরআন পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর বাণী

        মানব জাতির সর্বকালের এবং সর্বযুগের জন্য যে কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে, তা কোন মানুষের রচনা করা কিতাব নয়। পবিত্র কোরআন যে যুগে অবতীর্ণ হয়েছিল, তদানীন্তন যুগের বিভ্রান্ত লোকজন বলতো, 'এ কিতাব মানুষের রচিত।' এ ধরনের কথা প্রতিটি যুগেই বিভ্রান্ত লোকজন বলে থাকে। যারা এ ধরনের ধারণা পোষণ করে থাকে, তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা'য়ালা সূরা বাকারার ২৩ আয়াতে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন-

وَإِنْ كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِمَّا نَزَلْنَا عَلَى عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّنْ مِثْلِهِ

        আমার বান্দার প্রতি যে কিতাব অবতীর্ণ করেছি, তা আমার প্রেরিত কি-না, সে বিষয়ে তোমাদের মনে যদি কোন প্রকার সন্দেহ সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে এর অনুরূপ একটি সূরা রচনা করে আন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কথা পরিষ্কার করে দিলেন। কোরআন অবতীর্ণের যুগে যারা ধারণা করতো যে, এটা মানুষের রচনা করা কিতাব-তাহলে যারা এ ধরনের ধারণা পোষণ করছে, তারাও মানব জাতির বাইরের কেউ নয়। তারাও তো মানুষ। সুতরাং মানুষ হিসেবে তারাও এ ধরনের কোরআন রচনা করতে সক্ষম, অতএব কোরআনের একটি সূরার অনুরূপ একটি সূরা রচনা করে তারা প্রমাণ করে দিক যে, বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কোরআন আল্লাহর বাণী বলে দাবি করছেন, তা আল্লাহর বাণী নয়-বরং তা মানুষের রচনা করা।

        মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অবিশ্বাসীদের লক্ষ্য করে বলেন, তোমাদের মনে যদি এ ধারণা সৃষ্টি হয়ে থাকে যে, এ কোরআন 'মানুষের কথা' তাহলে তো জ্ঞানী, বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ, পন্ডিত বলে দাবিদার সব মানুষেরই এ ধরনের কথা বলার ক্ষমতা থাকা উচিত যে, 'আমি এই কিতাব রচনা করেছি।' অথচ এ ধরনের কোন ক্ষমতা তোমাদের মধ্যে কারো নেই। তবুও তোমরা আমার কিতাবের প্রতি অবিশ্বাস পোষণ করছো। তোমাদের দাবি তো তখনই গ্রহণযোগ্য হতে পারে, যখন তোমরা তোমাদের দাবির অনুকূলে আমার কিতাবের ন্যায় একটি কিতাব রচনা করতে সক্ষম হবে। কিন্তু আমি উপর্যুপরি চ্যালেঞ্জ দিয়েছি, গোটা মানব মন্ডলী মিলিত হয়েও এমন ধরনের একটি কিতাব রচনা করতে অক্ষম। সুতরাং নিজেদের অক্ষমতার প্রতি স্বীকৃতি দিয়ে প্রকৃত সত্য গ্রহণ করে আমার প্রেরিত কিতাবের প্রতি অনুগত হয়ে যাও-এতেই তোমার জীবনের সার্বিক উন্নতি ও মুক্তি নির্ভরশীল।

        কোরআন যাঁর বাণী সেই আল্লাহ বলেন, তোমরা যারা আমার দাসত্ব পরিত্যাগ পূর্বক নানা ধরনের অসার বস্তুকে নিজেদের প্রভু বানিয়ে নিয়েছো। অথচ প্রভু হওয়ার যাবতীয় যোগ্যতা কেবল মাত্র আমারই রয়েছে। তোমরা যাদেরকে প্রভু মনে করে দাসত্ব করছো, তোমাদের সেসব প্রভুদেরকে বলো, কোরআনের অনুরূপ একটি সূরা রচনা করে তোমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসুক। কিন্তু তারা তোমাদেরকে কোন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করতে সম্পূর্ণ অক্ষম। আর এ থেকেই তো তোমাদের অনুভব করা উচিত যে, তোমাদের কোন দাবীর অনুকূলে যখন তারা এগিয়ে আসতে সক্ষম নয়, তখন তারা দাসত্ব লাভের যোগ্য হতে পারে না। দাসত্ব লাভের একমাত্র যোগ্য তো তিনিই-যিনি অনুগ্রহ করে তোমাদেরকে সত্য সঠিক পথের সন্ধান দেয়ার জন্য কোরআনের মতো একটি অতুলনীয় কিতাব প্রেরণ করেছেন।

        কোন কোন মানুষ এ ধারণা পোষণ করে যে কোরআনের ব্যাপারে আল্লাহ তা'য়ালা যে চ্যালে প্রদান করেছেন, সে চ্যালেঞ্জ শুধুমাত্র পবিত্র কোরআনের আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য, সাহিত্যিক মান ও সৌন্দর্য এবং উচ্চাঙ্গের ভাষার ব্যাপারে প্রযোজ্য। এ ধরনের ভুল ধারণা যারা পোষণ করে, তারা মূলতঃ কোরআনের গভীরে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই বিভ্রান্তিকর চিন্তাধারায় আবর্তিত হয়। প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর কোরআনের মর্যাদা এসব ক্ষুদ্র চিন্তা-চেতনা থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। কোরআনের শব্দ, ভাষা এবং সাহিত্যিক মান, বর্ণনাশৈলীর দিক দিয়ে যে অনবদ্য, অতুলনীয় এ ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। পক্ষান্তরে যে কারণে এ কথা বলা হয়েছে যে, 'মানবীয় চিন্তা-চেতনা, জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করে এ ধরনের কিতাব রচনা করা সম্ভব নয়' সে কারণগুলো পবিত্র কোরআনে আলোচিত বিষয়াদি, কোরআন কর্তৃক উপস্থাপিত জীবনাদর্শ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য ও তত্ত্বসমূহ। কোরআন যেসব বিষয়ে আলোচনা করেছে, যে শিক্ষা মানব জাতির সম্মুখে পেশ করেছে, যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বার মানব সভ্যতার সামনে উন্মোচন করেছে, যে আদর্শের দিকে মানব জাতিকে আহ্বান জানাচ্ছে, তা কোন মানবীয় মন-মস্তিষ্ক কল্পনাও করতে পারে না।

        শুধু মানব জাতিই নয়-জ্বিন ও মানব জাতি সম্মিলিতভাবে কিয়ামত পর্যন্তও চেষ্টা-সাধনা করতে থাকে, তবুও আল্লাহর কোরআনের অনুরূপ কোন কিতাব রচনা করতে সক্ষম হবে না। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা বনী ইসরাঈলের ৮৮ নং আয়াতে বলেন-

قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآنِ لا يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوكَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا -

        বলে দাও, মানব ও জ্বিন জাতি সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে কোরআনের মতো একটি জিনিস আনার চেষ্টা করে তবুও তারা আনতে সক্ষম হবে না, তারা পরস্পরের সহযোগী হয়ে গেলেও। 
(সূরা বনী ইসরাঈল)

        পবিত্র কোরআন যাঁর ওপরে অবতীর্ণ হলো, তিনি হঠাৎ করে আকাশ থেকে অবতরণ করে এ দাবী করেননি যে, আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর কিতাব নিয়ে এসেছি। বরং সেই পূত ও পবিত্র ব্যক্তিত্ব জীবনের চল্লিশটি বছর সেই লোকগুলোর মাঝেই অতিবাহিত করেছেন, যে লোকগুলো এ অপবাদ দিচ্ছে যে, 'কোরআন তাঁর নিজের রচনা করা।' যারা এ অপবাদ দিচ্ছে, তারাও এ কথা ভালো করে জানতো, এই ব্যক্তির পক্ষে এমন ধরনের কোন কিতাব রচনা করা কোন ক্রমেই সম্ভব নয় এবং এই ব্যক্তির পক্ষে সামান্যতম মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করা সম্পূর্ণভাবে অসম্ভব। তবুও তারা যখন এই অপবাদের কালিমা আল্লাহর রাসূলের ওপরে লেপন করার ব্যর্থ চেষ্টা করলো, তখন স্বয়ং আল্লাহ তাঁকে বলতে বললেন-

قُلْ لَوْ شَاءَ اللهُ مَا تَلوتُهُ عَلَيْكُمْ وَلَا أَدْرَكُمْ بِهِ - فَقَدْ لَبِثْتُ فِيْكُمْ عُمُراً مِنْ قَبْلِهِ - أَفَلَا تَعْقِلُونَ

        হে রাসূল! আপনি ওদেরকে জানিয়ে দিন, আমি তোমাদেরকে এ কোরআন শুনাবো এটা যদি আল্লাহ না চাইতেন, তাহলে আমি কোন ক্রমেই তা তোমাদেরকে শুনাতে সক্ষম হতাম না এমনকি এই কোরআন সম্পর্কে কোন সংবাদও তোমাদেরকে জানাতে পারতাম না। আমি তো তোমাদের মধ্যেই আমার জীবনের সুদীর্ঘকাল অতিবাহিত করে আসছি। তোমরা কি এ বিষয়টিও অনুভব করতে সক্ষম হচ্ছো না? (সূরা ইউনুছ-১৬)

        যারা এ অপবাদ আরোপ করছিল যে, নিজের রচনা করা কিতাব তিনি আল্লাহর বাণী বলে চালিয়ে দিচ্ছেন, তাদেরকে লক্ষ্য করে মহান আল্লাহ জানিয়ে দিলেন, আমি যদি আমার রাসুলের ওপরে এ কোরআন অবতীর্ণ না করতাম তাহলে তিনি তোমাদেরকে এ কোরআন শুনাতে পারতেন না এমনকি এ কোরআন সম্পর্কে কোন সংবাদও তোমাদেরকে জানাতে পারতেন না। আমি না জানালে তিনি যে কোরআন শুনাতে সক্ষম হতেন না, এ কথা তোমাদের চেয়ে আর বেশী ভালো কে জানে? কেননা, তাঁর শৈশব, কৈশোর ও যৌবন কাল তোমাদের মাঝেই অতিবাহিত হয়েছে। যে ব্যক্তি তার জীবনের সুদীর্ঘকাল তোমাদের মাঝে অতিবাহিত করলো, সে ব্যক্তির যোগ্যতা সম্পর্কে তোমরা তো পরিপূর্ণভাবে অবগত রয়েছো। আমি যাঁর ওপরে আমার কোরআন অবতীর্ণ করেছি, সেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন অদৃশ্য জগৎ থেকে হঠাৎ করে তোমাদের মাঝে আবির্ভূত হননি বা তিনি তোমাদের কাছে কোন অপরিচিত ব্যক্তিত্ব নন। তিনি যখন তোমাদেরকে শুনালেন যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে নবী নির্বাচিত করা হয়েছে, তার ক্ষণপূর্বেও কি তোমরা তোমাদের এই সুপরিচিত ব্যক্তিত্বের মুখে কোরআনের কোন আয়াত বা কোরাআনে আলোচিত বিষয়বস্তু, কোরআন পরিবেশিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের বক্তব্য শুনেছিলে? নিশ্চয়ই তোমরা তা ইতিপূর্বে তাঁর মুখ থেকে শোননি।

        তাহলে কি তোমাদের মনে এ প্রশ্ন জাগে না, দীর্ঘকালের পরিচিত এই লোকটির মুখ থেকে সম্পূর্ণ অপরিচিত যে কালাম আমরা শুনছি, তা কোন মানুষের রচনা নয়? ক্ষণিকের মধ্যে এই লোকটির মধ্যে কিভাবে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হলো? এতকাল এই লোকটি যে ভাষায় ও ভঙ্গীতে কথা বলে এলো, সে ভাষা ও ভঙ্গীতে কোন অতিন্দ্রীয় শক্তির স্পর্শে পরিবর্তন ঘটলো? সম্পূর্ণ নিরক্ষর লোকটির মুখ থেকে কিভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের তথ্য সমৃদ্ধ কথা নির্গত হলো? এসব বিষয়ে কি তোমাদের মনে কোন প্রশ্ন সৃষ্টি হয় না? এসব দিক চিন্তা করলেই তো তোমরা অনুভব করতে সক্ষম হবে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কালাম তোমাদেরকে শুনাচ্ছেন, তা তাঁর নিজের রচনা করা নয়-বরং তা আল্লাহর কালাম। আমি যাঁর প্রতি আমার কোরআন অবতীর্ণ করেছি, তিনি এমন নন যে, আমার কালাম তোমাদেরকে শুনিয়ে দিয়ে তিনি অন্য কোথাও চলে যান। বরং আমার কালাম তোমাদের সামনে পেশ করার পর তিনি তোমাদের মাঝেই পূর্বের ন্যায় বসবাস করতে থাকেন। তোমাদের সাথে আত্মীয়তা ও সামাজিকতা যেভাবে ইতিপূর্বে রক্ষা করতেন, এখনও তাই করছেন। তিনি কোন ভাষায় কথা বলেন, তাঁর রাচন ভঙ্গী কি ধরনের তা তোমরা সুদীর্ঘকাল শুনেছো এবং এখনও শুনছো। আবার তিনি আল্লাহর কালাম হিসেবে যা তোমাদেরকে শুনাচ্ছেন, তার ভাব ও ভাষা, বাচন ভঙ্গী, বর্ণনাশৈলী, প্রকাশ রীতি, শব্দ চয়ন এমন নতুন ধরনের যে, যা ইতিপূর্বে তোমরা কেউ শোননি। এই পার্থক্য নিশ্চয়ই তোমরা অনুভব করে থাকো। সুতরাং তোমরা তোমাদের অনুভূতি শক্তির মাধ্যমেই অনায়াসে বুঝতে পারবে যে, এটা আল্লাহর কালাম।

        মহান আল্লাহর এই যুক্তি শুধুমাত্র সেই যুগের জন্যই প্রযোজ্য ছিল না, বরং আল্লাহর এসব যুক্তি অতীতকালে যেমন প্রযোজ্য ছিল, বর্তমান কালেও তেমনিভাবে প্রযোজ্য এবং অনাগত কালেও প্রযোজ্য হবে। আরবী ভাষা সম্পর্কে যারা প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেছে, তাদের সামনে যদি কোরআনের আয়াত ও হাদীস পেশ করা হয়, তারাও একবার মাত্র পাঠ করেই আল্লাহর বাণী এবং রাসূলের কথার মধ্যে, সুস্পষ্ট পার্থক্য রেখা অঙ্কন করতে সক্ষম হবেন। সুতরাং পবিত্র কোরআন যে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ কিতাব এবং এটা যে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর বাণী, এ কথার সাক্ষী স্বয়ং আল্লাহর কোরআন। এই কিতাব এমন ধরনের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত যে. এই বৈশিষ্ট্যই মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে।

Post a Comment

0 Comments