বায়ুমন্ডলে জলীয় বাষ্প কিভাবে সৃষ্টি করেছেন

        বিজ্ঞানীদের ধারনা অনুসারে পৃথিবীর মূল আবহাওয়ামন্ডলের বিস্তৃতি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে •৫০ মাইল বা ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত উঁচু। পৃথিবীর আবহাওয়ামন্ডলের ৯৯ শতাংশই এর মধ্যে পড়েছে। তবে ১ হাজার মাইল বা ১ হাজার ৬ শত কিলোমিটার উঁচু পর্যন্ত পৃথিবীর আবহাওয়ামন্ডলের গ্যাসের হাল্কা অস্তিত্ব বিরাজমান। পৃথিবীর এই বায়ুমন্ডলের ৭৮ ভাগই নাইট্রোজেন, ২১ ভাগ অক্সিজেন, ১ ভাগ আর্গন। এছাড়া রয়েছে কার্বনডাই-অক্সাইড, অন্যান্য গ্যাস ও জলীয় বাষ্প। বায়ুমন্ডলের এসব উপাদানসমূহ উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের টিকে থাকার জন্য একান্ত অপরিহার্য।

        মানুষের জীবন ধারনের জন্য অক্সিজেন অপরিহার্য। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানব শরীরে অক্সিজেন গ্রহণ করা হয় এবং তা মানবদেহের বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। মানুষের জীবন ধারনের জন্য একান্ত প্রয়োজন হলো আগুন। অক্সিজেন ব্যতিত আগুন প্রজ্জলিত হয় না। কয়লা, তেল বা অন্য কোন দহনের জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। বায়ুমন্ডলে থাকা নাইট্রোজেন গ্যাস যে কোন ধরনের দহন কার্য নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। উদ্ভিদ-বৃক্ষ-তরু-লতার জন্য নাইট্রোজেন অপরিহার্য। বায়ুমন্ডলে অবস্থিত কার্বনডাই অক্সাইড গ্যাস উদ্ভিতের জন্য প্রাণস্বরূপ। পানি এবং কার্বনডাই অক্সাইড থেকে সূর্যের আলোতে বৃক্ষতরু-লতার সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় শ্বেতসার খাদ্য ও অক্সিজেন গ্যাস প্রস্তুত হয় এবং অনাবশ্যকীয় অক্সিজেন বায়ুমন্ডলে ছেড়ে দেয়।

        এভাবে মানুষ এবং অন্যান্য জীব-জন্তু শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বায়ুমন্ডল থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বনডাই অক্সাইড ছেড়ে দেয়। পক্ষান্তরে বৃক্ষ, তরু-লতা বায়ুমন্ডল থেকে কার্বনডাই অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ছেড়ে দিয়ে এদের সমতা রক্ষা করে।

        আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পৃথিবীর উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বায়ুমন্ডলকে আদেশ দান করেছেন, যেন বায়ুমন্ডল গোটা পৃথিবীকে আবৃত করে রাখে। ফলে দিন ও রাত, গ্রীষ্ম এবং শীতকালের উষ্ণতার পার্থক্য বেশী হতে না দিয়ে জীব-জন্তু ও উদ্ভিদ জগৎ টিকে থাকার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে। মহান আল্লাহ বায়ুমন্ডলে নানা ধরনের স্তর সৃষ্টি করেছেন। এসব স্তরের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। এর একটি স্তরের নাম হলো ওজোন স্তর। এই ওজোন স্তর সূর্য থেকে আসা ক্ষতিকর রশ্মি (Harmful ray) শোষণ করে জীব জগৎ ও উদ্ভিদ জগতকে হেফাজত করে। বায়ুমন্ডলের আরেকটি স্তরের নাম হলো অমড্রযদণরণ। এই স্তর থাকার কারণে মানুষ যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সমর্থ হয়েছে। আল্লাহ তা'য়ালা বায়ুমন্ডলে জলীয় বাষ্প সৃষ্টি করেছেন। ভূ-পৃষ্ঠের সাগর, মহাসাগর, নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড় ইত্যাদি থেকে সূর্যের তাপে পানি বাষ্পে পরিণত হয়ে আল্লাহর আদেশে বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে। এই জলীয় বাষ্প ওপরে ওঠার পর ক্রমে তা শীতল হতে থাকে এবং পানির বিন্দু সৃষ্টি হয়। এরপর তা ঘনীভূত হয়ে আল্লাহর আদেশে মেঘমালায় পরিণত হয়। মহান আল্লাহ বায়ুমন্ডলে উষ্ণতা ও চাপের পার্থক্য সৃষ্টি করেছেন। ফলে মেঘ দূর-দূরান্তে চলে যায়। তারপর আল্লাহর আদেশে বৃষ্টি বর্ষিত হয়ে ভূ-পৃষ্ঠ সিক্ত করে। এভাবে আল্লাহ মৃত যমীনকে জীবিত করেন। মহান আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

وَاللَّهُ الَّذِي أَرْسَلَ الرِّيحَ فَتُثيرُ سَحَابًا فَسُقْنَاهُ إِلَى بَلَدٍ مَّيِّتٍ فَأَحْيَيْنَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا

        তিনিই আল্লাহ যিনি বায়ু প্রেরণ করে এবং বায়ু দ্বারা মেঘমালা সঞ্চালিত করেন। তারপর তিনি তা নির্জীব ভূ-খন্ডের দিকে পরিচালিত করেন এবং মৃত যমীনকে জীবন্ত করে তোলেন। (সূরা ফাতির-৯)

        পৃথিবীর যেখানে বৃষ্টি প্রয়োজন আল্লাহ তা'য়ালা বায়ুকে আদেশ করেন সেখানে মেঘমালা সঞ্চালিত করার জন্য। মুহূর্তের মধ্যে বায়ু সে আদেশ পালন করে। কি পরিমাণ বৃষ্টি বর্ষিত হবে এবং বৃষ্টির ফোটার আকার কি হবে সেটাও আল্লাহ তা'য়ালা নির্ধারণ করে দেন। এভাবে বৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহ পৃথিবীকে সিক্ত করেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা আরাফের ৫৭ নং আয়াতে বলেন- 

وَهُوَ الَّذِي يُرْسِلُ الرِّيحَ بُشْرًا بَيْنَ يَدَى رَحْمَتِهِ حَتَّى إِذَا أَقَلَّتْ سَحَابًا ثِقَالًاً سُقْنَاهُ لِبَلَدٍ مَّيْت فَأَنْزَلْنَا بِهِ الْمَاءَ فَأَخْرَجْنَا بِهِ مِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ 

        তিনি নিজের অনুগ্রহের (বৃষ্টি বর্ষণের) প্রথমে বাতাসকে সুসংবাদবাহী হিসেবে প্রেরণ করেন। তারপর যখন সে বাতাস পানি ভারাক্রান্ত মেঘমালা উত্থিত করে, তখন সে বাতাসকে কোন মৃত (শুষ্ক) যমীনের দিকে প্রেরণ করেন, পরে তা থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। তারপর যমীন থেকে নানা ধরনের ফলমূল উৎপদন করেন।

সুরক্ষিত মহাকাশ

         আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আকাশে তথা উর্ধ্বজগতে কত সহস্র ধরনের বিশালাকারের অকল্পনীয় জগৎ সৃষ্টি করেছেন, সে সম্পর্কে সামান্য ধারণা ওপরে পেশ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে এই আকাশ মন্ডল কিসের ওপর নির্ভর করে ওপরে অবস্থান করছে? এই প্রশ্নের জবাব কোন মানুষ বিজ্ঞানীদের পক্ষে দেয়া সম্ভব হয়নি। কোন বিষয়ে মানুষ জ্ঞানার্জন করলে বা জ্ঞান থাকলে তাকে সে বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করলে জবাব পাওয়া যেতে পারে। আসলে বর্তমান বিজ্ঞানীগণ আকাশের কোন সন্ধানই লাভ করতে সমর্থ হয়নি। সর্বাধুনিক দূরবিক্ষণ যন্ত্র দ্বারা তাদের চোখে যা ধরা পড়েছে, সে সম্পর্কে তারা পৃথিবীবাসীর কাছে ধারণা পেশ করেছেন। আকাশের কোন ঠিকান তারা খুঁজে পাননি। মহাশূন্যের অসংখ্য জগৎ সম্পর্কে তারা বলেছেন, সেখানে এমন ধরনের অদৃশ্য শক্তি বিরাজ করছে যে, তারা প্রতিটি গ্রহ-উপগ্রহকে এক আকর্ষণী শক্তির মাধ্যমে যার যার কক্ষপথে পরিভ্রমণ করতে বাধ্য করছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-


اللَّهُ الَّذِي رَفَعَ السَّمَوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا

        তিনিই আল্লাহ, যিনি আকাশমন্ডলকে দৃশ্যমান নির্ভর ব্যতিরেকেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। 
(সূরা রা'দ-২)

        কোন পিলার নেই, কোন স্তম্ভ নেই-মানুষের দৃষ্টিতে কোনকিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না, অথচ আকাশ ঠিকই যথাস্থানে অবস্থান করছে। অদৃশ্যমান কোন নির্ভরের ওপরে আকাশ স্থির রয়েছে। এই আকাশ জগতে আল্লাহ তা'য়ালা যে অসংখ্য জগৎ সৃষ্টি করেছেন, যার বিশলতা সম্পর্কে কল্পনাও করা যায় না, সেসব জগৎ একটির সাথে আরেকটি সংঘর্ষ বাধিয়ে ধ্বংসলীলা সংঘটিত করছে না। উর্ধ্বজগতের এমন সব অংশ যার ভেতরকার প্রতিটি অংশকে অত্যন্ত শক্তিশালী সীমান্ত অন্যান্য অংশ থেকে পৃথক করে রেখেছে। যদিও এ সীমান্ত রেখা মহাশূন্যে অদৃশ্যভাবে অঙ্কিত রয়েছে তবুও সেগুলো অতিক্রম করে কোন জিনিসের এক অংশ থেকে অন্য অংশে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন। রাব্বুল আলামীন বলেন-

وَلَقَدْ جَعَلْنَا فِي السَّمَاءِ بُرُوجًا وَزَيَّتُهَا لِلنَّظِرِينَ

        আকাশে আমি অনেক শক্তিশালী দূর্গ নির্মাণ করেছি, দর্শকদের জন্য সেগুলে, সুসজ্জিত করেছি। 
(সূরা হিজর-১৬)

        উল্লেখিত আয়াতে 'বুরুজ' শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এই বুরুজ শব্দের অর্থ করা হয়েছে, দূর্গ, শক্তিশালী ইমারত বা প্রাসাদ। মহান আল্লাহই ভালো জানেন তিনি ঊর্ধ্বজগতে কি ধরনের বুরুজ নামক জগৎ সৃষ্টি করেছেন। তবে আধুনিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, উর্ধ্বজগৎ থেকে যে ক্ষতিকর রশ্মি পৃথিবীর দিকে ছুটে আসে, তা যেসব স্তরে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ছেঁকে প্রয়োজনীয় রশ্মি পৃথিবীতে প্রেরণ করে, সেসব স্তরই বুরুজ হতে পারে। আবার উর্ধ্বজগতে শয়তানের প্রবেশ পথে যেসব বাধা নির্মাণ করা হয়েছে, তাও বুরুজ হতে পারে। সুতরাং আকাশ জগতসমূহে কোথাও কোন দুর্বলতা নেই। সবকিছু নির্মিত হয়েছে অত্যন্ত শক্তিশালী ভিত্তির ওপরে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

أَفَلَمْ يَنْظُرُوا إِلَى السَّمَاءِ فَوْقَهُمْ كَيْفَ بَنَيْنَهَا وَزَيَّنَهَا وَمَا لَهَا مِنْ فُرُوجٍ

        এরা কি কখনো নিজেদের ওপরে অবস্থিত আকাশমন্ডলের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখে না? কিভাবে আমি তা নির্মাণ করেছি এবং সুসজ্জিত করেছি আর তাতে কোথাও কোন ধরনের ফাঁক ও ফাটল নেই।
(সূরা ক্বাফ-৬)

        আকাশ জগতের এই বিস্ময়-উদ্দীপক বিশালতা সত্ত্বেও এই বিরাট বিস্তীর্ণ মহাবিশ্ব ব্যবস্থা একটি ধারাবাহিক ও সুদৃঢ় ব্যবস্থা এবং এর বন্ধন, গ্রন্থনা এতই দৃঢ়-দুচ্ছেদ্য যে, তার কোথাও কোন ধরনের ফাটল বা অসামঞ্জস্য দেখতে পাওয়া যায় না। এর ধারাবাহিকতা কোথাও গিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

تَبْرَكَ الَّذِي جَعَلَ فِي السَّمَاءِ بُرُوجًا وَجَعَلَ فِيهَا سرَاجًا وَقَمَرًا مُنِيرًا

        অসীম বরকত সম্পন্ন তিনি-যিনি আকাশে বুরুজ নির্মাণ করেছেন এবং তার মধ্যে একটি প্রদীপ ও একটি আলোকময় চাঁদ উজ্জ্বল করেছেন। তিনিই রাত ও দিনকে পরস্পরের স্থলাভিষিক্ত করেছেন। 
(সূরা আল ফুরকান-৬১-৬২)

        যে আল্লাহর প্রশংসা করতে বলা হয়েছে, তিনি অসীম বরকত সম্পন্ন। তিনি আকাশকে পৃথিবীর ছাদ হিসাবে নির্মাণ করে তা অন্ধকারাচ্ছন্ন করেননি। সূর্যকে সেখানে প্রদীপ হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তা'য়ালা এই সূর্যরশ্মির ভেতরে এমন উপাদান রেখেছেন, যা পৃথিবীর প্রাণীসমূহের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সূর্যের তাপ ব্যতিত পৃথিবীতে কোন কিছুই টিকে থাকতে পারে না, নতুন কিছু সৃষ্টিও হতে পারে না। আকাশ মন্ডলে তিনি অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টি করে তার ভেতরে আলো দান করেছেন। মাথার ওপরে তারাজ্বলা অপূর্ব সৌন্দর্য মন্ডিত আকাশ দেখে মানুষ আমোদিত হবে, মায়াবী চাঁদের জ্যোসনায় অবগাহন করে হৃদয়-মন জুড়াবে। ক্লান্তি দূরিকরণে রাতকে তিনি দিয়েছেন বিশ্রামের জন্য, দিনকে দিয়েছেন জীবন ধারনের উপকরণ সন্ধানের জন্য। এসব দান করে মানব জাতিকে যিনি ধন্য করেছেন-তিনিই হলেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন।

Post a Comment

0 Comments