মু'মিনের বৈশিষ্ট্য

        নামাযের আলোচনা আমরা পবিত্র কোরআনের সূরা লুকমানের সেই আয়াত দিয়ে শুরু করছি, যে আয়াতে বলা হয়েছে-

تلك ايت الكتبِ الْحَكِيمِ هُدًى وَرَحْمَةً للْمُحْسِنِينَ الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلوةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكوة وَهُمْ بِالآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ أُولئِكَ عَلَى هُدًى مَنْ رَّبِّهِمْ وأُولئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

        এগুলো হচ্ছে একটি জ্ঞানগর্ত কিতাবের আয়াত। পথনির্দেশনা ও 'অনুগ্রহ সৎকর্মশীলদের জন্য। যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত আদায় করে এবং শেষ বিচার দিনের প্রতি নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে। এরাই তাদের রব-এর পক্ষ থেকে সঠিক পথে রয়েছে এবং এরাই হবে সফলকাম। (সূরা লুকমান-২-৫)

        জ্ঞানগর্ভ কিতাব- অর্থাৎ মহাগ্রন্থ আল কোরআন হলো মুহসিনীন বা সৎলোকদের জন্য পথনির্দেশনা ও রহমত। মুহসিনীনদের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উল্লেখিত আয়াতে বলেন, 'যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত আদায় করে এবং শেষ বিচার দিনের প্রতি নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে।' অর্থাৎ মুহসিনীন বা 'সৎকর্মশীল লোকদের প্রধান তিনটি গুণই হলো, তারা নামায আদায় করে, সম্পদশালী হলে যাকাত আদায় করে এবং মৃত্যুর পরের জীবন তথা বিচার দিবসের প্রতি দৃঢ় ও নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে। এই তিনটি গুণই যে মুহসিনীন বা সৎকর্মশীলদের লোকদের একমাত্র গুণ- এ কথা কিন্তু আলোচ্য আয়াতে বলা হয়নি।

        আলোচ্য সূরার তৃতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, এই কিতাব মুহসিনীন বা সৎকর্মশীল লোকদের জন্য হিদায়াত ও রহমত। এ কথা বলে মুহসিনীন বা সৎকর্মশীল লোকদের পরিচয় স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, তারা জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে রাবতীয় কাজে একমাত্র এই কিতাব থেকেই পথনির্দেশনা গ্রহণ করে। অর্থাৎ এই কিভাবের প্রতিটি আদেশ-নিষেধ তারা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসরণ করে। এই কিতাবের আদেশ-নিষেধ অনুসরণ করার যোগ্যতা অর্জনের জন্য যে তিনটি গুণ একান্ত প্রয়োজন, সেই তিনটি গুণের কথাই আল্লাহ তা'য়ালা আলোচ্য সূরার চতুর্থ আয়াতে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা নামায আদায় করে, যাকাত দান করে এবং আখিরাতের প্রতি নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে।

        কারণ মুহসিনীন বা সৎকর্মশীল হতে হলে মালব চরিত্রে এই তিনটি গুণের প্রয়োজনীয়তা এত অধিক যে, এই তিনটি গুণ যারা অর্জন করতে সক্ষম হয়, অপরাপর সৎ গুণাবলীর সমাহার তার চরিত্রে এয়ন্সিতেই ঘটে। এই তিনটি গুণ অর্জন করতে সক্ষম হলে, কোরআন-হাদীসে বর্ণিত অপরাপর সৎ গুণ ক্রমশ ব্যক্তির চরিত্রে প্রকাশ পেতে থাকে।

        অর্থাৎ নামায, যাকাত ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস- এই তিনটি গুণ অন্য সকল সৎ গুণের আমদানি কারক বা স্রষ্টা। প্রথমত আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কর্তৃক নির্দেশিত পন্থায় যারা নামায আদায় করে, তাদের মধ্যে কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশ পালন করার এক স্থায়ী:অভ্যাস সৃষ্টি হয় এবং তাদের হৃদয়ে সময়ের প্রত্যেক মুহূর্তে আল্লাহর ভয় জাগরুক থাকে। ফলে-সেই ব্যক্তির পক্ষে অন্যায়, কাজ থেকে বিরত থাকা খুবই সহজ বিষয়ে পরিণত হয়। অন্যায় সারী

        দ্বিতীয় ইসলাম নির্দেশিত পন্থায় যারা যাকাত আয়েয় করে, তাদের মধ্যে আত্মত্যাগের প্রবণতা ক্রমশ দৃঢ় ও শক্তিশালী হতে থাকে। দুনিয়ার ধন-সম্পদের প্রতি তাদের হৃদয় থেকে লোভ-লালসা বিদূরিত হতে থাকে এবং মন-মানসিকতা ক্রমশ আল্লাহ তা'য়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের পথের দিকে ধাবিত হতে থাকে। কৃপণতার মতো খারাপ গুণ, চরিত্র থেকে বিদায় নেয়।শ

        ফলে এসব লোক পার্থিব ধন-সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অন্যায়-অবৈয় পথে সম্পদের পাহাড় গড়ার নেশায় মেতে ওঠে না। আর এ কথা স্বতঃসিদ্ধ-বে, ক্ষ্যার অবৈধ পথে ধন-সম্পদ অর্জন করতে যাওয়ার অর্থই হলো নানা ধরনের দুষ্কৃতির মধ্যে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেল্ম এবং সমাজ কাঠামোয় দুর্নীতি মামক স্কুন সৃষ্টি করা।

        তৃতীয় যে গুণের কথাটি বলা হয়েছে, তাহল্যে তারা আখিরাতের প্রভি নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে। যারা এ কথা বিশ্বাস করে যে, এই পৃথিবীর জীবনই একমাত্র জীবন নয়- মুত্যুর পরেও আরেকটি অনস্ত জীবন রয়েছে এবং সেই জীবনে এই পৃথিবীতে করে যাওয়া যাবতীয় কর্মের হিসাব মহান স্ক্রাল্লাহ তা'য়ালার আদালতে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পেশ করতে হবে। হিসাবের পরে সৎ ও অসৎ কর্মানুযায়ী পুরষ্কার ও শাস্তি প্রদান করা হবে।

        দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহির অনুভূতি সৃষ্টি হয়। পৃথিবীতে তারী স্বৈচ্ছাচারী হয় না, 'মন যা চায়- তাই তারা করতে পারে না। এদের জীবন হয় পরিমার্জিত, সংযত ও নিয়ন্ত্রিত এবং প্রত্যেকটি কথা ও কাজের মধ্যে সততা-ন্যায় পরায়ণতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে বক্ষমান গ্রন্থে আমরা প্রথম গুণটি সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ্।

প্রধান বৈশিষ্ট্য

        মহান আল্লাহ তা'য়ালা মুহসিনীন তথা সৎ লোকদের প্রধান যে তিনটি গুণের কথা উল্লেখ করেছেন, এই তিনটি গুণ এমনই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যে- উল্লেখিত তিনটি গুণ যে ব্যক্তি অর্জন করতে সক্ষম হবে, স্বাভাবিকভাবেই সেই ব্যক্তির চরিত্রে অন্যান্য সকল ভালো গুণসমূহ ক্রমশ বিকশিত হতে থাকবে। তিনটি গুণের মধ্যে সর্বপ্রথম নামাযের কথা বলা হয়েছে। কারণ একমাত্র এই নামাযই মানুষকে ক্রমশ আল্লাহ তা'য়ালার একনিষ্ঠ গোলামে পরিণত করে এবং ব্যক্তির চরিত্রে অসংখ্য সৎ গুণসমূহ বিকশিত করে। মানুষের চরিত্র থেকে যাবতীয় খারাপ গুণ বিদূরিত করে এবং গর্হিত কাজ ও মানুষের মধ্যে ক্রমশ যোজন যোজন ব্যবধান সৃষ্টি করে।

        তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে যে, নামায জিনিসটা কি এবং মহাগ্রন্থ আল কোরআনে ও রাসূলের হাদীসে সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে নামায আদায়ের ব্যাপারে কেনো এত তাগিদ করা হয়েছে? এ জন্য নামায সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রত্যেক মুসলমানেরই একান্ত আবশ্যক। হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে-

        হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, 'আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-ভোমরা ভেবে দেখো, তোমাদের 'কারোর দরজার সামনে দিয়ে একটি নদী থাকে এবং সে তাতে প্রতিদিন পাঁচবার গোসল করে, তাহলে তার শরীরে কোনো ময়লা থাকবে কি? সাহাবায়ে কেরাম জবাব দিলেন, না- তার শরীরে কেনো ময়লা থাকবে না। আল্লাহর রাসুল বললেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের এটিই হচ্ছে দৃষ্টান্ত। এ নামাযগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তা'য়ালা গোনাহসমূহ মুছে ফেলে দেন। (বোখারী, মুসলিম)

        অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির বাড়ির সামনে যদি নদী থাকে এবং সেই ব্যক্তি যদি উক্ত নদীতে প্রতিদিন পাঁচবার গোসল করে, তাহলে সেই ব্যক্তির শরীরে কোনো ময়লা জমার অবকাশ থাকে না। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রদর্শিত পন্থানুসারে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সেই ব্যক্তি পাপের ময়লা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়- আর পাপের ময়লা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার অর্থই হলো সেই ব্যক্তি যাবতীয় গর্হিত কর্মকান্ড থেকে নিজেকে দূরে রাখে। একজন মানুষ যখন নিজেকে অসৎ গুণাবলী থেকে নিজেকে দূরে রাখে, তখন তার মধ্যে অনিবার্যরূপে সৎ গুণাবলী বিকশিত হতে থাকে।

        এই বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে একান্তভাবেই একটি প্রশ্নের সৃষ্টি হয়, সে কোন নামায- যে নামায আদায় করলে পাপের ময়লা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা যায় এবং স্বভাব-চরিত্রে অনিবার্যরূপে সৎ গুণাবলী বিকশিত হতে থাকে? সেই নামায সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করতে হলে সর্বপ্রথমে প্রয়োজন 'ইবাদাত' শব্দটির মমার্থ অনুধাবন করা। যেহেতু মহান আল্লাহ তা'য়ালা মানুষ ও জ্বিন সম্প্রদায়কে সৃষ্টিই করেছেন একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করার উদ্দেশ্যে। এ জন্য 'ইবাদাত' বলতে কি বুঝায়, কোন্ বস্তুর নাম 'ইবাদাত', আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর বান্দার কাছ থেকে কোন্ 'ইবাদাত' চান এবং মানুষকে কোন্ 'ইবাদাত' শিক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে তিনি অগণিত নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন- এ বিষয়টি আমাদেরকে স্পষ্টভাবে বুঝে নিতে হবে। 

        এ কথা দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ইবাদাতের সঠিক ও তাত্ত্বিক অর্থ বর্তমানে মুসলিম জনগোষ্ঠী ভুলে গিয়েছে। মুসলমানরা নামায-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও কোরআন তিলাওয়াতসহ অন্যান্য সামান্য কিছু কাজের নাম দিয়েছে ইবাদাত এবং এ কথা বুঝে নিয়েছে যে, এসব কাজ করার অর্থই হলো ইবাদাত করা এবং এসব কাজ আঞ্জাম দিয়ে অন্তরে প্রশান্তি অনুভব করা যে, ইবাদাতের হক আদায় হয়ে গিয়েছে। এই বিরাট ভুলের মধ্যে মুসলিম মিল্লাতের সাধারণ মানুষ যেমন নিপতিত হয়েছে, অনুরূপভাবে নিমজ্জিত হয়েছে মুসলিম মিল্লাতের অধিকাংশ চিন্তানায়কগণ। জীবনের অত্যন্ত ক্ষুদ্রতম অংশ 'ইবাদাত' নামক এই কাজের জন্য বরাদ্দ করে জীবনের অবশিষ্ট বিরাট অংশ তারা মহান আল্লাহর ইবাদাত থেকে নিজেদেরকে স্বাধীন বানিয়ে নিয়েছে। এর একমাত্র কারণ হলো, তারা 'ইবাদাত' শব্দের সঠিক মর্ম অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে।

        এ কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ তা'য়ালা একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করার উদ্দেশ্যে মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং কোরআনেও এ কথাটি একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, মানুষ একমাত্র আল্লাহরই ইবাদাত করবে এবং এই ইবাদাতের সাথে অন্য কাউকে শরীক করবে না। কারণ যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা'য়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, সেই উদ্দেশ্য সম্পর্কে বান্দার যদি স্পষ্ট ধারণা না থাকে তাহলে তার মানব জীবনই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য।

        একজন ছাত্র যদি লেখাপড়ায় কৃতকার্য হতে না পারে, তাহলে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে ছাত্র তার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। বুণন শিল্পী যদি যথাযথভাবে বুণন কাজে তার দক্ষতা প্রমাণ করতে না পারে, তাহলে সে এ কথাই প্রমাণ করবে যে- বুণন শিল্পী হিসাবে সে ব্যর্থ হয়েছে। অনুরূপভাবে একজন মানুষ যদি তাকে সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে না জানে, তাহলে এ কথাই প্রমাণ হবে যে, মানুষ হিসাবে তার গোটা জীবনই সে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করেছে। মানুষ হিসাবে এই বিষয়টি সময়ের প্রত্যেক মুহূর্তে চেতনার জগতে জগরুক রাখতে হবে যে, একমাত্র মহান আল্লাহর ইবাদাত করার উদ্দেশ্যেই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এই উদ্দেশ্য সাধনের মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানব জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতা।

        আরবী ভাষার عبد 'আব্দ' শব্দ থেকে 'ইবাদাত' শব্দটি এসেছে এবং 'আবদ' শব্দের অর্থ হলো চাকর, ভৃত্য, দাস বা গোলাম। ইংরেজী ভাষায় যাকে বলা হয় Servant। সুতরাং ইবাদাত শব্দের অর্থ হলো, গোলামী করা বা দাসত্ব করা। ইংরেজী ভাষায় দাসত্ব বলতে Slavery বুঝায় এবং ইবাদাত শব্দের অর্থ এভাবে করা যেতে পারে Work or serve as a slave। কোনো দাস বা ভৃত্য যদি যথার্থভাবেই তার মনিবের আজ্ঞানুবর্তী হয় বা মনিবের আদেশানুসারে যাবতীয় কাজের আঞ্জাম দেয় তাহলে বলা যেতে পারে যে, লোকটি তার মনিবের দাসত্ব করছে। আর ইসলামী পরিভাষায় একেই বলা হবে লোকটি তার মনিবের ইবাদাত করছে।

        আর মনিবের দেয়া যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেও যে চাকর যথারীতি তার কর্তব্য কর্ম সম্পাদন করে না, মনিবের আদেশের বিপরীত কাজ করে তাহলে এ ধরনের চাকরকে বলা হবে অকৃতজ্ঞ। অর্থাৎ চাকরটি সুস্পষ্টভারে মনিবের নাফরমানীমুলক কাজ করে যাচ্ছে। চাকরের কাজ হয় সাধারণত তিনটি। চাকরের প্রথম কাজ হলো, সে যার চাকর প্রথমে তাকে মনিব হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।.. কারণ মনিব তার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানসহ যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করছেন। এ কারণে চাকর একমাত্র মনিবের আদেশ ব্যতীত অন্য কারো আদেশ মানবে না এবং মনিবের আনুগত্য ব্যতীত অন্য কারো আনুগত্য করবে না। মনিবের দেয়া যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার কারণে চাকর মনিবের দেয়া দায়িত্বের প্রতি সামান্যতম অবহেলা প্রদর্শন করবে না এবং মনিবের অপছন্দনীয় কোনো কাজে সে নিজেকে জড়িত করবে না।

        মনিব চাকরের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করছেন, এ জন্য চাকরের এটা অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় যে, সে মনিবের প্রতি যথাযথভাবে সম্মান প্রদর্শন করবে। মনিবকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য তার সাধ্যানুসারে চেষ্টা করবে, মনিবের সম্মান-মর্যাদার বিপরীত কোনো কাজ করবে না বা এ ধরনের কোনো চিন্তাও মনে স্থান দেবে না। এই তিনটি কাজ যথাযথভাবে যে চাকর আঞ্জাম দেয়, তাকেই সঠিক অর্থে চাকর বলা যেতে পারে 1 এভাবে যে চাকর কাজ করে, সেই চাকর সম্পর্কেই বলা যায় যে, চাকরটি মনিবের ইবাদাত করছে।

        মহান আল্লাহ তা'য়ালা মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং এই পৃথিবীতে যথাযথভাবে টিকে থাকার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তার যাবতীয় ব্যবস্থা তিনি অনুগ্রহ করে করেছেন। সুতরাং আল্লাহ তা'য়ালা হলেন মনিব আর মানুষ হলো তাঁর গোলাম বা চাকর। পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল আগমন করেছেন, তাঁরা এই কথাটিই আনুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন- তোমাদের মনিব হলেন একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এবং তোমাদের দায়িত্ব হলো, তোমরা কেবলমাত্র সেই আল্লাহরই দাসত্ব বা ইবাদাত করবে- অন্য কারো নয়। তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যে পৃথিবীতে তোমাদেরকে পাঠিয়েছেন- সেই পৃথিরীকে তোমাদের জন্য তিনিই বাসোপযোগী করেছেন, এখানে সুষ্ঠুভাবে জীবন ধারনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তা একমাত্র তিনিই পূরণ করেছেন। আর এই কাজে তাঁর সাথে অন্য কেউ শরীক নেই নেই।

        সুতরাং তোমরা একমাত্র তাঁকেই মনির হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁরই আনুগত্য করবে, তাঁরই আইন অনুসরণ করবে, তাঁরই দেয়া জীবন বিধান অনুসারে পৃথিবীতে নিজের জীবন পরিচালনা করবে এবং তাঁর অসন্তুষ্টিমূলক কোনো কাজে নিজেদেরকে জড়িত। করবে না। সংক্ষেপে এটাই হলো ইবাদাত শব্দের মূল অর্থ: চাকর মনিবের দেয়া, যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে মনিবের আদেশানুসারে যদি নিজেকে পরিচালিত করে, তাহলে বলা যেতে পারে যে চাকরটি মনিবের ইবাদাত করছে। আর চাকর যদি মনিবের দেয়া যাৱতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে মনিবের আদেশ অনুসরণ না করে, তাহলে বলা যেতে পারে যে- চাকরটি মনিবের নাফরমানী করছে, বা মনিবের আদেশ অমান্য করছে। চাকর যদি মনিবের দেয়া বাসস্থানে অবস্থান করছে, মনিবের দেয়া যাবতীয় উপকরণে জীবন ধারণ করছে।

        মনিব সেই চাকরকে তার চব্বিশ ঘন্টার কর্মসূচী দিয়ে দিলো। কখন সে কোন্ কোন্ কাজ আঞ্জাম দেবে, কখন সে আহার করবে, কখন বিশ্রাম করবে, নিদ্রা যাবে, মনকে প্রফুল্ল রাখার জন্য চিত্ত বিনোদন করবে- অর্থাৎ একজন মানুষের জন্য সুষ্ঠু ও স্বাস্থ্যসতে জীবন ধারণের উপযোগী কর্মসূচী মনিব প্রদান করলেন। কর্মসূচী অনুসারে চারুর মনিবের দো আদেশসমূহ পালন করতে থাকবে- এটাই হলো চাকরের দায়িত্ব।

        কর্মসূচী অনুসারে মনিষের সন্তানকে স্কুলে দিয়ে আসা ও নিয়ে আসার সময় হলো। বাগানের গাছগুলোয় পানি সিঞ্চনের সময় হলো। বাগানের আগাছাসমূহ পরিষ্কার করার সময় হলো। পণ্ডদল এসে সাজানো বাগান তছনছ করতে থাকলো, চাকর পণ্ডদলকে ভাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করলো না। সে কোনো দায়িত্ব পালন না করে মনিবের দেয়া খরে অবস্থান করে মনিব যে লিখিত কর্মসূচী দিয়েছেন, তা মধুর স্বরে বার বার আবৃত্তি করতে থাকলো আর মনিবের প্রশংসা করতে থাকলো।

        এই ধরনের চাকর সম্পর্কে তো এ কথাই বলা হবে যে, চাকরটি মনিবের ইবাদাত করছে না- বরং সে মনিবের দেয়া যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে প্রত্যেক পদে মনিবের আদেশ অমান্য করছে। মনিবের বাগানের সবুজ-শ্যামল সজিব গাছগুলো পানির অভাবে শুকিয়ে ক্রমশ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, প্রখর রৌদ্রতাপে গাছগুলো সজিবতা হারিয়ে বিবর্ণ হয়ে পড়ছে, পণ্ডদল বাগানে প্রবেশ করে সাজানো বাগান তছনছ করে দিচ্ছে। আর চাকর সে দিকে দৃষ্টি না দিয়ে মনিবের দেয়া কর্মসূচী মধুর স্বরে পড়ছে এবং মনিবের প্রশংসা করছে। সুতরাং এই চাকর মনিবের ইবাদাত না করে মনিবের নাফরমানী করে যাচ্ছে। এই ধরনের চাকর সম্পর্কে লোকজন মনির লোকটিকে তো এই পরামর্শই দেবে, 'ঐ অকৃতজ্ঞ চাকরকে ঝেটিয়ে বিদায় করে দিয়ে একজন আনুগত্য পরায়ণ চাকর বহাল করুন।'

        মানুষের ক্ষেত্রে যদি এই কথা প্রয়োজ্য হয়, তাহলে মহান আল্লাহ তা'য়ালার ঐসব চাকর সম্পর্কে কি বলা যাবে? যে চাকরকে পৃথিবীতে জীবন পরিচালনার জন্য আল্লাহ তা'য়ালা কোরআন নামক কর্মসূচী দিয়েছেন, কিন্তু সেই চাকর কোরআনের কোনো আদেশ বাস্তবায়ন করার চেষ্টা না করে কেবলমাত্র কোরআন তিলাওয়াত করছে, আল্লাহ তা'য়ালার উদ্দেশ্যে একের পর এক সিজদা দিয়েই যাচ্ছে, বার বার আল্লাহ তা'য়ালার প্রশংসা করছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই পৃথিবী নামক বাগানকে সুন্দর সজিব রাখার লক্ষ্যে তাঁর চাকরকে কোরজানের কর্মসূচী যাস্তবায়ন করার আদেশ দিলেন, কিন্তু চাকর সে আদেশ পালন না করে কর্মসূচী তিলাওয়াত করতে থাকলো।

        ফলে পৃথিবী নামক এই বাগানে শয়তান নানা ধরনের আগাছা সৃষ্টি করতে লাগলো, গোটা বাগানকে তছনছ করার লক্ষ্যে তৎপরতা চালাতে থাকলো। পোটা পৃথিবীব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করে পৃথিবীময় অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বালিয়ে দিলো। আল্লাহর সেই চাকর এসব দিক থেকে চোখ বন্ধ করে রেখে- অশান্তি, অনাচার, অত্যাচার-জুলুম, নির্যাতন-নিষ্পেষন বিদূরিত করে পৃথিবীতে শাস্তি স্থাপনের লক্ষ্যে আল্লাহ তা'য়ালা যে কর্মসূচী দিয়েছেন, তা তিলাওয়াত করতে থাকলো।

        এই ধরনের চাকর সম্পর্কে কি এ কথা বলা যাবে যে, সে আল্লাহর ইবাদাত করছে? অবশ্যই সে আল্লাহর ইবাদাত করছে না- বরং সে প্রত্যেক পদে আল্লাহর নাফরমানী করে যাচ্ছে। অথচ দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে, ইবাদাত শব্দের সঠিক অর্থ জানা না থাকার কারণে অধিকাংশ মানুষ আল্লাহর ঐসব নাফরমান চাকরদের সম্পর্কে পরম শ্রদ্ধার সাথে মন্তব্য করে থাকে, 'লোকটি আল্লাহর ইবাদাত গুজার বান্দাহ্- লোকটি অত্যন্ত পরহেজগার মানুষ।' একটি অফিসে একজন লোক চাকরী করে। সে যার চাকরী করে সেই মনিব তার চাকরকে ডিউটি চলাকালে পরিধানের জন্য বিশেষ পোষাক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। মনিব যখন অফিসে আসবেন, চাকর মনিবকে সালাম জানাবে- এ আদেশও তিনি দিয়েছেন। সেই সাথে অফিসের যাবতীয় আসবাব পত্র রক্ষাণাবেক্ষণসহ অফিসের নিরাপত্তার দায়িত্বও তার প্রতি অর্পণ করেছেন। কোনো দুর্বৃত্তের দল অফিসে প্রকাশ্যে বা চুপিসারে প্রবেশ করে অফিসের যেন ক্ষতিসাধন করতে না পারে, সেটা প্রতিরোধ করার জন্য মনিব সেই চাকরকে অস্ত্রও প্রদান করেছেন। চাকরের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করে অফিসকে কর্মচঞ্চল ও অফিসে সার্বিক শান্তি বজায় রাখার প্রয়োজনীয় উপকরণ দিয়ে সজ্জিত করে চাকরের প্রতি দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।

        এখন এই চাকর যদি শুধুমাত্র বিশেষ পোষাক পরিধান করে অফিসে হাজিরা দেয় এবং মনিবকে সালাম জানায়, অথচ তার ওপরে অর্পিত কোনো দায়িত্ব সে পালন না করে- দুর্বৃত্তদল কর্তৃক অফিস আক্রান্ত হচ্ছে, কিন্তু চাকর মনিবের দেয়া অস্ত্র ব্যবহার না করে দুর্বৃত্তদলকে নির্বিঘ্নে অফিস লুট করার কাজে সহযোগিতা করে। তাহলে এই চাকরকে কি মনিবের অনুগত চাকর বলা যাবে? সাধারণ জ্ঞান-বিবেক, বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষও এই ধরনের চাকরকে নানা ধরনের খারাপ বিশেষণে বিশেষিত করবে।

        কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, আল্লাহর কোনো চাকর যখন এই ধরনের আচরণ স্বয়ং আল্লাহর সাথে করছে- আমাদের সমাজের জ্ঞানী-গুণী, বুদ্ধিজীবী-পন্ডিত, শিক্ষিত-অশিক্ষিত তথা সর্বশ্রেণীর লোকদের কাছে আল্লাহর সেই চাকর অত্যন্ত পরহেজগার, ইবাদাত গুজার, আল্লাহভীরু, ধর্মভীরু, সৎলোক ও ন্যায়-পরায়ণ ইত্যাদি উত্তম বিশেষণে বিশেষিত হচ্ছে। এর একমাত্র কারণ হলো, ইবাদাত বলতে কি বুঝায়- তা আমরা অনুধাবন করিনি এবং সঠিক ইবাদাতের সাথে আমাদের পরিচয় নেই।

        মহান আল্লাহ তা'য়ালা পৃথিবী নামক এই অফিসে শান্তি, শৃংখলা, স্বস্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার দায়িত্ব অর্পণ করেছেন মুসলমানদের প্রতি। এই পৃথিবীতে খোদ শয়তান এবং মানুষের মধ্যে যারা তার মুরীদ রয়েছে, তারা যেনো তাদের বানানো মতবাদ-মতাদর্শ, আদর্শ, নিয়ম-নীতি, পদ্ধতি ইত্যাদি প্রকাশ্যে বা চুপিসারে চালু করে পৃথিবীর শান্তিময় পরিবেশকে বিষাক্ত করে না তোলে, সেদিকে মুসলমানদের সজাগ দৃষ্টি রাখার আদেশ দিয়েছেন। তাকে কোরআন নামক সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ার দিয়ে সজ্জিত করেছেন- যে হাতিয়ার দিয়ে মুসলমানরা শয়তানের যাবতীয় আক্রমণ প্রতিহত করবে।

        অথচ-মুসলমানরা সেদিকে দৃষ্টি দিচ্ছে না। বরং এদের মধ্যে কেউ কেউ কোরআন নামক সেই হাতিয়ারকে রুটি-রুজি অর্জনের মাধ্যম বানিয়েছে, কেউ কোরআনকে তাবিজের কিতাবে পরিণত করেছে। কেউ মাথায় টুপি-পাগড়ী ও গায়ে জুব্বা পরিধান করে ঐ দুর্বৃত্তদলকে সহযোগিতা করছে, যারা মন-মস্তিষ্ক প্রসূত চিন্তাধারা, মতবাদ-মতাদর্শ, নিয়ম-নীতি সমাজ ও দেশে চালু করে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। পক্ষান্তরে আল্লাহর দ্বীনের দুশমনদের সহায়তাকারী একশ্রেণীর টুপি, পাগড়ী, জুব্বা পরিধানকারী আলিম, পীর-মাশায়েখ উপাধিধারী লোকগুলো দ্বীনদার, ঈমানদার, পরহেজগার ইবাদাত গুজার নামে লোকদের কাছে আখ্যায়িত হচ্ছে। এর একমাত্র কারণ হলো, ইবাদাত সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞানের অভাব। এ কথা স্পষ্ট মনে রাখতে হবে, টুপি-পাগড়ী, জুব্বা পরিধান করা, পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা, রমজান মাসের রোজা পালন করা এবং সামর্থ থাকলে যাকাত আদায় করা ও মক্কায় গিয়ে হজ্জ পালন করে আসার নামই শুধু ইবাদাত নয়। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে যে ইবাদাতের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন, শুধুমাত্র উক্ত কাজগুলো সম্পাদন করার মাধ্যমে সেই উদ্দেশ্যে পূরণ হয় না। আল্লাহ তা'য়ালা যে ইবাদাত করার উদ্দেশ্যে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, সেই ইবাদাত হলো মানুষ তার জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের সকল দিক, বিভাগ ও স্তরে সময়ের প্রত্যেক মুহূর্তেই একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করে জীবন পরিচালিত করবে এবং কোরআন-হাদীসের বিপরীত যা কিছুর অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে রয়েছে, তা অনুসরণ করতে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করবে। মানুষের মনিব আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর গোলামদের জন্য যে সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সেই সীমার মধ্যেই গোলামদের যাবতীয় তৎপরতা ও গতিবিধি সীমাবদ্ধ থাকবে। এভাবে যে ব্যক্তি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমার মধ্যে সন্তুষ্ট চিত্তে অবস্থান করে জীবন পরিচালিত করবে, তার জীবনের সবটুকুই ইবাদাত হিসাবে গণ্য হবে।

        কোরআন-সুন্নাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত সীমার মধ্যে অবস্থান করে রাজনীতি করা, দেশ পরিচালনা করা, প্রতিবেশী দেশসমূহের সাথে আচরণ করা, কারো সাথে বন্ধুত্ব ও শত্রুতা করা, নিজের পারিবারিক জীবন পরিচালনা করা, সমরাঙ্গণে বীর-বিক্রমে যুদ্ধ করা, দাম্পত্য জীবনের হক আদায় করা, স্ত্রী, সন্তান-সন্ততির প্রতি মহব্বত পোষণ করা, আহারাদি করা, বিশ্রাম গ্রহণ করা বা নিদ্রা যাওয়া, মলমুত্র ত্যাগ করা, কোনো বিষয়ে আনন্দ প্রকাশ করা, কোনো কারণে দুঃখ প্রকাশ করা বা রোদন করা, কারো সাথে লেন-দেন করা, ব্যবসা-বাণিজ্য করা, চাকরী করা, কাউকে শিক্ষা দেয়া, ক্ষেতে হাল-চাষ করা, এক কথায় রান্না ঘর আর বাথরুমের কাজ থেকে শুরু করে দেশ পরিচালনার সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে দেশ পরিচালনা করার যাবতীয় কাজই ইবাদাতের মধ্যে গণ্য।

        অর্থাৎ যেসব কাজ সম্পর্কে সাধারণ মানুষ এই ধারণা অর্জন করেছে যে, এসব কাজ হলো, 'দুনিয়াদারীর কাজ' এসব কাজই ইবাদাতের মধ্যে শামিল হবে, যদি তা কোরআন-সুন্নাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমার মধ্যে অবস্থান করে সম্পাদন করা হয়। আর আল্লাহ তা'য়ালা মানুষকে সৃষ্টিই করেছেন এই উদ্দেশ্যে যে, তারা তাদের যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করবে একমাত্র তাঁরই দেয়া নির্ধারিত সীমার মধ্যে অবস্থান করে।

        মানুষ মাতৃগর্ভ থেকে পৃথিবীতে আগমন করার পরে যখন জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ধারণা অর্জন করে, তখন থেকে শুরু করে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত একমাত্র আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার নামই হলো ইবাদাত। শুধুমাত্র নামায-রোজা, হজ্জ-যাকাতের নামই ইবাদাত নয়। এই ইবাদাত করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট স্থান বরাদ্দ করা হয়নি, কোনো সময়ও নির্ধারণ করা হয়নি এবং এই ইবাদাতের কোনো বাহ্যিক রূপ নেই। পানির অতল তলদেশে, পাতাল গহ্বরে প্রবেশ করে অথবা মহাকাশের শূন্যে গর্ভে অবস্থান করেও এই ইবাদাত করা যায়। অর্থাৎ মানুষ যেখানেই অবস্থান করুক না কেনো, সর্বত্রই তাকে স্মরণে রাখতে হবে যে- মহান আল্লাহ তা'য়ালা তার মনিব আর সে হলো ঐ মনিবের গোলাম। আল্লাহর গোলামী থেকে সে এক মুহূর্তের জন্যেও নিজেকে মুক্ত-স্বাধীন ভাবতে পারে না। যখন সে নামায আদায় করছে, তখন যেমন সে আল্লাহর গোলাম, আর যখন সে দেশের সর্বময় ক্ষমতার আসনে আসন গ্রহণ করেছে, তখনও সে মহান আল্লাহর গোলাম।

        কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, নামায-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও কোরআন তিলাওয়াতই যদি শুধুমাত্র ইবাদাত না হয়, তাহলে এগুলো কোন্ নামে আখ্যায়িত করা যাবে? এর জবাব হচ্ছে, অবশ্যই এগুলো ইবাদাত এবং এসব ইবাদাত মুসলমানদের প্রতি বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়েছে এ জন্য যে- যে উদ্দেশ্যে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এসব ইবাদাতের মাধ্যমে মানুষকে পূর্ণরূপে প্রস্তুত করা।

        নামায এমন একটি ইবাদাত- যে ইবাদাত একজন মুসলমানকে প্রত্যেক দিন পাঁচ বার এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সে মহান আল্লাহর গোলাম এবং একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব করাই তাঁর দায়িত্ব।

        রোজা এমন একটি ইবাদাত যে, বছরের একটি পূর্ণ মাস সময়ের প্রত্যেক মুহূর্তে একজন মনে এ কথা জাগরুক রাখে- সে মহান আল্লাহর গোলাম। রমজান মাসে দিনের বেলায় হালাল কাজসমূহ থেকে রোজা একজন মুসলমানকে বিরত রেখে এ কথাই জানিয়ে দেয়, 'আল্লাহর আদেশে যেমন তুমি হালাল কাজ থেকে বিরত রয়েছো, তেমনি বছরের অবশিষ্ট মাসগুলোয় মহান আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকবে।' এভাবে রোজা একজন মুসলমানকে সেই ইবাদাতের দিকে অগ্রসর করিয়ে দেয়, যে ইবাদাত করার লক্ষ্যে আল্লাহ তা'য়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।

        যাকাত নামক ইবাদাত একজন মুসলমানকে এ কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সে যা উপার্জন করছে তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে দান করছেন। সুতরাং এই দান সে তার নিজের প্রবৃত্তির চাহিদা অনুযায়ী ব্যয় করতে পারে না। তার উপার্জনে মহান আল্লাহ তা'য়ালা অন্যের যে অধিকার নির্ধারণ করেছেন, সেই অধিকার তাকে আদায় করতে হবে। এভাবে যাকাতও তাকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সে স্বেচ্ছাচারী নয়- সে মহান আল্লাহর আদেশের অনুগত গোলাম। হজ্জ এমন একটি ইবাদাত যে, এই হজ্জ নামক মহাসম্মেলন একজন মুসলমানের মনে তার মনিব আল্লাহ তা'য়ালার প্রেম-ভালোবাসার প্রবাহিত ঝর্ণাধারা সৃষ্টি করে দেয়। একমাত্র আল্লাহ তা'য়ালাই যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও মহান, সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে তাঁর সম্মান ও মর্যাদা- এ কথা হজ্জ একজন মুসলমানের মধ্যে সৃষ্টি করে দেয়।

        কোরআন তিলাওয়াত নামক ইবাদাত তিলাওয়াতকারীর মনে এ কথাই সৃষ্টি করে দেয় যে, সে তার মালিকের পাঠানো বাণী তিলাওয়াত করছে, মালিক তার জীবন পরিচালনার জন্য যে পথনির্দেশনা অনুগ্রহ করে দিয়েছেন, সে তাই তিলাওয়াত করছে- তথা মালিকের সাথে কথা বলছে। এভাবে এসব ইবাদাত মানুষকে সেই লক্ষ্য পানে এগিয়ে দেয়, যে লক্ষ্যে আল্লাহ তা'য়ালা মানুষ সৃষ্টি করেছেন।

Post a Comment

0 Comments