নবী করীম (সা:) মহান আল্লাহ তা'য়ালার নির্দেশে পবিত্র মক্কার বুকে ইসলামী আন্দোলনের সূচনা করার প্রায় এক যুগ অতিবাহিত হবার পরে দিকে দিকে তাওহীদের স্রোত নীরবে প্রবাহিত হচ্ছিল। সামান্য সময়ের ব্যবধানেই সে স্রোত দু'কুল প্লাবিত বন্যার রূপ ধারণ করবে। ইসলাম বিরোধিরা তাওহীদের এই অদম্য স্রোতধারা বন্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালালেও তাওহীদের দুর্দমনীয় স্রোতধারার সম্মুখে তারা বাধার বিন্ধাচল দাঁড় করাতে পারেনি। নানা প্রচেষ্টায় এই স্রোতের কেন্দ্রবিন্দু নবী করীম (সা:) কে নিস্তব্ধ নিথর করার তৎপরতা চালিয়েছে।
কিন্তু তাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে তাওহীদের এই স্রোতধারা আরব ভূমির প্রত্যন্ত অঞ্চল প্লাবিত করেছে। এমন একটি গোত্রের অস্তিত্ব সে সময় ছিল না, যে গোত্রে দু'একজন মানুষ ইসলামী কাফেলার কর্মী ছিলেন না। আরবের আনাচে কানাচে সৃষ্টি হয়েছিল ইসলামী আন্দোলনের সক্রিয় সমর্থক। এ আন্দোলনের প্রভাবে প্রতিটি গোত্র ছিলো প্রভাবিত। এক যুগ পূর্বে নবী করীম (সা:) মাত্র একজন কর্মী হযরত খাদিজা (রা:) কে সাথে নিয়ে যে কার্যক্রমের পুনরাবৃত্তি করেছিলেন, আজ সে আন্দোলনের কর্মী প্রত্যেক ঘরে ঘরে।
খোদ মক্কাতেই অত্যন্ত নিষ্ঠাবান একদল মানুষ গড়ে উঠেছিল যারা এ মহান আন্দোলনের সাফল্যের জন্য যে কোনো বিপদের ঝুকি গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন। তাঁরা নিজের প্রাণ, কষ্টার্জিত ধন-সম্পদ অকাতরে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন। সুদূর মদীনায় শক্তিশালী বিরাট দু'টি' গোত্র এই মহান কার্যক্রমের সমর্থক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সে সময় এটা একান্ত প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, নবী করীম (সা:) কে মক্কা থেকে মদীনায় যেতে হবে এবং চারদিকে ছড়িয়ে থাকা বিক্ষিপ্ত মুসলিমকে একত্রিত করে একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করা। তিমিরাচ্ছন্ন রজনীর অবসান ছিল অত্যাসন্ন। পূর্ব গগণে তরুণ তপনের ইশারা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ঠিক এই সময়েই মহান আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাহকে তাঁর কাছে ডেকে নিলেন। এ সময়েই তাঁর ওপর অবতীর্ণ করা হলো সূরা বনী ইসরাঈল। মহান ইসলামী রাষ্ট্রের ১৪ টি মূলনীতি দান করা হলো। শিক্ষাদান পর্যায়ে নৈতিকতা ও সমাজতত্বের এমন বড় বড় কতকগুলো মৌলনীতি উপস্থাপিত করা হলো, যার ওপরে ভিত্তি করে মানব জীবনের যাবতীয় সাংগঠনিক কাঠামো কায়েম করাই নবী করীম (সা:)-এর আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল। ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষকগণ এই ১৪টি মূলনীতিকে 'ইসলামের ঘোষণাপত্র' নামে আখ্যায়িত করেছেন।
এই ঘোষণাপত্র ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার এক বছর পূর্বেই সমগ্র আরববাসীর সামনে তুলে ধরা হয়েছিল। মিরাজের উপহার, বিশ্ব মানবতার এই মুক্তি সনদে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল, যে মহান উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য সামনে রেখে হযরত মুহাম্মাদ (সা:) সীমাহীন অত্যাচার ও নির্যাতন হাসি মুখে বরণ করে নিচ্ছেন, সে উদ্দেশ্য হলো সমগ্র মানব সমাজের কল্যাণ সাধন করা। এই ১৪টি মূলনীতির মধ্যেই নিহিত রয়েছে সমগ্র বিশ্বের মানবতার মহাকল্যাণ। এই মূলনীতির ভিত্তিতে যে সমাজ এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে, সে সমাজ এবং রাষ্ট্রই হবে আকাশের নিচে আর মাটির বুকে একমাত্র আদর্শ রাষ্ট্র।
এই নীতির বাইরে অন্য কোনো নীতি অবলম্বন করা হলেই অশান্তি আর হাহাকার অনিবার্য। মানুষ প্রতি মুহূর্তে যে শান্তির জন্য লালায়িত, সে শান্তি এই মিরাজের উপহারের মধ্যেই নিহিত। মানুষের মুক্তির এটাই একমাত্র সনদপত্র। পবিত্র কুরআনে সূরা বনী ইসরাঈলে মিরাজের উপহার, মানব জাতির মুক্তির মহাসনদ পেশ করা হয়েছে। আমরা সে ১৪টি দফা এবং তার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা এখানে পেশ করবো। উল্লেখ্য এ সকল দফা উক্ত সূরার ২৩ নং আয়াত থেকে ৩৭ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।
وقَضَى رَبُّكَ أَلا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ -
এক. 'তোমার মালিক ফায়সালা করে দিয়েছেন, কারো দাসত্ব করো না'। (সূরা বনী ইসরাঈল-২৩)
প্রথম দফার তাৎপর্য হলো, আল্লাহ তা'য়ালা ব্যতীত আর কারো পূজা, উপাসনা, বন্দেগী, দাসত্ব তথা গোলামী এবং শর্তহীন আনুগত্য করা যাবে না। একমাত্র তাঁরই আদেশকে আদেশ এবং তাঁরই আইনকে আইন বলে গ্রহণ করতে হবে। তাঁর আইন ব্যতীত আর কারো আইন গ্রহণ ও অনুসরণ করা যাবে না। ইসলামী রাষ্ট্রের সকল আইনের উৎস হলেন মহান আল্লাহ তা'য়ালা। অন্য কথায় পবিত্র কুরআন এবং সুন্নাহ। নবী করীম (সা:) হিজরত করে মদীনায় যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, সে রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল এই কথাটির ওপরে যে, মহান আল্লাহই হলেন একমাত্র আইনদাতা। মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদ স্থাপিত হয়েছিল এ মতাদর্শের ভিত্তিতে যে, একমাত্র মহান আল্লাহই হলেন সমগ্র বিশ্বের মালিক এবং শাসক, তাঁর দেয়া আইনই এই পৃথিবী নামক রাষ্ট্রের আইন। একমাত্র মহান আল্লাহ তা'য়ালার দেয়া আইনই সকল ভুল-ভ্রান্তির উর্ধ্বে, এই আইনই মানব জাতির একমাত্র অনুসরণীয় আইন এবং সকল মানুষ শর্তহীনভাবে তাঁরই বিধান অনুসরণ করবে।
وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا طَ إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِندَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُل لَّهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوْلاً كَرِيمًا ۖ وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُل رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا -
দুই. 'তোমাদের পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো, তাদের একজন বা উভয়ই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয় তাহলে তাদের সাথে বিরক্তিসূচক কিছু বলো না এবং কখনো তাদের ধমক দিয়ো না, তাদের সাথে সম্মানজনক ভদ্রজনোচিত কথা বলবে। অনুকম্পায় তুমি তাঁদের প্রতি বিনয়াবনত থেকো এবং বলো, হে আমার মালিক, তাঁদের প্রতি ঠিক সেভাবেই তুমি দয়া করো, যেমন করে শৈশবে তাঁরা আমাকে লালন পালন করেছিলো'। (সূরা বনী ইসরাঈল-২৩-২৪)
অর্থাৎ শিশুকালে আমি যেমন অসহায় ছিলাম, আমার সেই অসহায় অবস্থায় আমার মাতা-পিতা আমার প্রতি যেমন মমতাভরে যত্ন নিয়েছেন, তারা আমার প্রতি যত্ন ও মমতা পোষণ না করলে কোনোক্রমেই আমার পক্ষে এই পৃথিবীতে জীবিত থাকা ও আমার পক্ষে বেড়ে ওঠা সম্ভব হতো না। আমার সেই মাতা-পিতা আজ বৃদ্ধাবস্থায় উপনীত হয়েছে, তারা অসহায়, হে আল্লাহ! আপনি তাদের প্রতি করুণা করুন!
দ্বিতীয় দফায় বলা হয়েছে, ইসলামী সমাজের মানসিক ও নৈতিক প্রশিক্ষণ এবং মুসলমানদের সাংস্কৃতিক শিষ্টাচারের ক্ষেত্রে মাতা-পিতার প্রতি আচরণ ও আনুগত্য এবং তাদের অধিকারের রক্ষণাবেক্ষণকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ জিনিসগুলো চিরকালের জন্য এই নীতি প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে যে, ইসলামী রাষ্ট্র নিজের আইন-কানুন, ব্যবস্থাপনামূলক বিধান ও শিক্ষানীতির মাধ্যমে পরিবার প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী ও সংরক্ষিত করার চেষ্টা ও পরিবারের ভিত্তি দৃঢ় করবে। কারণ, দেশের আদর্শ নাগরিক সরবরাহ করে আদর্শ পরিবার। পরিবারে যে শিশুর জন্ম হবে সে শিশুকে যদি ইসলামী আদর্শের ধাঁচে গঠন করা হয়, তাহলে সেই শিশুই হয় দেশের আদর্শ নাগরিক। এ কারণে দ্বিতীয় দফাতেই আদর্শ পরিবারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
কুরআনের গবেষকগণ উল্লেখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, একজন মুসলমানের উপরে যেমন ফরজ মহান আল্লাহর আইন কানুন মেনে চলা তেমনিভাবে ফরজ মাতা-পিতার খেদমত করা। আল্লাহর অধিকারের পরেই মাতা-পিতার অধিকার। মাতা-পিতার সাথে সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হবে। আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর নিজের অধিকারের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে যেভাবে তাগিদ করেছেন ঠিক একইভাবে তাগিদ করেছেন মাতা-পিতার ব্যাপারে। মাতা-পিতা যখন বয়সের প্রান্তে পৌঁছে যায় তখন স্বাভাবিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়েন, আর দূর্বল মানুষ নিজেদেরকে অসহায় বোধ করেন। সে সময় সন্তানকে স্মরণ করতে হবে নিজের শৈশবের কথা।
শিশু বয়সে সে ছিল অসহায়, নড়াচড়া করার ক্ষমতাও ছিল না, ক্ষুধার যন্ত্রণায় মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেলেও বলার ক্ষমতা ছিলনা। মলমুত্র ত্যাগ করে শরীরে মাখামাখি করলেও নিজের ক্ষমতা ছিল না ঐ অবস্থা থেকে নিজেকে পরিচ্ছন্ন করার। সন্তানকে স্মরণ করতে হবে সে সময় মাতা ব্যতীত তার কোনো উপায় ছিল না। সেই মুহূর্তে পিতা-মাতা অসীম স্নেহ মমতা ভালোবাসা দিয়ে, আন্তরিকতার সাথে অবর্ণনীয় দুঃখ যন্ত্রণা সহ্য করে তাকে প্রতিপালিত করেছেন। তাঁরা সন্তানের আনন্দে আনন্দিত হয়েছেন আর কষ্ট দেখলে বিচলিত হয়েছেন।
এসব কারণে সন্তানকে নিজের শৈশবের কথা স্মরণ করে মাতা-পিতার জন্য আন্ত রিকতার সাথে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে, 'রাব্বুল আলামীন! আমার শৈশব কালে তাঁরা যেমন আমাকে অসীম মায়া-মমতা ও ধন-সম্পদ ব্যয় করে প্রতিপালিত করেছেন, তাদের এই বৃদ্ধাবস্থায় তুমি তাদের প্রতি করুণা বর্ষণ কর'!
মানুষ বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হলে শারীরিক পরিবর্তনের সাথে সাথে মানসিক পরিবর্তনও সাধিত হয়। মানুষের মন মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, অল্পতেই মানুষ বিরক্ত হয়ে পড়ে। মাতা-পিতার ক্ষেত্রেও এমনটি হয়। সন্তানকে বুঝতে হবে, বয়সের কারণে মা-বাপ নানা ধরনের অনাকাংখিত কথা-বার্তা বলবে। সুতরাং সন্তানের কর্তব্য হচ্ছে বয়সের কারণে তাদের রূক্ষ মন-মানসিকতার প্রতি সদা সতর্ক সজাগ দৃষ্টি রাখা। এ সময় মা-বাপ যত কথাই বলুন না কেনো, তাদের প্রতিটি কথাই পরম খুশী ও ধৈর্যের সাথে গ্রহন করা, তাদের কথায় বিরক্তি প্রকাশ বা তাদের সাথে ক্রোধভরে কথা না বলা। তাদের সাথে কথাবার্তায় আচার আচরণে, চলা ফেরায় সন্তানকে হতে হবে বিনয়ী এবং কোমল স্বভাবের। তাদের আদেশ সন্তুষ্টির সাথে পালন করতে হবে। তাদের সামনে অনুগত হয়ে থাকতে হবে, বৃদ্ধ বয়সে মাতাপিতা যখন দূর্বল হয়ে অপরের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েন, সে সময় সন্তানকে একজন অনুগত ভৃত্যের ন্যায় তাদের সাথে আচরণ করতে হবে। মাতা-পিতার খেদমত করে তাদের প্রতি সন্তান করুণা বা অনুগ্রহ করছে এই ধারণা মনে স্থান দেয়া যাবে না। বরং তাদের খেদমত করে অন্তরে তৃপ্তি অনুভব করতে হবে, সন্তান তার মাতা-পিতার খেদমত করার সুযোগ পেয়েছে, এ কারণে সে মহান আল্লাহর দরবারে সেজদাবনত হয়ে শুকরিয়া আদায় করবে।
বৃদ্ধ বয়সে মাতা-পিতা নানা ধরনের অনাকাংখিত, অবাঞ্ছিত, বিরক্তিকর কথা বলতে পারে। এ সময়ে সন্তান মোটেও বিরক্ত হবে না। তাকে স্মরণ করতে হবে তার নিজের শৈশব কালের কথা, সে সময়ে স্বয়ং সে শিশু অবস্থায় নানা ধরনের বিরক্তিকর প্রশ্ন করেছে, প্রশ্নের পরে প্রশ্ন করে তাঁদেরকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে, মা-বাপ তার শিশুসুলভ সকল আচরণ ধৈর্যের সাথে, হাসি মুখে মেনে নিয়েছেন, মমতাসিক্ত কণ্ঠে শিশু সন্তানের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। এ সকল কথা স্মরণে রেখে মা-বাপের সাথে উত্তম আচরণ করতে হবে। সন্তানকে প্রত্যেক মুহূর্তে মাতা- পিতার মর্যাদার প্রতি সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
কেননা বৃদ্ধ বয়সে মানুষের মান অভিমান, ক্রোধ বৃদ্ধি পায় বা মানসিক ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটে। বৃদ্ধ বয়সে মা-বাপ নিজের মান-মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য, নিজের গুরুত্ব প্রকাশ করার জন্য নানা কথা বলতে থাকেন। কারণে অকারণে ক্রোধ প্রকাশ করতে থাকেন, কোনো বিষয়ে মতামত দিলে তার মতামতই মেনে নেয়ার জন্য অহেতুক চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। সন্তানদের প্রতি তিনি যে অসন্তুষ্ট এ ব্যাপারে মত প্রকাশ করেন। সন্তানকে তাদের এ সকল অহেতুক আচরণ হাসি মুখে সহ্য করতে হবে। কোনক্রমেই বিরক্তি প্রকাশ করা যাবে না। সন্তানকে মনে রাখতে হবে, সেও একদিন মা-বাপের মত বৃদ্ধ হয়ে তার নিজের সন্তানের মুখাপেক্ষী হবে।
মাতা-পিতা সম্পর্কিত পবিত্র কুরআনের উল্লেখিত আয়াতের সারমর্ম ইসলামী চিন্ত াবিদগণ যেভাবে বর্ণনা করেছেন, সেভাবেই উল্লেখ করা হলো। কুরআন হাদীসের আলোকে নিজের সন্তনের ওপরে মাতা-পিতার দশটি হক বা অধিকার রয়েছে। সে অধিকারগুলো-
১। মাতা-পিতা যদি নিঃস্ব অভাবী হন তাহলে তাদের অভাব দূর করার আন্তরিক চেষ্টা এবং তাদের সকল প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করবে সন্তান।
২। যদি তাদের সেবাযত্নের প্রয়োজন হয় তাহলে সন্তান তাদের সেবাযত্ন করবে।
৩। তাদের যদি বাসস্থান বা পোষাক না থাকে তাহলে সন্তান তাদের বাসস্থান ও পোষাকের ব্যবস্থা করে দিবে।
৪। মাতা-পিতা আহবান করার সাথে সাথে তৎক্ষণাৎ সন্তান তাদের সামনে উপস্থিত হবে।
৫। তাঁদের সামনে ভদ্র ও নম্র ভাষায় কথা বলতে হবে। কোনো অবস্থাতেই তাদের সাথে কর্কশ ভাষায় কথা বলা যাবে না।
৬। যে কোনো কারণই ঘটুক না কেনো তাদের সাথে সামান্যতম বেয়াদবি করা যাবে না।
৭। মাতা-পিতার সাথে একই সঙ্গে পথ চলতে গিয়ে তাদের সামনে চলা যাবে না, অপ্রয়োজনে তাদের ডানে বামে যাওয়া যাবে না।
৮। সন্তান নিজের জন্য যা পছন্দ-অপছন্দ করবে মা-বাপের জন্যও তাই করবে।
৯। সন্তান মাতা-পিতার জন্য নামাজ আদায় করে দোয়া করবে। যে সকল সন্তান মা- বাপের জন্য দোয়া করে না তাদের জীবনযাত্রা সমস্যা সংকুল হয়। অপরদিকে যে কোনো সমস্যা দেখা দিলে মাতা-পিতার জন্য দোয়া করলে সমস্যা দূর হয়ে যায়।
১০। মাতা-পিতা আদেশ দিলে তৎক্ষণাৎ পালন করতে হবে। অবশ্য তাদের আদেশ আল্লাহ-রাসূলের আদেশের বিপরীত হলে সে আদেশ পালন করা যাবে না।
মাতা-পিতা ব্যতীত যেমন কোনো মানুষের পক্ষে এই পৃথিবীতে আগমন করা অসম্ভব ঠিক তেমনি অসম্ভব পরকালে মুক্তি অর্জন করা। এ কারণে কোনো মানুষ নিজের মাতা-পিতা হতে সম্পর্কহীন হতে পারে না। পৃথিবীর জীবনে তাদের গুরুত্ব যেমন অপরিসীম ঠিক তেমনি আখেরাতের জীবনে সফলতা ও মুক্তির জন্যও তাদের গুরুত্ব সীমাহীন। মা-বাপকে খুশী করে এই পৃথিবীর জীবনে যেমন কল্যাণ পাওয়া যাবে তেমনি পরকালেও জান্নাত পাওয়া যাবে। সুতরাং কোনো অবস্থাতেই মাতা-পিতার অধিকার পদদলিত করা যাবে না।
وَآتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ
- তিন. আত্মীয়-স্বজনকে তাদের যথার্থ পাওনা আদায় করে দিবে এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদেরও তাদের অধিকার বুঝিয়ে দিবে। (সূরা বনী ইসরাঈল-২৬)
وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا - إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ طَ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا -
চার, অপব্যয় করো না। অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই আর শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ।
(সূরা বনী ইসরাঈল-২৬-২৭)
وَإِمَّا تُعْرِضَنَّ عَنْهُمُ ابْتِغَاءَ رَحْمَةً مِّنْ رَّبِّكَ تَرْجُوْهَا فَقُل لَّهُمْ قَوْلًا مَّيْسُورًا -
পাঁচ. যদি তাদের থেকে (অভাবী আত্মীয়, অসহায় মানুষ, মুসাফির এবং বিপদগ্রস্ত মানুষ) তোমাকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হয় এ কারণে যে, বর্তমানে তুমি আল্লাহ তা'য়ালার দেয়া করুণার সন্ধানে ব্যস্ত রয়েছো, তাহলে তাদেরকে কোমল কন্ঠে উত্তর দাও। (সূরা বনী ইসরাঈল-২৮)
এই কয়েকটি দফার মূল উদ্দেশ্যে হলো রাষ্ট্রের নাগরিক তাঁর স্বীয় রোজগার এবং অর্থ- সম্পদ একমাত্র নিজের ভোগ-বিলাসের জন্যই নির্দিষ্ট করে নিবে না। বরং ভারসাম্যমূলক ও ইনসাফের সাথে নিজের প্রয়োজন পূর্ণ করার পরে তাঁর নিজের আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী এবং অভাবী মানুষদের অধিকার প্রদান করবে। রাষ্ট্রের সমাজ জীবনে পারস্পরিক সাহায্য, সহানুভূতি ও সহযোগিতা, অপরের অভাব উপলব্ধি করা এবং তা দূর করার মানসিকতা জীবস্ত থাকবে। সচ্ছল ব্যক্তি অসচ্ছল ব্যক্তিকে সাহায্য করবে। ধনী আত্মীয় তাঁর গরীব আত্মীয়কে সাহায্য করবে। ইসলামী রাষ্ট্রে একজন মুসাফির যেখানেই যাবে, সেখানেই সে নিজেকে অতিথি বৎসল মানুষ কর্তৃক পরিবেষ্টিত দেখতে পাবে। ইসলামী সমাজে মানুষ অধিকার সচেতন হবে। ধনী ব্যক্তি সচেতন হবে তাঁর এ ধন-সম্পদে অভাবী মানুষদের অধিকার রয়েছে।
একজনের সম্পদ বিনষ্ট হতে দেখলে আরেকজন তা রক্ষা করবে। ধনী ব্যক্তি কাউকে কিছু দিলে তাঁর মনে এ ধারণা জাগবে না যে, সে গরীবের প্রতি অনুগ্রহ করছে। বরং তাঁর মনে এ ধারণা জাগ্রত থাকবে যে, সে তাঁর অধিকার আদায় করছে। কোনো মানুষের যদি দান করার ক্ষমতা না থাকে তাহলে সে মহান আল্লাহর কাছে দান করার ক্ষমতা প্রার্থনা করবে। কোনো অভাবী তাঁর কাছে এলে সে তাঁর কাছে বিনয়ের সাথে ক্ষমা চাইবে।
ইসলামের ঘোষণাপত্রের এই দফাগুলোর ভিত্তিতেই মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রে ওয়াজিব ও নফল সাদকার বিধানসমূহ কার্যকরী করা হয়। এ সকল দফার ভিত্তিতেই ওয়াকফ, অসিয়ত ও মীরাসের নিয়ম-কানুন নির্ধারিত হয়। ইয়াতিমের অধিকার সংরক্ষণ করা হয়। প্রত্যেক জনবসতীর ওপর মুসাফিরের নিম্নপক্ষে তিনদিন পর্যন্ত মেহমানদারী করার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
সমাজের নৈতিক ব্যবস্থা কার্যত এমন পর্যায়ে উন্নীত করা হয় যে, যার ফলে সমাজের সর্বস্তরে একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা, সহানুভূতি, সাহায্য-সহযোগিতা, দানশীলতার মন-মানসিকতা প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। এমনকি সমাজের জনগোষ্ঠীর মধ্যে দান করার প্রবণতা এমন তীব্র হয়ে ওঠে যে, স্বতস্ফুর্তভাবে আইনগত অধিকারসমূহ আদায় করা ছাড়াও আইনের জোরে যে সব নৈতিক অধিকার আদায় ও প্রদান করা যায় না, সে সব অধিকারসমূহ মানুষ উপলব্ধি করে তা আদায় করতে থাকে। এসব দফার ভিত্তিতে নবী করীম (সা:) এমনই এক কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের মন-মানসিকতা এমন এক স্তরে উপনীত করেছিলেন যে, মানুষ অন্যের অধিকার আদায় না করা পর্যন্ত মনে শান্তি স্বস্তি অনুভব করতো না।
وَلَاتَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلى عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطُهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُوْمًا مَّحْسُورًا
ছয়. নিজের হাত গলার সাথে বেঁধে রেখো না এবং তা একেবারে খোলাও ছেড়ে দিও না, এমন করলে স্বয়ং তুমি নিন্দিত এবং দুর্বল হয়ে পড়বে। (সূরা বনী ইসরাঈল-২৯)
গলায় হাত বেঁধে রাখা, এটি রূপক কথামাত্র। এ কথাটি কৃপণতার অর্থে ব্যবহৃত হয়। আর হাত খোলা ছেড়ে দেয়ার অর্থ হলো, হিসাব না করে খরচ করা, ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে ব্যয় করা। ওপরের দফাগুলোর সাথে এই দফাটি একত্রে পড়লে এটা উপলব্ধি করা যায় যে, মানুষের মধ্যে এতটা ভারসাম্য থাকতে হবে, তাঁরা কৃপণ হয়ে অর্থ নিজের হাতে কুক্ষিগত না করে, অর্থের আবর্তন বন্ধ করে না দেয়, অপব্যয়ী হয়ে নিজের অর্থের সর্বনাশ না ঘটায়, নিজের অর্থশক্তি নিঃশেষ করে না দেয়। মানুষের ভেতরে ভারসাম্যের এমন সঠিক উপলব্ধিবোধ থাকতে হবে যে, মানুষ ব্যয় করার ক্ষেত্রে ব্যয় করবে এবং অপব্যয় করে নিজের অর্থশক্তি ধ্বংস করবে না।
অহংকার ও প্রদর্শনেচ্ছামূলক এবং লোক দেখানো ব্যয়, বিলাসিতা, নোংরা ও অশ্লীল কর্মে ব্যয়, এমন ধরনের খরচ যা মানুষের প্রকৃত প্রয়োজনে ও কল্যাণমূলক কাজে ব্যবহারের বদলে অর্থ ভ্রান্ত পথে ব্যয় করে, এমন করা মহান আল্লাহ তা'য়ালার অনুগ্রহের সাথে অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের শামিল। আর এসব যারা করে তাঁদেরকেই বলা হয়েছে শয়তানের ভাই।
এই দফা মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্রে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল। প্রকৃত বিষয়ও এটাই যে, একটি সৎ ও সত্যনিষ্ঠ সমাজকে নৈতিক অনুশীলন, সামষ্টিক চাপ প্রয়োগ ও আইনগত বাধা-নিষেধ আরোপের মাধ্যমে অযথা অর্থ ব্যয় থেকে বিরত রাখা উচিত। মদীনার রাষ্ট্রে প্রথমত অপব্যয় ও বিলাসিতার বহু নীতি প্রথাকে আইন প্রয়োগ করে উচ্ছেদ করা হয় এবং তা হারাম বলে ঘোষিত হয়। দ্বিতীয়ত পরোক্ষভাবে আইনগত কৌশল অবলম্বন করে বৃথা অর্থ ক্ষয়ের রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়।
সে সময় সমাজে এমন অনেক ধরনের প্রথা ও রসম রেওয়াজ চালু ছিল যা উদযাপন করতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হত। ব্যয়ের এ সকল বাহুল্য পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ইসলামী রাষ্ট্রকে বিশেষ ক্ষমতা বলে এবং বিশেষ ব্যবস্থাপনায় বিধান জারী করে সুস্পষ্ট অপব্যয়ের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টির ক্ষমতা দেয়া হয়। যাকাত ও সাদকার বিধানের মাধ্যমে কৃপণতার অভ্যাসকে ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়া হয়। মানুষ অর্থ-সম্পদ কুক্ষিগত করে অর্থের আবর্তনের পথ রুদ্ধ করে দেবে এ সম্ভাবনাও নির্মূল করে দেয়া হয়। এসব কৌশল গ্রহণ করার পাশাপাশি সমাজে এমন সাধারণ জনমত গঠন করা হয়, মানুষকে এমনভাবে শিক্ষিত করা হয় যে, দানশীলতা ও অপব্যয়ের মধ্যকার পার্থক্য নাগরিক সঠিকভাবে জানতো এবং কৃপণতা ও ভারসাম্যমূলক ব্যয়ের মধ্যে উত্তম রূপেই পার্থক্য করতে সক্ষম হত।
মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে যে জনমত গঠন করা হয়েছিল, সে জনমত কৃপণদেরকে অপমানিত করে, ব্যয়ের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষাকারীদের সম্মানিত করে, অপব্যয়কারীকে নিন্দা করে, দানকারীদের সমাজের উঁচু স্তরে স্থান করে দেয়। মদীনার রাষ্ট্রে যে শিক্ষা দেয়া হয়েছিল, সে নৈতিক ও মানসিক প্রশিক্ষণের প্রভাব বর্তমানেও মুসলিম সমাজে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। বর্তমানেও পৃথিবীর সকল দেশে মুসলমানরা কৃপণদের ঘৃণার দৃষ্টিতে এবং অর্থ-সম্পদ কুক্ষিগতকারীকে ঘৃণার চোখে দেখে। দানশীল ব্যক্তিগণ বর্তমানেও মুসলমানদের দৃষ্টিতে মর্যাদাবান। কৃপণ যারা, তাদের সম্মান বর্তমানেও মুসলমানদের কাছে নেই।
وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلَاقٍ ط نَحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُمْ طَ إِنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خطءا كبيرًا -
সাত. দারিদ্রতার ভয়ে নিজেদের সন্তান হত্যা করো না। আমি তাদেরকেও রিযিক দান করবো এবং তোমাদেরকেও। প্রকৃত পক্ষে তাদেরকে হত্যা করা এক ভয়ংকর অপরাধ। (সূরা বনী ইসরাঈল-৩১)
সন্তান যাতে পৃথিবীতেই আসতে না পারে এ কারণে প্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রচেষ্টা ও উপায় উদ্ভাবন করা হয়েছে। জন্ম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সে যুগে আজল করা হতো। আজল করার অর্থ হলো, 'পুরুষের জনন ইন্দ্রিয় মিলন কালে শুক্র নির্গত হবার মুহূর্তে স্ত্রীর যৌনাঙ্গ থেকে বাইরে বের করে শুক্রপাত করা'।
এরূপ করলে সন্তান গর্ভে আসবে না এ ধরনের নিশ্চয়তা ছিলো না। অধিক সন্তানের কারণে অথবা সন্তান প্রয়োজন নেই এ কারণে মানুষ সন্তান জন্ম লাভের সাথে সাথে অথবা কিছুটা বড় হলে তাকে হত্যা করতো। শুধু কন্যা সন্তানকেই হত্যা করা হতো না, পুত্র সন্তানকেও হত্যা করা হত। এ যুগে সন্তান হত্যা করার পদ্ধতি আধুনিক রূপে পরিবর্তিত হয়েছে মাত্র। বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা প্রয়োগ করে সন্তান হত্যা করার বহুবিধ উপায় উদ্ভাবন এবং বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করে সন্তানকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জন্ম নিরোধের যত ধরনের উপায় এ পর্যন্ত উদ্ভাবন করা হয়েছে এসবের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে সন্তানকে এই পৃথিবীতে আসতে না দেয়া। এ ধরনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড মানব জাতির জন্য মহাবিপদই ডেকে আনছে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ তথা গর্ভনিরোধ, গর্ভপাত, সদ্যপ্রসূত সন্তান হত্যা বা ভ্রূণ হত্যা করা ইসলাম পরিপূর্ণভাবে হারাম ঘোষণা করেছে। ডাক্তার যদি স্বাস্থ্যগত বা অন্য কোনো বৈধ কারণে পরামর্শ দেন তাহলে সে কথা স্বতন্ত্র।
ঈমানদার ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত ইসলাম অন্য কোনো কারণে তথাকথিত জন্ম নিয়ন্ত্রণ বৈধ করেনি। নৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক তথা মানবিক সকল দিক দিয়েই তথাকথিত গর্ভনিরোধ অত্যন্ত অশুভ। যে মাতা-পিতা সন্তান কামনা করে না তারা স্বয়ং সন্তানের শত্রু হয়ে দাঁড়ায় এবং তারা যে গোটা মানব জাতির শত্রু হয়ে দাঁড়াবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? যে পিতামাতা স্বয়ং নিজের সন্তানের প্রাণের শত্রু হয়, তারা যে সকল মানুষের সাথে শত্রুতা করতে সামান্যতম দ্বিধা করবে না এ কথা নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায়।
এর কারণ, নিজ ঔরসজাত, নিজ গর্ভস্থ অথবা নিজের গর্ভের সন্তানকে স্বয়ং নিজের হাতেই নিঃশেষ করার জন্য সর্বপ্রথম নিজের মধ্যে চরম নিষ্ঠুরতা, অমানুষিকতা, কঠোরতা, নির্মমতা ও নিতান্তই পশুপ্রবৃত্তির উদ্ভব হওয়া আবশ্যক। নতুবা এমন ধরনের কাজ কোনো ব্যক্তির দ্বারা সম্ভব হতে পারে না। সমাজের মানুষের এই নিষ্ঠুরতা ও সন্ত ানের প্রতি কঠোর মনোভাব সংক্রমিত হয়ে সমগ্র জাতিকে গ্রাস করে এবং সমগ্র জাতির প্রতিই তা অবশেষে আরোপিত হয়।
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও একথা সত্য, গোটা প্রাণী জগতে এমন দৃষ্টান্ত নেই, তারা নিজের সন্তানকে নিজেরাই ধ্বংস করে। ভাবতে বড় আশ্চর্য লাগে, যে কাজ পশু করে না সেই নোংরা কাজ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষ কিভাবে করে? আজল প্রথা প্রাচীন আরব সমাজে প্রচলিত থাকলেও ইসলামী জীবন দর্শন তা মোটেও সমর্থন করেনি।
وَلَا تَقْرَبُوا الزِّني إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلاً
আট. ব্যভিচারের ধারে কাছেও অগ্রসর হয়ো না, তা অত্যন্ত গর্হিত কর্ম এবং খুবই নোংরা পথ।
(সূরা বনী ইসরাঈল-৩২)
এই দফাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মানুষের আদিম রিপুর মুখে লাগাম দেয়া হয়েছে এই দফার মাধ্যমে। 'যিনা ব্যভিচার করো না' এ কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে যিনা ব্যভিচারের ধারে কাছেও যেও না। এই আদেশ যেমন ব্যক্তির জন্য তেমনি সমগ্র জাতির জন্য। একজন মানুষ ব্যভিচার থেকে দূরে থাকবে শুধু এমন নয়, বরং ব্যভিচারের দিকে একজন মানুষকে টেনে নিয়ে যায় ব্যভিচারের এমন সব সূচনাকারী এবং প্রাথমিক উদ্যোগ ও আকর্ষণ সৃষ্টিকারী বিষয়সমূহ থেকেও সে দূরে অবস্থান করবে। যিনা ব্যভিচার নারী ধর্ষণ এসব গর্হিত কাজ এমনিতেই ঘটে না। এসব কাজের পেছনে কিছু কার্যকারণ সক্রীয় থাকে। এই দফার প্রেক্ষিতে সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে ব্যভিচার, ব্যভিচারের উদ্যোগ এবং তার কারণসমূহের পথ বন্ধ করে দেয়া রাষ্ট্রের জন্য আবশ্যক হয়ে পড়ে। এ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়ন, শিক্ষা ও অনুশীলন দান, সামাজিক পরিবেশের সংস্কার সাধন, রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের যথাযোগ্য বিন্যাস সাধন এবং অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যবস্থা অবলম্বন করবে। মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্রে এই ধারা রাষ্ট্রের বুনিয়াদে পরিণত হয়। এই ধারা বলে ব্যভিচার এবং ব্যভিচারের অপবাদকে ফৌজদারী অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়।
ব্যভিচার বাস্তবায়নে উদ্যোগকারী অবাধ মেলামেশার বিরুদ্ধে নারী-পুরুষদের জন্য পর্দার আইন জারী করা হয়। নগ্নতা অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতার প্রচার ও প্রসার কঠোর হাতে দমন করা হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে এসবের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা হয়। ব্যভিচারের নিকট আত্মীয় মদ, নাচ, যৌন উদ্দীপনামূলক গান ও ছবির ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। সমাজের সর্বস্তর থেকে অপবিত্রতা বিদায় করা হয়। অর্থাৎ যেসকল কাজ মানুষকে ব্যভিচারের দিকে আকর্ষণ করে, সেসব কাজের শিকড় সমূলে উৎপাটিত করা হয়। সেই সাথে বিয়ে সম্পর্কিত সহজ আইন প্রণয়ন করা হয়। নারীর অধিকার রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের মনে এমন আল্লাহভীতি সৃষ্টি করা হয় যে, মানুষ নিজের উদ্যেগেই ব্যভিচার সংঘটিত হবার কারণসমূহ উৎখাত করে।
وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللهُ إِلَّا بِالحَقِّ ط وَمَنْ قُتِلَ مَظْلُومًا فَقَدْ جَعَلْنَا لِوَلِيِّهِ سُلْطَانًا فَلَا يُسْرِفْ فِي الْقَتْلِ طَ إِنَّهُ كَانَ مَنْصُورًا -
নয়, কোনো জীবনকে অন্যায়ভাবে হত্যা করো না, যা আল্লাহ তা'য়ালা হারাম করেছেন; যে ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয় আমি তার উত্তরাধিকারীকে (এ) অধিকার দিয়েছি (সে চাইলে রক্তের বিনিময় দাবী করতে পারে), তবে সে যেনো হত্যার (প্রতিশোধ নেয়ার) ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করে; কেননা (হত্যার মামলায় যে ব্যক্তি মষলুম) তাকেই সাহায্য করা হবে। (সূরা বনী ইসরাঈল-৩৩)
'প্রাণদণ্ডের শাস্তি প্রয়োগের অধিকার একমাত্র আদালতের' কোনো ব্যক্তি বা সমাজ এ শাস্তি প্রয়োগ করতে পারবে না। ভয়ঙ্কর অপরাধ যে কোনো ব্যক্তিই সংঘটিত করুক না কেনো, হত্যা করার মত শাস্তি প্রয়োগ আদালতের হাতে। 'সত্যের ভিত্তি ব্যতীত' বলতে প্রমাণ বুঝানো হয়েছে। অপরাধীর অপরাধ প্রমাণ হলে ইসলাম যে সকল অপরাধের শাস্তি হিসাবে প্রাণদণ্ড দিয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে হত্যা করার নির্দেশ দেয়া যায়। এই দফায় আত্মহত্যাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ মানুষ নিজেকে নিজের মনিব এবং নিজের মালিকানাকে সে নিজেই শেষ করে দিতে পারে, এমন ধারণা করা মারাত্মক ভুল। সে নিজেকে শেষ বা নিজেকে অন্যায় কাজে নিয়োজিত করবে এ অধিকার তাকে দেয়া হয়নি। এই পৃথিবী একটি পরীক্ষা কেন্দ্র, এখানে পরীক্ষা যে ধরনেরই হোকনা কেনো, এ পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে সে পালিয়ে যাবে এ অধিকার তাকে দেয়া হয়নি।
وَلَا تَقْرَبُوا مَالَ الْيَتِيمِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ حَتَّى يَبْلُغَ أَشُدَّه ص
দশ. ইয়াতিমের ধন-সম্পদের কাছেও যেয়ো না, তবে এমন কোনো পন্থায় যা (ইয়াতিমের জন্যে) উত্তম (বলে প্রমাণিত) হয় তা বাদে- যতোক্ষণ পর্যন্ত সে (ইয়াতিম) তার বয়োপ্রাপ্তির পর্যায়ে উপনীত হয়।
(সূরা বনী ইসরাঈল-৩৪)
وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ جِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْؤُولاً -
এগার, প্রতিশ্রুতি মেনে চলো, কেননা (কিয়ামতের দিন এ) প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে (তোমাদের) জিজ্ঞাবাদ করা হবে। (সূরা বনী ইসরাঈল-৩৪)
وَأَوْفُوا الْكَيْلَ إِذَا كِلْتُمْ وَزِنُوا بِالقِسْطَاسِ الْمُسْتَقِيمِ طَ ذَالِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تأويلاً -
বার. কোনো কিছু পরিমাপ করার সময় মাপ কিন্তু পুরোপুরিই করবে, আর (ওযন করার জিনিস হলে) দাঁড়িপাল্লা সোজা করে ধরবে; (লেনদেনের ব্যাপারে) এই হচ্ছে উত্তম পন্থা এবং পরিণামের (দিক থেকে) এটাই হচ্ছে উৎকৃষ্ট। (সূরা বনী ইসরাঈল-৩৫)
ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাতের ব্যাপারে কুরআন-হাদীসে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্রে অক্ষম সম্পর্কিত নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, এই রাষ্ট্রের যেসব নাগরিক তাদের নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করার ক্ষমতা এবং যোগ্যতা নেই বা হয়নি, ইসলামী রাষ্ট্রই তাদের স্বার্থের সংরক্ষক। নবী করীম (সা:) ইসলামী রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন, 'যার কোনো অভিভাবক নেই আমিই তাঁর অভিভাবক'। অসহায়, ইয়াতিম এবং অক্ষম মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রশাসন। প্রশাসনিকভাবে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হবে।
চুক্তি অনুসরণ করার ব্যাপারে ইসলামী রাষ্ট্র দৃঢ়তা অবলম্বন করবে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ইসলামী রাষ্ট্র কোনক্রমেই অন্য রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করবে না। মানুষ ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক জীবন পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে ওয়াদা পালন করবে। এ পর্যায়ে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটলে মহান আল্লাহর দরবারে এ সম্পর্কে জবাবদিহী করতে হবে।
অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সততা বজায় রাখার ব্যাপারে রাষ্ট্র তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকা পালন করবে। দেশের ভেতরে ব্যবসা বা ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কোনো নাগরিক যেন প্রতারিত না হয়, বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও যেন কোনো ধরনের বৈষম্য বা প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করা না হয়, ইসলামী রাষ্ট্র আইন প্রয়োগ করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ব্যবসার ক্ষেত্রে অন্যের অধিকারে যেন কেউ হস্তক্ষেপ করতে না পারে, রাষ্ট্র সেদিকে দৃষ্টি রাখবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, যেন ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই উভয়ের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে। কারো মনে যেন এ ধারণা সৃষ্টি না হয় সে প্রতারিত হবে।
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ ط إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَائِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولاً -
তের, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, (অযথা) তার পেছনে পড়ো না; কেননা (কিয়ামতের দিন) কান, চোখ ও অন্তর, এ সব কয়টির (ব্যবহার) সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করা হবে।
(সূরা বনী ইসরাঈল-৩৬)
অনুমান বা কল্পনা নির্ভরতা ইসলামী রাষ্ট্রে প্রশ্রয় পাবে না। অনুমানের ভিত্তিতে কাউকে গ্রেফতার বা দোষারোপ করা যাবে না। সন্দেহের বশে কোনো মানুষকে গ্রেফতার করা যাবে না। তদন্তে দোষী প্রমাণীত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দেয়া যাবে না। এই দফায় এ কথা স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক নিজেদের ব্যক্তিগত বা সামাজিক জীবনে নিছক সন্দেহ বা অনুমানের পেছনে না চলে জ্ঞানের পেছনে চলবে। নৈতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে, আইনের ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, দেশ শাসনের ক্ষেত্রে, জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, শিক্ষার ক্ষেত্রে তথা জীবনের সকল ক্ষেত্রে অনুমান নির্ভর কিছু গ্রহণ করা যাবে না।
সঠিক জ্ঞানের পরিবর্তে অনুমানের পেছনে চলার কারণে মানুষের জীবনে যে অসংখ্য ক্ষতিকর মতামতের সৃষ্টি হয়, ইসলাম এসব ক্ষতি থেকে মানুষের চিন্তা এবং কর্ম মুক্ত রাখতে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করে। নৈতিকতার ক্ষেত্রে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, অমূলক ধারণা বা কল্পনা থেকে দূরে অবস্থান করবে। কোনো দল বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কুধারণা বা সন্দেহের কারণে অনুসন্ধান ব্যতীত দোষারোপ করবে না। ইসলামী আইনের ক্ষেত্রে এই দফার ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন করা হয়, শুধুমাত্র অনুমান বা সন্দেহের বশে কোনো ব্যক্তি বা দেশ বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে না। অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, সন্দেহের বা অনুমানের ভিত্তিতে কাউকে গ্রেফতার বা মারধর করা বা আটক রাখা সম্পূর্ণ অবৈধ।
অমুসলিমদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার তদন্ত ব্যতীত কোনো কথা সমাজে ছড়িয়ে দেয়া যাবে না। প্রমাণ ব্যতীত তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। শিক্ষানীতির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, যেসব তথাকথিত জ্ঞান শুধুমাত্র সন্দেহ অনুমান এবং দীর্ঘসূত্রিতাময় ধারণা ও কল্পনানির্ভর, এসবের ভিত্তিতে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা যাবে না। পাঠ্য তালিকায় এসব কিছু অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও বলা হয়েছে, অনুমান করে বা কল্পনা করে কোনো কিছুর অনুসরণ করা যাবে না। যা অনুসরণ করতে হবে আল্লাহ তা'য়ালা এবং তাঁর রাসূল তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। কুরআন হাদীসের জ্ঞানের ভিত্তিতে যা প্রমাণীত তাই অনুসরণ করতে হবে।
وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا جِ إِنَّكَ لَنْ تَخْرِقَ الْأَرْضَ وَلَنْ تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُولاً -
চৌদ্দ, আল্লাহর যমীনে (কখনোই) দম্ভভরে চলো না, কেননা (যতোই অহঙ্কার করোনা কেনো), তুমি কখনো এ যমীন বিদীর্ণ করতে পারবে না, আর উচ্চতায়ও তুমি কখনো পর্বত সমান হতে পারবে না
(সূরা বনী ইসরাঈল-৩৭)
এমনভাবে চলাফেরা করবে না, এমন ভাষায় এবং ভঙ্গিতে কথা বলবে না যে, তোমার চলাফেরায় বা কথায় অহংকার প্রকাশ পায়। তোমার সকল আচরণে অহংকার বা দম্ভের চিহ্নমাত্র যেন না থাকে। সমাজের কোনো ব্যক্তি না এমন আচরণ করবে না রাষ্ট্র এমন আচরণ করবে। বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে না। তাদের সাথে বন্ধুর মত আচরণ করবে। তাদের সাথে ওয়াদা বা চুক্তি করলে তা পালন করবে। এই ১৪ দফার ভিত্তিতে মদীনায় যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে রাষ্ট্র ক্রমশঃ বিশাল আকার ধারণ করেছিল। হযরত উমার (রা:) এর শাসনামলে প্রায় অর্ধপৃথিবী তাঁর শাসনাধীনে ছিল। নবী করীম (সা:) যে সময় রাষ্ট্রের শাসক ছিলেন এবং তাঁর পরে চার খলীফা, হযরত হুসাইন (রা:) এর স্বল্প মেয়াদী শাসনকাল, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা:) এর শাসনকাল, হযরত উমার ইবনে আব্দুল আজিজ (রাহ:) এর শাসনকাল, এ সকল শাসকদের শাসনামলে রাষ্ট্রের কোনো মন্ত্রী বা চাপরাসির আচরণেও সামান্য অহংকার দেখা যায়নি।
রাষ্ট্রের শাসকবর্গ, গভর্নর এবং সেনাপতিদের জীবনে ক্ষমতাগর্ব ও অহংকারের বিন্দুমাত্র অংশ ছিল না। সে সময় যুদ্ধের ময়দানে একদল আরেকদলের বিরুদ্ধে ক্রোধ উদ্রেককারী কথা বলতো। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর মুখ থেকে দম্ভ অহংকারের একটি শব্দও নির্গত হত না। তাদের চলাফেরা, ওঠাবসা, কথাবার্তা, পোষাক-পরিচ্ছদ, চলার বাহন, বাসস্থান, আচার আচরণ কোনো কিছুর ভেতর থেকেই তাদের বিপুল ক্ষমতার সামান্যতম লক্ষণ প্রকাশ পেত না। মুসলিম বাহিনী যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে কোনো দেশে প্রবেশ করলে, তাদের হাঁটা বা কথার মধ্যে অহংকারের চিহ্ন থাকতো না। তাঁরা যে একটি দুঃসাহসী বাহিনী এ কথা প্রতিপক্ষের দেশের নাগরিকদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করার সামান্যতম প্রচেষ্টা তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। তাদের আচরণ, ব্যবহার ছিল কোমল, মমতার মাধুরী মিশ্রিত এবং সৃষ্টিসমূহের প্রতি সহানুভূতিশীল। প্রত্যেক সৃষ্টির প্রতি তাঁরা ছিলেন সজাগ-সতর্ক, অতি ক্ষুদ্র একটি পিপীলিকার প্রতি নিজের অজান্তেও যেনো রূঢ় আচরণ না করেন এ ব্যাপারে তাঁরা সজাগ থাকতেন।
0 Comments