নবী করীম (সা:) হিজরত করে মদীনা পৌঁছার পরপরই সেখানে একটি আদর্শিক বিপ্লব সাধিত হয়েছিল। মদীনার সিংহভাগ মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। কিন্তু এর মধ্যেও দু'চারটি গোত্র ছিল যারা প্রথমে ইসলাম গ্রহণ করেনি। আউস গোত্রের একটি ছোট অংশ নবী করীম (সা:)-এর আগমনের পরও তাদের ভ্রান্ত আদর্শ আঁকড়ে ধরেছিল। পরবর্তীতে অবশ্য সকলেই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল।
সার্বিক পরিস্থিতি কিছুটা নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে নবী করীম (সা:) মদীনার জনগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে ভাষণ পেশ করেছিলেন। ভাষণের সূচনায় তিনি মহান আল্লাহ তা'য়ালার প্রশংসা করে বললেন, 'হে মানুষ! তোমরা আখিরাতের জন্য পূজি অর্জন করো। মনে রেখো, তোমাদের মধ্যে হয়তঃ কোনো ব্যক্তি দ্রুতই ইন্তেকাল করবে। তার পশু সম্পদ পরিচালনা করার মতো কেউ থাকবে না। তখন তাকে তার প্রতিপালক প্রশ্ন করবেন, তোমার কাছে কি আমি রাসুল প্রেরণ করিনি? তোমার প্রতি অনুগ্রহ করে আমি তোমাকে ধন-সম্পদ দান করিনি? সে সকল সম্পদ থেকে তুমি আখিরাতের জন্য কি প্রেরণ করেছো?'
নবী করীম (সা:) বললেন, 'তখন সে ব্যক্তি তাঁর চারদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করবে। কিন্তু একমাত্র জাহান্নাম ব্যতীত আর কিছুই দেখতে পাবে না। সুতরাং তোমাদের উচিত ঐ জাহান্নাম থেকে নিজেকে রক্ষা করা। একটি খুরমা দান করে হলেও আখিরাতের পূজি অর্জন করা। যার দান করার মতো কিছুই নেই, তাঁর উচিত ভালো কথা বলে নিজেকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করা। কারণ মহান আল্লাহ তা'য়ালা ভালো কাজের পুরস্কার দশগুণ থেকে সাতশত গুণ বৃদ্ধি করে দেন'। (ইবনে হিশাম)
একটি বিষয় লক্ষনীয়, নবী করীম (সা:) তাঁর প্রথম ভাষণে মানুষকে আখিরাতের কথা বলেছেন। মানুষের মধ্যে আল্লাহর কাছে জবাবদিহীর অনুভূতি সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর জীবনে আরাম আয়েশ ভোগ করার জন্য মানুষ প্রচুর অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে থাকে। কিন্তু এই জীবন ক্ষণস্থায়ী, পক্ষান্তরে পরকালের জীবন অনন্ত, যার কোনো শেষ নেই। সে অফুরন্ত জীবনে মানুষ যেন অনাবিল সুখ-শান্তিতে থাকতে পারে, এ কারণে তিনি মানুষকে আল্লাহ তা'য়ালার রাস্তায় দান করতে অনুপ্রাণিত করেছেন।
যাদের অর্থ-সম্পদ দান করার মতো সামর্থ নেই তাদেরকে বলা হয়েছে, দান সামান্য হলেও মহান আল্লাহ তা'য়ালা তার পুরস্কার বৃদ্ধি করে দিবেন। এভাবে সামান্য কোনো কিছু দান করতে অসমর্থ হলে তার উচিত মানুষকে সৎ উপদেশ দেয়া ও মানুষের সাথে উত্তম ব্যবহার করা। এসবের বিনিময়েও মহান আল্লাহ তা'য়ালা তাকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবেন।
পৃথিবীতে মানুষকে সৎ বানানোর কোনো টেকনোলজি আবিষ্কার হয়নি এবং হবেও না। একমাত্র আখিরাতের ভয় ব্যতীত মানুষ কোনোক্রমেই সৎ হতে পারে না। মানুষের মাথায় যখন এই চিন্তা ক্রিয়াশীল থাকে যে, তাঁর সকল কাজের হিসাব মহান আল্লাহর কাছে পেশ করতে হবে। তখন সে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই সৎ হতে বাধ্য। এ কারণেই নবী করীম (সা:) প্রথমে মানুষের অন্তরে আখিরাতের ভয় বা আল্লাহ ভীতি প্রবেশ করিয়েছেন। অপরদিকে সমগ্র ত্রিশপারা কুরআনে সর্বাধিক আলোচিত বিষয় হলো আখিরাত। আখিরাতের আলোচনা সম্বলিত আয়াতসমূহ একত্রিত করলে তা প্রায় দশ পারার সমান হবে বলে কুরআন বিশেষজ্ঞগণ মতামত দিয়েছেন। একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে দীর্ঘ আলোচনার একটিই উদ্দেশ্য, তাহলো মানুষের মনে পরকালের জবাবদীহী জাগ্রত করে মানুষকে সৎ মানুষে পরিণত করা।
নবী করীম (সা:) তাঁর আরেক ভাষণে বলেছেন, 'সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ তা'য়ালার। আমি তাঁরই প্রশংসা করছি এবং তাঁর কাছেই সাহায্য কামনা করছি। আমরা যাবতীয় নিষিদ্ধ কর্ম এবং আমাদের নফসের প্ররোচনা 'থেকে তাঁর কাছেই আশ্রয় কামনা করছি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যাকে সত্য পথ প্রদর্শন করেন তাকে কোনো শক্তি ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে না। মহান আল্লাহ এক এবং তাঁর কোনো অংশীদার নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, তিনি ব্যতীত অন্য কোনো আইন দাতা, বিধান দাতা, ইলাহ নেই। মহান আল্লাহ তা'য়ালার কুরআনই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ বাণী। যার অন্তরে কুরআনের প্রতি আকর্ষণ রয়েছে, কুফুরির অন্ধকারের অধিবাসী হয়েও যে ব্যক্তি কুরআনের আলোর অধিবাসী হয়েছে, মানুষের মনগড়া কথা তথা আদর্শ ত্যাগ করে যে ব্যক্তি কুরআনকে আঁকড়ে ধরেছে, সে ব্যক্তি অবশ্যই সফল হয়েছে। কারণ কুরআনের আদর্শের তুলনায় ভিন্ন কোনো আদর্শ বা কথা সুন্দর নয়'।
তিনি তাঁর ভাষণে বলেন, 'মহান আল্লাহ তা'য়ালা যা পছন্দ করেন তোমরা তা গ্রহণ করো এবং নিজের সমগ্র সত্তা দিয়ে আল্লাহ তা'য়ালাকে ভালোবাসো। আল্লাহ তা'য়ালার কুরআন তিলাওয়াত করো, তাঁকে স্বরণে রাখো, নিজের হৃদয়কে কঠিন হতে দিওনা। কারণ মহান আল্লাহ তাঁর সকল সৃষ্টি থেকে কাউকে নির্বাচিত করবেন এবং সৃষ্টির সকল কর্ম থেকেও কিছু কর্ম নির্বাচিত করবেন। আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকেও কিছু বান্দাকে নির্বাচিত করেছেন। মহান আল্লাহ সর্বোত্তম কথা ভালোবাসেন'।
আল্লাহ তা'য়ালার নবী (সা:) আরো বলেন, 'মানুষকে যা কিছু দান করা হয়েছে, তার ভেতরে হালালও আছে এবং হারামও আছে। সুতরাং তোমরা মহান আল্লাহর দাসত্ব করো এবং তাঁর সাথে কারো শরীক করো না। সত্যিকার অর্থেই আল্লাহ তা'য়ালাকে ভয় করো। তোমরা যে কথা বলবে তা কাজে পরিণত করবে। এভাবে আল্লাহ তা'য়ালার কাছে সত্যবাদী হবে। মহান আল্লাহর রহমত দিয়ে একে অপরের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করলে তিনি নারাজ হন'।
বিশ্বনবী (সা:) তাঁর ভাষণে একটি কথা এভাবে বলেছেন যে, 'তোমাদেরকে যা কিছু দান করা হয়েছে তার ভেতর যেমন হালাল আছে এবং হারামও আছে, সুতরাং তোমরা আল্লাহ তা'য়ালার দাসত্ব করো এবং তাঁর সাথে কারো শরীক করো না'। এ কথার তাৎপর্য হলো, হারাম হালাল তথা যাবতীয় বিষয়ে মহান আল্লাহ তা'য়ালা যে বিধান দান করেছেন তাই অনুসরণ করবে। এ ব্যাপারে অন্য কারো বিধান অনুসরণ করবে না। যদি করো তাহলে যার বিধান অনুসরণ করবে তাকে স্রষ্টার আসনে বসানো হলো, আর এটাই শিরক করা। এই শিরক থেকে মুসলিমগণ নিজেদেরকে অবশ্যই রক্ষা করবে।
নবী করীম (সা:) এর হিজরতকালে মদীনায় তিন শ্রেণীর মানুষ ছিল। মদীনায় এক শ্রেণীর মানুষের অস্তিত্ব তখন পর্যন্ত ছিল যারা মদীনারই অধিবাসী এবং মূর্তিপূজক। অন্য স্থান থেকে ইয়াহুদীরা এসে মদীনায় বাসস্থান গড়ে তুলেছিল। আর মক্কা থেকে হিজরতকারী মুসলমানরা এবং মদীনার আনসাররা। যাদের মধ্যে চিন্তার ঐক্য ছিল না। মূর্তিপূজকদের চিন্তা চেতনা ছিল এক ধরনের, ইয়াহুদীদের চিন্তা ছিল আরেক ধরনের আর মুসলমানদের চিন্তা ছিল সে সময় সমগ্র পৃথিবীর অন্য মানুষদের চিন্তা থেকে ভিন্ন।
এই তিন গোষ্ঠীকে একত্রিত করে তাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তি কাজে লাগিয়ে একটি শক্তিশালী জাতিতে পরিণত করা এবং বিশ্বের মানচিত্রে একটি অজেয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে নবী করীম (সা:) মনোনিবেশ করলেন। মদীনায় যে সকল মূর্তিপূজক ছিল তাদের শক্তি ক্রমশঃ ক্ষয় হয়ে আসছিল। কারণ প্রতিদিনই দু'একজন করে ইসলাম গ্রহণ করছিল, ফলে তাদের সংখ্যা ক্রমশঃ হ্রাস পাচ্ছিল। ইয়াহুদীরা যদিও ইসলাম এবং মুসলমানদের শত্রু ছিল তবুও তারা প্রকাশ্যে শত্রুতা করতে সাহস পেত না।
নবী করীম (সা:) ইসলামী বিধান পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে মূর্তিপূজক এবং ইয়াহুদীদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের আহ্বান করে একটি বৈঠক করলেন। কোনো বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি মদীনার ভেতরের এবং আশেপাশের সকল গোত্রপতিদের আহ্বান করেছিলেন সে বৈঠকে। তিনি তাদের কাছে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন এবং অভ্যন্তরীণ সাম্প্রদায়িক ঐক্য ও সম্প্রীতির প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করলেন। দীর্ঘ আলোচনার পর সকলের সম্মতির ভিত্তিতে একটি ঘোষণাপত্র বা সনদপত্র প্রস্তুত করা হয়।
সে সনদ পত্রে প্রথমেই লেখা হলো মুহাজির, আনসার ও অন্য মুসলমানদের সম্পর্ক, তাদের অধিকার এবং দায়িত্ব কর্তব্য, বিচার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন দিক। গুরুত্বসহকারে একটি কথা লেখা হলো, 'সকল বিষয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার থাকবে নবী করীম (সা:) এর এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর ইখতিয়ারে'।
ইয়াহুদীদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ঘোষণা, সকল গোত্রের ধর্মীয় স্বাধীনতার ঘোষণা এবং তাদের সম্পদের মালিকানার প্রতি স্বীকৃতি ইত্যাদী বিষয় সম্পর্কে ঘোষণা করা হলো। সকল গোত্র বা সম্প্রদায়ের ওপর প্রযোজ্য পরিকল্পিত এই সাধারণতন্ত্রের সংবিধানে সকল গোত্রের প্রতিনিধিবর্গ নিজ নিজ নাম স্বাক্ষর করেন। আমরা সে ঘোষণাপত্র বা সনদপত্রের বিস্তারিত বিবরণ সীরাতে ইবনে হিশাম থেকে উদ্ধৃত করলাম।
0 Comments