মহাকাশে সূর্যের পরিণতি

        বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুসারে সূর্য হলো মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ২০ হাজার কোটি তারকার মধ্যে একটি মাঝারি মানের তারকা হলো সূর্য এবং এটাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এই সৌরজগৎ। সৌরজগতে যতো বস্তু আছে তার ৯৯ দশমিক ৮৫ ভাগই রয়েছে সূর্যের দখলে। সৌরজগতের ভেতরের দিকের গ্রহগুলোকে বলা হয় ইনার প্লানেট এবং তুলনামূলকভাবে এরা আয়তনে ছোট। সৌরজগতের প্রাণকেন্দ্র সূর্যের প্রভাব বলয় বিশাল এবং এই প্রভাব বলয়ভুক্ত অঞ্চলকে বলা হয়ে থাকে হেলিওস্ফেয়ার। আর এর সীমান্ত রেখাকে বলা হয় হোলিওপজ। বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুসারে সূর্য থেকে হোলিওপজ-এর দূরত্ব ১শ' এ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট বা জ্যোতির্বিদ্যা একক। ১ এ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট সমান ১৫ কোটি কিলোমিটার বা ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল। অর্থাৎ সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বকেই এক জ্যোতির্বিদ্যা একক বলা হয়।


        মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কয়েকটি সর্পিল বাহু রয়েছে। তেমনই একটি বাহুতে আমাদের সৌরজগতের অবস্থান। সৌরজগৎ অবস্থান করছে মিল্কিওয়ের নিরক্ষীয় তল থেকে ২০ আলোকবর্ষ ওপরের দিকে। আর গ্যালাক্সি কেন্দ্র থেকে সৌরজগতের দূরত্ব ২৮ হাজার আলোকবর্ষ। সূর্য আকাশের বুকে জ্বলন্ত এক অগ্নিকুন্ড। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর ভেতরে দান করেছেন বিপুল শক্তি, বিশাল আয়তন আর তীব্র গতি। এ কারণে সূর্য লাভ করেছে এক মহাদানবীয় মর্যাদা। এই সূর্য ভয়ঙ্কর উত্তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে অবিশ্রান্তভাবে আর সেই অগ্নিস্নানে প্রজ্জ্বলিত অবস্থায় প্রতি মুহূর্তে এগিয়ে চলেছে বিশাল একটি জগৎ বিকাশ আর সমৃদ্ধির বিস্ময়কর সোপানে। আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে সূর্য তাপের কারণেই পৃথিবীর সমস্ত কিছু সজীব রয়েছে। সূর্য মানেই জীবন ও সৃষ্টির উৎস। সূর্যহীনতায় এই সমৃদ্ধজগৎ পরিণত হবে প্রাণের স্পন্দনহীন এক মহাঅন্ধকার জগতে।

        মহাজগতের বিচারে সূর্য এক অতি তুচ্ছ একটি তারকা। কারণ এর থেকে কয়েক কোটি গুণ বিশালাকৃতির সূর্য আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন অন্যান্য গ্যালাক্সির ভেতরে এবং বর্তমান দৃশ্যমান সূর্যের মতো তিনকোটি সূর্যকে ঐসব সূর্য চুষে খেয়ে হজম করার ক্ষমতা রাখে। পৃথিবীর শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মানব সভ্যতা বিকাশের জন্য যে শক্তি ব্যয় করা হয়েছে, বর্তমান সূর্য তার কক্ষপথে ঘুরতে প্রতি সেকেন্ডে সেই শক্তি ব্যয় করে থাকে। শুধু তাই নয়, এই জ্বলন্ত সূর্যের সম্মুখ ভাগ থেকে এক প্রকার জ্বালানি গ্যাস নির্গত হয়। বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছে 'স্পাইকোল'। এই গ্যাস প্রতি সেকেন্ডে ষাট হাজার মাইল বেগে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, রেরিয়ে যাচ্ছে। এই স্পাইকোল গ্যাস যদি পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করত, তবে গোটা পৃথিবী জ্বলে পুড়ে ভগ্ন হয়ে যেত। কিন্তু প্রতি সেকেন্ডে ষাট হাজার মাইল বেগে যে গ্যাস বের হচ্ছে-কোন এক অদৃশ্য শক্তি ষাট হাজার মাইল বেগে সে গ্যাসকে আবার সূর্যের দিকে ফিরিয়ে দিচ্ছে যেন সৃষ্টিজগৎ কোন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

        সৌর জগতের মোট ভরের ৯৯. ৮৫ শতাংশই সূর্যের। সূর্যের ভর হলো আমাদের পৃথিবীর ভরের ৩ লক্ষ ৩২ হাজার ৮ শ' গুণ। আ সূর্যের ব্যাস হলো পৃথিবীর ব্যাসের ১০৯ গুণ অর্থাৎ ১৩ লক্ষ ৯০ হাজার কিলোমিটার। সূর্য পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৫৮০০ ডিগ্রি কেলভিন এবং কেন্দ্রের তাপমাত্রা ১ কোটি ৫৬ লক্ষ কেলভিন। বিশাল সৌরজগতের মোট ভরের ৯৯ দশমিক ৮ শতাংশের বেশি ভর হচ্ছে সূর্যের। সূর্যের মোট ভরের ৭৫ শতাংশ হলো হাইড্রোজেন এবং বাকি ২৫ শতাংশ হিলিয়াম। সূর্যের মোট অণুর সংখ্যা হিসাব করলে এর ৯২ দশমিক ১ শতাংশ হলো হিলায়াম। হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম ছাড়া আরেকটু ভারী পদার্থের পরিমাণ সূর্যে দশমিক ১ শতাংশ। সূর্য অবিরত মিল্কিওয়ের কেন্দ্রকে যেমন প্রদক্ষিণ করে চলেছে তেমনি নিজেও অবিরাম নিজ অক্ষে লাটিমের মতোই ঘুরছে।

        প্রতি সেকেন্ডে সূর্য থেকে ৩৮৬ বিলিয়ন মেগাওয়াট শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে। এই পরিমাণ হাইড্রোজেন পুড়ে উৎপন্ন হয় ৬৯ কোটি ৫০ লক্ষ টন হিলিয়াম এবং গামারে'র আকারে ৫০ লক্ষ টন শক্তি। উৎপাদিত এই শক্তি কেন্দ্র ছেড়ে যতই বাইরে দিকে বেরিয়ে আসতে থাকে ততই সেই শক্তি মহান আল্লাহর কুদরতি ব্যবস্থার কারণে শোষিত হতে থাকে এবং তা থেকে ষিকীর্ণ তাপমাত্রা হ্রাস পেতে থাকে। সূর্যের বাইরের দিককে বা পৃষ্ঠদেশকে বলে ফটোস্ফিয়ার। এই এলাকার তাপমাত্রা ৫ হাজার ৮ শ' কেলভিন। গ্যালাক্সি কেন্দ্র থেকে প্রায় ৩০, ০০০ আলোকবর্ষ দূরবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত সূর্য ছায়াপথের নিজস্ব সঞ্চালন প্রক্রিয়ায় প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার অর্থাৎ ১৫৬ মাইল বেগে ধাবিত হচ্ছে। সূর্যের এই প্রচন্ড গতিই তাকে ক্রমশঃ ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

        বিজ্ঞানীগণ বলছেন, সূর্য তার সমস্ত হাইড্রোজেন জ্বালানি এক সময় শেষ করে ফেলবে এবং ক্রমশঃ তা শেষ হয়ে যাচ্ছে, সূর্যের অন্তিমকাল ঘনিয়ে আসছে। এক সময় তার গতি থাকবে না, তেজ থাকবে না, তখন সে ধ্বংস হয়ে যাবে। হাইড্রোজেন জ্বালানি শেষ হয়ে গেলেই সূর্যের পরিসমাপ্তি ঘটবে লাল দানবে (Red giant)। নক্ষত্রের বিলয় প্রক্রিয়ায় এই লাল দানবের অভ্যন্তরে জ্বালানি সংকট, অভিকর্ষ বলের প্রভাব তখন কার্যকর হবে ধ্বংস পতন ঘটিয়ে। এই ধ্বংস পতনের কেন্দ্রবিন্দুতে চাপজনিত কারণে পরিণামে সৃষ্টি হবে একটি সাদা বামন। শীতল, অনুজ্জ্বল, নির্জীব ও অত্যধিক ঘনত্বসম্পন্ন সূর্য সাদা বামনাকৃতি লাভ করবে, তখন তা মহাজাগতিক উচ্ছিষ্টে পরিণত হবে এবং তখনই সূর্য চিরতরে হারিয়ে যাবে মানুষের দৃষ্টির বাইরে।

        এই অবস্থার দিকেই নির্দেশ করে আল্লাহর কোরআন বলছে, সূর্যকে গুটিয়ে ফেলা হবে অর্থাৎ সূর্যকে এমন অবস্থায় উপনীত করা হবে যে, ভার আলো ও উত্তাপ বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। সূর্যে আলো এবং উত্তাপ থাকবে না ফলে এই পৃথিবীতে প্রাণের স্পন্দনও থাকবে না, কোন উদ্ভিদ সৃষ্টি হবে না, নদী-সমুদ্রের পানি বাষ্পে পরিণত হয়ে মেঘমালায় পরিণত হবে না, বৃষ্টি বর্ষণও হবে না। স্বাভাবিকভাবেই সমস্ত সৃষ্টির অন্তিম দশা ঘনিয়ে আসবে। সূর্যের মতই অন্যান্য গ্রহ, নক্ষত্র, নিহারিকা পুঞ্জের অভ্যন্তরে যে জ্বালানি শক্তি রয়েছে এবং যার কারণে তা উজ্জ্বল দেখায়, এসব জ্বালানি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এক সময় তা অন্ধকারের বিবরে হারিয়ে যাবে। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে বর্তমানে যে যার অবস্থানে রয়েছে। সেদিন মাধ্যাকর্ষন শক্তিকে অকার্যকর করে দেয়া হবে। তখন সমস্ত কিছুই ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়তে থাকবে।

Post a Comment

0 Comments