নবী করীম (সা:) অষ্টম হিজরী সনের রমজান মাসের দশ তারিখে মদীনা থেকে মক্কা অভিযানে বের হলেন। তিনি ইতোপূর্বে এমন বর্ণাঢ্য সাজে কোনো অভিযানেই বের হননি। মক্কা অভিযানে তিনি এমন সুসজ্জিত অবস্থায় বের হলেন, যেন ইসলামের শত্রুদের কলিজায় কম্পন জাগে। দশ হাজার সুসজ্জিত বাহিনী আল্লাহ তা'য়ালার রাসূলের সাথে। রাসূল (সা:) এগিয়ে যাচ্ছেন তাঁর মাতৃভূমির দিকে। যেখান থেকে একদিন তিনি অশ্রু বিসর্জন দিয়ে বের হয়ে এসেছিলেন। কা'বাঘরের দিকে তাকিয়ে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, 'হে কা'বা! তোমার নিষ্ঠুর সন্তানরা আমাকে থাকতে দিল না'। তিনি বিশাল এক বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। এবার আর জনমানবহীন প্রান্তর দিয়ে নয়, জনপদ দিয়েই তিনি তাওহীদের বিজয় কেতন উড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিটি জনপদ থেকেই পতাকাসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী তাঁর নেতৃত্বাধীন মিছিলে যোগ দিয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি করছে। বিশাল এক জনসমুদ্র তরঙ্গের ওপরে তরঙ্গ সৃষ্টি করে মক্কার দিকে প্রবল বেগে এগিয়ে চলেছে। বিভিন্ন গোত্রের দু'একজন তখন পর্যন্ত ইসলামের প্রতি শত্রুতা পোষণ করতো, তারা চক্ষু বিষ্ফোরিত করে তাওহীদের এই তরঙ্গ দেখছে।
নবী করীম (সা:) মক্কার অনতিদূরে মাররুজ জাহরান নামক এলাকায় এসে যখন উপনীত হলেন রাতের নিকষ কালো অন্ধকার সমগ্র পরিবেশের ওপর অবগুণ্ঠন টেনে দিয়েছে। সেখানেই তিনি যাত্রা বিরতি করে সৈন্যবাহিনীকে শিবির স্থাপন করতে আদেশ দিলেন। অসংখ্য তাঁবু স্থাপন করা হলো। তিনি আদেশ দিলেন, প্রত্যেক তাঁবুতেই যেন পৃথকভাবে রান্নার আয়োজন করা হয়। এ কারণে প্রতিটি তাঁবুতেই পৃথকভাবে উনুন জ্বালানোর প্রয়োজন হলো। ক্ষণিকের মধ্যেই অগণিত উনুন জ্বলে উঠলো। রাতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে বিশাল প্রান্তর আলোকিত হয়ে উঠলো। সে আলোয় মক্কা নগরী যেন উদ্ভাসিত হয়ে গেল।
ভয়ে আতঙ্কে ইসলাম বিরোধিদের কলিজা যেন কন্ঠনালী দিয়ে বের হয়ে আসার উপক্রম হলো। নবী করীম (সা:) রাতের অন্ধকারে অধিক সংখ্যক উনুন প্রজ্জ্বলিত করার যে আদেশ দিয়েছিলেন, এর পেছনে ছিল সামরিক কৌশল। ইসলামের শত্রুগণ যেন ধারণা করে লক্ষ লক্ষ বাহিনী মক্কার দিকে এগিয়ে আসছে। ঘটেছিলও তাই, কুরাইশরা দেখতো যেন লক্ষ লক্ষ উনুন জ্বলছে। উনুনের সংখ্যা যখন নিরূপণ করা যাচ্ছে না তাহলে সৈন্য সংখ্যা নিশ্চয়ই কয়েক লক্ষ হবে। চরম আতংকে তাদের নিশ্বাস যেন বন্ধ হবার উপক্রমন হলো।
তারা নবী করীম (সা:) এর বাহিনীর সঠিক সংখ্যা জানার জন্য হযরত খাদিজা (রা:) এর ভাইয়ের সন্তান হাকিম ইবনে হিজাম, বুদাইল ইবনে ওরাকা ও তাদের নেতা স্বয়ং আবু সুফিয়ানকে প্রেরণ করলো। তারা ছদ্মবেশে মুসলিম বাহিনীর দিকে এগিয়ে গেলো প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য। ওদিকে বিশ্বনবী (সা:) এর চাচা আব্বাস (রা:) ইসলাম গ্রহণ করলেও তিনি মক্কাতেই অবস্থান করতেন। তিনি যেদিন পরিবার-পরিজনসহ মদীনার দিকে হিজরত করলেন, সেদিনই নবী করীম (সা:) মদীনা থেকে মক্কা অভিযানে বের হলেন। পথে চাচা ভাতিজার সাক্ষাৎ হলো। তিনিও মক্কা অভিযানে শামিল হলেন। হযরত আব্বাস (রা:) ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, যদি এমন কাউকে পেতেন তাহলে তার কাছে সংবাদ প্রেরণ করতেন, সে যেন মক্কায় গিয়ে কুরাইশদের কাছে বলে, যথা সময়ে এসে নবী করীম (সা:) এর কাছে আত্মসমর্পণ করে নিজেদের নিরাপত্তা কামনা করে।
হযরত আব্বাস (রা:) নবী করীম (সা:) এর সাদা খচ্চড়ে আরোহন করে চারদিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিচ্ছিলেন। এমন সময় তাঁর সাথে মক্কার বিখ্যাত নেতা আবু সুফিয়ানের দেখা হলো। তিনি তাঁকে বললেন, 'দেখতে পাচ্ছো তো, আল্লাহর রাসূল (সা:) বিশাল এক বাহিনী নিয়ে এসেছেন। মক্কার কুরাইশরা এবার ধূলার সাথে মিশে যাবে'। আবু সুফিয়ান ব্যগ্র কন্ঠে বললেন, 'আমার মা-বাবা তোমার জন্য কুরবান হোক! এই অবস্থায় কি করতে হবে আমাকে বলে দাও'। হযরত আব্বাস (রা:) বললেন, 'তোমাকে দেখলে নিশ্চয়ই মুসলিম বাহিনী মাথা কেটে নেবে এতে সন্দেহ নেই। তুমি আমার এই খচ্চড়ের পেছনে উঠে বসো। আল্লাহর রাসূল (সা:) এর কাছে চলো। আমি তোমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছি'।
মক্কার ইসলাম বিরোধী কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান, যার দাপটে রণভূমি কেঁপে উঠেছে। সেই নেতা আজ নিজের প্রাণের মায়ায় কোনো কথা না বলে রাসূল (সা:) এর চাচার পেছনে উঠে বসলো। হযরত আব্বাস (রা:) দ্রুত গতিতে খচ্চর ছুটিয়ে নবী করীম (সা:) এর দিকে অগ্রসর হলেন। হযরত উমার (রা:) যে স্থানে উনুন জ্বালিয়ে ছিলেন তার পাশ দিয়েই হযরত আব্বাস (রা:) যাচ্ছিলেন। হযরত উমার (রা:) তাঁকে দেখে বললেন, 'আল্লাহর শোকর যে তিনি তাঁর দুশমনকে আমাদের মধ্যে এনে দিয়েছেন'।
কিন্তু তাঁকে হত্যা করতে হলে নবী করীম (সা:) এর অনুমতি প্রয়োজন, এ কারণে তিনি দ্রুত উঠে নবী করীম (সা:) এর দিকে গেলেন। হযরত আব্বাস (রা:) খচ্চর ছুটিয়ে রাসূল (সা:) এর কাছে উপস্থিত হয়ে আবু সুফিয়ানের প্রাণ ভিক্ষার আবেদন করলেন। হযরত উমার (রা:) ও তাঁকে হত্যার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। নবী করীম (সা:) কোনো পক্ষেই সাড়া দিলেন না। হযরত আব্বাস (রা:) হযরত উমার (রা:) কে বললেন, 'হে উমার! এই লোক যদি তোমার কবিলার হতো তাহলে কি তুমি এতটা কঠোর হতে পারতে?' হযরত উমার (রা:) বললেন, 'আপনি এমন করে বলবেন না। আপনি যেদিন ইসলাম কবুল করেছিলেন, সেদিন আমি যা আনন্দিত হয়েছিলাম আমার পিতা খাত্তাব ইসলাম কবুল করলেও এতটা আনন্দিত হতাম না'।
এই সেই আবু সুফিয়ান, যার নেতৃত্বে নবী করীম (সা:) এর প্রিয় চাচা হযরত হামজা (রা:) কে হত্যা করে তাঁর বুক চিরে কলিজা বের করে চিবিয়ে ছিল আবু সুফিয়ানেরই স্ত্রী হিন্দা। স্বয়ং আবু সুফিয়ান হযরত হামজা (রা:) এর পবিত্র দেহে বর্শার আঘাত করে কটুক্তি করেছিল। তাঁর অতীত কর্ম তৎপরতা সকল মুসলমানের সামনে ছিল স্পষ্ট। অজস্র অপরাধে সে অপরাধী। তাঁর প্রতিটি অপরাধই ছিল মৃত্যুদণ্ডযোগ্য। কিন্তু যাঁর সামনে তিনি নত মস্তকে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি ছিলেন রাহমাতুল্লিল আলামীন। করুণার মূর্ত প্রতীক হিসাবে যিনি পৃথিবীতে আগমন করেছেন। নবী করীম (সা:) আবু সুফিয়ানের দিকে পবিত্র গ্রীবা বাড়িয়ে তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে অভয় দান করলেন, 'কোনো ভয় নেই, এটা ভয়ের জায়গা নয়'। প্রাণের দুশমনদের প্রতি এটাই ছিলো নবী করীম (সা:) এর সীরাত।
বুখারী শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রেফতার বরণের পরপরই আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ঐতিহাসিক আত তাবারী বলেন, আবু সুফিয়ানের সাথে নবী করীম (সা:) এর কিছু কথা হয়েছিল। রাসূল (সা:) তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 'হে আবু সুফিয়ান! এখনো কি তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না যে আল্লাহ তা'য়ালা ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই?' আবু সুফিয়ান বলেছিলেন, 'আজ যদি অন্য কোনো ইলাহ থাকতো, তাহলে তো আমাদের কাজেই আসতো'। নবী করীম (সা:) তাঁকে পুনরায় প্রশ্ন করেছিলেন, 'হে আবু সুফিয়ান আমি যে আল্লাহ তা'য়ালার রাসূল এতে কি তোমার সন্দেহ আছে?' তিনি জবাব দিয়েছিলেন, 'সামান্য একটু সন্দেহ আছে'।
শেষ পর্যন্ত আবু সুফিয়ান ইসলাম কবুল করেছিলেন। নবী করীম (সা:) তাঁকে মর্যাদা দিয়েছিলেন এবং তিনি এক সময় প্রকৃত ঈমানাদার হয়েছিলেন। ইসলামের পক্ষে তিনি যুদ্ধও করেছেন। তায়েফের যুদ্ধে তাঁর একটি চোখ আহত হয়েছিল। ইয়ারমুকের যুদ্ধে উক্ত চোখটি সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মক্কা বিজয়ের দিন নবী করীম (সা:) আবু সুফিয়ানকে লক্ষ্য করে বললেন, 'আপনি মক্কায় গিয়ে ঘোষণা করে দিন, যে ব্যক্তি অস্ত্র ত্যাগ করবে সে নিরাপত্তা লাভ করবে। যে ব্যক্তি কা'বায় আশ্রয় গ্রহণ করবে সে নিরাপত্তা লাভ করবে। যে ব্যক্তি নিজের গৃহের দরোজা বন্ধ রাখবে সে নিরাপত্তা লাভ করবে। আর ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের বাড়িতে থাকবে তারাও নিরাপত্তা লাভ করবে'। অথচ এই আবু সুফিয়ান ওহুদের ময়দানে নবী করীম (সা:) কে হত্যার উদ্দেশ্যে হন্যে হয়ে খুঁজে ছিলো। পক্ষান্তরে আল্লাহর রাসূল (সা:) তাঁকে এত বেশী মর্যাদা দিলেন যে, তাঁর বাড়িতে যারা আশ্রয় গ্রহণ করবে তারাও আজকের এই বিজয়ের দিনে নিরাপত্তা পাবে। তদানীন্তন আরবে কারো বাড়িকে নিরাপত্তার স্থল হিসাবে ঘোষণা দেয়ার অর্থ ছিল তাকে অধিক সম্মান প্রদর্শন করা। নবী করীম (সা:) আবু সুফিয়ানের ক্ষেত্রে তাই করেছিলেন। (ইবনে আল জাওযী, আল মুজতবা, পৃষ্ঠা নং-৮৩)
আবু সুফিয়ান (রা:) মক্কায় গিয়ে জনগণের মধ্যে নবী করীম (সা:) এর ঘোষনা শুনিয়ে দিলেন। তাঁর ঘোষনা শুনে মক্কার কুরাইশরা হতবিহ্বল হয়ে পড়লো। তিনি নিজের সম্পর্কে ঘোষনা দিলেন, 'আজ থেকে আমি তোমাদের আর নেতা নই, আমার পরিচয় শোনো, আমি মুসলমান'।
তাওহীদের সেনাবাহিনী মক্কার দিকে অগ্রসর হতে থাকলো। নবী করীম (সা:) তাঁর প্রিয় চাচা হযরত আব্বাস (রা:) কে বললেন, 'আবু সুফিয়ানকে উচ্চস্থানে দাঁড় করিয়ে দাও, তাওহীদের সেনাবাহিনীর রূপ চেহারা সে দু'চোখ ভরে উপভোগ করুক'।
নবী করীম (সা:) আল্লাহ তা'য়ালার পথের অকুতোভয় সৈনিকদের নিয়ে মক্কা নগরীতে প্রবেশ করছেন, কুরাইশরা ভয়ে আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়লো। কেউ আবু সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করলো, কেউ বা কা'বাঘরে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। কয়েকজন মক্কা ত্যাগ করে পালিয়ে গেল। হযরত আব্বাস (রা:) নও মুসলিম হযরত আবু সুফিয়ান (রা:) কে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলেন। তাওহীদের বিশাল বাহিনী সমুদ্রের তরঙ্গের মতই মক্কা নগরীতে আছড়ে পড়লো।
এক নয়ানভিরাম বিস্ময়কর দৃশ্যের অবতারণা হলো। আরবের বিভিন্ন গোত্র তাদের নিজের গোত্রের পতাকা উড়িয়ে মক্কা নগরীতে প্রবেশ করছেন। প্রতিটি সৈন্যর চেহারায় তাওহীদের দ্যুতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। আল কুরআনের সৈনিকরা আল্লাহু আকবর বলে তাকবীর দিয়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বীর দর্পে কুচকাওয়াজ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। সর্বপ্রথম গিফারী গোত্রের মিছিল সামনের দিকে এগিয়ে গেল। তার পেছনে জুবায়না গোত্র। মহান আল্লাহ তা'য়ালা হুদায়বিয়া সন্ধিকে 'ফতহুম মুবিন' অর্থাৎ প্রকাশ্য বিজয় বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। আজ তার বাস্তব অবস্থা মানুষ দেখতে পাচ্ছে। এরপর বিভিন্ন গোত্রের মিছিল বজ্রকণ্ঠে তাওহীদের শ্লোগানে মক্কা নগরীকে প্রকম্পিত করে এগিয়ে গেল।
নও মুসলিম হযরত আবু সুফিয়ান (রা:) জান্নাতি দৃশ্য দেখতে দেখতে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলেন। তাঁর সাথে ছিলেন নবী করীম (সা:) এর চাচা হযরত আব্বাস (রা:)। সেদিন তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল তাঁরই ওপর। তিনি চিনতে পারছিলেন না, কোনটা কোন্ বাহিনী। হযরত আব্বাস (রা:) এর কাছ থেকে তিনি বিভিন্ন বাহিনীর পরিচয় তিনি জেনে নিচ্ছিলেন।
এবার এগিয়ে এলো বিশাল এক মিছিল নিয়ে সেনাপতি হযরত সায়াদ ইবনে উবায়দা (রা:)। আবু সুফিয়ান (রা:) জিজ্ঞাসা করলেন, 'বর্ণাঢ্য সাজে সজ্জিত এই বিশাল বাহিনীর পরিচয় কি?' হযরত আব্বাস (রা:) বললেন, 'এই বাহিনী মদীনার আনসারদের'।
হযরত উবায়দা (রা:) দেখলেন হযরত আবু সুফিয়ান (রা:) দাঁড়িয়ে আছেন আর তাঁর পাশেই রয়েছেন নবী করীম (সা:) এর প্রিয় চাচা হযরত আব্বাস (রা:)। তাঁকে দেখে তিনি বললেন, 'হে আবু সুফিয়ান! আজকের দিন রক্তপাতের দিন। কা'বাকে আজ উন্মুক্ত এবং বৈধ করে দেয়া হবে'।
অর্থাৎ আজ কা'বা এলাকায় রক্তপাত করা বৈধ। আবু সুফিয়ান বুঝলেন, আজ মক্কা নগরীতে রক্তের প্লাবন বইয়ে দেয়া হবে। তিনি শংকিত হয়ে পড়লেন। তাহলে তাঁর আত্মীয়-স্বজন এবং মক্কার অধিবাসীরা কেউ আজ জীবিত থাকবে না? এমন সময় তিনি দেখলেন নবী করীম (সা:) কে পরিবেষ্টন করে সাহাবায়ে কেরাম বিশাল মিছিল সহকারে মক্কা নগরীতে প্রবেশ করছেন। এই মিছিলের পতাকা ছিল হযরত যুবায়ের ইবনে আওয়াম (রা:) এর হাতে।
হযরত আবু সুফিয়ান (রা:) উচ্চ কন্ঠে বললেন, 'হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আপনি শুনেছেন, উবায়দা কি বলে গেল!'
আল্লাহ তা'য়ালার রাসূল (সা:) জানতে চাইলেন, 'কি বলেছে উবায়দা?'
হযরত আবু সুফিয়ান (রা:) জানালেন, 'উবায়দা বলে গেল আজকের দিন রক্তপাতের দিন। কা'বাকে আজ উন্মুক্ত এবং বৈধ করে দেয়া হবে'।.
নবী করীম (সা:) তাঁকে অভয় দান করে বললেন, 'উবায়দাহ ভুল বলেছে। আজ কা'বা শরীফের মর্যাদা দেয়ার দিন'। অর্থাৎ কোনো রক্তপাত নয়, কা'বাঘরের প্রকৃত যে মর্যাদা আজ সেই মর্যাদা দেয়ার দিন।
পবিত্র মক্কা নগরীতে এক পথে মিছিল প্রবেশ করেনি। বিভিন্ন পথ ধরে মিছিল প্রবেশ করছিল। হযরত খালিদ (রা:) এর নেতৃত্বে এক বিশাল মিছিল নগরীতে প্রবেশ করছিল। বুখারী শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে, বিজয়ী বীর বিশ্বনবী (সা:), যাঁকে এই নগরীর লোকজন অবর্ণনীয় অত্যাচার করেছে। তাদেরই মধ্যে তিনি বিজয়ী বীর হিসেবে প্রবেশ করছেন। অথচ তাঁর চেহারায় গর্ব অহংকারের কোনো চিহ্ন নেই। তাঁর সকল আচরণে ক্ষমা আর মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পাচ্ছে। সুললিত কণ্ঠে তিনি সূরা ফাত্হ্ তিলাওয়াত করছেন। সূরা ফাত্হ-এ বিজয়ের সুসংবাদ দিয়ে হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় নাজিল হয়েছিল।
ইসলাম সম্পর্কে না জেনে অথবা বিদ্বেষ অন্তরে রেখে যারা বলেন, ইসলাম তরবারীর শক্তিতে প্রচার হয়েছে, তারা আজকের এই অভূতপূর্ব দৃশ্য কল্পনার দৃষ্টিতে একবার দেখুন, ইসলাম কোন্ শক্তির কারণে বিজয়ী হয়েছে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফ্ফাল (রা:) বলেন, আমি মক্কা বিজয়ের দিন আল্লাহর রাসূল (সা:)-কে উটের ওপর বসে মধুর কন্ঠে সুরা ফাহ্ পাঠ করতে দেখেছি। হযরত মুআবিয়া ইবনে কুররা (রা:) বলেন, যদি আমার পাশে লোকজন ভীড় করার আশংকা না থাকতো, তাহলে মুগাফ্ফালের মত আমিও আল্লাহর রাসূল (সা:) এর কুরআন তিলাওয়াত শুনতাম। (বুখারী)
নবী করীম (সা:) এর নির্দেশ ছিল, কোনো ধরনের বাধা না এলে কারো প্রতি আঘাত করা যাবে না। কিন্তু কুরাইশদের একটি হঠকারী দল হযরত খালেদ (রা:) এর মিছিলের ওপর আক্রমন করলো। তিনজন সাহাবা শাহাদাতবরণ করলেন। বাধ্য হয়ে হযরত খালেদ (রা:) আক্রমণ করলেন। কুরাইশদের বিভ্রান্ত দলের ১৩ জন নিহত হলো। নবী করীম (সা:) দূর থেকে যুদ্ধের দৃশ্য দেখে খালেদ (রা:) কে তলব করলেন। কৈফিয়ত চাইলেন, কেনো যুদ্ধ শুরু করা হলো। তিনি জানালেন, প্রতিপক্ষ তাদের ওপরে প্রথমে আক্রমন করে তিনজনকে শহীদ করেছে। তখন নবী করীম (সা:) বললেন, 'আল্লাহ তা'য়ালার ইচ্ছা এমনই ছিল'।
নবী করীম (সা:) এর পতাকা হাজুন নামক স্থানে রাখা হলো। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হলো, 'হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আপনি আজ কোথায় থাকবেন? আপনি কি আপনার সেই পুরোনো বাড়িতেই থাকবেন?'
আল্লাহর রাসূল (সা:) বললেন, 'আকীল কি কোনো জায়গা রেখেছে!' তারপর তিনি বললেন, 'ঈমানদার ব্যক্তি কাফিরদের উত্তরাধিকারী হয় না। আর কাফিরও ঈমানদারের উত্তরাধিকারী হয় না'। (বুখারী)
ইসলামী বিধানে কোনো মুসলমান কোনো অমুসলিমের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারে না। নবী করীম (সা:) এর চাচা আবু তালিব যখন ইন্তেকাল করেছিলেন সে সময় হযরত আলী (রা:) এর ভাই আকীল অমুসলিম ছিলেন। তিনি রাসূল (সা:) এর এবং তাঁর পিতার সকল সম্পদ আবু সুফিয়ানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন।
বিশ্বনবী (সা:) নিজের থাকার জন্যে কা'বার ঐ স্থানের কথা বললেন, যেখানে ইসলাম বিরোধিরা ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য একত্রিত হয়ে শপথ গ্রহণ করতো। তিনি মক্কা বিজয়ের সময় মক্কার উচ্চ এলাকা কাদা নামক স্থান দিয়ে প্রবেশ করেছিলেন। তিনি যে উটের আরোহী ছিলেন তাঁর পেছনে বসেছিলেন মৃতার যুদ্ধে শাহাদাতপ্রাপ্ত হযরত যায়িদ ইবনে হারিসা (রা:) এর সন্তান হযরত উসামা (রা:)। বিশ্বনবী (সা:) এর পবিত্র মাথা মুবারকে এ সময় ছিল লোহার শিরস্ত্রাণ।
0 Comments