ভূ-পৃষ্ঠের আবরণ কীজন্য সৃষ্টি করেছেন

        আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সমস্ত প্রাণী জগতের কল্যাণের জন্য ভূ-পৃষ্ঠের আবরণ সৃষ্টি করে টেনে দিয়েছেন বা বিস্তৃত করে দিয়েছেন। কিন্তু এই আবরণের বিষয়টি এতটা সহজ নয়। চিন্তা গবেষণা করলে মাটির এই আবরণটির গঠনের কলা-কৌশল দেখলে সেজদায় মাথানত হয়ে আসে। যমীনকে আল্লাহ কিভাবে বিস্তৃত করেছেন, এ সম্পর্কে মানুষকে বলা হয়েছে, তোমরা চিন্তা করো-গবেষণা করো তাহলেই তোমরা অনুভব করতে সক্ষম হবে, আমি আল্লাহ তোমাদের কেমন রব। সূরা যারিয়াতের ৪৮ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-

وَالْأَرْضَ فَرَشْنَهَا فَنِعْمَ الْمُهِدُونَ 

        এবং আমি ভূমিকে বিছিয়ে দিয়েছি, দেখতো আমি কত চমৎকার করে বিছিয়েছি। আমি আল্লাহ তোমার এমন রব-তুমি না চাইতেই আমি তোমাকে সৃষ্টি করা.. পূর্বেই তোমার কল্যাণের যাবতীয় বস্তু সৃষ্টি করে রেখেছি। দেখতো, আমি তোমার জন্য কত সুন্দর করে সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছি। পৃথিবীর এই যমীনকে তোমার জন্য কি করেছি শোন-

وَالْأَرْضَ مَدَدْنَهَا وَالْقَيْنَا فِيهَا رَوَاسِي وَأَنْبَتْنَا فِيهَا مِنْ كُلِّ شَيْءٍ مَّوْزُون

        আমি যমীনকে বিস্তৃত করেছি, তারপর এর ওপরে পাহার গেড়ে দিয়েছি, তারপর যমীনের ওপরে নব ধরনের উদ্ভিদ দান করেছি এবং এসব উদ্ভিদ যেখানে যতটুকু প্রয়োজন, সেখানে ততটুকুই দান করেছি। (সূরা হিজর-১৯)

        গোলাকার উত্তপ্ত পৃথিবীর পৃষ্ঠ মাটির স্তর দিয়ে ঢেকে দিয়ে বা বিস্তৃত করে দিয়ে যথাযথ উষ্ণতা, পানি, বায়ু ইত্যাদি সৃষ্টি করে আল্লাহ পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী করেছেন। ভূ-পৃষ্ঠের মাটির ভেতরে আল্লাহ স্তর সৃষ্টি করেছেন বা বিছানার মতো করে বিছিয়ে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ فِرَاشًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً

        তোমাদের জন্য মাটিকে বিছানা ও আকাশকে ছাদ করেছেন। (সূরা বাকারাহ্-২২) সূরা ত্বাহায় আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন- الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ مَهْدًا তোমাদের জন্য মাটিকে বিছানা করেছেন। (সূরা ত্বাহা-৫৩)

        সূরা নূহের ১৯ আয়াতেও বলেছেন, মাটিকে তোমাদের জন্য আমি বিছানা হিসেবে বিছিয়ে দিয়েছি। তোমাদের কল্যাণের জন্য আমি এই ব্যবস্থা করেছি, সুতরাং আমার দেয়া বিধান ত্যাগ করে কেনো তোমরা অন্যের রচিত বিধান অনুসরণ করছো? আল্লাহ তা'য়ালা বলেন- أَلَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ مِهْدًا মাটিকে তোমাদের জন্য বিছানা হিসেবে বিছিয়ে দিয়েছি, তা কি তোমরা দেখতে পাও না?

ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে

        আল্লাহর আদেশে বৃষ্টি বর্ষিত হতে থাকে। কোন একটি ধূলি কণাও যেন শুষ্ক না থাকে মহান আল্লাহ সে ব্যবস্থা করেন। গাছ ফলে-ফুলে সুশোভিত হবে-এ জন্য প্রয়োজন হয় কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম ইত্যাদি। আল্লাহ হলেন রাব্বুল আলামীন-তিনি এসবের ব্যবস্থা করেন। বৃক্ষ-তরুলতা বায়ুমন্ডলে থাকা কার্বনডাই-অক্সাইড থেকে কার্বন সংগ্রহ করে, বায়ুমন্ডল মাটি ও পানি থেকে হাইড্রোজেন সংগ্রহ করে এবং বায়ুমন্ডল ও পানি থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করে। এছাড়াও নানা পদার্থসমূহ মাটি থেকে সংগ্রহ করে। এসব ব্যবস্থা যিনি করেছেন তিনিই হলেন রাব্বুল আলামীন।

        এই পৃথিবীকে তিনি প্রাণীকুলের জন্য বাসোপযোগী করেছেন। বিজ্ঞানীগণ বলেছেন, এই পৃথিবী আকৃতিতে গোলাকার। পৃথিবীর কেন্দ্রস্থ অঞ্চল উত্তপ্ত অবস্থায় রয়েছে। কেন্দ্রস্থ এলাকার উষ্ণতা সবচেয়ে বেশি এবং ওপরের দিকের উষ্ণতা ক্রমশঃ কমে এসেছে। পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ শিলা, বালি ও মাটি দিয়ে গঠিত। এই ভূ-পৃষ্ঠের নিচে মহান আল্লাহ নানা ধরনের খনিজ সম্পদ দিয়ে ভরপুর করে দিয়েছেন। আবার ওপরের দিকে রয়েছে নদী, সাগর, মহাসাগর এবং বনজসম্পদ। নদী-সাগর-মহাসাগরের গর্ভে আল্লাহ তা'য়ালা মানুষের কল্যাণের জন্য অগণিত সম্পদ দান করেছেন। বনজ সম্পদ শুধু মানুষেরই কল্যাণে আসে না, সমস্ত প্রাণীকুল বনজ সম্পদ থেকে যেন উপকৃত হতে পারে, মহান আল্লাহ সে ব্যবস্থাও করেছেন।

        পৃথিবীর ওপরে শূন্যমার্গে বায়ুমন্ডল দিয়ে আবৃত করা রয়েছে। মাটি, পানি ও বায়ুমন্ডল সৃষ্টি করেছেন বলে এই পৃথিবী মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য বসবাসোপযোগী হয়েছে। এই পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ সম্পর্কে আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন-

اللهُ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الأَرْضَ قَرَارُهُ السَّمَاءَ بِنَاءً وَصَوَّرَكُمْ فَأَحْسَنَ صُورَكُمْ وَرَزَقَكُمْ مِّنَ الطَّيِّبَتِ ذَالِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ فَتَبْرَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ

        আল্লাহই তোমাদের জন্য এই পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী করেছেন এবং ওপরে আকাশের গম্বুজ নির্মাণ করেছেন, যিনি তোমাদের প্রতিকৃতি রচনা করেছেন, অত্যন্ত সুন্দর করে বানিয়েছেন, যিনি তোমাদেরকে পবিত্র জিনিস সমূহের রিস্ক দান করেছেন। তিনিই আল্লাহ এসব কাজ যিনি নিপুণভাবে সম্পাদন করেছেন তিনি তোমাদের রব, অসীম অপরিমেয় বরকতওয়ালা বিশ্বলোকের সেই রব।

        আল্লাহ তা'য়ালা শুধু এই পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগিই করেননি, এই পৃথিবীকে মানুষের জন্য শয্যা বানিয়েছেন, পৃথিবীতে মানুষের জন্য অসংখ্য কল্যাণের পথ সৃষ্টি করেছেন। সূরা যুখরুফের ৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-

الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضِ مَهْدًا وَجَعَلَ لَكُمْ فِيهَا سُبُلاً لَّعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ 

        যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে করেছেন শয্যা এবং সেখানে তোমাদের কল্যাণের জন্য পথ করে দিয়েছেন যেন তোমরা নিজেদের গন্তব্যস্থলের সন্ধান লাভ করতে সক্ষম হও। (সূরা যুখরুফ-৯)

ভূপৃষ্ঠের কম্পন

        মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে ডেকে বলেন, আমার সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে দেখতো, আমি কী ভাবে সৃষ্টি করেছি। সূরা লুকমানের ১০ নং আয়াতে বলা হচ্ছে-

 خَلَقَ السَّمَوَات بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا وَالْقَى فِي الْأَرْضِ رواسي أَنْ تَمِيدَ بِكُمْ وَبَثَّ فِيهَا مِنْ كُلِّ دَابَّةٍ وَأَنْزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَنْبَتْنَا فِيهَا مِنْ كُلِّ زَوْجٍ كَرِيمٍ 

        তোমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখো, তিনি আকাশ মন্ডল সৃষ্টি করেছেন কোন ধরনের স্তম্ভ ব্যতিতই, তিনি যমীনের বুকে পর্বতমালা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে স্থাপন করে দিয়েছেন, যেন যমীন তোমাদেরকে নিয়ে হেলে না যায়। তিনি সব ধরনের জীব-জন্তু যমীনের বুকে বিস্তার করে দিয়েছেন, আকাশ থেকে পানি বর্ষিয়েছেন এবং যমীনের বুকে রকমারী উত্তম জিনিসসমূহ উৎপাদন করেছেন।

        এসব আয়াতে 'কাঁপা' বা 'হেলে' যাওয়া শব্দ দিয়ে আমরা যে মাটির ওপরে অবস্থান করছি সেই মাটিকে বা পৃথিবী পৃষ্ঠকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু এসব আয়াত থেকে গোটা ভূ-পৃষ্ঠের কম্পন বা আন্দোলিত হবার কথা বুঝানো হয়নি। বরং গোটা পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ আন্দোলিত না হয়েও ভূ-পৃষ্ঠের যে কোন স্থান যে কোন মুহূর্তে আন্দোলিত হতে পারে। কারণ আমরা দেখতে পাই যে, পৃথিবীর একটি দেশে ভূমিকম্প হলে অন্য দেশ তা অনুভব করতে পারে না। আবার একটি দেশের ভেতরেও একটি বিশেষ এলাকায় ভূমিকম্প অনুভূত হয় কিন্তু পার্শ্ববর্তী এলাকায় তা অনুভূত হয় না। সুতরাং এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, ভূ-পৃষ্ঠের কম্পন হওয়ার জন্য পৃথিবীর গোটা ভূ-পৃষ্ঠ কাঁপার প্রয়োজন হয় না। ভূমিকম্পের কারণে স্থানীয়ভাবে ভূ-পৃষ্ঠের কম্পন হয় এবং সেই কম্পন দূরবর্তী কোন স্থানকে প্রভাবিত নাও করতে পারে-সাধারণত এটা করে না তাই আমরা দেখতে পাই। আল্লাহ তা'য়ালা যদি পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি না করতেন তাহলে ভূ-পৃষ্ঠের এই স্থানীয় কম্পন বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতো এবং ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধিলাভ করতো। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

 وَجَعَلْنَا فِي الْأَرْضِ رَوَاسِي أَنْ تَمِيدَ بِهِمْ 

        আমি ভূ-পৃষ্ঠে পাহাড়-পর্বত স্থাপন করে দিয়েছি যেন ভূ-পৃষ্ঠ তাদের নিয়ে কাঁপতে না পারে। 
(সূরা আম্বিয়া-৩১)

        রেল লাইনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে আমরা দেখতে পাই যে, ইস্পাত নির্মিত পাতগুলোর নিচে রয়েছে অনেকগুলো ইস্পাতের পাত বা মোটা কাঠ। এগুলোর সাথে লোহার মোটা গজাল দিয়ে রেল লাইনগুলো অত্যন্ত মজবুতভাবে এঁটে দেয়া হয়েছে যেন ট্রেন চলাচলের সময় তা নড়াচড়া করতে না পারে। তেমনি আল্লাহ তা'য়ালা পাহাড়-পর্বতগুলো গজালের ন্যায় ভূ-পৃষ্ঠের গভীরে গেঁথে দিয়েছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-- وَالْجِبَالَ أَوْتَادًا আর পাহাড়গুলো গ্রাফীর ন্যায় গেঢ়ে দিয়েছি। 
(সূরা নাবা-৭)

        গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, পাহাড়-পর্বতের উচ্চতা ভূ-পৃষ্ঠের ওপরে যত পরিমাণ দৃষ্টিগোচর হয় তারচেয়েও অনেক বেশী মাটির অতলদেশে প্রোথিত রয়েছে। কোন পর্বতমূল ভূ-গর্ভের কতটা গভীরে প্রোথিত রয়েছে তা নির্ভর করে সেই পর্বতটির সৃষ্টির সূচনা কিভাবে হয়েছিল। অর্থাৎ আগ্নেয়গিরির লাভার মাধ্যমে তা সৃষ্টি হয়েছে না অন্য কোনভাবে। গড় হিসেবে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১০ থেকে ১৫ মাইল পর্যন্ত পুরু বা মোটা হতে পারে। এ কারণে পর্বতের মাটির নিচের মূল অংশ ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১০ থেকে ১৫ মাইল গভীরে প্রোথিত থাকতে পারে। এরচেয়ে অধিক গভীরে অতিরিক্ত উত্তাপের কারণে পদার্থগুলো গলিত অবস্থা প্রাপ্ত হয়। আমরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখতে পাই, পাহাড়-পর্বতসমূহ ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ওপরের দিকে উত্থিত হয়ছে এবং নিচের দিকেও বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে। সুতরাং পাহাড়-পর্বতগুলো ভূ-পৃষ্ঠে গজালের ন্যায় বিদ্ধ হয়ে রয়েছে, আল্লাহ তা'য়ালা এ ব্যবস্থা করেছেন। আল্লাহ বলেন-

وَالْجِبَالَ أَرْسَهَا مَتَاعًا لَّكُمْ وَلَأَنْعَامِكُمْ 

        আল্লাহ ভূ-পৃষ্ঠে পর্বত প্রোথিত করে দিয়েছেন, জীবিকার সামগ্রী হিসেবে তোমাদের জন্য এবং তোমাদের পশুর জন্য। (সূরা নাযিয়াত-৩২-৩৩)

        আল্লাহ তা'য়ালা পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি করেছেন এবং এগুলোর সঠিক অবস্থান দান করেছেন। পর্বতের এই সঠিক অবস্থিতির কারণে বাতাস তথা মেঘের গতি নিয়ন্ত্রিত হয় এবং বৃষ্টি বর্ষণে সহায়ক হয়। পাহাড়-পর্বত থেকে প্রবাহিত নদ-নদীর পানি প্লাবিত হয়ে কৃষি কাজের জন্য মাটির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধিলাভ করে। নদ-নদীর পানি নিয়ন্ত্রিত করে দূর-দূরান্তে পানির সরবরাহ করা সম্ভব হয় এবং পানিবিদ্যুৎ উৎপন্ন করে মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়। এভাবে নানা ধরনের খাদ্য সামাগ্রী উৎপন্ন হচ্ছে এবং তা মানুষ ও প্রাণীকুলের আহার যোগাচ্ছে। এগুলো যিনি সম্পাদন করেছেন তাঁর নামই হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। কোরআন ঘোষণা করছে-

وجَعَلَ فِيهَا رَوَاسِي وَأَنْهُرًا 

        এবং তিনি ভূ-পৃষ্ঠে পর্বতমালা ও নদী সৃষ্টি করেছেন। (সূরা রা'দ-৩)

Post a Comment

0 Comments