যাকাতের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ শর্তাবলী কী কী

        বাহ্যিক শর্তাবলী: উল্লেখ্য, যাকাতদাতা ব্যক্তি কয়েকটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখবে।

     প্রথমতঃ মনে মনে ফরয যাকাত দেয়ার নিয়ত করা। অমুক অমুক মালের যাকাত দেই- এরূপ নির্দিষ্ট করা জরুরী নয়। ওলীর নিয়ত উন্মাদ ও অপ্রাপ্ত বয়স্কের নিয়তের স্থলবর্তী হবে। তদ্রূপ শাসনকর্তার নিয়ত মালের মালিকের নিয়তের স্থলাভিষিক্ত হবে- যদি মালের মালিক যাকাত না দেয়। কিন্তু এটা দুনিয়ার বাহ্যিক বিধান। আখেরাতে সে দাবী থেকে মুক্ত হবে না যে পর্যন্ত নতুনভাবে যাকাত না দেয়। যাকাত দেয়ার জন্য কাউকে উকিল করা হলে এবং তখন নিয়ত করে নিলে অথবা উকিলকে নিয়তেরও উকিল করা হলে যথেষ্ট হবে। কেননা, নিয়তের জন্যে উকিল করাও নিয়ত। দ্বিতীয়তঃ বছর পূর্ণ হয়ে গেলে তড়িঘড়ি যাকাত দেয়া উচিত। সদকায়ে ফেতর ঈদের দিন থেকে বিলম্বিত করা উচিত নয়। যেব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও মালের যাকাত দিতে বিলম্ব করে, সে গোনাহগার হবে। এর পর যদি তার মাল বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং যাকাতের প্রাপককে পাওয়ার সামর্থ্য থাকে, তবে যাকাত তার যিম্মায় থেকে যাবে। যদি যাকাতের প্রাপক না পাওয়ার কারণে বিলম্ব হয় এবং ইতিমধ্যে মাল বিলুপ্ত হয়ে যায় তবে যাকাত যিম্মায় থাকবে না। বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেও যাকাত দেয়া জায়েয যদি মাল নেসাব পরিমাণে হয়ে যায়। দু'বছরের যাকাত অগ্রিম দেয়াও জায়েয। অগ্রিম যাকাত দিলে যদি যাকাত গ্রহীতা মিসকীন বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে মারা যায় অথবা দর্মত্যাগী হয়ে যায় অথবা অন্য কোন মাল প্রাপ্তির কারণে ধনী হয়ে যায়, অথবা মালের মালিকের মাল বিলুপ্ত হয়ে যায়, তবে যা কিছু সে অগ্রিম দিয়েছিল তা যাকাতরূপে গণ্য হবে না। দেয়ার সময় ফিরিয়ে দেয়ার শর্ত যোগ করে না থাকলে এটা ফেরত লওয়াও সম্ভবপর নয়। কাজেই মালের মালিককে অবশ্যই পরিণতির দিকে লক্ষ্য রেখে অগ্রিম যাকাত দিতে হবে।


        তৃতীয়তঃ যাকাতস্বরূপ যে মাল ওয়াজেব হয়, তার বিনিময়ে মূল্য দিতে পারবে না; বরং যে মাল ওয়াজেব হয় তাই দেবে। এমনকি, স্বর্ণের বিনিময়ে রূপা এবং রূপার বিনিময়ে স্বর্ণ দেবে না, যদিও মূল্য বাড়িয়েই দেয়া হয়। সম্ভবতঃ যারা ইমাম শাফেয়ীর উদ্দেশ্য বুঝে না, তারা এ ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শন করে। তারা কেবল দেখে, ফকীরের অভাব দূর করাই উদ্দেশ্য। অথচ এটা প্রকৃত জ্ঞানের কথা নয়। কেননা, ফকীরের অভাব দূর করা যাকাতের উদ্দেশ্য ঠিকই; কিন্তু এটা পূর্ণ উদ্দেশ্য নয়; বরং উদ্দেশ্যের একটি অংশ মাত্র। শরীয়তের ওয়াজেব বিষয়সমূহ তিন প্রকার। এক, নিছক এবাদত। এতে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের কোন দখল নেই। উদাহরণতঃ হজ্জে কংকর নিক্ষেপ করা। এতে কাজটি শুরু করাই শরীয়তের উদ্দেশ্য, যাতে বান্দা তার দাসত্ব ও গোলামী এমন কাজ দ্বারা প্রকাশ করে, যার অর্থ বোধগম্য নয়। কেননা, যে কাজের অর্থ বোধগম্য, তা সম্পাদনে মানুষের মনও সাহায্য করে। ফলে তাতে খাঁটি দাসত্ব প্রকাশ পায় না। কারণ একমাত্র মাবুদের আদেশের কারণেই কর্ম সম্পাদন করাকে দাসত্ব বলা হয়। হজ্জের অধিকাংশ ক্রিয়াকর্ম এমনি ধরনের। এ কারণেই রসূলে আকরাম (সাঃ) স্বীয় এহরামে এরশাদ করেন:

لبيك لحجة حقا تعبدا ورقا .

        আমি উপস্থিত আছি দাসত্বস্বরূপ হজ্জের জন্যে। অর্থাৎ, এ এহরাম কেবল আনুগত্যের মাধ্যমে দাসত্ব প্রকাশ করা এবং যেভাবে আদেশ হয়েছে তা মেনে নেয়া এমন কোন যুক্তি ব্যতিরেকে, যা এ আদেশ পালনে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। দ্বিতীয় প্রকার ওয়াজেব কর্ম এমন, যার পেছনে কোন যুক্তিযুক্ত উদ্দেশ্য রয়েছে- নিছক এবাদত বা দাসত্ব প্রকাশ উদ্দেশ্য নয়; যেমন কর্জ শোধ করা এবং ছিনিয়ে নেয়া বস্তু ফেরত দেয়া। এতে নিয়ত ও কর্মই ধর্তব্য নয়; বরং হকদারের কাছে তার হক আসল অথবা বিনিময়- যেকোন আকারে পৌঁছে গেলেই ওয়াজেব আদায় হয়ে যাবে। এ দু'প্রকার ওয়াজেব সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা, ফলে সকলেরই বোধগম্য। কিন্তু তৃতীয় প্রকার ওয়াজেব কর্মে বান্দার অভাব দূর করা এবং তার দাসত্ব পরীক্ষা করা উভয় বিষয় উদ্দেশ্য। এ প্রকার ওয়াজেব কর্মে উভয় বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা ওয়াজেব এবং যে বিষয় অধিক প্রকাশ্য, তার দিকে লক্ষ্য রেখে অপর বিষয়টি ভুলে যাওয়া উচিত নয়। কেননা, অপর বিষয়টি অর্থাৎ দাসত্ব পরীক্ষার দিকটিই অধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়া বিচিত্র নয়। যাকাত এমনি ধরনের একটি ওয়াজেব কর্ম। ইমাম শাফেয়ী ব্যতীত অন্য কেউ এ নিগূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কেও ওয়াকিফহাল নয়। যাকাতে গরীবের অভাব দূর করা একটি প্রকাশ্যতম বিষয় বিধায় এটা সহজে বোধগম্য। বিস্তারিত বর্ণনা অনুযায়ী যাকাত প্রদান করে দাসত্ব প্রকাশ করাও শরীয়তের লক্ষ্য। এদিক দিয়েই যাকাত নামায ও হজ্জের সমকক্ষ হয়ে ইসলামের একটি স্তম্ভ সাব্যস্ত হয়েছে। এতে সন্দেহ নেই, প্রত্যেক প্রকারের মাল পৃথক করা, তা থেকে যাকাতের পরিমাণ বের করা এবং তা বর্ণিত আট প্রকার খাতে বন্টন করা একটি কঠিন কাজ। এতে শৈথিল্য করলে গরীবের স্বার্থে কোন ত্রুটি দেখা দেয় না; কিন্তু দাসত্ব প্রকাশে অবশ্যই ত্রুটি থেকে যায়।

        চতুর্থতঃ যাকাতের অর্থ অন্য শহরে স্থানান্তর করবে না। কেননা প্রত্যেক শহরের মিসকীন সেই শহরের যাকাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। স্থানান্তর করা হলে তাদের আশা ভঙ্গ হবে। স্থানান্তর করলে এক উক্তি অনুযায়ী যাকাত আদায় হয়ে যাবে, কিন্তু মতভেদজনিত সন্দেহ থেকে বেঁচে থাকা ভাল। কাজেই প্রত্যেক শহরের যাকাতের মাল সেই শহরের গরীবদের মধ্যে বন্টন করবে।

        পঞ্চমতঃ কোরআনের বর্ণিত আট প্রকার খাতের মধ্যে থেকে যে কয় প্রকার খাত শহরে বিদ্যমান আছে, যাকাতের মাল ততভাগে ভাগ করবে। কেননা, নির্ধারিত খাতে যাকাতের অর্থ পৌঁছানো যাকাতদাতার উপর ওয়াজিব।

    অর্থাৎ, যাকাত এই লোকদের কাছে পৌঁছা উচিত। এ আয়াতটি এমন, যেমন কোন রুগ্ন ব্যক্তি ওসিয়ত করে, তার এক-তৃতীয়াংশ মাল ফকীর ও মিসকীনদের জন্যে। এ ওসিয়ত এটাই চায় যে, তার মালের মধ্যে উভয় প্রকার লোক অংশীদার থাকবে। আয়াতেও সকল প্রকারের অংশীদারিত্ব বুঝানো হয়েছে। এবাদত অধ্যায়ে বাহ্যিক বিষয়াদিতে লিপ্ত হওয়া থেকে বেঁচে থাকা উচিত এবং আভ্যন্তরীণ বিষয়াদির প্রতিও দৃষ্টি দেয়া বাঞ্ছনীয়। আট প্রকারের মধ্যে দু'প্রকার খাত তো অধিকাংশ শহরেই অনুপস্থিত। এক, অন্তর জয় করার জন্যে যাদেরকে যাকাত দেয়া হয় এবং দুই, যাকাতের কর্মচারীবৃন্দ। চার প্রকার খাত সকল শহরেই বিদ্যমান আছে- ফকীর-মিসকীন, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি ও নিঃস্ব মুসাফির। দু'প্রকার খাত কতক শহরে পাওয়া যায় এবং কতক শহরে পাওয়া যায় না। তারা হল গাযী ও মুকাতাব।

        সুতরাং যাকাতদাতার শহরে যদি পাঁচ প্রকার খাত বিদ্যমান থাকে, 'তবে যাকাতের অর্থ সমান পাঁচ ভাগে ভাগ করবে এবং প্রত্যেক প্রকার খাতকে এক ভাগ দেবে। প্রত্যেক খাতের সমান সংখ্যক ব্যক্তিকে দেয়াই ওয়াজেব নয়; বরং এক প্রকারের দশ ব্যক্তিকে এবং অন্য প্রকারের বিশ ব্যক্তিকে দেয়ার অধিকার যাকাতদাতার রয়েছে। তবে প্রত্যেক প্রকারের সংখ্যা যেন তিন জনের কম না হয়। সুতরাং শহরে পাঁচ প্রকার খাত বিদ্যমান থাকলে যাকাত পনর ব্যক্তির মধ্যে বন্টন করবে। যাকাতের পরিমাণ কম হওয়ার কারণে এভাবে বন্টন করা কঠিন হলে অন্য যাকাতদাতাদের সাথে শরীক হয়ে যাবে এবং সকলের মাল একত্রিত করে পনর ব্যক্তিকে সমর্পণ করবে, যাতে তারা পরস্পরে ভাগাভাগি করে নেয়। কেননা, সকলকে দেয়া জরুরী।

Post a Comment

0 Comments