বিদায় হজ্জের ভাষণ

        আরাফাতে অবস্থান করা হযরত ইবরাহীমের পবিত্র স্মৃতির সাথে জড়িত। তিনিই এই স্থানকে হাজিদের অবস্থানের জন্যই নির্বাচন করেছিলেন। এই স্থানের একটা জায়গার নাম হলো নামিরাহ। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এখানে অবস্থান করলেন এবং সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ার পরে তিনি আরফাতের ময়দানে গমন করলেন। এই ময়দানেই তিনি তাঁর উটনী কাসওয়ার ওপরে বসে বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষন দিয়েছিলেন।

        আল্লাহর নবী বললেন, 'হে জনমন্ডলী! আজ আমি তোমাদেরকে যে কথা বলবো তা মনোযোগ দিয়ে শুনো। আমার ধারণা, আর বোধহয় তোমাদের সাথে একত্রে হজ্জ করার সুযোগ নাও হতে পারে। জেনে রেখো, জাহিলিয়াতের যুগের সমস্ত অন্ধ বিশ্বাস এবং প্রথা, অনাচার, কুসংস্কার আমার পায়ের নীচে দলিত মথিত হলো। অজ্ঞতার যুগের রক্ত প্রতিশোধ গ্রহণ আজ থেকে চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। আমি সর্বাগ্রে আমার বংশের রাবিয়া ইবনে হারিসের রক্ত প্রতিশোধ গ্রহণ রহিত করলাম। সে যুগের সুদ প্রথাও রহিত করলাম। আমি প্রথমে আমার বংশের আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের সুদের দাবী নাকচ করে দিলাম।

        (আরবে প্রথা ছিল, কেউ কাউকে নিহত করলে প্রতিশোধ গ্রহণ করতেই হবে। এই প্রতিশোধের পালা বংশ পরস্পরায় চলতো। রাবিয়া ইবনে হারিসের সন্তান আরেক গোত্রের হাতে নিহত হয়েছিল। বিচারের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে, কিন্তু নিজেরা আইন হাতে উঠিয়ে নিতে পারবে না। আব্বাস ইবনে আব্দুল মোত্তালিবের সুদের ব্যবসা ছিল। তিনি অর্থ ধার দিয়ে সুদ আদায় করতেন। তখন পর্যন্ত আরবের অনেক লোকের কাছেই তিনি সুদের অর্থ পেতেন)

        একজন অপরাধ করলে আরেকজনকে শাস্তি দেয়া তথা পিতার অপরাধের কারণে সন্তানকে বা সন্তানের অপরাধের কারণে পিতাকে কোন শাস্তি দেয়া যাবে না। (এই নিষ্ঠুর প্রথা সে সময় সারা আরবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। অপরাধীকে ধরতে না পারলে তার নির্দোষ আত্মীয়কে শাস্তি দেয়া হত) যদি কোন নাক কাটা হাবশী গোলামকেও তোমাদের নেতা নির্বাচন করা হয় এবং সে যদি তোমাদের মধ্যে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করে, তাহলে তোমরা তাঁর আনুগত্য করবে। তাঁর নির্দেশ পালন। করবে।

        সাবধান! দ্বীনের ব্যাপারে সীমা লংঘন করো না। এই সীমা লংঘনের কারণে অতীতে বহু জাতি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে। মনে রেখো, তোমাদের সবাইকে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হতে হবে এবং সমস্ত কর্মের হিসাৰ তাঁর কাছে দিতে হবে। সাবধান। আমার পরে তোমরা পথ ভ্রষ্ট হয়ে কাফেরদের মত একে অপরের রক্তপাত করো না। সাবাধান! তোমাদের পরস্পরের ধন-সম্পদ পরস্পরের কাছে আজকের পবিত্র দিনের মত, এই পবিত্র মাসের মত এবং এই পবিত্র মক্কার মতই পবিত্র।

        জেনে রেখো, আরবদের ওপরে অনারবদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। অনারবদের আরবদের ওপরে কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সবাই আদমের সন্তান আর আদম হলো মাটি থেকে সৃষ্টি। মনে রেখো, এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই এবং সমস্ত মুসলমানদের নিয়ে একটা অবিচ্ছেদ্য সমাজ। হে মানুষ। আমার পরে আর কোন নবীর আগমন ঘটবে না। তোমাদের পরে আর কোন নতুন উম্মত সৃষ্টি হবে না। এই বছরের পরে তোমাদের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়ত আর হবে না। সুতরাং জ্ঞান অপৃত হবার পূর্বেই আমার কাছে হতে শিক্ষা গ্রহণ করো।

        বিশেষ করে চারটি কথা ভালো করে স্মরণ রেখো, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না। ন্যায়ের ভিত্তি ব্যতীত তোমরা কাউকে হত্যা করো না। অপরের দ্রব্য আত্মসাৎ করো না। ব্যভিচারের ধারে কাছেও যেও না। আমি তোমাদের কাছে যা রেখে যাচ্ছি, তা দৃঢ়ভাবে ধারণ যদি করে রাখো, তাহলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর কিতাব এবং আমার প্রদর্শিত পথ রেখে যাচ্ছি। (অর্থাৎ রাসূলের সুন্নাত)

        হে উপস্থিত জনমন্ডলী। শয়তান হতাশ হয়েছে। কারণ আরবে সে আর কোনদিন পূজা লাভ করবে না। কিন্তু সাবধান! তোমরা যাকে ছোট মনে করো, তার ভেতর দিয়েই শয়তান তোমাদের মহাক্ষতি সাধন করে। তোমরা এ সম্পর্কে সতর্ক হও। নারীদের সম্পর্কে আমি তোমাদের সতর্ক করছি, তাদের সাথে নিষ্ঠুর ব্যবহার করার ব্যাপারে আল্লাহর আযাবকে ভয় করো। তোমরা তাদেরকে আল্লাহর জিম্মাদারীতে গ্রহণ করেছো। আল্লাহর নির্দেশের আওতায় তোমরা নিজেদের জন্য তাদেরকে বৈধ করে নিয়েছো। তোমাদের স্ত্রীর ওপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে, তেমন তাদেরও তোমাদের ওপর অধিকার রয়েছে। মনে রেখো, তোমরাই তাদের আশ্রয়। আমি তোমাদেরকে তোমাদের দাস-দাসী সম্পর্কে সাবধান করছি। তাদের ওপরে কোন ধরণের নির্যাতন করবে না। তাদের সাথে এমন ব্যবহার করো না যে, তারা মনে আঘাত পায়। তোমরা যা আহার করবে, তোমরা যা পরিধান করবে তাদেরকেও তাই আহার করাবে এবং তাই পরিধান করাবে। তোমরা যারা এখানে উপস্থিত আছো, আমার কাছে থেকে যা শুনলে, যারা উপস্থিত নেই তাদের কাছে তা পৌঁছে দিও। তাদের ভেতরে কেউ কেউ শ্রোতাদের থেকেও অধিক স্মৃতি শক্তি সম্পন্ন ও বোধ শক্তি সম্পন্ন হতে পারে।

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের ভাষন একত্রে পাওয়া অত্যন্ত কষ্টকর। কারণ যিনি যতটুকু শুনেছেন এবং স্মরণ রাখতে পেরেছেন, ততটুকুই তিনি বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন হাদীসে ভাষনের বিভিন্ন অংশ বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহর নবীর ভাষন একত্রে সমস্ত মানুষ শুনতে পায়নি। কারণ বর্তমান সময়ের মত সে যুগে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা ছিল না। এ কারণে বিভিন্ন স্থানে ঘোষক নিযুক্ত করা হয়েছিল। তাঁরা রাসূলের ভাষন উপস্থিত মানুষকে জানিয়ে দিচ্ছিলেন।

        এরপর আল্লাহর নবী আরাফাত এবং মিনায় উপস্থিত মানুষদের লক্ষ্য করে বললেন, 'আমি আমার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছি কিনা, এ সম্পর্কে তোমাদেরকে আল্লাহ জিজ্ঞাসা করবেন। তখন তোমরা কি জবাব দিবে?'

        লক্ষ মানুষের বজ্রকণ্ঠ শোনা গেল, 'হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আপনার ওপরে অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছেন, আল্লাহর বাণী আপনি আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। আমরা আল্লাহর কাছে এই সাক্ষ্য দিবো।'

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'হে আল্লাহ। তুমি সাক্ষী থাকো।'

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন তাঁর অর্পিত এই দায়িত্ব পালন করছিলেন, তখন মহান আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে তাঁকে জানিয়ে দিলেন, আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্য সম্পূর্ণ করে দিয়েছি এবং আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি পূর্ণ করেছি, আর তোমাদের জন্য ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসাবে কবুল করে নিয়েছি। (সূরা মায়েদা-৩)

        এরপর আল্লাহর নবী হযরত বিলাল রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুকে আযান দিতে বললেন। তারপর যোহর ও আসরের নামায এক সাথে আদায় করলেন। নামায শেষ হলে তিনি নিজের অবস্থানের কাছে এসে অনেকক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। তারপর সূর্য অস্ত গেলে তিনি যাত্রা করলেন। এ সময়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের উটনীর পেছনে হযরত উসামা ইবনে যায়েদ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বসেছিলেন। বিশাল এক জনসমুদ্রের মাঝ দিয়ে তিনি আসছিলেন। হাতের ছড়ি দিয়ে তিনি ইশারা করছিলেন আর মৃদুকণ্ঠে বলছিলেন, 'হে জনমন্ডলী! শান্তির সাথে।'

        বারবার এই কথাটি বলছিলেন। অর্থাৎ কোন বিশৃংখলা যেন না হয়। পথে এক সময় তিনি পবিত্রতা অর্জন করলেন। হযরত উসামা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু তাঁকে জানালেন, 'হে আল্লাহর রাসূল! নামাযের সময় শেষ হয়ে আসছে।' 

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম জানালেন, 'নামায আদায়ের জায়গা সামনে আসছে।' আল্লাহর নবী মুজদালিফায় এসে মাগরিবের নামায আদায় করলেন। তারপর মানুয়জন নিজেদের তাঁবুতে গিয়ে উপস্থিত তাদের জিনিষ পত্র' খুলবে, এমন সময় এশার নামাযের আযান হলো। অর্থাৎ মাগরিবের নামায এবং এশার নামাযের ভেতর সময়ের তেমন ব্যবধান ছিল না। সেদিন রাতে আল্লাহর নবী বিশ্রাম গ্রহণ করেছিলেন। অন্যান্য রাতের মত রাত জেগে নামায আদায় বা আল্লাহর কাছে সিজদা দিয়ে থাকা, এমন করেননি। হাদীস বিশারদগণ বলেন, এই একটি মাত্র রাতই আল্লাহর নবী তাহাজ্জুদের নামায আদায় করেননি।

        ইতোপূর্বে কুরাইশরা সূর্য ওঠার পরে মুজদালিফা ত্যাগ করতো। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সে প্রথা রহিত করে সূর্য উদিত হরার পূর্বেই মুজদালিফা ত্যাগ করলেন। এ সময় তাঁর সাথে তাঁর চাচাত ভাই হযরত ফজল ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু ছিলেন। এই দিনটি ছিল জিলহজ্জ মাসের দশ তারিখ শনিবার। তারপর তিনি মীনায় জামরার কাছে উপস্থিত হয়ে কিশোর বালক হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহ তা'য়ালা আনহুকে পাথর কুড়িয়ে এনে দিতে বললেন। তিনি পাথর এনে দিলে আল্লাহর নবী পাথর নিক্ষেপ করলেন।

        এরপর তিনি কোরবানীর দিকে গেলেন। তিনি বললেন, 'কোরবানীর জন্য শুধুমাত্র মীনাই নয়, মক্কার যে কোন স্থানেই কোরবানী হতে পারে।'

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের সাথে একশত উট ছিল। কিছু উট তিনি নিজ হাতে জবেহ করলেন, বাকীগুলো জবেহ করার জন্য হযরত আলীকে আদশে দিলেন। উল্লেখ্য, আল্লাহর নবী যখন মদীনা থেকে যাত্রা করেন, তখন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু ছিলেন ইয়েমেনে। তিনি ইয়েমেন থেকে মুসলমানদের একটি বিশাল দল নিয়ে মক্কায় উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি এ আদেশও দিলেন, এর গোস্তসহ সমস্ত কিছুই যেন বণ্টন করে দেয়া হয়। কশাইকে অন্য খাত থেকে যেন মজুরী দেয়া হয়।

        তারপর তিনি মাথা মুড়ালেন। পবিত্র চুল মোবারক তাঁর নির্দেশে মুসলমানদের ভেতরে বন্টন করা হলো। এরপর তিনি মক্কায় গিয়ে কা'বাঘর তাওয়াফ করলেন এবং জমজমের পানি পান করলেন। পানি পান করার পূর্বে তিনি নিজের বংশের লোকদেরকে ডেকে বললেন, 'আমার যদি এই ভয় না হত যে, আমাকে এমন করতে দেখে লোকেরা তোমাদের হাত থেকে বালতি কেড়ে নিয়ে পানি উঠিয়ে পান করবে, তাহলে আমি নিজ হাতে পানি উঠিয়ে পান করতাম।'

        হযরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু পানি উঠিয়ে দিয়েছিলেন। আল্লাহর নবী কেবলার দিকে দাঁড়িয়ে পানি পান করেছিলেন। এরপর সেখান থেকে মীনায় গিয়ে যোহরের নামায আদায় করেছিলেন। তবে এ সম্পর্কে মতভেদ আছে। কেউ বলেছেন মক্কাতেই যোহরের নামায আদায় করেছিলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম হজ্জ আদায় করলেন। তিনি তাঁর উম্মতদেরকে বারবার দেখছিলেন এবং শেষ বারের মতই করুণ কন্ঠে বলেছিলেন, 'বিদায়! বন্ধুগণ বিদায়!' এই হজ্জই ছিল দুই জাহানের বাদশাহর জীবনের শেষ হজ্জ।

Post a Comment

0 Comments