কোরআনের সম্মান ও মর্যাদা

        বিশ্বের সর্বকালের সর্বযুগের একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই কোরআনে কারীমের মাধ্যমে একটি জাতির পরিবর্তন সাধিত করেছিলেন। গোটা বিশ্বে রেডিক্যাল চেঞ্জ এনেছিলেন। এ কথা অত্যন্ত দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলছি, পৃথিবীতে মানব রচিত কোন বিধান দিয়ে কোনদিন কল্যাণ বয়ে আসবে না। জাতি সুখ এবং সমৃদ্ধি কখনো দেখতে পাবে না। অপরের রক্তচক্ষু দেখে গোলাম হয়ে চিরকাল কাটাতে হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। ভয়ে আতঙ্কে কাতর হয়ে পড়তে হবে। এই বিশ্বের মাঝে যদি আমরা বলিষ্ঠতা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে আগ্রহী হই, একটি সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ ও জাতি কামনা করি, তাহলে কোরআনে কারীম প্রবর্তিত একটি সমাজ ব্যতীত অন্য কোন পথে তা কোনক্রমেই সম্ভব নয়।

        আল্লাহর কোরআন আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ এবং এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ সম্পদ আল্লাহ তা'য়ালা আর অন্য কিছু দেননি। গোটা বিশ্ববাসীর জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত হলো কোরআন। আল্লাহর এই কিতাব হচ্ছে এই মহাবিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বিস্ময়। মানুষের হেদায়াতের জন্য এই কোরআনে আল্লাহ তা'য়ালা সমস্ত কিছুই বলে দিয়েছেন, নতুন করে কোন কিছু আর বলার প্রয়োজন নেই। আল্লাহর পক্ষ থেকে আর একটি শব্দ এবং অক্ষরও মানুষের কাছে হেদায়াতের জন্য প্রেরণ করা হবে না। এই কোরআনের সম্মান ও মর্যাদা যে কতবেশী, তা মানুষের পক্ষে কল্পনাও করা সম্ভব নয়। এ জন্য আল্লাহর এ কিতাবের সম্মান ও মর্যাদা সবচেয়ে বেশী।

        সর্বময় ক্ষমতার উৎস হলেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এবং যাবতীয় সম্মান ও মর্যাদা তাঁর জন্যই নির্দিষ্ট। তাঁর পক্ষ থেকেই এ কোরআন মানব জাতির জীবন বিধান হিসাবে প্রেরণ করা হয়েছে। পৃথিবীতে মানুষের জন্য আল্লাহ তা'য়ালা যত নিয়ামত দান করেছেন, তার ভেতরে এই কোরআনই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। এই নেয়ামতের গুরুত্ব, সম্মান ও মর্যাদা অনুধাবন করার জন্যই একে অবতীর্ণ করা হয়েছে রমজানের কদরের রাতে। এ সম্পর্কে আল্লাহ সূরা বাকারায় বলেন-

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ

        রমজানের মাস, এতে কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে, যা গোটা মানব জাতির জন্য জীবন-যাপনের বিধান আর এটা এমন সুস্পষ্ট উপদেশাবলীতে পরিপূর্ণ, যা সঠিক ও সত্য পথপ্রদর্শন করে এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য পরিষ্কাররূপে নির্ধারণ করে।

        কোরআনের সম্মান ও মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রেখেই তা রমজান মাসে অবতীর্ণ করা হয়েছে। আর যাদের জন্য এই কোরআনের মতো মহান নিয়ামত দান করা হয়েছে, তাদেরকে বলা হয়েছে, তোমরা এই অমূল্য নিয়ামত লাভ করলে এ জন্য তোমরা শোকর আদায় করো। কিভাবে শোকর আদায় করতে হবে, সেটাও আল্লাহ তা'য়ালা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন যে, রোজা পালন করে শোকর আদায় করো।

        ব্যক্তিগতভাবেও কোন মানুষ যদি তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজে সফলতা অর্জন করে, তখন সে আনন্দ প্রকাশ করে। একটি জাতি যখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজে সফলতা অর্জন করে, তখন সে জাতি বিজয় উৎসবের মাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ করে। মুসলিম একটি মিল্লাতের নাম। এই মিল্লাত বা জাতির পিতা হলেন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস্ সালাম। এই জাতি গোটা পৃথিবীতে নেতৃত্ব দেবে এ জন্য যে, এরা গোটা পৃথিবীতে কোরআনের আদর্শ বাস্তবায়ন করবে। কারণ কোরআনের আদর্শ যদি এরা বাস্তবায়ন না করে, তাহলে গোটা পৃথিবী জুড়ে ব্যাপক ভাঙন ও বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।

        বর্তমানে পৃথিবী জুড়ে অশান্তির দাবানল যেভাবে প্রজ্জ্বলিত হয়েছে, এর মূল কারণ হলো, কোরআনের আদর্শের অনুপস্থিতি। এই কোরআন স্বয়ং সম্মানিত ও মর্যাদাবান এবং তা আগমন করেছে তাঁর অনুসারীকে পৃথিবীতে সম্মান ও মর্যাদার আসনে আসীন করার লক্ষ্যে। অর্থাৎ কোরআন তার অনুসারীদেরকে পৃথিবীর নেতৃত্বের আসনে বসিয়ে দেয়। এটা কোন কল্পনার বিষয় নয়-মুসলমানদের অতীত ইতিহাস এ কথার সাক্ষী। যতদিন মুসলমানরা কোরআন অনুসরণ করেছে, গোটা পৃথিবীর নেতৃত্ব ছিল তাদেরই পদতলে।

        সুতরাং, এই অমূল্য নিয়ামত দান করে তার শোকর আদায় করার জন্য রোজা পালন করতে বলা হয়েছে। বিষয়টি একটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে অনুধাবন করা যাক, যেমন জাতিয় কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে জনগণ যেন তাতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায় সে জন্য নির্দিষ্ট একটি সময় সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়। বিষয়টির ওপরে সরকার সতর্ক দৃষ্টি রাখে যেন সকল স্তরের জনসাধারণ অংশগ্রহণ করতে পারে। যে অনুষ্ঠানে জনগণ অংশগ্রহণ করবে, সে অনুষ্ঠানের গুরুত্ব অনুযায়ী সরকার ক্ষেত্র বিশেষে সময় বর্ধিত করে যেন সে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা থেকে কেউ বঞ্ছিত না থাকে। ঠিক তেমনি, কোরআনের সম্মান ও মর্যাদা এত বেশী যে, এটা লাভ করে মানুষ শোকর আদায় করবে। এই শোকর আদায় থেকে কেউ যেন বঞ্ছিত না থাকে, সে ব্যাপারেও আল্লাহ তা'য়ালা ব্যাবস্থা করে রেখেছেন।

        আল্লাহর গৃহীত সে ব্যবস্থাটি হলো, কোন কারণবশতঃ শোকর আদায়ের মাস রমজান মাসে কেউ যদি রোজা পালন করার সুযোগ না পায়, তাহলে বছরের যে কোন সময়ে সে রোজার কাযা আদায় করে শোকর পালনে অংশগ্রহণ করতে পারে। এই সুযোগ দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র কোরআনের সম্মান ও মর্যাদার কারণে। রমজান মাসের রোজাকে শুধুমাত্র আল্লাহভীতি অর্জনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমই করা হয়নি, বরং মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে যে বিরাট ও মহান নে'মাত আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অনুগ্রহ করে দিয়েছেন, রোজাকে তার শোকর আদায়ের মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের জন্য কোন নে'মাতের শোকর আদায় এবং অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সর্বোত্তম পদ্ধতি এটাই তো হতে পারে, যে বিরাট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে এ নে'মাত দেয়া হয়েছে, নে'মাত যারা লাভ করলো, তাদের দায়িত্ব হলো সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের উপযোগী করে নিজেকে গঠন করার জন্য সর্বাত্মক সাধনায় লিপ্ত হওয়া।

        আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কোরআনের মতো নে'মাত এ জন্য আমাদেরকে দান করেছেন যে, আমরা তাঁকে সন্তুষ্ট করার পথ ও পদ্ধতি অবগত হয়ে সে অনুসারে নিজেদেরকে প্রস্তুত করবো এবং গোটা পৃথিবীকেও সেই পথেই পরিচালিত করার জন্য সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করবো। আর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করার সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম হলো রোজা এবং রমজান মাসে এ জন্যই কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, কোরআন দিয়ে আমাদেরকে ধন্য এবং বিজয়ী করা হয়েছে। আমরা শোকর আদায় শেষে বিজয় উৎসব যেন উদযাপন করতে পারি এর জন্য দেয়া হয়েছে ঈদ উৎসব। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَالِكَ فَلْيَفْرَحُوا 

        হে নবী! বলো, এটা আল্লাহর অনুগ্রহ ও অপার করুণা যে, তিনি এটা (কোরআন) প্রেরণ করেছেন। এ জন্য তো লোকদের আনন্দ ফূর্তি করা উচিত। (ইউনুস-৫৮)

        কোরআনের মতো অতুলনীয় নে'মাত লাভ করে আমরা বিজয়ী হয়েছি, সেই বিজয় উৎসবই হলো ঈদ। কোরআনের মতো নিয়ামতকে যে রাতে অবতীর্ণ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে আল্লাহু তা'য়ালা বলেন-

إِنَّا أَنْزَلْنُهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَرَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ 

        আমি এটি এক বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি। (সূরা দুখান-৩)

        এভাবে সূরা কদরেও বলা হয়েছে, এ কোরআন আমি কদরের রাতে অর্থাৎ অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ রাতে অবতীর্ণ করেছি। সে রাত যে কতটা মহিমান্বিত রাত, যার মর্যাদা সম্পর্কে কোন মানুষ কল্পনাও করতে সক্ষম নয়। অগণিত রাত-ব্যাপী নামাজেরত থেকে যে সওয়াব অর্জন করতে পারে, সে রাতে এক রাকাআত নামাজ আদায় করে সেই একই সওয়াব অর্জন করতে পারে। এ রাতের সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে হাদীসে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। কোরআনের সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন-

وَإِنَّهُ فِي أُمِّ الْكِتَابِ لَدَيْنَا لَعَلِيُّ حَكِيمٌ

         প্রকৃতপক্ষে এটা মূল কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে যা আমার কাছে অত্যন্ত উঁচু মর্যাদা সম্পন্ন ও জ্ঞানে পরিপূর্ণ। 

        কোরআনের পরিচয় আল্লাহ জানিয়ে দিয়ে এ কথাও স্পষ্ট করে দিলেন যে, কোন ব্যক্তি যদি তার অজ্ঞতা ও মূর্খতার কারণে আল্লাহর কোরআনের মূল্য ও মর্যাদা উপলব্ধি করতে সক্ষম না হয়, কোরআন পরিবেশিত অনুপম জ্ঞান ভান্ডার থেকে জ্ঞান আহরণ করে তা অনুসরণ করতে না পারে, তাহলে এটা সে ব্যক্তির লজ্জাজনক ব্যর্থতা আর দুর্ভাগ্য ছাড়া কি বলা যেতে পারে। কেউ যদি এ কিভাবকে ছোট করার প্রয়াস পায় এবং কিতাবের বক্তব্যের মধ্যে ভুল ধরার চেষ্টা করে তাহলে সেটা তার চরম হীনমন্যতা বৈ আর কিছু নয়।

        কোরআনকে কেউ সম্মান-মর্যাদা না দিলেই এর মূল্যে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে না। কেউ কোরআনের প্রভাব ও জ্ঞানকে গোপন করতে চাইলেই তা গোপন করতে পারে না। এটা যথাস্থানে একটি উচ্চ মর্যাদা স' পন্ন কিতাব যাকে এর অতুলনীয় শিক্ষা, মু'জিযাপূর্ণ বাগ্মিতা, নিষ্কলুষ জ্ঞান এবং যাঁর বাণী তাঁর গগনচুম্বী ব্যক্তিত্ব অতি উচ্চে তুলে ধরেছে। সুতরাং একে কেউ অবমূল্যায়ন করলেই তা মূল্যহীন হয়ে যায় না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা আনআ'ম-এর ৯২ আয়াতে বলেন- 

وَهُذَا كِتَابٌ أَنْزَلْنَهُ مُبْرَك -

        এটা একটি কিতাব, যা আমি অবতীর্ণ করেছি, বড়ই কল্যাণ ও বরকতপূর্ণ। এই কোরআনের যেমন সম্মান ও মর্যাদা, একে যারা অনুসরণ করবে, তাদেরও সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে এটা আল্লাহর ওয়াদা। আল্লাহ ওয়াদা করেছেন, যারা আমার কোরআন অনুসরণ করবে, তাদেরকে আমি পৃথিবীতে নেতৃত্ব দান করে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেবো। কেননা, আমার এ কিতাব কল্যাণময় ও বরকতপূর্ণ। এ বরকতপূর্ণ কিতাব আমি ইতিপূর্বে নবী ও রাসূলদেরকে দান করেছিলাম। এ থেকে কল্যাণ লাভ তারাই করতে পারে, যারা না দেখে তাদের রব্বকে ভয় করে এবং আখিরাতের দিনে হিসাব গ্রহণের বিষয়ে ঈমান রাখে।।

Post a Comment

0 Comments