ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি আর রাষ্ট্রের সামান্য একজন নাগরিকের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু যখন মুসলিম জাহানের খলীফার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত, সে সময় তিনি একদিন সরকারী একটি অফিস পরিদর্শনে গেলেন। সেই অফিসে এক খৃষ্টান যুবক কর্মরত ছিলো। যুবকটি খলীফার সাথে সাক্ষাৎ করে তার চাকরী ক্ষেত্রে প্রমোশনের জন্য খলীফার কাছে আবেদন পত্র পেশ করেছিলো। বেশ কয়েকদিন পর ঘটনাক্রমে ঐ খৃষ্টান যুবকের সাথে খলীফার সাথে সাক্ষাৎ হলে যুবকটি খলীফাকে নিজের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে জানালো, 'সম্মানিত খলীফা। আমি সেই খৃষ্টান যুবক, আপনার কাছে • আমি আমার চাকরীতে প্রমোশনের জন্য আবেদন করেছিলাম।'
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুও স্বহাস্যে যুবককে উত্তর দিলেন, 'ওহে যুবক। আমি ওমরও সেই মুসলমান, তোমার আবেদন পত্র আমি যথাস্থানে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সাথে সাথে প্রেরণ করেছি। তুমি তোমায় প্রাপ্য বুঝে পাবে।'
মুসলিম জাহানের তৃতীয় খলীফা স্বয়ং হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর ঢাল হারিয়ে গেলো। তিনি অভিযুক্ত করলেন রাষ্ট্রের এক অমুসলিম নাগরিক ইয়াহুদীকে। খলীফা আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করলেন। আদালত খলীফাকে স্বশরীরে আদালতে উপস্থিত হওয়ার জন্য সমন পাঠালো। বাদী-বিবাদী আদালতে উপস্থিত হলে আদালত উভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য করেনি। প্রমাণের অভাবে আদালত খলীফা কর্তৃক দায়েরকৃত মামলাটি খারিজ করে দিয়েছিলেন। উপলব্ধি করার বিষয়, বাদী ছিলেন ইসলামী জাহানের স্বয়ং খলীফা আর বিবাদী ছিলেন সেই রাষ্ট্রের একজন অমুসলিম নাগরিক। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা কোরআন-সুন্নাহ্ভিত্তিক শাসিত রাষ্ট্র ও সমাজে পরিলক্ষিত হয়েছে এবং সেসব ঘটনা ইতিহাসের পাতায় সোনালী অক্ষরে দেদিপ্যমান রয়েছে।
এই ধরনের একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এককভাবে কোনো ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী সংগঠনের। দেশ ও সমাজের তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত সেই আদর্শবাদী সংগঠনের পক্ষেই সম্ভব কোরআন-সুন্নাহ্ ভিত্তিক একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সর্বস্তরের জনশক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা। আর সেই সংগঠন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে এমন একটি গঠনতন্ত্র প্রয়োজন, যে গঠনতন্ত্রের আলোকে গোটা সংগঠন নিয়মতান্ত্রিকভাবে যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালিত করবে। সংগঠনের প্রত্যেক স্তরে আদর্শিক প্রশিক্ষণ, সকল স্তরের জনশক্তির মধ্যে আদর্শ অনুসরণের নিষ্ঠা, আদর্শ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান, নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য, শৃংখলা, নিয়মানুবর্তিতা এবং সেই সাথে সংগঠনের আওতায় রাষ্ট্র ও সমাজ দক্ষতার সাথে পরিচালনার জন্য যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলার বাস্তবসম্মত কর্মসূচী ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
কোর্টে একটি মামলাও হলো না
এ কথা মানব জাতির ইতিহাসে প্রমাণিত সত্য যে, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ করা জীবন বিধান অনুসারে এই পৃথিবীতে যে মানব গোষ্ঠীই জীবন পারিচালিত করেছে, তারাই শাস্তি, স্বস্তি, নিরাপত্তা, কল্যাণ ও সফলতা অর্জন করেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে যেখানেই আল্লাহর বিধান অনুসরণ করা হয়েছে, সেখানেই খাদ্য-বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তার কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি। রাষ্ট্র ও সমাজ যাবতীয় অনাচার, বিপর্যয়, অশান্তি ও অকল্যাণ থেকে সুরক্ষিত থেকেছে। আর যেখানেই আল্লাহর বিধানের প্রতি অবজ্ঞা-অবহেলা প্রদর্শন করা হয়েছে, অমান্য বা বিরোধিতা করা হয়েছে, সেখানেই সার্বিকভাবে ভাঙ্গন ও বিপর্যয় ধেয়ে এসেছে। সুতরাং এ কথা ইতিহাসে প্রমাণিত সত্য যে, একমাত্র ইসলামী জীবন বিধানই মানব জাতির ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তি ও সফলতার একমাত্র গ্যারান্টি এবং মানব রচিত কোনো প্রকার মতবাদ-মতাদর্শ মানুষের জীবনে শান্তি, স্বস্তি, কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতার শোচনীয় স্বাক্ষর রেখেছে। মানব জাতির প্রত্যেকটি বিপর্যয়ের বাঁকেই আল্লাহর বিধান অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা সর্বাধিকভাবে অনুভূত হয়েছে এবং বর্তমানেও হচ্ছে। অতএব সার্বিক বিবেচনায় রাষ্ট্র'ও সমাজ পরিচালনার নেতৃত্ব আল্লাহভীরু জ্ঞানী-গুণী মুসলিম কর্তৃক পরিচালিত হতে হবে। এই ধরনের রাষ্ট্রে মুসলমানদের মধ্যে সর্বাধিক যোগ্যতা সম্পন্ন ও আল্লাহভীরু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে পরামর্শ পরিষদ বা মাজলিশে শূরা বর্তমান থাকবে এবং এই পদ্ধতির মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালিত হবে।
একমাত্র এই ধরনের রাষ্ট্র ও সমাজই দেশের জনগণের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করতে সক্ষম। কোরআন-সুন্নাহ্ ভিত্তিক এই ধরনের ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে অবলম্বিত হওয়ার কারণেই খোলাফায়ে রাশেদীনের খেলাফতকালে রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে নিম্ন পর্যায় পর্যন্ত সর্বত্র অন্যায়-অবিচার, দুর্নীতি, দুষ্কৃতি তথা যাবতীয় অপরাধ থেকে যুক্ত ছিলো। সর্বত্রই সততা আর ন্যায়-নীতির চিহ্ন ছিলো আকাশের প্রজ্জ্বল সূর্যের মতোই স্পষ্ট। খলীফাতুর রাসূল হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর খেলাফতকালে হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুকে প্রধান বিচারপতির পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো। পরবর্তী অবস্থা ইতিহাসে এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে-
0 Comments