জানা উচিত, যারা আখেরাতের কামনা করে, তাদের জন্যে যাকাত প্রদানে কয়েকটি আদব বা শিষ্টাচার রয়েছে। প্রথমতঃ যাকাত ওয়াজেব হওয়ার কারণ হৃদয়ঙ্গম করা এবং একথা অনুধাবন করা, যাকাত কোন দৈহিক এবাদত নয়; আর্থিক ক্ষমতা প্রয়োগ। এতদসত্ত্বেও এটা ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ সাব্যস্ত হল কেন? যাকাত ওয়াজেব হওয়ার কারণ তিনটি-
(১) শাহাদতের উভয় কলেমা পাঠের মানে হল তওহীদকে অপরিহার্য করা এবং মাবুদের একত্বের সাক্ষ্য প্রদান করা। এটা এমনভাবে পূর্ণ করতে হবে, যেন তওহীদে বিশ্বাসী ব্যক্তির কাছে এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন কিছু প্রিয় না থাকে। কেননা, মহব্বত অংশীদারিত্ব কবুল করে না এবং কেবল মুখে তওহীদ উচ্চারণ করা তেমন উপকারী নয়। বরং মহব্বত আছে কিনা, প্রিয় বস্তুর বিচ্ছেদ দ্বারা তা পরীক্ষা করা যায়। মানুষের কাছে মাল ও অর্থকড়ি অত্যন্ত প্রিয় বস্তু। কেননা, এটাই সাংসারিক কার্যোদ্ধারের মোক্ষম হাতিয়ার। দুনিয়াতে মানুষ অর্থ-সম্পদকেই আপন মনে করে এবং মৃত্যুকে ঘৃণা করে। অথচ মৃত্যুর মধ্যে আরাধ্য পরম প্রিয়ের সাক্ষাৎ ঘটে। তাই মানুষের দাবীর সত্যতা যাচাই করার জন্যে কাম্য ও প্রিয় অর্থ সম্পদ আল্লাহর পথে বিসর্জন দিতে বলা হয়েছে। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা বলেন:
إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةُ .
আল্লাহ্ মুমিনদের জান ও মাল বেহেশতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন।
বলাবাহুল্য, এটা জেহাদ অর্থাৎ আল্লাহ্ তাআলার দীদার লাভের আগ্রহে প্রাণ বিসর্জন দেয়া এবং অর্থকড়ি থেকে হাত গুটিয়ে নেয়া সাথে সম্পর্ক রাখে। অর্থ ব্যয় করার এই রহস্যের প্রতি লক্ষ্য করলে মানুষ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রথম শ্রেণী তারা, যারা তওহীদকে সত্যিকাররূপে মেনে এবং অঙ্গীকার পূর্ণ করে সমস্ত ধনসম্পদ থেকে হাত গুটিয়ে নেয়। তারা নিজেদের কাছে না কোন আশরাফী রাখে, না টাকা-পয়সা। যাকাত ওয়াজেব হওয়ার কোন সুযোগই তারা রাখে না। জনৈক বুযুর্গ ব্যক্তিকে কেউ জিজ্ঞেস করল দুশ' দেরহামে কি পরিমাণ যাকাত ওয়াজেব? তিনি বলেন: শরীয়তের আইনে সাধারণ মানুষের উপর পাঁচ দেরহাম ওয়াজেব, কিন্তু আমাদের উপর গোটা দুশ' দেরহামই দিয়ে দেয়া ওয়াজেব। একবার রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) যখন দান খয়রাতের ফযীলত বর্ণনা করলেন, তখন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) তাঁর সমস্ত ধনসম্পদ এবং হযরত ওমর (রাঃ) অর্ধেক মাল দান করলেন। রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) হযরত আবু বকরকে জিজ্ঞেস করলেন: তুমি তোমার পরিবারের জন্যে কি রেখেছ? তিনি বললেন: আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলকে রেখেছি। হযরত ওমরকে জিজ্ঞেস করলেন: তুমি কি রেখেছ? তিনি বললেন: পরিবারের জন্যে ততটুকু রেখে দিয়েছি, যতটুকু এখানে উপস্থিত করেছি। রসুলে করীম (সাঃ) বললেনঃ তোমাদের উভয়ের মধ্যে ততটুকু তফাৎ, যতটুকু তোমাদের কথার মধ্যে তফাৎ। দ্বিতীয় শ্রেণী তারা, যারা অর্থ সম্পদ সঞ্চয় করে রাখে এবং অভাব-অনটনের সময় খয়রাতের মওসুমের অপেক্ষা করতে থাকে। তাদের মর্তবা প্রথম শ্রেণীর তুলনায় কম। সঞ্চয় করার পেছনে তাদের উদ্দেশ্য থাকে প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যয় করা, বিলাসব্যসনে উড়িয়ে না দেয়া এবং প্রয়োজন মেটানোর পর কিছু বেঁচে গেলে সময় সুযোগ বুঝে তা সৎপথে ব্যয় করা। তারা কেবল যাকাতের অর্থ প্রদান করেই ক্ষান্ত থাকে না; বরং অন্য দান-খয়রাত করে। নখয়ী, শা'বী, আতা ও মুজাহিদ প্রমুখ আলেমের অভিমত, অর্থ সম্পদের মধ্যে যাকাত ছাড়া আরও হক আছে। শা'বীকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন: হাঁ, আরও হক আছে। তুমি আল্লাহ তাআলার এই এরশাদ শ্রবণ করনি, অনাথদেরকে দান করে। এই আলেম আমি তাদেরকে যা দেই, তা থেকে তারা ব্যয় করে।) এবং তোমরা আমার দেয়া রিযিক থেকে ব্যয় কর।( আয়াত দুটিকেও তাদের দাবীর সপক্ষে পেশ করে বলেন: এসব আয়াত যাকাতের আয়াত দ্বারা রহিত হয়নি; বরং মুসলমানদের পারস্পরিক হক এসব আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। অর্থ এই, ধনী ব্যক্তি কোন অভাবগ্রস্তকে পেলে যাকাত ছাড়া অন্য মাল দ্বারা তার অভাব দূর করবে। এ সম্পর্কে ফেকাহ্ শাস্ত্রের বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, অভাবের কারণে কেউ মরণাপন্ন হয়ে গেলে তার অভাব দূর করা অন্যদের উপর ফরযে কেফায়া। কিন্তু এতে বলা যায়, ধনী ব্যক্তির উপর কেবল এতটুকু ওয়াজেব, যে পরিমাণ অর্থ দ্বারা তার অভাব দূর হয়ে যায়, সেই পরিমাণ অর্থ তাকে কর্জ দেবে। যাকাত দিয়ে থাকলে দান করে দেয়া তার উপর ওয়াজেব নয়। কেউ কেউ বলেন: দান করাই ওয়াজেব- কর্জ দেয়া দুরস্ত নয়। মোট কথা, এ ব্যাপারে মতভেদ আছে তবে কর্জ দেয়া হচ্ছে সর্বনিম্ন স্তরে নেমে যাওয়া, যা সর্বসাধারণের স্তর।
তৃতীয় শ্রেণী তারা, যারা কেবল ওয়াজেব যাকাত আদায় করেই ক্ষান্ত থাকে বেশীও দেয় না এবং কমও দেয় না। এটা সর্বনিম্ন মর্তবা। সাধারণ মানুষ তাই করে। কারণ তারা ধন-সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট ও কৃপণ হয়ে থাকে এবং পরকালের আসক্তি তাদের মধ্যে কম। তাই আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
إن تَشالُكُمُوهَا فَيُحْفِكُمْ تَبْخَلُوا .
অর্থাৎ, যদি তিনি তোমাদের কাছে অর্থ সম্পদ চান এবং পীড়াপীড়ি করেন, তবে তোমরা কৃপণতা করবে।
যাকাত ওয়াজেব হওয়ার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, মানুষকে কৃপণতা দোষ থেকে মুক্ত করা। কেননা, এটা হচ্ছে অন্যতম বিনাশকরী দোষ। রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেনঃ
ثلاث مهلكات شح مطاع وهوى يتبع وعجائب المرء بنفسه .
তিনটি বিষয় বিনাশকারী- লোভ, খেয়ালখুশী এবং আত্মপ্রীতি। আল্লাহ্ তাআলা বলেন:
وَمَن يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ .
যাদেরকে লোভ-লালসা থেকে বাঁচিয়ে রাখা হয়, তারাই সফলকাম। বলাবাহুল্য, অর্থ সম্পদ দান করার অভ্যাস গড়ে তোলাই কৃপণতা দোষ দূর করার উপায়। এ কারণের দিক দিয়ে যাকাত পবিত্রকারী; অর্থাৎ যাকাত যাকাতদাতাকে কৃপণতার মারাত্মক অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করে দেয়। এ পবিত্রকরণ ততটুকু হবে, যতটুকু মানুষ দান করে এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করে আনন্দ ও খুশী অনুভব করবে। যাকাত ওয়াজেব হওয়ার তৃতীয় কারণ, নেয়ামতের শোকর আদায় করা। কেননা, আল্লাহ তাআলার নেয়ামত যেমন বান্দার শরীরে নিহিত নেয়ামতের শোকর, তেমনি আর্থিক এবাদত অর্থসম্পদে নিহিত নেয়ামতেরও শোকর। সুতরাং যেব্যক্তি গরীবকে অভাবী হয়ে তার কাছে হাত পাততে দেখেও আল্লাহ তাআলার শোকর করে না যে, আল্লাহ তাকে ধনী করেছেন এবং অপরকে তার প্রতি মুখাপেক্ষী করেছেন, সে অত্যন্ত নীচ।
দ্বিতীয় আদব, ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিগণ যাকাত ওয়াজেব হওয়ার পূর্বেই তা আদায় করে দেয়া, যাতে তাদের খোদায়ী আদেশ পালনে আগ্রহ বুঝা যায়, গরীবরা মানসিক শান্তি লাভ করে এবং সময়ের বাধাবিঘ্ন থেকে মুক্ত থাকা যায়। বিলম্বে যাকাত আদায় করার মধ্যে অনেক বিপদাপদের আশংকা থাকে। প্রথমতঃ এতে গোনাহে লিপ্ত হওয়ার আশংকা থাকে। সুতরাং অন্তরে পুণ্যের প্রেরণা প্রকাশ পেলে তাকে সুবর্ণ সুযোগ জ্ঞান করবে। এরূপ প্রেরণা ফেরেশতা কর্তৃক অবতীর্ণ হয়ে থাকে। মুমিনের অন্তর আল্লাহ তাআলার দু'অঙ্গুলির মধ্যস্থলে থাকে। তাতে পরিবর্তন আসতে দেরী লাগে না। এছাড়া শয়তান দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং অপকর্মের আদেশ করে। তাই সৎকর্মের প্রেরণা অন্তরে উদয় হওয়া গনীমত মনে করবে। একত্রে যাকাত দিলে তা আদায় করার জন্যে কোন উত্তম মাস নির্দিষ্ট করে নেবে, যাতে মাসের গুণে নৈকট্য অধিক অর্জিত হয়। উদাহরণতঃ বছরের প্রথম ও সম্মানিত মাস মহররম মাসে অথবা পবিত্র রমযান মাসে যাকাত দেবে। কেননা, রসূলুল্লাহ (সাঃ) এ মাসে সর্বাধিক দান খয়রাত করতেন; এমনকি গৃহে কোন কিছু রাখতেন না। রমযানে শবে কদরেরও ফযীলত আছে, যাতে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। মুজাহিদ (রহঃ) বলতেন: রমযান বলো না। কেননা, এটা আল্লাহ তাআলার একটি নাম; বরং রমযান মাস বলো। যিলহজ্জ মাসও অন্যতম সম্মান ও ফযীলতের মাস। এতে হজ্জে আকবর হয়। কোরআনে উল্লিখিত আইয়্যামে মালুমাত এবং আইয়্যামে মাদুদাত এ মাসেই রয়েছে। রমযান মাসের শেষ দশ দিন এবং যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন অধিক ফযীলত রাখে।
তৃতীয় আদব হচ্ছে সুখ্যাতি ও রিয়া থেকে দূরে থাকার জন্যে গোপনে যাকাত আদায় করা। রসূলে করীম (সাঃ) বলেন:
افضل الصدقة جهد المقل الى فقير في سر -
সর্বোত্তম দান এই যে, দরিদ্র ও সম্বলহীন ব্যক্তি শ্রমের মাধ্যমে উপার্জন করে তা গোপনে কোন ফকীরকে দিয়ে দেবে। জনৈক আলেম বলেন: তিনটি বিষয় দান-খয়রাতে সওয়াব ভান্ডার। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে গোপনে দান করা। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: বান্দা গোপনে কোন কাজ করলে আল্লাহ তাআলা তা গোপন খাতায় লিপিবদ্ধ করেন। অতঃপর সে যদি তা প্রকাশ করে তবে আল্লাহ তাআলা তা গোপন খাতা থেকে প্রকাশ্য খাতায় স্থানান্তর করেন। এর পর যদি সে এ কর্মের কথা অন্য কাউকে বলে, তবে গোপন ও প্রকাশ্য উভয় খাতা থেকে তা দূর করে রিয়ার খাতায় লেখে দেয়া হয়। এক মশহুর হাদীসে বর্ণিত আছে, আল্লাহ তাআলা সাত ব্যক্তিকে সেদিন ছায়াতলে রাখবেন যেদিন আরশের ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না। তাদের মধ্যে একজন সেই ব্যক্তি, যে কোন কিছু দান করলে তার বাম হাতও জানতে পারে না যে, ডান হাত কি দান করেছে। এক হাদীসে আছে-
وصدقة السر تطفى غضب الرب
গোপন দান আল্লাহ তাআলার ক্রোধ নির্বাপিত করে। আল্লাহ বলেনঃ
وَإِنْ تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُم
যদি দান খয়রাত গোপনে ফকীরদের হাতে পৌঁছাও, তবে এটা তোমাদের জন্যে উত্তম। গোপনে দান করার উপকারিতা হচ্ছে রিয়া ও খ্যাতির কুফর থেকে আত্মরক্ষা করা। রসূলে করীম (সাঃ) বলেন: যারা খ্যাতির জন্যে দান করে, দানের কথা অন্যের কাছে বলে এবং দান করে অনুগ্রহ প্রকাশ করে, আল্লাহ তাআলা তাদের দান কবুল করেন না। যে দানের কথা অন্যের কাছে বলে বেড়ায় সে খ্যাতি অন্বেষণ করে। যে জনসমাবেশে দান করে, সে রিয়াকার। গোপনে দান করলে এ দুটি বিপদ থেকে মুক্ত থাকা যায়। বুযুর্গগণ গোপনে খয়রাত করার ব্যাপারে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। গ্রহীতা যাতে দাতাকে চিনতে না পারে সে ব্যাপারে তাঁদের চেষ্টার অন্ত ছিল না। এজন্যে কেউ কেউ অন্ধের হাতে খয়রাত রেখে দিতেন। কেউ ফকীরের গমন পথে ও তার বসার জায়গায় খয়রাত ফেলে রাখতেন। কেউ ঘুমন্ত ফকীরের কাপড়ের কোণে খয়রাত বেঁধে দিতেন। কেউ অন্যের হাতে ফকীরের কাছে পৌঁছে দিতেন যাতে ফকীর দাতার অবস্থা না জানে। তারা আল্লাহর ক্রোধ নির্বাপিত করার উপায় সৃষ্টি করা এবং খ্যাতি ও রিয়া থেকে বেঁচে থাকার উদ্দেশে এভাবে দান খয়রাত করতেন। যদি কোন এক ব্যক্তিকে অবহিত না করে খয়রাত করা অসম্ভব হয়, তবে মিসকীনকে সমর্পণ করার জন্যে একজন উকিলের হাতে খয়রাত সোপর্দ করা উত্তম। এতে মিসকীন জানতে পারবে না, দাতা কে ? কারণ মিসকীন জানলে রিয়া ও অনুগ্রহ উভয়টি হয়। আর উকিলের জানার মধ্যে কেবল রিয়াই হবে। সুখ্যাতি লাভের উদ্দেশে দান করলে দানকর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে। কেননা, যাকাতের উদ্দেশ্য কৃপণতা দূর এবং ধনসম্পদের মহব্বত হ্রাস করা। ধনসম্পদের মহব্বতের তুলনায় খ্যাতির মহব্বত মনকে অধিক আচ্ছন্ন করে। আখেরাতে উভয়টিই ক্ষতিকর কিন্তু কৃপণতা কবরে দংশনকারী বিচ্ছুর এবং রিয়া বিষধর সর্পের আকৃতি লাভ করবে। মানুষকে উভয় শত্রু দুর্বল ও নির্ধন করার আদেশ দেয়া হয়েছে, যাতে এদের যন্ত্রণা সম্পূর্ণ দূরীভূত হয় অথবা হ্রাস পায়।
চতুর্থ আদব, যেখানে জানা যায়, প্রকাশ্যে দান করলে অন্যরা উৎসাহিত হবে, সেখানে প্রকাশ্যে দান করবে। এক্ষেত্রে রিয়া থেকে আত্মরক্ষা করার উপায় আমরা রিয়া অধ্যায়ে বর্ণনা করেছি। প্রকাশ্যে দান করা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন:
ان تبدوا الصَّدَقْتِ فَنِعِمَّا هِيَ .
যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান খয়রাত কর, তবে তা খুবই ভাল। এটা এমন স্থলে, যেখানে অপরকে উৎসাহিত করা উদ্দেশ্য হয় অথবা সওয়ালকারী জনসমাবেশে সওয়াল করে। এক্ষেত্রে রিয়ার ভয়ে প্রকাশ্যে দান বর্জন করা উচিত নয়; বরং দান করা উচিত এবং মনকে যথাসম্ভব রিয়া থেকে মুক্ত রাখা দরকার। কারণ, প্রকাশ্যে দান করার মধ্যে অনুগ্রহ প্রকাশ ছাড়া আর একটি অপকারিতা আছে। তা হচ্ছে, ফকীরের মুখোশ উন্মোচন করে দেয়া। কেননা, অধিকাংশ ফকীর তাদের স্বরূপ প্রকাশ পাওয়া অপছন্দ করে। সুতরাং প্রকাশ্যে প্রার্থনা করে সে যখন নিজের পর্দা নিজেই খুলে দেয়, তখন তার বেলায় এই অপকারিতা নিষিদ্ধ নয়। উদাহরণতঃ কেউ যদি গোপনে ও লোকচক্ষুর অন্তরালে পাপাচার করে, তবে প্রকাশ করা ও খোঁজাখুঁজি করা অন্যের জন্যে নিষিদ্ধ। কিন্তু যেব্যক্তি নিজে পাপাচার প্রকাশ করে, অন্যেরা তার পাপাচার প্রকাশ করলে তা তার জন্যে শাস্তির কারণ হবে। কিন্তু এ শাস্তির আসল কারণ সে নিজেই। এ জন্যেই রসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন:
من القى جلباب الحياء فلاغيبة له .
অর্থাৎ, যেব্যক্তি লজ্জার মুখোশ দূরে নিক্ষেপ করে, তার গীবত গীবত নয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وأَنْفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَكُمْ سِرًّا وَعَلَانِيَّةٌ .
অর্থাৎ, আমি যা দিয়েছি, তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় কর।
এ আয়াতে প্রকাশ্যে দান করারও আদেশ করা হয়েছে। কারণ, এতে অন্যদেরকে উৎসাহিত করার উপকারিতা আছে।
মোট কথা, প্রকাশ্যে দান করার মধ্যে যেসব উপকারিতা ও অপকারিতা রয়েছে, সেগুলো সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করে নেয়া উচিত। ব্যক্তি বিশেষে এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন অবস্থা হয়ে থাকে। কতক পরিস্থিতিতে কতক ব্যক্তির জন্য প্রকাশ্যে দান করাই উত্তম হয়। উপকারিতা ও অপকারিতা জানার পর কিভাবে দান করা উত্তম, তা আপনা আপনিই ফুটে উঠবে।
পঞ্চম আদব, নিজের দানকে কম মনে করা। কারণ, অনেক মনে করলে আত্মপ্রীতিতেও লিপ্ত হবে, যা একটি মারাত্মক ব্যাধি। আত্মপ্রীতি আমলসমূহ বাতিল করে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَيَوْمَ حُنَيْنِ إِذْ أَعْجَبَتْكُمْ كَثَرَتُكُمْ فَلَمْ تُغْنِ عَنْكُمْ شَيْئًا .
হুনায়ন যুদ্ধের কথা স্মরণ কর, যখন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদেরকে আত্মপ্রীতিতে লিপ্ত করে দিয়েছিল, অতঃপর তা তোমাদের কোন উপকার করেনি।
বলা হয়, এবাদতকে যতই ক্ষুদ্র জ্ঞান করা হবে, তা আল্লাহর কাছে ততই বড় হবে। পক্ষান্তরে গোনাহকে যতই বড় মনে করা হবে, তা আল্লাহর কাছে ততই ক্ষুদ্র হবে। জনৈক বুযুর্গ বলেন: তিনটি বিষয় ব্যতীত খয়রাত পূর্ণ হয় না- এক, খয়রাতকে ক্ষুদ্র জ্ঞান করা, দুই খয়রাত আদায়ে বিলম্ব না করা এবং তিন, গোপনে খয়রাত করা। আত্মপ্রীতি ও বড় মনে করা সকল এবাদতেই রয়েছে। এর প্রতিকার হল এলেম ও আমল। এলেম একথা জানা যে, সমস্ত মালের মধ্যে দশ ভাগের একভাগ অথবা চল্লিশ ভাগের এক ভাগ খুবই কম। এ পরিমাণ খয়রাত নেহায়েত নিম্নস্তরের খয়রাত। সুতরাং এই নিম্নস্তরের খয়রাতের জন্যে লজ্জা করা উচিত- একে বড় মনে করা উচিত নয়। আর যদি কেউ সমস্ত মাল অথবা অধিকাংশ মাল খয়রাত করে তবে তার চিন্তা করা উচিত যে, মাল তার কাছে কোথেকে এল এবং সে তা কোথায় ব্যয় করছে। মাল তো আসলে আল্লাহ তাআলার। তিনি অনুগ্রহপূর্বক বান্দাকে দান করেছেন' এবং ব্যয় করার তওফীক দিয়েছেন। সুতরাং আল্লাহর পথে অধিকাংশ দান করে তাকে বড় মনে করা উচিত নয়। যদি দোয়ার নিয়তে মাল দান করে, তবে যার বিনিময়ে দ্বিগুণ ত্রিগুণ সওয়াব পাবে, তাকে বড় মনে করবে কেন? আমল এই যে, লজ্জিত হয়ে দান করবে। কারণ, অবশিষ্ট মাল নিজের কাছে রেখে দেয়া হয়। এটা যেন এমন, যেমন কেউ কারও কাছে কিছু আমানত রাখে। এর পর ফেরত দেয়ার সময় কিছু অংশ ফেরত দেয় এবং কিছু অংশ রেখে দেয়। এটা লজ্জার বিষয় নয় কি? মাল সমস্তটাই আল্লাহর। তিনি সমস্তটা দান করার আদেশ দেননি। কারণ, কৃপণতার কারণে এ আদেশ পালন করা তোমাদের জন্যে কঠিন হত। সেমতে তিনি নিজেই বলেন : فَيُحْفِكُمْ تَبْخَلُوا অর্থাৎ, যদি তিনি আতিশয্য সহকারে সমস্ত মাল দান করার আদেশ দেন, তবে তোমরা কৃপণতা করবে; সানন্দে ও সন্তুষ্ট চিত্তে দান করবে না।
ষষ্ঠ আদব, নিজের মালের মধ্যে যা উৎকৃষ্ট; পবিত্র ও অধিক পছন্দনীয় তাই খয়রাতের জন্যে বেছে নেয়া। কেননা, আল্লাহ তাআলা পবিত্র। তিনি পবিত্র মালই কবুল করেন। হযরত আনাস (রাঃ)-এর রেওয়ায়েতে রসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন: সুসংবাদ সেই ব্যক্তির জন্যে, যে গোনাহ ছাড়া হালাল উপায়ে অর্জিত মাল দান করে। নিকৃষ্ট মাল দান করার মানে হচ্ছে নিজের অথবা পরিবারের লোকদের জন্যে উৎকৃষ্ট মাল রাখা এবং আল্লাহ্ তাআলার উপর অন্যদেরকে অগ্রাধিকার দেয়া। এটা নিঃসন্দেহে বেআদবী। যদি কেউ মেহমানের সাথে এরূপ ব্যবহার করে এবং ভাল খাদ্য নিজেরা খেয়ে মেহমানের সামনে খারাপ খাদ্য পেশ করে, তবে মেহমান নিঃসন্দেহে তার শত্রু হয়ে যাবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
بَايُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِنْ طَيِّبَتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ وَلَا تَيَمَّمُوا الْخَبِيثَ مِنْهُ تُنْفِقُونَ وَلَسْتُمْ بِأَخِذِيهِ إِلَّا أَنْ تُغْمِضُوا فِيهِ .
অর্থাৎ, মুমিনগণ, তোমরা তোমাদের উপার্জন থেকে এবং আমি মাটি থেকে যা উৎপন্ন করি, তা থেকে পবিত্র বস্তু ব্যয় কর। তোমরা ব্যয় করার জন্যে অপবিত্র বস্তুর নিয়ত করো না, যা তোমরা নিজেরা চক্ষু বন্ধ না করে গ্রহণ করতে পার না। অর্থাৎ এমন বস্তু দান করো না, যা তোমরা লজ্জা ও অপছন্দ ছাড়া গ্রহণ কর না।
মোট কথা, আপন পালনকর্তার জন্যে এমন বস্তু পছন্দ করো না। হাদীসে আছে, এক দেরহাম লক্ষ দেরহামকেও পেছনে ফেলে দেয়। কারণ, মানুষ এই একটি দেরহামকে তার উৎকৃষ্ট ও হালাল মাল থেকে সানন্দে দান করে। আর কখনও লক্ষ দেরহাম এমন মাল থেকে দান করা হয়, যাকে সে নিজেই খারাপ মনে করে। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা তাদের নিন্দা করেছেন, যারা আল্লাহর জন্যে এমন বস্তু সাব্যস্ত করে, যা তারা নিজেদের জন্যে খারাপ মনে করে। আল্লাহ বলেন:
وَيَجْعَلُونَ لِلَّهِ مَا يَكْرَهُونَ وَتَصِفُ الْسِنَتُهُمُ الْكِذَّبَ أَنَّ لَهُمُ الْحُسْنَى لَا جَرَمَ أَنَّ لَهُمُ النَّارَ .
তারা তাদের অপছন্দনীয় বস্তু আল্লাহর জন্যে সাব্যস্ত করে। তাদের মুখ মিথ্যা বর্ণনা করে, পুণ্য তাদের জন্যই। এটা স্বতঃসিদ্ধ, তাদের জন্যে রয়েছে অগ্নি।
সপ্তম আদব, দান খয়রাতের জন্যে এমন লোক তালাশ করা, যাদের দ্বারা দান-খয়রাত মর্যাদাশীল ও পবিত্র হয়। যেনতেন লোকের হাতে তা পৌঁছে দেয়া ঠিক নয়। ছয়টি গুণের মধ্যে থেকে দুটি গুণ যাদের মধ্যে পাওয়া যায় তাদেরকে খয়রাত দেবে।
প্রথম- এমন লোক তালাশ করবে, যে পরহেযগার, সংসারবিমুখ ও কেবল আখেরাতের ব্যবসায়ে লিপ্ত। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ
لا تاكل الا طعام تقى ولا ياكل طعامك الاتقى .
পরহেযগার ব্যক্তির খাদ্য ছাড়া খেয়ো না এবং তোমার খাদ্য যেন পরহেযগার ছাড়া কেউ না খায়।
এর কারণ, পরহেযগার ব্যক্তি খেয়ে তার পরহেযগারীকে শক্তি যোগাবে। ফলে যে খাওয়াবে সে তার এবাদতে শরীক হয়ে যাবে। হাদীসে আরও আছে- তোমরা তোমাদের খাদ্য পরহেযগারদেরকে খাওয়াও আর অনুগ্রহ যা কর, ঈমানদারদের প্রতি কর। জনৈক আলেম তার দানের মাল সুফী ফকীরগণ ছাড়া অন্য কাউকে দিতেন না। তাকে কেউ বলল: এ মাল বিশেষ এক সম্প্রদায়কে না দিয়ে সকল ফকীরকে দিলেই তো ভাল হত। তিনি বললেন: না, এই বিশেষ সম্প্রদায়ের সাহসিকতা আল্লাহর জন্যে ব্যয়িত হয়ে যায়।। তারা উপবিষ্ট হলে তাদের সাহসিকতা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। সুতরাং এক ব্যক্তিকে দান করে যদি আমি তার সাহসিকতা আল্লাহর দিকে আকৃষ্ট করতে পারি, তবে এটা আমার মতে হাজার ব্যক্তিকে দান করা অপেক্ষা উত্তম, যাদের সাহসিকতা কেবল সংসারের দিকেই নিবিষ্ট। এ উক্তিটি হযরত জুনায়দ বাগদাদী (রহঃ)-এর কাছে কেউ উত্থাপন করলে তিনি একে চমৎকার উক্তি বলে অভিহিত করলেন এবং বললেন: এ লোকটি একজন ওলী আল্লাহ। বহু দিন যাবত আমি এর চেয়ে উত্তম উক্তি শ্রবণ করিনি। কথিত আছে, এক সময় এই বুযুর্গ ব্যক্তি আর্থিক সংকটে পড়ে দোকান বন্ধ করে দিতে মনস্থ করেন। হযরত জুনায়দ তাঁর কাছে কিছু পুঁজি প্রেরণ করে বললেন: এই অর্থ দ্বারা দোকানের মাল কিনে নাও, দোকান বন্ধ করো না। তোমার মত ব্যক্তির জন্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিকর নয়। লোকটি ছিলেন সবজি বিক্রেতা। কোন দরিদ্র লোক তাঁর কাছ থেকে সবজি ক্রয় করলে তিনি দাম নিতেন না।
দ্বিতীয়তঃ বিশেষভাবে এলেমধারী ব্যক্তিকে খয়রাত দেবে। তাকে দিলে তার এলেমকে সাহায্য যোগানো হবে। এলেম এবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ যদি তাতে নিয়ত ঠিক তাঁকে। হযরত ইবনে মোবারক (রহঃ) দান-খয়রাত বিশেষভাবে এলেমধারীদেরকে দিতেন। কেউ তাঁকে বলল: আপনার খয়রাত ব্যাপকভাবে দিলেই তো ভাল হত। তিনি বললেন: আমি নবুওয়তের মর্তবার পর আলেমদের মর্তবা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কোন মর্তবা আছে বলে জানি না। আলেমের মন যদি অভাব অনটনে ব্যাপৃত থাকে, তবে সে এলেমের জন্যে সময় সুযোগ পাবে না। কাজেই তাঁকে দেয়ার অর্থ এলেমের জন্যে তাঁকে সুযোগ করে দেয়া।
তৃতীয়- তাকওয়ায় সাচ্চা ও তওহীদে পাকা ব্যক্তিকে খয়রাত দেবে। তওহীদে সাচ্চা হওয়ার অর্থ, যখন কারও কাছ থেকে খয়রাত গ্রহণ করবে, তখন আল্লাহ তাআলার হামদ ও শোকর করবে এবং মনে করবে, এ নেয়ামত তাঁরই পক্ষ থেকে। মধ্যবর্তী ব্যক্তির প্রতি লক্ষ্য করবে না। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর দরবারে বান্দার শোকর এটাই যে, সে সকল নেয়ামত আল্লাহর পক্ষ থেকে মনে করবে। লোকমান তাঁর পুত্রকে উপদেশ দেন, নিজের ও আল্লাহ তাআলার মাঝখানে অপরকে নেয়ামতদাতা সাব্যস্ত করবে না। যেব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অপরের শোকর করে, সে যেন নেয়ামতদাতাকে চেনেই না এবং বিশ্বাস করে না যে, মধ্যবর্তী ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার নিয়ন্ত্রণাধীন। কেননা, আল্লাহ তাআলাই তাকে দানে বাধ্য করেছেন এবং দানের আসবাবপত্র সরবরাহ করেছেন। সে যদি দান না করতে চাইত, তবে তা পারত না। কেননা, পূর্বাহ্ণে আল্লাহ মনে জাগরূক করেছেন যে, দান করার মধ্যেই তার ইহলৌকিক কল্যাণ নিহিত। যেব্যক্তি এটা বিশ্বাস করে, তার দৃষ্টি আল্লাহ ব্যতীত অপরের দিকে যাবে না। দাতার জন্য এরূপ ব্যক্তির বিশ্বাস প্রশংসা ও শোকরের চেয়ে বেশী উপকারী। যেব্যক্তি দান করার কারণে প্রশংসা ও দোয়া করে, সে দান না করার কারণে নিন্দা এবং বদ দোয়াও করতে পারবে। বর্ণিত আছে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) কোন এক ফকীরের কাছে কিছু খয়রাত প্রেরণ করে দূতকে বলে দিলেন: ফকীর যা বলে মনে রাখবে। ফকীর খয়রাত গ্রহণ করে বলল: আল্লাহর শোকর, যিনি রিযিকদানকারীকে ভুলেন না এবং শোকরকারীকে বরবাদ করেন না। ইলাহী! আপনি আমাকে বিস্তৃত না হলে আপনার রসূল (সাঃ)-কে এমন করুন যে, তিনি আপনাকে না ভুলে যান। দূত এসে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জানালে তিনি ফকীরের উক্তিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন। দেখ, এই ফকীর তার দৃষ্টি কিভাবে আল্লাহ তাআলাতে নিবদ্ধ করেছে! রসূলুল্লাহ (সাঃ) এক ব্যক্তিকে তওবা করতে বললে সে বলল: আমি কেবল আল্লাহ' তাআলার দিকে তওবা করি- মুহাম্মদ (সাঃ)-এর দিকে নয়। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন: তুমি হকদারের হক চিনতে পেরেছ। হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর অপবাদ মোচনের আয়াত অবতীর্ণ হলে হযরত আবু বকর (রাঃ) তাঁকে বললেন: আয়েশা! দাঁড়াও, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মস্তক চুম্বন কর। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন: আল্লাহর কসম, আমি এরূপ করবো না। আমি আল্লাহ ব্যতীত কারও কাছে কৃতজ্ঞ নই। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন: আবু বকর! তাকে ছাড়, কিছু বলো না। এক রেওয়ায়েতে আছে, হযরত আয়েশা (রাঃ) পিতা আবু বকরকে এই জওয়াব দেন-
الحمد لله لا يحمدك ولا يحمد صاحبك .
অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলার শোকর। এতে আপনার ও আপনার সঙ্গীর অর্থাৎ রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কোন অনুগ্রহ নেই। রসূলুল্লাহ (সাঃ) অস্বীকৃতি জানাননি, অথচ অপবাদ মোচনের তাঁর মাধ্যমেই হযরত আয়েশার কাছে পৌঁছেছিল। নেয়ামত আল্লাহ তাআলা ছাড়া অপরের পক্ষ থেকে মনে করা কাফেরদের বৈশিষ্ট্য। সেমতে আল্লাহ বলেন-
وَإِذَا ذُكِرَ اللهُ وَحْدَهُ اشْمَازَتْ قُلُوبُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ وَإِذَا ذُكِرَ الَّذِينَ مِن دُونِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ -
যখন এককভাবে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন যারা পরকালে বিশ্বাস করে না, তাদের অন্তর স্তব্ধ হয়ে যায়। আর যখন আল্লাহ ব্যতীত অন্য দেবদেবীদের নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন তারা হর্ষোৎফুল্ল হয়ে যায়।
যেব্যক্তির অন্তর মাধ্যমের প্রতি তাকানো থেকে মুক্ত নয় এবং একে নিছক মাধ্যম মনে করে না, তার মন যেন শেরকে খফী তথা গোপন শেরক থেকে আলাদা হয়নি। তার উচিত আল্লাহকে ভয় করা এবং স্বীয় তওহীদকে শেরকের ময়লা ও সন্দেহ থেকে পরিষ্কার করা।
চতুর্থ- যারা আপন অবস্থা গোপন রাখে, অভাব-অভিযোগ ও কষ্টের কথা খুব একটা বর্ণনা করে না, অথবা যেব্যক্তি পূর্বে ধনী ছিল, এখন সর্বস্বহারা, কিন্তু পূর্বের অভ্যাস পরিত্যাগ করে না এবং পুরোপুরি ভদ্রতা বজায় রেখে জীবন যাপন করে এরূপ লোককে খয়রাত দেবে। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন-
يَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ أَغْنِيَاء مِنَ التَّعَفُّفِ تَعْرِفُهُمْ بسيْمُهُمْ لَا يَسْتَلُونَ النَّاسِ الْحَافًا .
সওয়াল থেকে বেঁচে থাকার কারণে মূর্খরা তাদেরকে ধনী মনে করে। তুমি তাদেরকে চেহারা দেখে চিনতে পারবে। তারা মানুষের গায়ে পড়ে সওয়াল করে না। অর্থাৎ, সওয়াল করার মধ্যে আতিশয্য করে না। কারণ, তারা আপন বিশ্বাসে ধনী এবং সবর দ্বারা সম্মানী। প্রত্যেক মহল্লায় ধার্মিক লোকদের মাধ্যমে এরূপ ব্যক্তিদের তালাশ করা উচিত। এরূপ সম্ভ্রমী লোকদের মনের অবস্থা খয়রাতকারীদের জানা উচিত। কেননা, তাদেরকে খয়রাত দেয়া প্রকাশ্য সওয়ালকারীদেরকে খয়রাত দেয়ার তুলনায় কয়েক গুণ বেশী সওয়াব রাখে।
পঞ্চম- যারা অধিক সন্তান-সন্ততিসম্পন্ন অথবা রোগাক্রান্ত অথবা কোন কারণে দুর্দশাগ্রস্ত, তাদেরকে খয়রাত দেবে। আয়াতে বলা হয়েছে:
لِلْفُقَقَرَاءِ الَّذِينَ أُحْصِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا يَسْتَطِيعُونَ ضَرْبًا فِي الْأَرْضِ .
সেসব ফকীরের জন্যে, যারা আল্লাহর পথে আটকা পড়েছে, তারা স্বদেশে চলাফেরা করতে পারে না। অর্থাৎ, যারা আখেরাতের পথে পরিবার-পরিজনের কারণে অথবা রুজি-রোজগারের স্বল্পতার কারণে অথাব আত্মসংশোধনের কারণে আটকা পড়েছে। ফলে দেশে সফর করার শক্তি রাখে না। কেননা, এসব কারণে তাদের হাতে পায়ে জিঞ্জির পড়েছে। হযরত ওমর (রাঃ) এক গৃহের লোকদেরকে এক পাল ছাগল অথবা দশটি ছাগল অথাবা আরও বেশী দান করতেন। রসূলুল্লাহ (সাঃ) সন্তান-সন্ততির সংখ্যা অনুযায়ী দান করতেন। হযরত ওমর (রাঃ)-কে কেউ জাহ্দুল বালা'র উদ্দিষ্ট অর্থ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন: সন্তান সন্ততির আধিক্য এবং অর্থ সম্পদের স্বল্পতা।
ষষ্ঠ- যে ফকীর আত্মীয় এবং রক্তের সাথে সম্পর্কশীল, তাকে খয়রাত দেবে। এতে খয়রাতও হবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্কও বজায় থাকবে। আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার মধ্যে অনেক সওয়াব। হযরত আলী (রাঃ) বলেন: যদি আমি এক দেরহাম দিয়ে আমার কোন ভাইয়ের আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখি, তবে তা আমার মতে বিশ দেরহাম খয়রাত করা অপেক্ষা উত্তম। যদি বিশ দেরহাম দিয়ে সম্পর্ক বজায় রাখি, তবে এটা একশ' দেরহাম খয়রাত করার চেয়ে ভাল। পরিচিতদের মধ্যে বন্ধুদেরকে আগে দান করা উচিত; যেমন অপরিচিতদের তুলনায় আত্মীয়কে আগে দেয়া উত্তম।
মোট কথা, এসব প্রার্থিত গুণের প্রতি লক্ষ্য রেখে খয়রাত দেয়া উচিত। এগুলোর প্রত্যেকটিতে অনেক স্তর রয়েছে। সর্বোচ্চ স্তর অন্বেষণ করা উচিত। কোন ব্যক্তির মধ্যে এসব গুণের মধ্য থেকে কয়েকটি পাওয়া গেলে তাকে নেয়ামত মনে করতে হবে। যে উপযুক্ত লোক খোঁজাখুঁজি করবে, সে দ্বিগুণ সওয়াব পাবে। ভুল হয়ে গেলেও এক সওয়াব নষ্ট হবে না।
0 Comments