সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাবের নাম হলো আল কোরআনুল কারীম। এ কিতাব মানব জাতিকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরণ করা হয়েছে। এ জন্য এর নাম হলো কিতাবুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর কিতাব। এই কোরআনকে অবতীর্ণের সময় কাল থেকে পৃথিবী ধ্বংস হবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের জন্য একমাত্র জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কোরআনের পূর্বেও মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের কাছে নবী ও রাসূলদের মাধ্যমে আসমানি কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে। কোরআনুল কারীমে সেসব আসমানি কিতাবের নাম তাওরাত, যাবূর ও ইঞ্জিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআন প্রধান ফেরেস্তা হযরত জিবরাইল আলাইহিস্ সালাম মহান আল্লাহর আদেশে বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপরে অবতীর্ণ করেছেন। এ কিতাবকে সহীহ শুদ্ধভাবে পড়ে শুনানো এবং এর প্রকৃত অর্থ বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূলের ওপরে দেয়া হয়েছিল। এ কিতাব পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর বাণী এবং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন এ কিতাবের সঠিক ব্যাখ্যাতা। সারা পৃথিবীর মানব মন্ডলীর পৃথিবীতে শান্তি এবং আলমে আখিরাতে মুক্তি এই কোরআনের শিক্ষা অনুসরণের ওপরে পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল। এ কারণেই পবিত্র কোরআন যে কোন ধরনের মানুষের পক্ষে বুঝতে পারা সম্ভব। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-
وَلَقَدْ يَسِّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِكْرِ فَهَلْ مِنْ مُّدَّكِرٍ
আমি এ কোরআন উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ মাধ্যম বানিয়েছি। এখন উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি? (সূরা ক্বামার-৪০)
মানুষের জন্য এ কোরআন হৃদয়ঙ্গম করা সহজ হলেও সবার পক্ষে এ কোরআন থেকে হেদায়েত লাভ করা সম্ভব নয়। হেদায়েত লাভ করতে হলে যেসব শর্ত পূরণ করা প্রয়োজন, সেসব শর্ত যাঁদের মধ্যে বিদ্যমান থাকবে, কেবল তাঁরাই এ কোরআন থেকে হেদায়েত লাভ করতে সক্ষম হবেন। এ কোরআন একদিনে বা একই সময়ে অংতীণ হয়নি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে প্রয়োজন অনুসারে, ঘটিতব্য বা সংঘটিত কারণে, সময়ের বিভিন্ন পর্যায়ে অল্প অল্প করে রাসূলের ওপরে অবতীর্ণ করেছেন।
পবিত্র কোরআন আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হলেও তার বর্ণনাশৈলী, বাচনভঙ্গী পৃথিবীতে প্রচলিত আরবী ভাষার অনুরূপ নয়। এই কিতাবের ভাষা প্রচলিত আরবী ভাষা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং কোরআনের ভাষা নির্ধারণ করেছেন স্বয়ং আল্লাহর রাব্বুল আলামীন। এই কোরআনের ভাষা যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে তেমনি কোরআন যে ভাব প্রকাশ করে, সে ভাবও এসেছে আল্লাহর পক্ষ থেকেই। এ কোরআন যাঁর ওপরে অবতীর্ণ হয়েছে নিঃসন্দেহে তিনি মানব জাতির বাইরের কেউ ছিলেন না। তিনিও মানুষ ছিলেন, তবে পৃথিবীর অন্যান্য মানুষ থেকে তিনি ছিলেন ভিন্ন। কোরআনের বাহক মানুষ ছিলেন এ কথা স্বয়ং আল্লাহ তাঁকেই বলতে বলেছেন-
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ
বলো, আমিও তোমাদের অনুরূপ একজন মানুষ। (সূরা আল কাহ্ফ-১১০)
কোরআনের বাহক মানুষ ছিলেন বলে এর ভাষা ও বাচনভঙ্গী, বর্ণনাশৈলী, শব্দ চয়ন, ভাব মানুষের রচিত কোন কিতাবের মতো নয়-বরং তা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ও আগত। এ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ মানব জাতিকে অবগত করেছেন-
ذَلِكَ الْكِتَابُ لأَرَيْبَ فِيهِ
এটা সেই কিতাব যার মধ্যে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। (সূরা আল বাকারা-২)
অর্থাৎ এটা সন্দেহাতীতভাবে আল্লাহর কিতাব, এটা এমন একটি কিতাব, যে কিতাবে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টিকারী একটি বাক্যও সংযোজন করা হয়নি। পৃথিবীর চিন্তাবিদগণ, গবেষকগণ নানা ধরনের গ্রন্থ রচনা করে থাকেন। তাঁদের গবেষণালব্ধ বিষয় বস্তু গ্রন্থাকারে মানব জাতির সামনে প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু তাঁরা গ্রন্থাকারে যেসব তথ্য ও তত্ত্ব প্রকাশ করেন, সে সম্পর্কে পূর্ণ নিশ্চয়তা সহকারে এ কথা বলতে সক্ষম নন যে, 'তাঁদের বিবৃত বিষয় সম্পূর্ণ সংশয় মুক্ত'।
কিন্তু পবিত্র কোরআন তার বিবৃত বিষয়, তথ্য ও তত্ত্ব সম্পর্কে সকল সন্দেহ ও সংশয় মুক্ত বলে স্পষ্ট ঘোষণাই শুধু দেয়নি, এ ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। কারণ এই কোরআন যাঁর বাণী তিনি সব ধরনের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য, দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান, ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য ও অতিদ্রীয় তথ্য, তত্ত্ব ও নির্ভুল জ্ঞানের একচ্ছত্র অধিপতি। তিনি যে কোন ধরনের দুর্বলতা, দোষ-ত্রুটি অক্ষমতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। সুতরাং তিনি যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, সে কিতাবে সামান্যতম সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না।
মানুষ সীমাবদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী। দুর্বলতা, ভ্রান্তি, অজ্ঞতা ও অক্ষমতার বন্ধনে আষ্টেপৃে জড়িত। মানুষ সন্দেহ আর সংশয়ের আবর্তে আবর্তিত হয় এবং এটা মানুষের স্বভাবজাত। এ কারণে মানুষের চিন্তার জগতে পবিত্র কোরআন সম্পর্কে যদি কোন সংশয় সৃষ্টি হয়, এ সংশয় • মানুষেরই অজ্ঞতা আর অক্ষমতার প্রত্যক্ষ ফসল। এর সাথে আল্লাহর কোরআনের ন্যূনতম কোন সম্পর্ক নেই। গগন চুম্বী বিশাল অট্টালিকার সামনে একজন মানুষ যদি তার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চোখের সামনে তুলে ধরে, তাহলে সে মানুষের দৃষ্টির সামনে থেকে আকাশ চুম্বী দেই শততলা অট্টালিকা আড়াল হয়ে যায়। কিন্তু তাই বলে অট্টালিকার অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। অট্টালিকা বিদ্যমান, এটা অটল বাস্তবতা। দুর্বলতা পরিবেষ্টিত সীমাবদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী মানুষ নিজের অক্ষমতার কারণে যদি কোরআনের সততা নিরূপণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার যাবতীয় ব্যর্থতা মানুষের ওপরেই আপতিত হয়, আল্লাহর কোরআনকে তা স্পর্শ করতে পারে না।
0 Comments