মেঘমালা থেকে বজ্রপাত

 

        মানুষ ক্ষেতে চাষ করে ফসল লাভের আশায় বীজ বপন করে বাড়িতে চলে আসে। কৃষক ক্ষেতে বীজ বপন করে তারপর তার পক্ষে আর মূল বিষয়ে করণীয় কিছুই থাকে না। যে ভূমিতে সে বীজ বপন করলো, এই ভূমি তার সৃষ্টি নয়। ভূমিতে উর্বরা শক্তি ও ফসল উৎপাদনের যোগ্যতা কোন মানুষ দান করেনি। বর্তমান বিজ্ঞানীগণ বলছেন, যে ঋতুতে বজ্রপাত অধিকহারে সংঘটিত হয়, সে ঋতুতে ফসলের উৎপাদন সবচেয়ে বেশী বৃদ্ধি পায়। কারণ বজ্রপাতের মাধ্যমে ভূমিতে যে নাইট্রোজেন চক্র ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে, এতে করে ভূমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি লাভ করে। এই নাইট্রোজেনই গাছের প্রাণশক্তি। যেসব মৌল উপাদান খাদ্য সামগ্রীতে সংগৃহীত হয়, সেটা মানুষের চেষ্টার ফসল নয়। জমিতে যে বীজ মানুষ বপন করে, তাকে বিকশিত করা ও প্রবৃদ্ধি লাভের যোগ্যতাও মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না। এই চাষাবাদ ও বীজ বপনকে সবুজ আভায় হিল্লোলিত চারাগাছে পরিপূর্ণ ক্ষেতে পরিণত করার জন্য ভূমির মধ্যে যে কার্যক্রম এবং মাটির ওপরে যে আলো, বাতাস, তাপ, শীতলতা ও মৌসুমী অবস্থার আবর্তন হওয়া প্রয়োজন, তার ভেতরে একটি জিনিসও মানুষের সৃষ্টি নয়। ফসলের ভেতরে দানা সৃষ্টির ব্যাপারেও মানুষের কোন ভূমিকা নেই। এগুলো সবই ঐ দয়াময় রাহমান-আল্লাহই অনুগ্রহ করে তাঁর বান্দাদের জন্য করে থাকেন। তিনি বলেন-

أَفَرَيْتُمْ مَّا تَحْرُثُوْنَ أَنْتُمْ تَزْرَعُوْنَهُ أَمْ نَحْنُ الزرعُوْنَ - لَوْ نَشَاءُ لَجَعَلْنَهُ حُطَامًا فَظَلْتُمْ تَفَكَّهُوْنَ 

        তোমরা কি কখনো চিন্তা-বিবেচনা করে দেখেছো, তোমরা যে বীজ বপন করো, তা থেকে তোমরা ফসল উৎপাদন করো না আমি করি? আমি ইচ্ছা করলে এই ফসলকে দানাবিহীন ভূষি বানিয়ে দিতে পারতাম। (সূরা আল ওয়াকী'আ-৬৩-৬৫)

মহাকাশে অদৃশ্য ছাকনি

        আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, আমার নাম রাহমান। তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পর্কে তোমরা একটু ভেবে দেখো। আমি তোমাদের জন্য পানির ব্যবস্থা কিভাবে করেছি। এই পানি তোমাদের জীবন, তোমাদের জীবন ধারণের জন্য অন্যান্য বস্তুর থেকে পানির প্রয়োজন সবচেয়ে বেশী। এই পানির স্রষ্টা তোমরা নও-আমিই দয়া করে তোমাদের জন্য সে পানি পরিবেশন করেছি। পৃথিবীর বুকে এই নদী-সমুদ্র, খাল-বিল-হাওড়, বিশালাকারের জলাধার আমিই সৃষ্টি করেছি। আমি সূর্য সৃষ্টি করে তার ভেতরে তাপ দান করেছি। এমন পরিমাণে তাপ দান করেছি যেন সে তাপে পানি শোষিত হয়ে বাষ্পাকারে মহাশূন্যের দিকে উত্থিত হয়। পানির ভেতরে এই গুণ-বৈশিষ্ট্য আমিই দান করেছি যে, একটি বিশেষ মাত্রার তাপ লাভ করলেই পানি বাষ্পে রূপান্তরিত হয়। আমি বাতাস সৃষ্টি করেছি। আমার আদেশে বাতাস সেই বাষ্প কণাগুলো ওপরের দিকে উঠিয়ে নিয়ে জমা করতে থাকে। তারপর আমার আদেশে তা মেঘমালায় পরিণত হয়। আমার আদেশে সেই মেঘ পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। যে স্থানের জন্য যতটুকু পানির অংশ ও পরিমাণ নির্দিষ্ট করা হয়, সেখানে ততটুকু পৌছে দেয়া হয়। ঊর্ধ্বজগতে আমি এমন শীতলতা সৃষ্টি করেছি যার ফলে পৃথিবী থেকে উত্থিত বাষ্প পুনরায় সেখানে পানিতে রূপান্তরিত হয়। তারপর আমারই আদেশে তা পৃথিবীতে বর্ষিত হয়।

        পানির ভেতরে মহান আল্লাহ যে বিশেষত্ব দান করেছেন, তা দেখলে সিজদায় মাথানত হয়ে আসে। সমুদ্রের পানি একদিকে লবণাক্ত, তারপরে এই মানুষ পানিতে কতকিছুর মিশ্রণ ঘটাচ্ছে। কলকারখানার নানা ধরনের বর্জ্য পদার্থ এই পানির সাথে মিলেমিশে একাকার হচ্ছে। মলমূত্র, বিষাক্ত দ্রব্য ও অজস্র মৃতদেহ এই পানিতে মিশে যাচ্ছে। পানির নিচে নানা ধরনের অস্ত্রের বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে। এভাবে পানি মারাত্মক আকারে দূষিত হয়ে পড়ছে। এই পানি পান করলে মানুষের পক্ষে জীবিত থাকা সম্ভব হবে না। আল্লাহ তা'য়ালা সূর্য থেকে তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তাপের মাধ্যমে পানি শোষিত হয়ে বাষ্পাকারে ওপরের দিকে উত্থিত হচ্ছে। মহাশূন্যে আল্লাহ এমন এক অদৃশ্য শক্তিশালী ছাকনি (Filter) নির্মাণ করেছেন যে, পানিতে যত জিনিস মিশ্রিত হয়েছে, তাপের দরুন পানি যখন বাষ্পে পরিণত হয়, তখন সব ধরনের মিশ্রিত জিনিস নিচে পড়ে থাকে এবং শুধুমাত্র পানির জলীয় অংশসমূহ ওপরের দিকে উঠে গিয়ে জমা হতে থাকে।

        আল্লাহ রাহমান, তিনি দয়া করে এ ব্যবস্থা না করলে পানি যখন ওপরের দিকে উত্থিত হতো, তখন সেই পানির মিশ্রিত যাবতীয় বস্তুও উঠে যেতো। এ অবস্থায় পানি হতো দুর্গন্ধময় পানের অযোগ্য। সমুদ্র থেকে যে বাষ্প ওপরের দিকে উঠে যায়, তা লবণাক্ত বৃষ্টির আকারে নেমে এসে পৃথিবীর সমস্ত ভূমিকে লবণাক্ত করে দিতো। ফলে পৃথিবীর ভূমিতে কোন ফসল হওয়া তো দূরের ব্যাপার, ক্ষুদ্র একটি উদ্ভিদও জন্ম নিত না। মানুষ ও মিষ্টি পানির জীবজগৎ এ পানি পানও করতে সক্ষম হতো না।

        পানি থেকে অসহনীয় দুর্গন্ধ আর দ্রবণীয়-অদ্রবণীয় বর্জ্য পদার্থ এবং লবণ নিষ্কাশনের এই ব্যবস্থা যিনি করেছেন, তিনিই রাহমান-অসীম দয়ালু আল্লাহ। যিনি পানির এই বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করেছেন তিনি সমস্ত দিক বিবেচনা করে তার অসীম জ্ঞানের মাধ্যমে আপন রাহ্যুতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই উদ্দেশ্যে করেছেন যে, তার তাঁর প্রিয় সৃষ্টিসমূহের জীবন ও প্রতিপালনের মাধ্যম ও উপায় হয়ে দাঁড়াবে। যেসব সৃষ্টি লবণাক্ত পানিতে জীবিত থাকতে ও লাতিত-পালিত হতে পারে, তিনি সেসব সৃষ্টিকে সমুদ্রে সৃষ্টি করেছেন এবং সেখানেই তারা অত্যন্ত আরামদায়ক অবস্থায় জীবন অতিবাহিত করছে। কিন্তু স্থলভাগ ও বায়ুমন্ডলে বসবাসের জন্য সৃষ্টি জীবের জীবন ও লালন-পালনের জন্য মিষ্টি পানি ছিল অপরিহার্য। এই প্রয়োজন পূরণের জন্য বৃষ্টির ব্যবস্থা কার্যকর করার পূর্বেই তিনি পানির ভেতরে এই গুণ ও বৈশিষ্ট্য রেখে দিয়েছেন যে, পানি তাপের প্রভাবে বাষ্পে পরিণত হওয়ার সময় এতে সংমিশ্রিত কোন জিনিসসহ উত্থিত হবে না বরং তা সম্পূর্ণ গন্ধ ও দূষিত বস্তু পরিশোধিত হয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পান ও জীবন ধারনের উপযোগী অবস্থায় উত্থিত হবে। তিনি রাহমান-তাঁর রাহমত সৃষ্টিজগৎ ব্যাপী পরিব্যাপ্ত।

Post a Comment

0 Comments