নবী করীম (সা:) এর প্রতি প্রাণাধিক ভালোবাসা- ঈমানের অপরিহার্য দাবী

 


        পবিত্র কুরআন ও হাদীসে নবী করীম (সা:) কে সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং সৃষ্টিসমূহের মধ্যে তাঁর যে অতুলনীয় মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে, এসব দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে স্পষ্টতই বুঝা যায়, একজন মুসলিম যদি পূর্ণ মুমিন হতে চায় তাহলে তাকে অবশ্য অবশ্যই নবী করীম (সা:) কে নিজ পরিবার পরিজন, সন্তান-সন্ততি, ধন-সম্পদ এমন কি নিজ প্রাণের তুলনায় অধিক ভালোবাসতে হবে। তাঁর প্রতি নিখাদ এবং সর্বাধিক ভালোবাসা না থাকলে কোনো মুসলিমের পক্ষে মুমিনের পূর্ণ স্তরে উপনীত হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে-

عَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يُؤْمِنُ أَحَدُ كُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَ وَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ

        হযরত আনাস (রা:) বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা:) বলেছেন, তোমাদের কেউই ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যে পর্যন্ত না আমি তার কাছে তার পিতা- মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয় হই। (বুখারী, মুসলিম)

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرِ رَضِيَ اللهُ تَعَالَى عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم لَا يُؤْمِنُ أَحَدُ كُمْ حَتَّى يَكُوْنَ هَوَاهُ تَبْعًا لِّمَا خِفْتُ بِهِ -

        হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা:) বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা:) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ আকাংখিত মানের মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের প্রবৃত্তিকে আমার আনীত বিধানের অধীন করে। (শরহে সুন্নাহ্- মিশকাত)

        নবী করীম (সা:) এর প্রতি ভালোবাসার অর্থ এটা নয় যে শুধুমাত্র কিছু সময় তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করা। মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা, রবিউল মাসের আগমনে রং বেরংয়ের ফেস্টুন বানিয়ে বিশাল মিছিল করা, তাঁর জীবনী আলোচনার উদ্দেশ্যে মাহফিলের আয়োজন ইত্যাদি করে নবী করীম (সা:) এর ভালোবাসার হক আদায় হয়ে যাবে।

        স্বয়ং আল্লাহ তা'য়ালা রাসূল (সা:) এর প্রতি দরূদ প্রেরণ করেন, তিনি ফিরিশতা ও মানুষকে তাঁর রাসূলের প্রতি দরূদ প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছেন, সুতরাং রাসূলের প্রতি দরূদ পাঠ করা বাধ্যতামূলক এবং তাঁর নাম শোনামাত্র দরূদ পাঠ না করলে গোনাহগার হতে হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। নবী করীম (সা:) এর প্রতি ভালোবাসা পোষণকারী মুসলমানদের মধ্যে দু'টি শ্রেণী দেখা যায়। একটি শ্রেণী নবী করীম (সা:) এর প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটায় এভাবে, তিনি পাগড়ী, টুপি ও লম্বা জামা ব্যবহার করেছেন, এরাও তাই করে। তিনি নামাজ, রোজা, যাকাত ও হজ্জ আদায় করেছেন, এরাও তাই করে। তিনি বিশেষ বিশেষ খাদ্য পছন্দ করেছেন, এরাও তাই পছন্দ করে। তিনি নফল নামাজ আদায় করেছেন, তাসবীহ-তাহলীল পাঠসহ কুরআন তিলাওয়াত করেছেন, এরাও তাই করে। এই শ্রেণীর মধ্যে কেউ কেউ রাসূলের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ হিসেবে রবিউল মাসের আগমনে তাঁর জীবনী আলোচনা, মিলাদ মাহফিল, নানা রংয়ের ফেস্টুন বানিয়ে মিছিল এবং রাসূল (সা:) এর উদ্দেশ্যে নানা ধরনের আবৃত্তি ও গান বা হামদ-নাতের আয়োজনও করে।

        আরেকটি শ্রেণীকে আমরা দেখতে পাই, তাঁরা রাসূল (সা:) কে ভালোবেসে কেউ কেউ দাড়ি রাখে, লম্বা জামাও ব্যবহার এবং নামাজ আদায় করে সেই সাথে নামাজের শিক্ষা সাহাবায়ে কেরামের মতো সকল স্তরে বাস্তবায়নের চেষ্টাও করে। এরাও যাকাত আদায়ের মাধ্যমে সাহাবায়ে কেরামের অনুরূপ যাকাত ভিত্তিক অর্থনীতি চালু করার লক্ষ্যে আন্দোলন করে। এরাও হজ্জ আদায় করে এবং হজ্জের শিক্ষানুসারে সমগ্র মুসলিম মিল্লাতকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করে। এরাও রাসূল (সা:) এর জীবনী পর্যালোচনার মাধ্যমে রাসূল (সা:) এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্যে আন্দোলন- সংগ্রাম করে। এরাও কুরআন তিলাওয়াত করে সেই সাথে কুরআন বুঝার চেষ্টা করে এবং কুরআনের নির্দেশসমূহ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল স্তরে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অর্থ ব্যয় করে, হাসিমুখে জেল-জুলুম বরণ করে এবং প্রয়োজনে প্রাণও দেয়। এরাও দরূদ পড়ে, হামদ-নাত আবৃত্তি করে এবং রাসূল (সা:) এর মর্যাদার প্রতি কেউ আঘাত করলে রাসূলের প্রতি সর্বাধিক ভালোবাসার কারণে বারুদের মতোই জ্বলে ওঠে।

        নবী করীম (সা:) এর প্রতি ভালোবাসা পোষণকারী মুসলিমদের মধ্যে এই দুই শ্রেণীর লোকদের ভালোবাসা কি সমপর্যায়ের? অথবা এই দুই শ্রেণীর ভালোবাসার মূল্যমান কি এক? রাসূলের প্রতি ভালোবাসার মধ্যে যেমন একদিকে রয়েছে ধন- সম্পদ বিনষ্ট হওয়া, জেল-জুলুম সহ্য করা ও নিজ প্রাণ দেয়ার ঝুঁকি। অপরদিকে রয়েছে ঝুঁকিহীন ভালোবাসা। শুধুমাত্র কুরআন তিলাওয়াত এবং তসবীহ-তাহলীল, নামাজ, রোজা, হজ্জ ও যাকাত আদায়, টুপি ও লম্বা জামা ব্যবহার, মিলাদ ও রবিউল আউয়াল মাসে মিছিলের আয়োজন করে রাসূল (সা:) এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের মধ্যে কোনো ঝুঁকি নেই।

        নবী করীম (সা:) এর প্রতি সাহাবায়ে কেরামের ভালোবাসা কেমন ছিলো তা জানা থাকলে বর্তমান মুসলিমদের মধ্যে এই দু'টি শ্রেণীর মধ্যে কোন শ্রেণীর ভালোবাসা প্রকৃত ভালোবাসা এবং সাহাবায়ে কেরামের ভালোবাসার কোটি ভাগের কিছু অংশ হলেও কোন্ শ্রেণীর মধ্যে রয়েছে তা জানা যাবে।

        সাহাবায়ে কেরামের সম্মুখে আল্লাহর রাসূল (সা:) বর্তমান ছিলেন এবং তাঁদের সম্মুখেই পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। রাসূল (সা:) কুরআনের শিক্ষানীতি অনুসারে সাহাবায়ে কেরামকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তাঁরা নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত আদায় করেছেন এবং বুঝে কুরআন তিলাওয়াত করেছেন। সেই সাথে তাঁরা নবী করীম (সা:) ও পবিত্র কুরআনের শিক্ষা জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও বাস্তবায়ন করেছেন। কুরআন ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাঁরা অকাতরে কষ্টার্জিত ধন-সম্পদ ব্যয় করেছেন। আল্লাহ তা'য়ালা ও রাসূলের মর্যাদার সাথে সাংঘর্ষিক কিছু দেখলে গর্জে উঠেছেন এবং দুশমনদের সাথে মুকাবেলা করতে গিয়ে তাঁরা পরিবার পরিজনসহ অকল্পনীয় অত্যাচার সহ্য করেছেন, প্রয়োজনে নিজের প্রাণ পর্যন্ত হাসিমুখে দান করেছেন। রাসূলের প্রতি ভালোবাসার প্রকৃত অর্থ হলো, তিনি মহান আল্লাহর নিকট থেকে যে আদর্শ নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেছেন, সেই আদর্শ সর্বাত্মক অনুসরণ করা এবং তা সমাজ ও দেশে বাস্তবায়ন করার জন্যে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও চেষ্টা করা। মহান আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

قُلْ إِنْ كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

        (হে নবী,) আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহ তা'য়ালাকে ভালোবাসো তাহলে আমার কথা মেনে চলো, (এভাবে আমাকে ভালোবাসলে) আল্লাহ তা'য়ালাও তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তিনি তোমাদের গোনাহ্ ক্ষমা করে দিবেন; আল্লাহ তা'য়ালা অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়াবান। 
(সূরা আলে ইমরাণ-৩১)

        নবী করীম (সা:) কে ভালোবাসার অর্থই হলো জীবনের সকল দিকে একমাত্র তাঁকেই  অনুসরণ করা, এখানে সহজ ও কঠিন দিক বলে কিছুই নেই এবং আংশিক অনুসরণেরও সুযোগ নেই। পরিবেশ পরিস্থিতি অনুসারে রাসূল (সা:) এর জীবনের সকল দিকই অনুসরণ করতে হবে। যারা সুবিধাবাদী নীতি অনুসরণে সহজ দিক বা আংশিক তথা ঝুঁকিমুক্ত অনুসরণ করবে অথবা করবে না, তাদেরকে আল্লাহ তা'য়ালা কোন্ বিশেষণে বিশেষিত করেছেন দেখুন। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

قُلْ أَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُوْلَ جِ فَإِن تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْكَافِرِينَ

         (হে রাসূল) আপনি (আরো) বলুন, তোমরা যদি আল্লাহ তা'য়ালা ও (তাঁর) রাসূলের কথা মেনে চলো, (এ আহ্বান সত্ত্বেও) তারা যদি (এ থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয় (আপনি জেনে রাখুন), আল্লাহ তা'য়ালা কখনো কাফিরদের পছন্দ করেন না। (সূরা আলে ইমরান-৩২)

        নবী করীম (সা:) কে একজন মানুষ যখন নিজ প্রাণেরও অধিক ভালোবাসতে সক্ষম হয় তখনই কেবল সেই মানুষের পক্ষে রাসূলের আদর্শের জন্যে নিজের কষ্টার্জিত ধন-সম্পদ অকাতরে ব্যয় করা সম্ভব হতে পারে। জেল-জুলুম অত্যাচার সহ্য করতে পারে এবং প্রয়োজনে নিজের প্রাণও কুরবান করতে পারে। একবার নবী করীম (সা:) এর সাথে কথোপকথনকালে হযরত উমার (রা:) বললেন-

لانت أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ إِلَّا نَفْسِي -

        'হে রাসূল (সাঃ)! আপনি আমার কাছে সকল কিছুর তুলনায় অধিক বেশি প্রিয় কিন্তু আমার প্রাণের চাইতে অধিক নয়'। এ কথা শুনে নবী করীম (সা:) বললেন-

وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُوْنَ أَحَبَّ إِلَيْكَ مِنْ نَفْسِكَ 

        'শপথ ঐ মহান সত্তার যাঁর হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের মধ্যে কেউ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ আমি তোমাদের কাছে তোমাদের প্রাণের তুলনায় অধিক প্রিয় না হই'। এ কথা শোনার সাথে সাথে হযরত উমার (রা:) বললেন-

أَنْتَ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ كُلِّ شَيْ حَتَّى نَفْسِي -

        'আপনি আমার কাছে এখন সকল কিছুর তুলনায় এমনকি আমার প্রাণের তুলনায় অধিক প্রিয়'। এবার নবী করীম (সা:) হযরত উমার (রা:)-কে পূর্ণ ঈমানের সনদ দিয়ে বললেন-

الآنَ يَا عُمَرُ -

        'হে উমার! এখন তোমার ঈমান পূর্ণতা লাভ করলো'।

        পবিত্র কুরআন ও সমগ্র হাদীস পর্যালোচনা করলে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, নবী করীম (সা:) কে ভালোবাসার অর্থই হলো তাঁর মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার লক্ষ্যে তাঁর পূর্ণাঙ্গ আদর্শ জীবনের সকল ক্ষেত্রে অনুসরণ করা। নিজ সুবিধা অনুসারে সহজ দিক মেনে চলা এবং বিপদ-ক্ষতি হতে পারে এ কথা মনে করে কঠিন দিক অনুসরণ না করা ঈমানদারের লক্ষণ নয়। নবী করীম (সা:) যা কিছু আদেশ করেছেন তা অনুসরণ করা এবং যা কিছু নিষেধ করেছেন তা বর্জন করার অর্থই হলো তাঁর প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা, এটা করতে পারলেই সীরাত মাহফিলের আয়োজন ও দরূদ পাঠ করা সার্থক হবে এবং আদালতে আখিরাতে তা নাজাতের উসিলা হবে। রাসূলের প্রতি ভালোবাসার নামে এমন কোনো ধরনের অনুষ্ঠান করা যাবে না বা এমন পদ্ধতিও অনুসরণ করা যাবে না, যা ইসলামী জীবন ব্যবস্থা অনুমোদন করেনি। সাহাবায়ে কেরাম তাঁর প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ যেভাবে ঘটিয়েছেন, সেই ভাবেই ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতে হবে এবং এটাই পরিপূর্ণ মুমিনের স্তরে উপনীত হবার একমাত্র পন্থা।

Post a Comment

0 Comments