মক্কা অভিযান-বিজয়ীর বেশে বিশ্বনবী

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম মক্কা অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকলেন। তাঁর এই অভিযানের এই প্রস্তুতি অত্যন্ত গোপনে হচ্ছিল। মক্কার ইসলাম বিরোধিরা যেন জানতে না পারে, এ কারণেই গোগনীয়তার প্রয়োজন ছিল। আল্লাহর নবী তাঁর পরিকল্পনার কথা কাউকে জানালেন না। যুদ্ধ বা রক্তপাত ছিল তাঁর পবিত্র স্বভাবের বাইরে। তিনি তাঁর পবিত্র অন্তর থেকে কামনা করতেন, মক্কা বিজয় যেন কোন ধরণের রক্তপাত ব্যতীতই হয়ে যায়। তিনি জানতেন, মক্কাবাসী তাঁর সাথে শত্রুতা করলেও তারা তাঁর পরম আপনজন। তারা বোঝেনা, সত্য চিনেনা, না বুঝে তাঁর সাথে শত্রুতা করে। সুতরাং কোন ধরণের যুদ্ধ ব্যতীতই তিনি মক্কা জয়েব আশা পোষন করছিলেন।

        গোপন পরিকল্পনার ভিত্তিতে তিনি অগ্রসর হতে থাকলেন। মিত্র গোত্রদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছিল, কিন্তু কেন কি উদ্দেশ্যে প্রস্তুত হতে বলা হলো, তারা তা জানতে পারলেন না। এমনকি হযরত আয়েশাও জানতেন না, আল্লাহর নবী কোনদিকে যাবেন। শত্রু পক্ষের গুপ্তচরদের দৃষ্টি এড়িয়ে তিনি বিশাল এক বাহিনী প্রস্তুত করলেন। সমস্ত বাহিনী মদীনায় একত্রিত করে মদীনা থেকে সবাই একত্রে যাত্রা করবেন, ব্যাপার এমন ছিল না। পথে যেন তারা আল্লাহর নবীর সাথে নিজের গোত্রের পতাকা আর বাহিনী নিয়ে মিলিত হয়, তিনি এমন ব্যবস্থা করলেন। কোন অভিযানের ব্যাপারে সাধারণত তিনি এত গোপনীয়তা অবলম্বন করতেন না।

        মদীনা থেকে কেউ বের হয়ে মক্কার দিকে যাবে, এমন পথসমূহে তিনি প্রহরা বসালেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে কুলসুমকে দায়িত্ব দিলেন, আল্লাহর নবী মদীনায় অনুপস্থিত থাকা অবস্থায় তিনি যেন মদীনার শাসকের দায়িত্ব পালন করেন।

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম অষ্টম হিজরী সনের রমজান মাসের দশ তারিখে মদীনা থেকে মক্কা অভিযানে বের হলেন। তিনি এমন বর্ণাঢ্য অবস্থায় কোন অভিযানেই বের হননি। এই অভিযানে তিনি এমন সুসজ্জিত অবস্থায় বের হলেন, যেন ইসলামের শত্রুদের কলিজায় কাঁপন ধরে। দশ হাজার সুসজ্জিত বাহিনী আল্লাহর রাসূলের সাথে। তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন তাঁর মাতৃভূমির দিকে। যেখান থেকে একদিন তিনি অশ্রু বিসর্জন দিয়ে বের হয়ে এসেছিলেন। কা'বাঘরের দিকে তাকিয়ে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, 'হে কা'বা! তোর নিষ্ঠুর সন্তানরা আমাকে থাকতে দিল না।'

        আল্লাহর নবী বিশাল এক বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। এবার আর জনমানবহীন প্রান্তর দিয়ে নয়, জনপদ দিয়েই তিনি তাওহীদের বিজয় কেতন উড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিটি জনপদ থেকেই পতাকাসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী আল্লাহর রাসূলের সাথে যোগ দিচ্ছে। বিশাল এক জনসমুদ্র তরঙ্গের ওপরে তরঙ্গ সৃষ্টি করে মক্কার দিকে প্রবল বেগে এগিয়ে চলেছে। বিভিন্ন গোত্রের দু'একজন তখন পর্যন্ত ইসলামের সাথে শত্রুতা পোষন করতো, তারা চক্ষু বিষ্ফারিত করে তাওহীদের এই তরঙ্গ দেখছে।

        আল্লাহর নবী রাতের অন্ধকারে মক্কা থেকে অনতিদূরে মাররুজ জাহরান নামক এলাকায় এসে উপনিত হলেন। সেখানেই তিনি যাত্রা বিরতি করে সৈন্যবাহিনীকে শিবির স্থাপন করতে আদেশ দিলেন। হাজার হাজার তাঁবু স্থাপন করা হলো। তিনি আদেশ দিলেন, প্রতিটি তাঁবুতেই যেন পৃথকভাবে রান্নার আয়োজন করা হয়। এ কারণে প্রতিটি তাঁবুতেই পৃথকভাবে চুলা জ্বালানোর প্রয়োজন হলো। ক্ষণিকের ভেতরেই হাজার হাজার চুলা জ্বলে উঠলো।

        রাতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে বিশাল প্রান্তর আলোকিত হয়ে উঠলো। সে আলোয় মক্কা নগরী যেন উদ্ভাসিত হয়ে গেল। ভয়ে ইসলাম বিরোধিদের কলিজা যেন কণ্ঠনালী দিয়ে বের হয়ে আসার উপক্রম হলো। বিশ্বনবী রাতের অন্ধকারে অধিক সংখ্যক চুলা জ্বালানোর যে আদেশ দিলেন, এর পেছনে ছিল সামরিক কৌশল। ইসলামের শত্রুগণ যেন ধারণা করে, লক্ষ লক্ষ বাহিনী মক্কার দিকে এগিয়ে আসছে। ঘটেছিলও তাই, কুরাইশরা দেখতো যেন লক্ষ লক্ষ চুলা জ্বলছে। চুলার সংখ্যা যখন নিরূপণ করা যাচ্ছে না, তাহলে সৈন্যর সংখ্যা নিশ্চয়ই লাখ কয়েক হবে।

        চরম আতংকে তাদের নিশ্বাস যেন বন্ধ হবার উপক্রমন হলো। তারা বিশ্বনবীর বাহিনীর সঠিক সংখ্যা জানার জন্য হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহার ভাইয়ের সন্তান হাকিম ইবনে হিজাম, বুদাইল ইবনে ওরাকা ও তাদের নেতা স্বয়ং আবু সুফিয়ানকে প্রেরণ করলো। তারা ছদ্মবেশে মুসলিম বাহিনীর দিকে এগিয়ে এলো প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য। ওদিকে আল্লাহর নবীর চাচা আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু ইসলাম গ্রহণ করলেও তিনি মক্কাতেই অবস্থান করতেন। তিনি যেদিন পরিবার পরিজন নিয়ে মদীনার দিকে হিজরত করলেন, সেদিনই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম মদীনা থেকে মক্কা অভিযানে বের হলেন। পথে চাচা ভাতিজার সাক্ষাৎ হলো। তিনিও মক্কা অভিযানে শামিল হলেন।

        হযরত আব্বাস ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, যদি এমন কাউকে পেতেন তাহলে তার কাছে সংবাদ প্রেরণ করতেন, সে যেন মক্কায় গিয়ে কুরাইশদের কাছে বলে, যথা সময়ে এসে আল্লাহর নবীর কাছে আত্মসমর্পণ করে নিজেদের নিরাপত্তা কামনা করে। হযরত আব্বাস বিশ্বনবীর সাদা খচ্চড়ে চড়ে অনুসন্ধান করছিলেন। এমন সময় তাঁর সাথে মক্কার আবু সুফিয়ানের দেখা হয়ে গেল। হযরত আব্বাস তাকে বললেন, 'দেখতে পাচ্ছো তো, আল্লাহর রাসূল বিশাল এক বাহিনী নিয়ে এসেছেন। মক্কার কুরাইশরা এবার ধূলার সাথে মিশে যাবে।'

         আবু সুফিয়ান ব্যগ্র কন্ঠে হযরত আব্বাসকে বললেন, 'আমার মা-বাপ তোমার জন্য কোরবান হোক। এই অবস্থায় কি করতে হবে আমাকে বলে দাও।'

         তিনি বললেন, 'তোমাকে দেখতে পেলে নিশ্চয়ই মুসলিম বাহিনী মাথা কেটে নেবে এতে সন্দেহ নেই। তুমি আমার এই খচ্চড়ের পেছনে উঠে বসো। আল্লাহর রাসূলের কাছে চলো। আমি তোমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।' মক্কার কুরাইশ নোত আবু সুফিয়ান, যার দাপটে রণভূমি কেঁপে উঠেছে। সেই নেতা আজ নিজের প্রাণের মায়ায় কোন কথা না বলে রাসূলের চাচার পেছনে উঠে বসলো। হযরত আব্বাস খচ্চর ছুটিয়ে আল্লাহর নবীর দিকে যেথে থাকলেন। হযরত ওমর আগুনের যে চুলা জ্বালিয়ে ছিলেন, তার পাশ দিয়েই হযরত আব্বাস যাচ্ছিলেন। হযরত ওমর তাকে দেখে ফেললেন। তিনি বলে উঠলেন, 'আল্লাহর শোকর যে, তিনি তাঁর দুশমনকে আমাদের ভেতরে এনে দিয়েছেন।'

        কিন্তু তাকে হত্যা করতে হলে আল্লাহর রাসূলের অনুমতি প্রয়োজন, এ কারণে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু দ্রুত উঠে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের দিকে ছুটলেন। হযরত আব্বাস খচ্চর ছুটিয়ে আল্লাহর নবীর কাছে উপস্থিত হয়ে আবু সুফিয়ানের প্রাণ ভিক্ষার আবেদন করলেন। হযরত ওমরও তাকে হত্যা করার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। বিশ্বনবী কোন পক্ষেই সাড়া দিলেন না। হযরত আব্বাস হযরত ওমরকে বললেন, 'হে ওমর! এই লোক যদি তোমার কবিলার হত তাহলে কি তুমি এতটা কঠোর হতে পারতে?'

         হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বললেন, 'আপনি এমন করে বলবেন না। আপনি যেদিন ইসলাম কবুল করেছিলেন, সেদিন আমি যা আনন্দিত হয়েছিলাম আমার পিতা খাত্তাব ইসলাম কবুল করলেও এতটা আনন্দিত হতাম না।'

        এই সেই আবু সুফিয়ান, যার নেতৃত্বে বিশ্বনবীর প্রিয় চাচা হযরত হামজা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুকে হত্যা করে তাঁর বুক চিরে কলিজা বের করে চিবিয়ে ছিল আবু সুফিয়ানেরই স্ত্রী হিন্দা। স্বয়ং আবু সুফিয়ান হযরত হামজার পবিত্র দেহে বর্শার আঘাত করে নানা কথা বলেছিল। তার অতীত কর্ম তৎপরতা সমস্ত মুসলমানের সামনে ছিল স্পষ্ট। অজস্র অপরাধে সে অপরাধী। তাঁর প্রতিটি অপরাধই ছিল মৃত্যুদন্ডের যোগ্য। কিন্তু যার সামনে সে দাঁড়িয়ে ছিল নতমস্তকে, তিনি ছিলেন রাহমাতুল্লিল আলামীন। করুণার মূর্ত প্রতীক হিসাবে যিনি পৃথিবীতে আগমন করেছেন। আল্লাহর নবী আবু সুফিয়ানের কানের কাছে মুখ নিয়ে অভয় দান করলেন, 'কোন ভয় নেই, এটা ভয়ের জায়গা নয়।'

        ঐতিহাসিক আত তাবারী বলেন, আবু সুফিয়ানের সাথে আল্লাহর নবীর কিছু কথা হয়েছিল। তিনি তাকে জিজ্ঞাস করেছিলেন, 'হে আবু সুফিয়ান। এখনো কি তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না, যে আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই?' আবু সুফিয়ান বলেছিল, 'আজ যদি অন্য কোন ইলাহ থাকতো, তাহলে তো আমাদের কাজেই আসতো।' আল্লাহর নবী তাকে জিজ্ঞাস করেছিলেন, 'আমি যে আল্লাহর রাসূল এতে কি তোমার সন্দেহ আছে?' সে জবাব দিয়েছিল, 'সামান্য একটু সন্দেহ আছে।'

        শেষ পর্যন্ত আবু সুফিয়ান ইসলাম কবুল করেছিল। আল্লাহর নবী তাঁকে মর্যাদা দিয়েছিলেন। সে এক সময় প্রকৃত ঈমানদার হয়েছিল। ইসলামের পক্ষে সে যুদ্ধেও গমন করেছে। তায়েফের যুদ্ধে তাঁর একটা চোখ আহত হয়েছিল। ইয়ারমুকের যুদ্ধে সে চোখ সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কোন বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু আল্লাহর নবীর কাছে সুপারিশ করেছিলেন, 'হে আল্লাহর রাসূল। আবু সুফিয়ান একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। আপনি যদি আজ তাকে অনুগ্রহ না করেন তাহলে তার মর্যাদা থাকে না।'

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'অবশ্যই আমি আজ তাকে মর্যাদা দিবো।' তারপর তিনি আবু সুফিয়ানকে লক্ষ্য করে বললেন, 'তুমি মক্কায় গিয়ে ঘোষনা করে দাও, যে ব্যক্তি অস্ত্র ত্যাগ করবে সে নিরাপত্তা লাভ করবে। যে ব্যক্তি কা'বায় আশ্রয় লাভ করবে, সে নিরাপত্তা লাভ করবে। যে ব্যক্তি নিজের গৃহের

        দরজা বন্ধ রাখবে, সে নিরাপত্তা লাভ করবে। আর ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের বাড়িতে থাকবে, তারাও নিরাপত্তা লাভ করবে।' তদানীন্তন আরবে কারো বাড়িকে নিরাপত্তার স্থল হিসাবে ঘোষনা দেয়ার অর্থ ছিল, তাকে অত্যন্ত সম্মান প্রদর্শন করা। আল্লাহর নবী আবু সুফিয়ানের ক্ষেত্রে তাই করেছিলেন। আবু সুফিয়ান মক্কায় গিয়ে আল্লাহর নবীর ঘোষনা জানালেন। তাঁর ঘোষনা শুনে মক্কার কুরাইশরা হতবিহ্বল হয়ে পড়লো। তিনি আরো ঘোষনা দিলেন,'আজ থেকে আমি তোমাদের আর নেতা নই, আমার পরিচয় শোন, আমি মুসলমান।'

        তাওহীদের সেনাবাহিনী মক্কার দিকে অগ্রসর হতে থাকলো। আল্লাহর নবী তাঁর প্রিয় চাচা হযরত আব্বাসকে বললেন, 'আবু সুফিয়ানকে উচ্চস্থানে দাঁড় করিয়ে দাও, তাওহীদের সেনাবাহিনীর রূপ চেহারা সে দেখুক।'

        বিশ্বনবী সৈনিকদের নিয়ে মক্কা নগরীতে প্রবেশ করছেন, কুরাইশরা ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়লো। কেউ আবু সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করলো, কেউ কা'বাঘরে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। কয়েকজন মক্কা ত্যাগ করে পালিয়ে গেল। হযরত আব্বাস নওমুসলিম আবু সুফিয়ানকে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলেন। তাওহীদের বিশাল বাহিনী সমুদ্রের তরঙ্গের মতই মক্কা নগরীতে আছড়ে পড়লো।

        এক বিস্ময়কর দৃশ্যের অবতারণা হলো। আরবের বিভিন্ন গোত্র তাদের নিজের গোত্রের পতাকা উড়িয়ে মক্কা নগরীতে প্রবেশ করছে। তাঁরা আল্লাহু আকবর শ্লোগানে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে আল্লাহর সৈনিকরা বীর দর্পে কুজকাওয়াজ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। সর্ব প্রথম গিফারী গোত্রের মিছিল সামনের দিকে এগিয়ে গেল। তার পেছনে জুবায়না গোত্র। মহান আল্লাহ হোদায়বিয়া সন্ধিকে 'ফতহুম মুবিন' অর্থাৎ প্রকাশ্য বিজয় বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। আজ তার বাস্তব অবস্থা মানুষ দেখতে পাচ্ছে। এরপর বিভিন্ন গোত্রের মিছিল বজ্রকণ্ঠে তাওহীদের শ্লোগানে মক্কা নগরীকে প্রকম্পিত করে এগিয়ে গেল।

        নওমুসলিম আবু সুফিয়ান এসব জান্নাতি দৃশ্য দেখতে দেখতে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলেন। তাঁর সাথে ছিলেন বিশ্বনবীর চাচা হযরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু। কারণ সেদিন তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর। তিনি চিনতে পারছিলেন না, কোনটা কোন বাহিনী। হযরত আব্বাসকে বিভিন্ন বাহিনীর পরিচয় তিনি জিজ্ঞাসা করছিলেন। এগিয়ে এলো বিশাল এক মিছিল নিয়ে সেনাপতি হযরত সায়াদ ইবনে উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু। আবু সুফিয়ান জিজ্ঞাসা করলেন, 'এই বিশাল বর্ণাঢ্য বাহিনী আবার কোন বাহিনী?' হযরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বললেন, 'এই বাহিনী মদীনার আনসারদের বাহিনী।'

        হযরত উবায়দা দেখলেন আবু সুফিয়ান দাঁড়িয়ে আছেন হযরত আব্বাসের সাথে। তাকে দেখে তিনি বললেন, 'হে আবু সুফিয়ান। আজকের দিন রক্তপাতের দিন। কা'বাকে আজ উন্মুক্ত এবং বৈধ করে দেয়া হবে।'

        অর্থাৎ আজ কা'বা এলাকায় রক্তপাত করা বৈধ। সুফিয়ান বুঝলেন, আজ মক্কা নগরীতে রক্তের প্লাবন বইয়ে দেয়া হবে। তিনি শংকিত হয়ে পড়লেন। তাহলে তাঁর আত্মীয়-স্বজন এবং মক্কার অধিবাসীরা কেউ আজ জীবিত থাকবে না? এমন সময় তিনি দেখলেন, বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে পরিবেষ্টন করে সাহাবায়ে কেরাম মিছিল করে মক্কা নগরীতে প্রবেশ করছেন। এই মিছিলের পতাকা ছিল হযরত যুবায়ের ইবনে আওয়াম রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর হাতে।

        আবু সুফিয়ান উচ্চকণ্ঠে বললেন, 'হে আল্লাহর রাসূল। আপনি শুনেছেন, উবায়দা কি বলে গেল।' আল্লাহর রাসূল জানতে চাইলেন, 'কি বলেছে উবায়দা?' আবু সুফিয়ান জানালেন, 'উবায়দা বলে গেল আজকের দিন রক্তপাতের দিন। কা'বাকে আজ উন্মুক্ত এবং বৈধ করে দেয়া হবে।'

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁকে অভয় দান করে বললেন, 'উবায়দা ভুল বলেছে। আজ কা'বা শরীফের মর্যাদা দানের দিন।' অর্থাৎ কোন রক্তপাত নয়, কা'বাঘরের প্রকৃত যে মর্যাদা, আজ সেই মর্যাদা দানের দিন।

        এরপর তিনি নির্দেশ দিলেন, 'উবায়দার হাত থেকে পতাকা নিয়ে তা যেন তাঁরই সন্তানের হাতে দেয়া হয়। পরিত্র মক্কা নগরীতে এক পথ ধরে মিছিল প্রবেশ করেনি। বিভিন্ন পথ ধরে মিছিল প্রবেশ করছিল। হযরত খালিদ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর নেতৃত্বে একটা বিশাল মিছিল নগরীতে প্রবেশ করছিল।

         বোখারী শরীফে এসেছে বিজয়ী বীর বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম, যাকে এই নগরীর লোকজন কতই না অত্যাচার করেছে। নামাযে দাঁড়ালে মাথার ওপর পশুর পচা নাড়ি ভুড়ি চাপিয়ে দিয়েছে। নবী মাথা উঠাতে পারেননি। শিশু ফতেমা পিতার এই করুণ অবস্থা দেখে কেঁদেছেন আর হাহাকার করেছেন। নবীকে পথে বের হতে দেয়নি। তাঁকে পাগল বলে ঢিল ছুড়েছে। রান্না করতে দেয়নি। রান্নার হাড়িতে আবর্জনা নিক্ষেপ করেছে। এত অত্যাচার যারা করেছে, তাদের ভেতরে তিনি বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করছেন।

        অথচ তাঁর চেহারায় গর্ব অহংকারের কোন চিহ্ন নেই। তাঁর সমস্ত আচরণে ক্ষমা আর মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পাচ্ছে। সুললিত কন্ঠে তিনি ঐ সূরা ফাত্‌হ্ তিলওয়াত করছেন। যে সূরায় বিজয়ের সুসংবাদ দিয়ে হোদায়বিয়ার সন্ধির সময় নাজিল হয়েছিল। ইসলাম তরবারীর শক্তিতে আসেনি। এই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে দেখুন, ইসলাম কোন শক্তির বিনিময়ে বিজয়ী হয়েছে।

        হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফ্ফাল রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বলেন, আমি মক্কা বিজয়ের দিন আল্লাহর রাসূলকে উটের ওপর বসে মিষ্টি কন্ঠে সূরা ফাত্‌হ্ পাঠ করতে দেখেছি। হযরত মুআবিয়া ইবনে কুররা বলেন, যদি আমার পাশে লোকজন ভীড় করার আশংকা না থাকতো, তাহলে মুগাফ্ফালের মত আমিও রাসূলের কোরআন তিলওয়াত শুনতাম। (বোখারী)

        আল্লাহর নবীর নির্দেশ ছিল, কোন ধরণের বাধা না এলে কারো প্রতি আঘাত করা যাবে না। কিন্তু কুরাইশদের একটা হঠকারী দল হযরত খালেদ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর মিছিলের ওপর আক্রমন করে বসলো। তিনজন সাহাবা শাহাদাতবরণ করলেন। বাধ্য হয়ে হযরত খালেদ হামলা করলেন। কুরাইশদের বিভ্রান্ত দলের ১৩ জন নিহত হলো। আল্লাহর নবী দূর থেকে যুদ্ধের দৃশ্য দেখে হযরত খালেদকে তলব করলেন। কৈফিয়ত চাইলেন, কেন যুদ্ধ শুরু করা হলো। তিনি জানালেন, প্রতিপক্ষ তাদের ওপরে প্রথমে আক্রমন করে তিনজনকে শহীদ করে দিয়েছে। তখন আল্লাহর নবী বললেন, 'আল্লাহর ইচ্ছা এমনই ছিল।'

        বিশ্বনবীর পতাকা হাজুন নামক স্থানে বসানো হলো। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, 'হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আজ কোথায় থাকবেন? আপনি কি আপনার সেই পুরোনো বাড়িতেই থাকবেন?' আল্লাহর রাসূল বললেন, 'আকীল কি কোন জায়গা রেখেছে!' তারপর তিনি বললেন, 'ঈমানদার ব্যক্তি কাফেরদের উত্তরাধিকারী হয় না। আর কাফেরও ঈমানদারের উত্তরাধিকারী হয় না। (বোখারী)

        ইসলামী আইনে কোন মুসলমান কোন অমুসলিমের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারে না। আল্লাহর নবীর চাচা আবু তালিব যখন ইন্তেকাল করেছিলেন, সে সময় হযরত আলীর ভাই আকীল অমুসলিম ছিলেন। তিনি আল্লাহর নবীর এবং তাঁর পিতার সমস্ত সম্পদ আবু সুফিয়ানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। বিশ্বনবী কা'বার ঐ স্থানে অবস্থানের কথা বললেন, যেখানে ইসলাম বিরোধিরা ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য একত্রিত হয়ে শপথ গ্রহণ করতো। তিনি মক্কা বিজয়ের সময় মক্কার উচ্চ এলাকা কাদা নামক স্থান দিয়ে প্রবেশ করেছিলেন। তিনি যে উটে বসেছিলেন, তাঁর পেছনে বসেছিলেন মৃতার যুদ্ধে শাহাদাত প্রাপ্ত হযরত যায়িদ ইবনে হারিসার সন্তান হযরত উসামা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুম। বিশ্বনবীর পবিত্র মাথা মোবারকে এ সময় ছিল লোহার শিরস্ত্রাণ। আল্লাহর নবী বিজয়ী হতে যাচ্ছেন। এ কারণে তিনি উটের ওপরে মহান আল্লাহর কাছে এতই কৃতজ্ঞশীল ছিলেন যে, তিনি মাথা নীচু করেছিলেন। তাঁর পবিত্র মাথা এতটাই নীচু হয়েছিল যে, তাঁর পবিত্র দাড়ি মোবারক উটের শরীরের সাথে স্পর্শ করছিলো।

        আহা! ঐ বিলালের ওপরে কি নিষ্ঠুর নির্যাতনই না করেছে মক্কার নিষ্ঠুর কাফেররা। তাঁর পবিত্র শরীরের গোস্ত আর রক্ত মক্কার পথে প্রান্তরে ছিটকে পড়েছে। তিনিও নবীর সাথে আছেন। কিন্তু তাঁর মনেও নেই কোন প্রতিশোধের সামান্যতম ইচ্ছা। সাহাবায়ে কেরামের চোখে মুখে মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার চিহ্ন। গোটা বিশ্বের কোন নেতা বা কোন বিজয়ী বাহিনীর এমন কোন ইতিহাস নেই, তারা বিজিত এলাকায় ক্ষমা আর করুণার মালা নিয়ে প্রবেশ করেছে। শুধু মাত্র ব্যতিক্রম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর অনুসারীরা। ক্ষমা আর করুণার সাগরে প্রাণের শত্রুও অবগাহন করেছে।

Post a Comment

0 Comments