মহান আল্লাহ তা'য়ালা এ পৃথিবীতে যে সকল নবী-রাসূল প্রেরণ করেছিলেন, তাদের জন্যে তিনটি বিষয় ছিলো অপরিহার্য এবং এ তিনটি বিষয়ই তাঁদেরকে দান করা হয়েছিলো। সে তিনটি বিষয় (এক) ওহী (দুই) উন্নত চরিত্র এবং (তিন) মু'জিযা বা অলৌকিক ক্ষমতা। একান্ত অপরিহার্য এ তিনটি বিষয় দিয়েই আল্লাহ তা'য়ালা সকল নবী-রাসূলকে প্রেরণ করেছিলেন।
এক. ওহী মহান আল্লাহ তা'য়ালা নবী-রাসূলদের প্রতি অবতীর্ণ করেন এবং প্রত্যেক নবী-রাসূলের জন্যে ওহী ছিলো একান্তই অপরিহার্য বিষয়। কারণ তাদেরকে যে মিশন দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছিলো, তা পূর্ণ করার জন্যেই তাঁদের প্রতি ওহী অবতীর্ণ করা হতো। ওহী ব্যতীত তাঁদের মিশন পূর্ণ হতো না।
নবী-রাসূলকে সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত করার জন্যে আল্লাহ তা'য়ালার এটা নিয়ম ছিলো না যে, তিনি তাঁদের সাথে আকাশ থেকে কোনো ফিরিশতা অবতীর্ণ করবেন এবং সে ফিরিশতা সকল মানুষকে আহ্বান জানিয়ে বলবেন, 'এ ব্যক্তিকে তোমাদের সকলের জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী নির্বাচিত করা হয়েছে, তোমরা এ ব্যক্তির আনুগত্য করো'।
দুই. সৃষ্টিগতভাবে এটি সকল মানুষের সহজাত ধারণা যে, নবী-রাসূলের চরিত্র হয় নিষ্কলুষ, সর্বাধিক উন্নত গুণ-বৈশিষ্টের অধিকারী এবং অপার্থিব জ্ঞান বিবেকের অধিকারী। আল্লাহ তা'য়ালা পৃথিবীতে যাদেরকে নবী-রাসূল হিসাবে মনোনীত করেছেন, সর্বাধিক উন্নত নৈতিক চরিত্রের গুণ-বৈশিষ্ট দান করেছেন। তাঁদের তুলনায় সমগ্র পৃথিবীতে উন্নত নৈতিক চরিত্র ও অভ্রান্ত জ্ঞানের অধিকারী আর কেউই ছিলেন না। আর এসব উন্নত বৈশিষ্ট আল্লাহ তা'য়ালা পূর্ব থেকেই তাদের স্বভাব-প্রকৃতির মধ্যে দান করেছিলেন।
নবী-রাসূলগণ যখনই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন, তখন ইসলামের দুশমনরা তাদের প্রতি নানা ধরনের কল্পিত অপবাদ দিলেও তাঁদের স্বভাব, প্রকৃতি, অভ্যাস ও নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে বিন্দুমাত্র অভিযোগ তোলার সাহস করেনি। কারণ তারা এ কথা ভালো করেই জানতো যে, এই ব্যক্তি আমাদের সকলের থেকে উন্নত বৈশিষ্টের অধিকারী।
তিন. মু'জিযা বা অলৌকিক ক্ষমতা। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সকল নবী- রাসূলকেই তাঁদের কর্মপরিধি এবং পরিবেশ পরিস্থিতির গুরুত্বানুযায়ী প্রয়োজন অনুপাতে মু'জিযা বা অলৌকিক ক্ষমতা দান করেছিলেন। এই মু'জিযা বা অলৌকিক ক্ষমতা সকলকেই একই ধরনের দান করা হয়নি। এর ধরন ছিলো ভিন্ন এবং পদ্ধতিও ছিলো ভিন্ন।
এ পৃথিবীতে সাধারণ মুসলমানের জন্যে 'অদৃশ্যের প্রতি ঈমান' আনাই যথেষ্ট, কিন্তু নবী-রাসূলদের যে দায়িত্ব সহকারে এ পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছিলো, তাদের জন্যে বিষয়টি 'অদৃশ্যের প্রতি ঈমান' পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিলো না। অর্পিত দয়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার জন্যে সৃষ্টির নিগূঢ় রহস্য ও মহাসত্য এত্যক্ষভাবে দর্শন করার প্রয়োজন ছিলো, এই প্রয়োজনের জন্যেই তাঁদেরকে মু'জিযা দান করা হয়েছিলো। পৃথিবীতে সাধারণ মানুষকে সত্য জানার জন্যে যেমন পরীক্ষা-নীরিক্ষা, আন্দাজ-অনুমান ও গবেষণা করতে হয়, তারপরেও সত্য উদঘাটন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। বর্তমানে যা সত্য বলে ধারণা করে পরবর্তীতে সে ধারণা পরিবর্তন করতে এ মানুষ বাধ্য হয়। অর্থাৎ পরিপূর্ণ সত্য জ্ঞান অনুধাবনের অভ্রান্ত ক্ষমতা মানুষের নেই বিধায় তারা তাদের ধারণা বার বার পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় এবং সত্যের ব্যাপারে মানুষের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়।
একজন নবী-রাসূলকেও আল্লাহ তা'য়ালা সাধারণ মানুষের অবস্থার ওপর ছেড়ে দেননি। তাঁদেরকে সৃষ্টি রহস্য নিজ চোখে দেখানো হয়েছে এবং আল্লাহ তা'য়ালা এ প্রক্রিয়াতেই তাঁদেরকে অভ্রান্ত জ্ঞান দান করেছেন। মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহীম (আ:) এর মু'জিযা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে সূরা বাকারার ২৬০ নং আয়াতে, হযরত সালেহ (আ:) এর মু'জিযা সম্পর্কে সূরা আ'রাফের ৭৩ নং আয়াতে, হযরত মূসা (আ:) এর মু'জিযা সম্পর্কে সূরা আ'রাফের ১১৬, ১১৭ নং আয়াত, সূরা ত্বাহা-এর ১৭ থেকে ২৩ ও ৭৭ নং আয়াত এবং অন্যান্য সূরায়, হযরত সুলাইমান (আ:) এর মু'জিযা সম্পর্কে সূরা আন্ নাম্ন-এর ১৬, ৩৮ ও ৪০ নং আয়াত, হযরত ঈসা (আ:) এর মু'জিযা সম্পর্কে সূরা মারইয়াম এর ২৭ ও ৩০ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এসব আয়াতের বিস্তারিত তাফসীর পড়লে নবী-রাসূলদের মু'জিযা সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করা যাবে। এ ছাড়াও পবিত্র কুরআনের অন্যান্য সূরাতেও বিভিন্ন নবী- রাসূলের মু'জিযা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।
অন্যান্য সকল নবী-রাসূলদের যেসকল মু'জিযা দান করা হয়েছিলো, তা ছিলো তাঁদের জীবনকালের সাথে সম্পর্কিত। তাঁরা যতদিন পর্যন্ত এ পৃথিবীতে জীবিত ছিলেন ততদিন পর্যন্ত তাঁদের মু'জিযার কার্যকারিতা ছিলো। ইন্তেকালের সাথে সাথে তাঁদের প্রতি দানকৃত মু'জিযারও কার্যকারিতার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। হযরত দাউদ (আ:) যে কোনো ধরনের লোহা হাতের সাহায্যে গলিয়ে তা দিয়ে ইচ্ছানুযায়ী লৌহজাত দ্রব্য প্রস্তুত করতে পারতেন এবং এ মু'জিযা মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেছিলেন। তাঁর ইন্তেকালের পরে এ ধরনের মু'জিযা আজ পর্যন্তও কেউ দেখাতে পারেনি এবং কিয়ামত পর্যন্তও পারবে না। লোহা ঠিকই আছে কিন্তু সেই মু'জিযা নেই।
হযরত সুলাইমান (আ:) সকল প্রাণীর ভাষা বুঝতেন এবং বাতাসকে তাঁর অনুগত করে দেয়া হয়েছিলো। কাঠের তক্তার ওপর বসে বাতাসকে তিনি আদেশ করতেন উড়িয়ে নিয়ে যাবার জন্যে। বাতাস তাঁকে উড়িয়ে নিয়ে যেতো। তাঁর ইন্তেকালের পরে এ মু'জিযা আর কাউকে দেয়া হয়নি, আজও বাতাস ও তক্তা রয়েছে কিন্তু সেই মু'জিযা আর নেই। তাঁর ইন্তেকালের সাথে সাথে ঐ মু'জিযার পরিসমাপ্তি ঘটেছে।
হযরত ইবরাহীম (আ:) পাখি যবেহ করে তা আহার করার পর পাখীর হাড় কোনো এক পাহাড়ের ওপর রেখে আসলেন, তারপর পাখিগুলোকে ডাক দিতেই হাড়গুলো পুনরায় জীবন্ত পাখি হয়ে তাঁর কাছে ফিরে এলো। তাঁর ইন্তেকালের সাথে সাথে এ মু'জিযার সমাপ্তি ঘটলো। কিয়ামত পর্যন্ত এ ক্ষমতা কারো হবে না যে, পাখি যবেহ করে আহার করার পর তার হাড় দিয়ে পুনরায় জীবিত পাখি তৈরী করা।
হযরত মূসা (আ:) হাতের লাঠি মাটিতে নিক্ষেপ করতেন তা এক বিশাল আকারের সর্পে পরিণত হতো। লাঠি সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে রয়েছে, কিন্তু মূসা (আ:) নেই বিধায় লাঠি সর্পে পরিণত হয় না। হযরত সালেহ (আ:) পাথুরে পাহাড় থেকে উন্ত্রী বের করে আনলেন সাথে সাথে সেই উন্ত্রী শাবকও প্রসব করলো। পৃথিবীতে অসংখ্য পাথুরে পাহাড় রয়েছে, কিন্তু এসব পাহাড় থেকে কেউ উট বের করা দূরে থাক, ক্ষুদ্র একটি পিপীলিকাও বের করতে পারে না। এভাবে সকল নবী-রাসূলের ইন্তেকালের সাথে সাথে তাঁদেরকে প্রদত্ত মু'জিযাও আল্লাহ তা'য়ালা উঠিয়ে নিয়েছেন।
ব্যতিক্রম শুধু নবী করীম (সা:) এবং তাঁকে প্রদত্ত মু'জিযা। মহান আল্লাহ তাঁকে অগণিত মু'জিযা দানে ধন্য করেছিলেন। পৃথিবীতে তাঁর আগমনের লক্ষণ দেখা দেয়ার পর থেকে মাতৃগর্ভে আসা, ভূমিষ্ঠ হওয়া, তাঁর শৈশব-কৈশোর, তারুণ্য, যৌবনকাল এবং ইন্তেকালের মুহূর্ত পর্যন্ত আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর মাধ্যমে যে সকল মু'জিযা ঘটিয়েছেন, তা একত্রিত করতে গেলে বিশাল আকৃতির গ্রন্থ রচনা প্রয়োজন। নবী করীম (সা:) বয়সে যখন কয়েক বছরের বালক, সমগ্র দেশে অনাবৃষ্টি দেখা দিলো। লোকজন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো, তারা বায়তুল্লাহর ছায়াতলে গিয়ে আল্লাহর দরবারে বৃষ্টির জন্যে দোয়া করবেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকলেই কা'বা শরীফে গিয়ে উপস্থিত হলো। চাচা আবু তালিব বালক নবী করীম (সা:) কে নিজের ঘাড়ে বসিয়ে কা'বা শরীফের ছায়াতলে গিয়ে মহান আল্লাহর দরবারে বৃষ্টির জন্যে দোয়া করতে থাকলেন। দোয়ার মধ্যে এক পর্যায়ে তিনি বালক মুহাম্মাদ (সা:) এর দিকে ইশারা দিয়ে আল্লাহ তা'য়ালাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, 'এই চেহারা দেখেও কি তুমি বৃষ্টি দিবে না!'
ইতিহাস কথা বলে, এভাবে বালক মুহাম্মাদ (সা:) কে দেখিয়ে বৃষ্টির জন্যে আবেদন করার পরে লোকজন নিজেদের ঘরে ফিরে যাবারও সময় পায়নি। ক্ষণিকের মধ্যে মক্কার আকাশ মেঘে ছেয়ে গেলো তারপর শুরু হলো প্রবল বর্ষণ।
নবী করীম (সা:) তখন ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি। অনাবৃষ্টির কারণে প্রাণীজগৎ এবং মানুষ ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বৃক্ষ তরুলতা শুকিয়ে যাচ্ছে। মসজিদে নববীতে সাহাবায়ে কেরাম নবী করীম (সা:) এর কাছে আবেদন জানালেন, তিনি যেনো বৃষ্টির জন্যে দোয়া করেন। বুখারী শরীফের হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহর রাসূল দোয়া করলেন উপস্থিত লোকজন বাড়িতে ফিরে যাবার সুযোগও পেলেন না। মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হলো।
একাধারে কয়েকদিন বৃষ্টি বর্ষণ হতে থাকলো। সাহাবায়ে কেরাম আবেদন জানালো, 'হে আল্লাহর রাসূল! বৃষ্টি বন্ধের জন্যে দোয়া করুন'। নবী করীম (সা:) মসজিদে নববীর মিম্বারে বসে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন আল্লাহ তা'য়ালা একান্ত দয়া করে বৃষ্টি বন্ধ করে দিলেন।
সে সময় মক্কায় কুস্তি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। দৈহিক শক্তির অধিকারী বীরগণ কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতো। নবী করীম (সা:) এসব প্রতিযোগিতায় কখনো অংশগ্রহণ করেননি। নবুয়্যাত লাভের পূর্বে আরবের খ্যাতিমান শ্রেষ্ঠ কুস্তিগীর তাঁর সাথে লড়াই করার জন্যে বার বার বলতে থাকলে তিনি সেই কুস্তিগীরকে এমন শিক্ষা দিয়ে ছিলেন যে, জীবিত থাকা পর্যন্ত সে আর কখনো নবী করীম (সা:) কে উত্যক্ত করেনি। দৈহিক শক্তির দিক থেকেও আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর রাসূলকে এমন মু'জিযা দান করেছিলেন যা কল্পনাও করা যায় না।
হযরত আলী (রা:) বলেছেন, 'আমি মক্কা নগরীর সেই সব পাহাড় আর বিশাল পাথরগুলোকে এখনো দেখলে চিনতে পারবো, যেসব পাহাড় আর পাথরের পাশ দিয়ে নবী করীম (সা:) এর সাথে পথ চলার সময় আমি দেখতাম, গাছগুলো তাঁর প্রতি ঝুঁকে আসছে আর বৃক্ষ ও পাথর থেকে আওয়াজ শুনতাম, হে আল্লাহর রাসূল, আপনার প্রতি মহান আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক'। (তিরমিযী)
নবী করীম (সা:) বলেছেন, 'আমি মক্কার ঐসব পাথরগুলোকে চিনি, নবুয়্যাত লাভ করার পূর্বে ঐসব পাথরের পাশ দিয়ে পথচলার সময় পাথরগুলোর মধ্য থেকে সালামের আওয়াজ ভেসে আসতো'। (মুসলিম, তিরমিযী, আহমাদ, দারেমী)
মসজিদে নববী প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে এতে মিম্বার ছিলো না। নবী করীম (সা:) একটি খেজুর গাছের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে ইসলামী জীবন বিধানের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বক্তব্য রাখতেন। মিম্বার বানানোর পরে তিনি মিম্বারে বসে বক্তব্য দিতে থাকলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম এবং আল্লাহর রাসূল (সা:) শুনতে পেলেন, কেউ যেনো করুণ কণ্ঠে কাঁদছে। কান্নার উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখা গেলো, সেই খেজুর গাছের খুঁটি থেকে কান্নার আওয়াজ নির্গত হচ্ছে। আল্লাহর হাবীবের স্পর্শ বঞ্চিত হয়ে বিরহ কাতর স্বরে শুকনো খেজুর গাছটি করুণ স্বরে কেঁদেছিলো। নবী করীম (সা:) উক্ত গাছটির দিকে এগিয়ে গিয়ে আদর জানানোর পরে গাছটির কান্না বন্ধ হলো। (বুখারী, তিরমিযী, আহমাদ, ইবনে মাজাহ্, দারেমী, নাসাঈ, আবু ইয়ালী, তাবরাণী, বায়হাকী)
খন্দক যুদ্ধের সময় পরীখা খননকালে বিশাল একটি পাথরের চাঁই পরীখা খননে বাধার সৃষ্টি করলো। সাহাবায়ে কেরামের সম্মিলিত চেষ্টাতেও পাথরের চাঁই ভাঙ্গা গেলো না। নবী করীম (সা:) এগিয়ে এসে গাঁইতি দিয়ে আঘাত করার সাথে সাথে বিশাল পাথরের চাঁইটি খণ্ড বিখণ্ড হয়ে গেলো। (বুখারী, নাসাঈ, বায়হাকী, আবু নাঈম, ইবনে সায়াদ, ইবনে ইসহাক, ইবনে জারীর)
নবী করীম (সা:) হযরত আবু বকর, হযরত উমার, হযরত উসমান, হযরত আলী, হযরত তালহা এবং হযরত যুবাইর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুম আজমাঈন, তাঁদেরকে সাথে নিয়ে একটি পাহাড়ের ওপর উঠলে পাহাড়টি আন্দোলিত হতে থাকে। আল্লাহর নবী (সা:) পাহাড়ের ওপর পবিত্র কদম মুবারক দিয়ে আঘাত করে বললেন, 'স্থির হও, তোমার ওপর আল্লাহর রাসূল, সিদ্দীক এবং শহীদ আরোহণ করেছে'। পাহাড় স্থির হয়ে গেলো। (বুখারী, মুসলিম, ইবনে হাম্বল, তিরমিযী, নাসাঈ, দারে কুতনী, আবু ইয়ালী, বায়হাকী)
নবী করীম (সা:) সাহাবায়ে কেরাম সমভিব্যাহারে ভ্রমণে ছিলেন। প্রাকৃতিক প্রয়োজন হলে তিনি দেখলেন পর্দা করার মতো কোনো আড়াল নেই। তিনি হযরত জাবের (রা:) কে সাথে নিয়ে খোলা ময়দানের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন ময়দানের এক পাশে দু'টো বৃক্ষ। তিনি বৃক্ষ দু'টোকে লক্ষ্য করে বললেন, 'মহান আল্লাহর আদেশে আমার আনুগত্য করো'। এরপর তিনি যেমনটি চাইলেন বৃক্ষ দু'টো তেমনি হয়ে গেলো এবং বৃক্ষ দু'টোকে আড়াল করে তিনি প্রাকৃতিক প্রয়োজন শেষ করলেন। তারপর পুনরায় বৃক্ষ দু'টো পূর্বের অনুরূপ হয়ে গেলো। (মুসলিম, আহমাদ, বায়হাকী)
হিজরতের সময়ের ঘটনা, প্রিয় বন্ধু হযরত আবু বকর (রা:) কে সাথে নিয়ে নবী করীম (সা:) মদীনার দিকে যাচ্ছেন। খাদ্য ফুরিয়ে যাওয়ায় পথিমধ্যে তাঁরা ক্ষুধা অনুভব করলেন। দেখলেন সুদর্শন এক কিশোর অনেকগুলো ছাগল চরাচ্ছে। নবী করীম (সা:) বালককে ডেকে জানতে চাইলেন, 'ছাগলের কি দুধ আছে?'
বালক জবাব দিলো, 'এ ছাগল আমার নয়, আমি অন্যের ছাগল চরাই। আমি এ ছাগলের মালিকের অনুমতি ব্যতীত আপনাদেরকে দুধ দিতে পারবো না'।
রাসূল (সা:) বললেন, 'ঠিক আছে, তুমি এমন একটি কম বয়সী ছাগী আমার কাছে নিয়ে এসো, যা এখনো বাচ্চা দেয়ার বয়সে উপনীত হয়নি'।
বালক অল্প বয়সী একটি ছাগী আনলো। হযরত আবু বকর (রা:) গর্তযুক্ত একটি পাথর যোগাড় করলেন যা দেখতে অনেকটা পাত্রের মতো। নবী করীম (সা:) কম বয়সী ছাগীর স্তনে বিস্মিল্লাহ বলে হাত দিতেই স্তন দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। বালকসহ তাঁরা দুধ পান করলেন এবং ছাগীর স্তন যেমন ছিলো পুনরায় তেমনি হয়ে গেলো। (ইবনে সায়াদ)
একজন মরুচারী বেদুঈন নবী করীম (সা:) এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে বললো, 'আপনি যে আল্লাহ তা'য়ালার রাসূল তা আমি কিভাবে বিশ্বাস করবো?'
নবী করীম (সা:) সম্মুখের দিকে একটি খেজুর গাছের দিকে ডান হাতের ইশারা করে বললেন, 'ঐ খেজুর গাছটি যদি আমার নির্দেশ মেনে নেয় তাহলে কি তুমি আমার প্রতি ঈমান আনবে?'
বেদুঈন জানালো, এমন ঘটনা ঘটলে সে ঈমান আনবে। রাসূল (সা:) গাছের খেজুর গুচ্ছের দিকে ইশারা করা মাত্র খেজুর গুচ্ছ গাছ থেকে পৃথক হয়ে তাঁর সম্মুখে এসে উপস্থিত হলো। তিনি পুনরায় ইশারা করতেই তা স্বস্থানে চলে গেলো। এ দৃশ্য দেখে বেদুঈন তখনি ইসলাম গ্রহণ করলো। (তিরমিযী, তারিখ-ই বুখারী)
হযরত আবু তালহা (রা:) এর বাহন ঘোড়াটি ছিলো অত্যন্ত দুর্বল ও রোগা। চলতে ফিরতে ছিলো খুবই দুর্বল। নবী করীম (সা:) একদিন সে ঘোড়ায় সওয়ার হওয়া মাত্র ঘোড়াটি ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন হয়ে গেলো। তিনি মদীনা শহর ঘুরে এসে বললেন, 'এই ঘোড়াটি খুবই কোমল এবং আরামদায়ক'। এরপর থেকে উক্ত ঘোড়াটির মুকাবিলায় অন্য ঘোড়াগুলো দুর্বল মনে হতো। (বুখারী)
সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে অনেকেই এমন ছিলেন যে তাঁরা নবী করীম (সা:)-এর খেদমতে গভীর রাত পর্যন্ত উপস্থিত থাকতেন। তারপর অন্ধকার রাতে বাড়ী ফিরতে তাঁদের চলার পথে দেখতে পেতেন, তীব্র আলো পথের অন্ধকার দূর করে দিচ্ছে। তাঁরা গন্তব্যে পৌছা পর্যন্ত আলো তাদের সাথী হয়ে থাকতো। রাতের অন্ধকারে রাসূল (সা:) এর কাছ থেকে বাড়ী ফিরে যাবার সময় কোনো সাহাবীর হাতের লাঠি থেকেও আলো নির্গত হতো এবং সে আলোয় পথ দেখে তাঁরা বাড়ী ফিরতেন। (বুখারী, হাকেম, ইবনে সায়াদ, বায়হাকী)
একজন সাহাবীর একটি উট হঠাৎ উন্মাদের মতোই আচরণ করতে লাগলো। এলাকার লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়লো, এ বিষয়টি নবী করীম (সা:) শোনামাত্র সেখানে গেলেন। সাহাবায়ে কেরাম তাঁকে অনুরোধ জানিয়ে বললেন, 'হে আল্লাহর রাসূল! পশুটির কাছে যাবেন না। মানুষকে আঘাত করা এ উটটির স্বভাবে পরিণত হয়েছে'।
নবী করীম বললেন, 'চিন্তা করো না'। কথা শেষ করেই তিনি উটটির দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁকে দেখামাত্র উটটির মধ্যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা গেলো। ক্ষণপূর্বের সেই উন্মাদনা দূর হয়ে গেলো। শান্ত ভঙ্গিতে উটটি নীচু হতে হতে রেসালাতে নববীর পবিত্র কদমে লুটিয়ে পড়লো। আল্লাহর রাসূল পবিত্র হাত মুবারক দিয়ে উটের মাথা মুখ স্পর্শ করে উটটি তার মালিককে ফেরৎ দিয়ে বললেন, 'আল্লাহর প্রত্যেক সৃষ্টিই জানে যে আমি আল্লাহর রাসূল, শুধু মানুষই নাফরমানী করে'। (দারেমী, আহমাদ, নাসাঈ, ইবনে আবি শাইবা, বায়হাকী, তাবারাণী, বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
নবী করীম (সা:) মদীনার এক সাহাবীর বাগানে গিয়ে দেখলেন, একটি উট বাঁধা রয়েছে আর উটটি করুণ কন্ঠে আওয়াজ করছে। আল্লাহর রাসূল (সা:) কে দেখে উটটি রেসালাতে নববীর দিকে অশ্রু সজল দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখ নাড়াতে থাকলো। তিনি উটটির কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। উটটি নীরব হয়ে আদর জানাতে লাগলো। তিনি উপস্থিত লোকদের কাছে জানতে চাইলেন, 'এ উটটির মালিক কে?' একজন সাহাবী এগিয়ে এসে জানালো সে এটির মালিক। নবী করীম (সা:) বললেন, 'আল্লাহ তা'য়ালা তোমাদেরকে এই নিরীহ প্রাণীর অধিকারী করেছেন। তোমাদের দায়িত্ব হলো এদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা। এই উটটি আমার কাছে অভিযোগ করছে যে, তুমি একে নির্যাতন করো এবং ক্ষুধার্ত রাখো'। (আবু দাউদ, আহমাদ, মুসলিম, আবু নাঈম)
নবী করীম (সা:) এর বলা কথাগুলো হযরত আবু হুরাইরা (রা:) স্মরণে রাখার জন্যে একদিন নিজের কাপড় বিছিয়ে দরবারে নববীতে বসলেন। রাসূল (সা:) এর কথা শেষ হতেই তিনি কাপড় গুটিয়ে নিজের বুকের সাথে মিশালেন। তিনি বলেন, এরপর থেকে আমি আর কখনো কোনো হাদীস ভুলিনি। (বুখারী, মুসলিম)
হযরত আবু তালহা (রা:) একদিন নবী করীম (সা:)-এর কণ্ঠস্বর শুনে অনুভব করলেন তিনি ক্ষুধার্ত। নিজ বাড়িতে গিয়ে স্ত্রী উম্মে সুলাইম (রা:) এর কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, মাত্র কয়েকটি রুটি রয়েছে এবং এগুলো সন্তানদের খাওয়াতে হবে। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, সন্তানরা ক্ষুধার্ত থাক- আল্লাহর রাসূলের জন্যে এ রুটি পাঠাতে হবে। উম্মে সুলাইম সন্তান হযরত আনাস (রা:) এর হাতে রুটিগুলো দিয়ে দরবারে নববীতে পাঠিয়ে দিলেন।
বালক আনাস (রা:) রুটিগুলো নিয়ে এসে দেখলেন, দরবারে নববীতে অনেক মানুষ। এখন এ রুটি দিলে রাসূল (সা:) কিছুই খেতে পাবেন না, সবগুলো লোকদের দিয়ে দিবেন। তিনি অপেক্ষা করতে থাকলেন, লোকগুলো বিদায় নিলে তিনি রুটিগুলো দিবেন। কিন্তু আল্লাহর রাসূল (সা:) এর দৃষ্টি হযরত আনাসের ওপর পতিত হলো। তিনি বললেন, 'তালহা তোমার মাধ্যমে খাবার পাঠিয়েছে?'
হযরত আনাস সম্মতিসূচক জবাব দিলেন। নবী করীম (সা:) সাহাবায়ে কেরামসহ হযরত তালহার বাড়ির দিকে যাত্রা করলেন। হযরত আনাসও নিজ বাড়িতে ফিরে এসে মায়ের কাছে রুটিগুলো দিলেন। এ দৃশ্য দেখে হযরত তালহা (রা:) বিস্মিত দৃষ্টিতে রাসূল (সা:) এর দিকে তাকিয়ে রইলেন। রাসূল (সা:) হযরত উম্মে সুলাইমকে বললেন, 'যা কিছু আছে নিয়ে এসো'।
হযরত আনাস (রা:) এর নিয়ে যাওয়া ঐ রুটিগুলো এবং সামান্য ঘী তাঁর সম্মুখে উপস্থিত করা হলো। নবী করীম (সা:) নিজ হাতে রুটিগুলো ছিঁড়ে টুকরো করে ঘী দিয়ে মাখালেন। তারপর দশজন দশজন করে সাহাবাকে ঘরে প্রবেশ করে খেতে বললেন। প্রত্যেক সাহাবা পেটপুরে আহার করলেন, আল্লাহর রাসূলের পবিত্র হাতের স্পর্শে মহান আল্লাহ এতই বরকত দিয়েছিলেন যে, মাত্র একজনের খাদ্য প্রায় আশিজন মানুষ খাবার পরও উদ্বৃত্ত রয়ে গেলো। (বুখারী)
তরুণ সাহাবী হযরত জাবের (রা:) এর পিতা অনেক ঋণ রেখে মৃত্যুবরণ করলে সকল ঋণের বোঝা এসে তাঁর কাঁধে চাপলো। ঋণ দাতাদের মধ্যে সকলেই ছিলো ইয়াহুদী। সেবার বাগানে যে খেজুর হলো তা সবগুলো দিয়েও ঋণ পরিশোধ হবে না। বিষয়টি তিনি আল্লাহর রাসূল (সা:) কে জানালেন। তিনি বললেন, 'গাছের খেজুরগুলো পেড়ে তুমি একস্থানে জমা করো'। হযরত জাবের (রা:) পরামর্শ মতো তাই করলেন। নবী করীম (সা:) এসে একস্থানে জমা করা খেজুরগুলোর চারপাশে ঘুরলেন। তারপর ঋণ দাতাদেরকে খেজুর দিয়ে ঋণ পরিশোধের আদেশ দিলেন। সকলের ঋণ পরিশোধের পরও দেখা গেলো, প্রথমে খেজুর যে পরিমাণ ছিলো সেই পরিমাণই রয়ে গিয়েছে। (বুখারী)
একজন সাহাবী নবী করীম (সা:) এর কাছ থেকে কিছু যব চেয়ে নিলেন। এরপর প্রত্যেক দিন তিনি তাঁর পরিবার পরিজন নিয়ে উক্ত যবের পাত্র থেকে যব নিয়ে খেতে থাকলেন। কয়েক দিন খাবার পরও পাত্রে যব যেমন ছিলো তেমনি রয়ে গেলো। তিনি যবের পরিমাণ ওজন করে দেখে বিষয়টি রাসূল (সা:) কে জানালেন। আল্লাহর রাসূল বললেন, 'তুমি যদি যব ওজন না করতে তাহলে পূর্বে যেমন তা বরকত দিচ্ছিলো, তা-ই দিতে থাকতো'। (মুসলিম, আহমাদ)
খন্দক যুদ্ধের সময় পরীখা খনন করতে করতে নবী করীম (সা:) সহ সকল সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন ক্ষুধার্ত। হযরত জাবের (রা:) নবী করীম (সা:) এর অবস্থা দেখে বাড়িতে গিয়ে নিজ স্ত্রীকে বিষয়টি জানালেন। তিনি একটি ছোট্ট ছাগল যবেহ করে যব দিয়ে তা রান্না করলেন। হযরত জাবের (রা:) চুপি চুপি নবী করীম (সা:) কে খেতে যাবার অনুরোধ করলেন। রাসূল (সা:) সকল সাহাবায়ে কেরামকে খুশীর সংবাদ জানিয়ে বললেন, 'জাবের আমাদের খাবার প্রস্তুত করেছে, তোমরা আমার সাথে চলো'।
সকলেই নবী করীম (সা:) এর সাথে এসে উপস্থিত হলেন। হযরত জাবের (রা:) ও তাঁর স্ত্রী বিব্রতবোধ করছেন। এ অবস্থা দেখে আল্লাহর রাসূল (সা:) বরকতের জন্যে দোয়া করে খাদ্য পরিবেশন করতে আদেশ করলেন। বিশাল এক বাহিনী খাওয়ার পরেও খাদ্য পাত্রে যেমন ছিলো তেমনি রয়ে গেলো। (বুখারী)
হুদাইবিয়ার সন্ধিকালে সাহাবায়ে কেরাম কুয়া থেকে পানি উত্তোলন করতে থাকলেন। এক পর্যায়ে কুয়ার পানি নিঃশেষ হয়ে গেলো। নবী করীম (সা:) এর কাছে সংবাদ পৌঁছলে তিনি পবিত্র মুখ মুবারকে কিছুটা পানি নিয়ে তা পানিহীন কুয়ায় নিক্ষেপ করা মাত্র কুয়া পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। (বুখারী)
সাহাবায়ে কেরাম সমভিব্যাহারে ভ্রমণে থাকা অবস্থায় পানি ফুরিয়ে গেলো। নবী করীম (সা:) এর জন্যে কিছুটা অজুর পানির ব্যবস্থা করা হলে তিনি নিজে অজু করে সে পানির পাত্রে হাত মুবারক রাখলেন। পবিত্র হাতের বরকতে প্রত্যেক আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে পানির ফোয়ারা ছুটতে লাগলো। অগণিত সাহাবায়ে কেরাম সে পানি দ্বারা নিজেদের প্রয়োজন পূরণ করলেন। (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী)
এ ধরনের অসংখ্য মু'জিযা সম্পর্কিত ঘটনা হাদীসের বিভিন্ন গ্রন্থে রয়েছে। মহান আল্লাহ তা'য়ালা নবী করীম (সা:) কে যে কত উচ্চে মর্যাদা দান করেছিলেন তা এসব মু'জিযাসমূহের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপে অনুভব করা যায়। তবে যারা আল্লাহ তা'য়ালা ও তাঁর রাসূলকেই বিশ্বাস করে না, কোনো মু'জিযাই তাদের কপাট বন্ধ অন্ধকার হৃদয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।
0 Comments