আমরা মিরাজের বিষয়টিকে এভাবে উল্লেখ করতে চাই, পবিত্র কুরআনের সূরা বনী ইসরাঈল-এ মহান আল্লাহ মিরাজের প্রসঙ্গে এভাবে বর্ণনা করেছেন-
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَا الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيهِ مِنْ آيَاتِنَا طَ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ
পবিত্র ও মহিমান্বিত (সেই আল্লাহ তা'য়ালা) যিনি তাঁর (এক) বান্দাহকে রাতের বেলায় মাসজিদে হারাম থেকে মাসজিদে আকসায় নিয়ে গেলেন, যার পারিপার্শ্বিকতাকে আমি (আগেই) বরকতপূর্ণ করে রেখেছিলাম, যেন আমি তাকে আমার (অদৃশ্য জগতের) কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি।
(সূরা বনী ইসরাঈল-১)
পবিত্র কুরআনের এই আয়াতে বাহ্যিক দিক দিয়ে এ কথা প্রমাণীত হয় না যে, বিশ্বনবী (সা:)-কে শারীরিকভাবে উর্ধ্ব আকাশ পাড়ি দিয়ে বিশেষ কোনো স্থানে নেয়া হয়েছিল। এ আয়াতে এ কথাই বাহ্যিক দিক দিয়ে বুঝা যায়, তাঁকে রাতের এক বিশেষ অংশে মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে জেরুজালিমের মসজিদুল আক্কসা পর্যন্ত ভ্রমণ করানো হয়েছে।
পক্ষান্তরে এই আয়াতের প্রথম শব্দ দিয়েই মহান আল্লাহ তা'য়ালা এই পৃথিবীর মানুষের কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তাঁর পক্ষে বিশ্বনবীকে শারীরিকভাবে মিরাজ করানো সম্ভব এবং তিনি তা করিয়েছেন। এই আয়াতের তাৎপর্য অনুধাবন না করার কারণ হলো, যে সময়ে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা পৃথিবীকে গ্রাস করছিল, বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারে পৃথিবীর মানুষ চমকিৎ হচ্ছিল, সে সময়ে গোটা পৃথিবীতে মুসলমানরা কোথাও ছিল ঘুমিয়ে, কোথাও ছিল তাঁরা পদানত, কোথাও ছিল তাঁরা ভিন্ন জাতির গোলামী করতে ব্যস্ত, কোথাও তাঁরা বিলাসিতার গড্ডালিকা প্রবাহে শরীর ভাসিয়ে দিয়েছিল, কোথাও তাঁরা আপন ভাইয়ের রক্তপাতে ছিল ব্যস্ত, কোথাও একে অপরের বিরুদ্ধে ফতোওয়াবাজীতে লিপ্ত ছিলো। আবিষ্কারের অবসর তাদের ভাগ্যে জোটেনি। আবিষ্কার করা তো দূরে থাক, তাঁরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে এই অবসর তাদের হয়নি।
ইসলাম বিরোধী শক্তি সমস্ত পৃথিবী নিজেদের নিয়ন্ত্রণে গ্রহণ করে শক্ত হাতে শাসনদণ্ড ধারণ করেছিল। পৃথিবীর নেতৃত্বও ছিলো ইসলাম বিদ্বেষীদের হাতে। আবিষ্কারের যাবতীয় উপকরণ তাদেরই হাতে। শিক্ষা ব্যবস্থা তাদের হাতে। কোন্ পদ্ধতিতে এবং কিভাবে কোন্ কোন্ বিষয় শিক্ষা দিতে হবে, এ সব কিছুই তাদের হাতে। কুরআনের শিক্ষকও ছিল তাঁরা বাইবেলের শিক্ষকও ছিল তাঁরাই। মুসলমান মুল্লাদের ক্ষীণ দাবীর কারণে এবং নিজেদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে কতক স্থানে ইসলাম শিক্ষার নামে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ দিল বটে, কিন্তু সে সব মাদ্রাসায় কি শিক্ষা দেয়া হবে সেটা আড়ালে বা প্রকাশ্যে থেকে তাঁরাই নির্ধারণ করে দিল।
এ অবস্থা অবলোকন করেই ডক্টর আল্লামা ইকবাল বলেছিলেন, 'মুল্লাকে মসজিদে নামাজ আদায়ের সুযোগ দেয়া হয়েছে আর মূর্খের দল ভেবেছে ভারতে বোধহয় ইসলামের স্বাধীনতা রয়েছে'।
আবার কোথাও যদিও বা ইসলামের প্রেমিকগণ নিজেদের উদ্যোগে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত করেছিল, সে সকল মাদ্রসায় কুরআনের আলোকে বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করে শিক্ষার্থীকে বুঝানো হবে, এমন শিক্ষকের ছিল তীব্র অভাব। স্কুল কলেজে যারা অধ্যয়ন করছিল তাঁরা তো পুরোপুরি ইসলাম বিরোধী শিক্ষাই লাভ করছিল। ইসলাম বিরোধিদের প্রচেষ্টায় মুসলমানদের ভেতরে দুই ধরণের শিক্ষায় দুটো দল সৃষ্টি হলো। মাদ্রাসা থেকে যারা বের হলো তাঁরা দেশ পরিচালনার অযোগ্য কিন্তু চরিত্রবান। তাদের চরিত্রে আল্লাহর ভয় কিছুটা পাওয়া গেল। আর স্কুল কলেজ থেকে যাঁরা বের হলো তাঁরা পাশ্চাত্যের অনুকরণে দেশ পরিচালনার যোগ্য বটে কিন্তু চরিত্রহারা। তাদের ভেতরে আল্লাহভীতি দূরে থাক, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের অনুপস্থিতি ছিল প্রকট।
ইসলাম বিরোধিদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কুরআন হাদীসের প্রচার প্রসার কিভাবে সম্ভব তা আমাদের বোধের অগম্য। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা ছিল তাই। পঞ্চাশ জন মানুষ একস্থানে সমবেত হয়ে আল্লাহ রাসূলের কথা শুনবে কি শুনবে না সেটাও ছিল ইসলাম বৈরীদের করুণার ওপর নির্ভরশীল। এই অবস্থায় ও পরিবেশে কুরআন ভিত্তিক গবেষণা ও কুরআনের বিজ্ঞান সম্পর্কিত আয়াতগুলোর রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব ছিলো না। বর্তমানে যা সম্ভব তা সে সময়ে সম্ভব ছিল না। ফলে এমন লোক তৈরী হতে পারেনি, যারা কুরআনের শব্দ দিয়েই প্রমাণ করে দিবে, ইসলাম যা বলে এবং বিশ্বনবী যা বলেছেন, করেছেন, তাঁর পবিত্র জীবনে যা ঘটেছে তার কোনটিই যুক্তিহীন বা অবৈজ্ঞানিক নয়।
মিরাজ সম্পর্কিত আলোচনায় আমরা বিজ্ঞানের নানা জটিল বিষয়ের অবতারণা করে অযথা গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধি করতে ইচ্ছুক নই। আমরা স্পষ্ট কথা বলতে চাই, এই পৃথিবী থেকে মানব শরীর কোনো কিছুর মাধ্যম ব্যতীত আকাশ ভ্রমণ করতে পারে না, তা অসম্ভব। মহান আল্লাহ উর্ধ্বাকাশে মানুষের কল্যাণের জন্যই নানা ধরনের স্তর ও মধ্যাকর্ষণ শক্তি সৃষ্টি করেছেন। রয়েছে মারাত্মক ক্ষতিকর গ্যাস ও বায়বীয় স্তর, প্রতি মুহূর্তে উল্কাপাত ঘটছে, রয়েছে ভাসমান পাথরের সাম্রাজ্য। এ সকল স্তর অতিক্রম করে আকাশ পর্যন্ত পৌঁছা বা আকাশ অতিক্রম করে ভিন্ন কোনো জগতে পৌছা অসম্ভব। এই চর্মদেহ নিয়ে ঐ সকল স্তর অতিক্রম করা কল্পনাও করা যায় না। পক্ষান্তরে বিজ্ঞান স্বীকার করে, 'যা আজ কল্পনার অতীত তাই আগামী কাল বাস্তবে দেখা যায়'।
এ কথাটি সর্বক্ষেত্রেই যেন প্রযোজ্য। আজ এক দলের সাথে বৈরী সম্পর্ক কাল আবার তা স্বাভাবিক। মিস্টার জুলভার্ণ যে সময় তাঁর পাতাল সম্পর্কিত কল্পনা প্রসূত লেখা লিখেছিলেন বর্তমানে তা বাস্তব। সুতরাং কিছু কল্পনা বাস্তবে পরিণত হওয়া সময় ও সাধনার বিষয় মাত্র। মিরাজ সম্পর্কে আজও মানুষের কাছে যা কল্পনার বিষয় কাল তা বাস্তবে রূপলাভ করবে না তা নিশ্চয়তা দিয়ে বলা সম্ভব নয়।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ মিরাজ সম্পর্কিত আয়াতের শুরুতে যদি বলতেন, 'আল্লাযি আস্রা' অথবা 'হুওয়াল্লাযি আস্ত্রা' অর্থাৎ যিনি বা তিনিই আল্লাহ যিনি তাঁর বান্দাহকে। কিন্তু এভাবে আল্লাহ তা'য়ালা বলেননি। তিনি বলেছেন, 'সুবহানাল্লাযি আস্রা' অর্থাৎ পাক পবিত্র ও মহিমান্বিত। আয়াত শুরু হয়েছে 'সুবহান' শব্দ দিয়ে। যার অর্থ হলো তিনি দুর্বলতা ও অক্ষমতা নামক নাপাকি বা অপবিত্রতা থেকে মুক্ত।
অর্থাৎ মানুষ যা অসম্ভব বলে চিন্তা করে তিনি সেই অসম্ভব থেকে মুক্ত। তাঁর কাছে অসম্ভব বলে কিছুই নেই। সৃষ্টি জগতে দৃশ্য অদৃশ্য যা কিছু আছে সব তাঁরই সৃষ্টি। যেখানে যে শক্তির অস্তিত্ব রয়েছে সবই তাঁর আজ্ঞাধীন। মানুষ যে শক্তিকে বড় বাধা বলে বিবেচনা করে তা মহান আল্লাহর গোলাম। আল্লাহর আদেশ ব্যতীত সে সব শক্তি বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। আল্লাহ তাদেরকে সক্রিয় হতে বললে তারা সক্রিয় হয় আর নিষ্ক্রীয় হতে বললে তারা নিষ্ক্রীয় হয়। সুতরাং নবী করীম (সা:) এর যে শারীরিকভাবে মিরাজ হয়েছিল এতে অসম্ভবের কিছুই নেই।
মহাকাশে ভ্রমণ ও বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে ভিন্ন জগতে পৌছার জন্য যে বাধা রয়েছে, সে বাধা তো মহান আল্লাহরই আজ্ঞাবহ। এ সব আজ্ঞাবহ সৃষ্টিসমূহ মানুষের ন্যায় স্বাধীন ক্ষমতা সম্পন্ন অবাধ্য গোলাম নয়। আল্লাহর আদেশের বিপরীত কিছু করার ক্ষমতাই ঐসব সৃষ্টিসমূহকে দেয়া হয়নি। মহান আল্লাহর প্রিয় এবং শ্রেষ্ঠ বন্ধু তাঁরই আদেশে পথ প্রদর্শক হযরত জিবরাঈল (আ:) এর মাধ্যমে এমন জগতে ভ্রমণে যাবেন, যে জগৎ সম্পর্কে মানুষ কল্পনাও করতে পারে না।
এরপরেও সাধারণ মানুষ যদি তা অসম্ভব বলে চিন্তা করে এ কারণে মহান আল্লাহ মানুষের সে ধারণাকে খণ্ডন করে বলেছেন, 'তোমরা যা অসম্ভব বলে চিন্তা করছো, যে সম্পর্কে তোমরা দুর্বল, তোমরা যা করতে অক্ষম, আমি আল্লাহ ঐ সকল দুর্বলতা, অক্ষমতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এবং ভ্রমণ পথের পারিপার্শ্বিকতাকে আমি (আগেই) বরকতপূর্ণ করে রেখেছিলাম'।
এরপরেও আরেকটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট করা যেতে পারে। পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রেই রাস্তায় ট্রাফিক ব্যবস্থা রয়েছে। যান-বাহন থামতে হবে এ জন্য একটি Signal এর ব্যবস্থা রয়েছে। চলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে এ জন্য আরেকটি ওধথভটফ-এর ব্যবস্থা রয়েছে। চলতে হবে এ জন্য আরেকটি Signal এর ব্যবস্থা আছে। এ সব Signal এর মুখোমুখি হলে যান-বাহনের চালক অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যান-বাহন চলতে হবে, এ ধরনের Signal পেলেও কারণ বিশেষে যান- বাহন চলে না। ট্রাফিক পুলিশ চলতে দেয় না। রাষ্ট্রের সম্মানিত ব্যক্তির জন্য বা বিদেশী সম্মানিত অতিথির ক্ষেত্রে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশে ট্রাফিক পুলিশ প্রচলিত নিয়মের ব্যতিক্রম করে। বিশেষ বিশেষ রাস্তায় যান-বাহন এবং সাধারণের চলাচল সাময়িকের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। যান-বাহনের গতি স্তব্ধ হয়ে যায়। সম্মানিত মেহমান চলে যাবার পরে গতি আবার সচল হয়।
মহান আল্লাহর সর্বোচ্চ মর্যাদায় আসীন সর্ব শ্রেষ্ঠ মেহমান আগমন করবেন। এমনও তো হতে পারে, মহান আল্লাহ পৃথিবীর সকল গতি সে সময় স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন। বৃক্ষের পাতা যেদিকে হেলেছিল গতি না থাকার কারণে পাতা ঐ অবস্থায় ছিল। চন্দ্র-সূর্য তারকা, বাতাস, মধ্যাকর্ষণ শক্তি, উর্ধ্ব জগতের যাবতীয় শক্তির গতি তিনি থামিয়ে দিয়ে তাঁর মর্যাদাবান সম্মানিত মেহমান বিশ্বনবী (সা:) কে তাঁর একান্ত সান্নিধ্যে নিয়েছিলেন। নিয়ে যাবার পথে যে সকল বাধার বিষয় রয়েছে, সে সম্পর্কে কুরআনের এ কথাও তো প্রযোজ্য যে, 'পারিপার্শ্বিকতাকে আমি (আগেই) বরকতপূর্ণ করে রেখেছিলাম' অর্থাৎ যা কিছু বাধা সৃষ্টি করে বলে তোমাদের ধারণা তা আমি পূর্বেই অপসারিত করেছিলাম। সুতরাং রুহানীভাবে মিরাজ হয়েছে না স্বাপ্নীকভাবে মিরাজ হয়েছে, এ সব কথা বলে বিতর্ক সৃষ্টির প্রয়োজন নেই।
1 Comments
alhamdulilla
ReplyDelete