নফল দান-খয়রাত ও তার ফযীলত

        নফল দান খয়রাতের ফযীলত সম্পর্কিত হাদীস নিম্নরূপ:

        রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: সদকা কর যদিও তা একটি খেজুর হয়। কেননা, এটা ক্ষুধার্তের কিছু না কিছু কষ্ট দূর করে এবং গোনাহকে এমনভাবে নির্বাপিত করে, যেমনভাবে পানি অগ্নি নির্বাপিত করে। তিনি

    আরও বলেনঃ

اتقوا النار ولو بشق تمرة فان لم تجدوا فبكلمة طيبة

        অর্থাৎ, এক খন্ড খেজুর দান করে হলেও দোযখ থেকে আত্মরক্ষা কর। যদি তা না পাও, তবে ভাল কথা বলে আত্মরক্ষা কর।

        রসূলে করীম (সাঃ) আরও বলেন: যে মুসলমান বান্দা তার পবিত্র উপার্জন থেকে সদকা করে- আল্লাহ তাআলা পবিত্রকেই গ্রহণ করেন- আল্লাহ তাআলা এই সদকা ডান হাতে গ্রহণ করেন, অতঃপর তা লালন-পালন করেন, যেমন তোমাদের কেউ উটের বাচ্চা লালন-পালন করে। অবশেষে খেজুর বেড়ে ওহুদ পাহাড়ের সমান হয়ে যায়।

        রসূলুল্লাহ (সাঃ) হযরত আবু দারদাকে বললেন: যখন তুমি শুরবা রান্না কর তখন তাতে বেশী পরিমাণে পানি দাও। অতঃপর তা থেকে প্রতিবেশীদেরকে দান কর। তিনি আরও বলেন: যে বান্দা ভাল সদকা দেয়, আল্লাহ তার সম্পদে অনেক বরকত দেন।

এক হাদীসে আছে-

كل امرا في ظل صدقته حتى يقضى بين الناس .

        অর্থাৎ, হাশরের মাঠে মানুষের মধ্যে ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক ব্যক্তি তার সদকার ছায়াতলে অবস্থান করবে। আরও আছে-

الصدقة تسد سبعين بابا من الشر 

    অর্থাৎ, সদকা অনিষ্টের সত্তরটি দরজা বন্ধ করে।

    আরও আছে-

صدقة السر تطفى غضب الرب .

    অর্থাৎ, গোপন সদকা পালনকর্তার ক্রোধ নির্বাপিত করে।

        এক হাদীসে বলা হয়েছে- যেব্যক্তি সচ্ছলতাবশতঃ দান করে, সে সওয়াবে সেই ব্যক্তির চেয়ে উত্তম নয়, যে অভাবের কারণে তা কবুল করে। এর উদ্দেশ্য সম্ভবতঃ এই, যেব্যক্তি সদকা কবুল করে নিজের অভাব দূর করে, যাতে ধর্মের কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারে, সে সেই দাতার সমান, যে তার দান দ্বারা ধর্মের অগ্রগতির নিয়ত করে। কেউ রসূলে আকরাম (সাঃ)-কে প্রশ্ন করল: কোন্টি সদকা উত্তম? তিনি বললেন: এমন সময়ে সদকা করা উত্তম, যখন মানুষ সুস্থ থাকে, মাল আটকে রাখতে চায়, অনেক দিন বাঁচার আশা রাখে এবং উপবাসকে খুব ভয় করে। সদকা দিতে এতদূর বিলম্ব করবে না যে, মরণোন্মুখ অবস্থায় বলতে থাকবে, এই পরিমাণ অমুককে এবং এই পরিমাণ অমুককে দেবে, অথচ তখন তোমার মাল অন্যের অর্থাৎ ওয়ারিসদের হয়ে গেছে। একদিন রসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীগণকে বললেন: তোমরা সদকা কর। এক ব্যক্তি আরজ করল: আমার কাছে একটি দীনার আছে। তিনি বললেন: এটি নিজের জন্যে ব্যয় কর। লোকটি বলল: আমার কাছে আরও একটি দীনার আছে। তিনি বললেন: এটি স্ত্রীর জন্যে ব্যয় কর। লোকটি বলল: আমার কাছে আরও একটি দীনার আছে, তিনি বললেন: এটি সন্তানদের জন্য ব্যয় কর। লোকটি আরজ করল, আমার কাছে আরেকটি দীনার আছে, তিনি বললেন এটি খাদেমের জন্যে ব্যয় কর। লোকটি বলল: আমার কাছে আর একটি দীনার আছে। তিনি বললেন: এটা যেখানে ভাল মনে কর, ব্যয় কর। রসূলে আকরাম (সাঃ) আরও বলেন: মুহাম্মদ পরিবারের জন্যে সদকা হালাল নয়। কারণ, সদকা মানুষের সম্পদের ময়লা। তিনি আরও বলেন: যেব্যক্তি ভিক্ষুককে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়, ফেরেশতারা তার গৃহের উপর সাত দিন পর্যন্ত ছায়া দান করেন না। দুটি কাজ রসূলুল্লাহ (সাঃ) অন্যের হাতে সোপর্দ করতেন না- নিজে করতেন। এক, ওযুর পানি নিজে রাখতেন ও তা ঢেকে দিতেন এবং দুই, মিসকীনকে নিজের হাতে দান করতেন। তিনি বলেন: সে ব্যক্তি মিসকীন নয়, যাকে এক খেজুর অথবা দুই খেজুর এবং এক লোকমা অথবা দুই লোকমা দিয়ে বিদায় করা হয়; বরং সেই মিসকীন যে সওয়াল থেকে বিরত থাকে। তুমি এ আয়াত পড়ে দেখ-

لَا يَسْتَلُونَ النَّاسَ الْحَافًا .

        অর্থাৎ, তারা মানুষের কাছে গায়ে পড়ে সওয়াল করে না।

        রসূলুল্লাহ (সাঃ) আরও বলেন: যে মুসলমান অন্য কোন মুসলমানকে বস্ত্র পরিধান করায়, সে মিসকীনের গায়ে ঐ বস্ত্রের তালি থাকা পর্যন্ত আল্লাহ্ তাআলার হেফাযতে থাকে।

        নফল সদকা সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরাম ও বুযুর্গগণের উক্তি নিম্নরূপঃ

        ওরওয়া ইবনে যুবায়র (রাঃ) বলেন: হযরত আয়েশা (রাঃ) পঞ্চাশ হাজার দেরহাম খয়রাত করেন অথচ তাঁর কোর্তায় তালিই থাকত। হযরত ওমর (রাঃ) বলতেন: ইলাহী, ধনসম্পদ ও ধনাঢ্যতা আমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তিকে দান করুন। সম্ভবতঃ সে তা আমাদের অভাবগ্রস্তদেরকে পৌঁছাবে। আবদুল আজীজ ইবনে ওমায়র (রহঃ) বলেন : নামায মানুষকে অর্ধেক পথে পৌঁছায়, রোযা বাদশাহের দ্বারে নিয়ে যায় এবং সদকা বাদশাহের সামনে উপস্থিত করে। ইবনে আবিল জা'দ (রহঃ) বলেন: সদকা মানুষ থেকে সত্তর প্রকার অনিষ্ট দূর করে। প্রকাশ্যে সদকা দেয়ার তুলনায় গোপনে দেয়ায় সত্তর গুণ বেশী সওয়াব। সদকা সত্তর শয়তানের চোয়াল বিদীর্ণ করে। হযরত ইবনে মসউদ (রাঃ) বলেন: এক ব্যক্তি সত্তর বছর আল্লাহ তাআলার এবাদত করার পর কোন একটি কবীরা গোনাহ করায় তার এবাদত বাতিল করে দেয়া হল। অতঃপর সে এক মিসকীনের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে এক খন্ড রুটি সদকা করল। ফলে আল্লাহ তার অপরাধ মার্জনা করে সত্তর বছরের এবাদত বহাল করে দিলেন। লোকমান তাঁর পুত্রকে বললেন: তুমি যখন কোন গোনাহ কর, তখন সদকা করবে। ইয়াহইয়া ইবনে মুআয (রহঃ) বলেনঃ সদকার দানা ব্যতীত কোন দানা দুনিয়ার পাহাড়ের সমান হয়ে যায় বলে আমার জানা নেই। সদকার দানা অবশ্যই এতটুকু হয়ে যায়। আবদুল আজীজ ইবনে আবী রুয়াদ বলেন: প্রথম যমানায় বলা হত, তিনটি বিষয় জান্নাতের ভান্ডারসমূহের মধ্যে দাখিল- রোগ গোপন করা, সদকা গোপন করা এবং বিপদাপদ গোপন করা। হযরত ওমর (রাঃ) বলেন: আমলসমূহ একে অপরের উপর গর্ব করল। সদকা বলল: আমি তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আবদুল্লাহ (রহঃ) চিনি খয়রাত করতেন এবং বলতেন: আমি দেখলাম, আল্লাহ তাআলা বলেন:

لَنْ تَنَالُو الْبَرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ .

        অর্থাৎ, তোমরা প্রিয় বস্তু ব্যয় না করা পর্যন্ত পূর্ণ নেকী পাবে না।

        আমি চিনি ভালবাসি, একথা আল্লাহ তাআলা জানেন। নখয়ী (রহঃ) বলেন: আল্লাহর জন্যে যে বস্তু দেব তাতে কোন দোষ থাকা আমার পছন্দনীয় নয়। ওবায়েদ ইবনে ওমায়ের (রহঃ) বলেন: কেয়ামতের দিন মানুষ সকল দিন অপেক্ষা অধিক ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত ও উলঙ্গ অবস্থায় উত্থিত হবে। অতঃপর যেব্যক্তি দুনিয়াতে আল্লাহর জন্যে ক্ষুধার্তকে আহার দিয়ে থাকবে, আল্লাহ তাকে পেট ভরে আহার করাবেন। যেব্যক্তি আল্লাহর জন্যে বস্ত্রহীনকে বস্ত্র পরিধান করিয়ে থাকবে, আল্লাহ তাকে বস্ত্র পরিধান করাবেন। হযরত হাসান বসরী (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করলে তোমাদের সকলকে ধনাঢ্য করে দিতেন- তোমাদের মধ্যে ফকীর থাকত না। কিন্তু তিনি একজনকে অপরজন দ্বারা পরীক্ষা করেছেন। শা'বী (রহঃ) বলেন: ফকীর ধনীর সদকার যতটুকু মুখাপেক্ষী, যদি ধনী তার তুলনায় আপন সদকার সওয়াবের অধিক মুখাপেক্ষী না হয়, তবে তার সদকা অনর্থক। এ সদকা তার মুখে নিক্ষেপ করা হবে। ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন: যে পানি সদকা করা হয় এবং মসজিদে পান করানো হয়, তা থেকে ধনী ব্যক্তি পান করলে আমরা দোষ মনে করি না। কেননা, যে পানি সদকা করে, সে পিপাসার্তদের জন্যে সদকা করে। বিশেষভাবে ফকীর-মিসকীনকে সদকা করার নিয়ত তার থাকে না। কথিত আছে, জনৈক দাস বিক্রেতা এক বাঁদী সঙ্গে নিয়ে হযরত হাসান বসরীর কাছ দিয়ে গমন করলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন: তুমি এই বাঁদী এক দুই দেরহামের বিনিময়ে বিক্রয় করতে সম্মত আছ কি? সে বলল: না। হাসান বসরী (রঃ) বললেন: যাও, আল্লাহ তাআলা তো এক পয়সা ও এক লোকমা সদকা করার বিনিময়ে বেহেশতের হুর দিতে সম্মত আছেন।

Post a Comment

0 Comments