জুলুম-নির্যাতনের কালো অধ্যায়

        এ পার্থিব জগতে বিভিন্ন দেশ ও সমাজে জালিম ও স্বৈরাচারী যখন কোনো ব্যক্তি, দল বা সম্প্রদায়ের প্রতি নির্যাতন করে তখন যদি কেউ প্রতিবাদ না করে তাহলে জালিম ও স্বৈরাচার উৎসাহিত হয়ে নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধিই করে থাকে, পৃথিবীর ইতিহাস এ কথার সাক্ষ্য বহন করে। নবী করীম (সা:) এর মক্কী জীবনে ঠিক এমনটিই ঘটেছিলো। প্রতাবশালী চাচা আবু তালিবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে সে সময় বিশ্বনবী (সা:) এর প্রতি শারীরিকভাবে অতটা নির্যাতন কেউ করতে পারেনি। আবু তালিবের অবর্তমানে ইসলামের শত্রুগোষ্ঠী মক্কায় নির্ভীক চিত্তে নবী করীম (সা:) এর প্রতি অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি করলো। তিনি যে পথ দিয়ে কা'বায় আসবেন সে পথে ময়লা আবর্জনা বা বিষাক্ত কাঁটা বিছিয়ে রাখতো দুশমনরা। তিনি কা'বায় নামাজ আদায় করছেন, তাঁকে নানাভাবে বিদ্রুপ করা হতো। নামাজে সিজদা দিয়েছেন এ সময় তাঁর পবিত্র মাথায় উটের পচা গলিত নাড়ি ভুড়ি চাপিয়ে দেয়া হতো। ছোট্ট মেয়ে ফাতিমা (রা:) পিতার এ অবস্থা দেখে করুণ কণ্ঠে কাঁদতেন আর পিতার মাথার ওপর থেকে আবর্জনা সরিয়ে মাথা ভার মুক্ত করতেন। তিনি নামাযে দাঁড়িয়েছেন, তাঁর পবিত্র গলায় কাপড় জড়িয়ে দু'দিক থেকে এমনভাবে টেনে ধরা হতো যে, তাঁর শ্বাস বন্ধ হয়ে যেত। ঐতিহাসিকগণ বর্ণনা করেছেন, এতে করে নবী করীম (সা:) এর কন্ঠে দাগ হয়ে যেত। বর্তমান সময়েও যেমন ইসলামের অনুসারী নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে ভুল বুঝিয়ে বিভ্রান্ত করে তাদেরকে ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়, ঠিক তেমনিভাবেই নবী করীম (সা:) এর বিরুদ্ধেও তৎকালে দুশমনরা কিশোর, তরুণ যুবকদের ব্যবহার করতো। তিনি বাইরে বের হলেই ইসলাম বিরোধী নেতৃবৃন্দ দুষ্ট প্রকৃতির ছেলেদের তাঁর পেছনে লেলিয়ে দিত। তাঁরা নবী করীম (সা:) এর পেছনে পেছনে যেত আর তাঁকে বিদ্রুপ করতো।

        তিনি নামাযে মধুর কন্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করতেন আর আবু জাহিল তাঁর সাথিদের নিয়ে নবীকে গালাগালি দিতো। তিনি লোকালয়ে গিয়ে মানুষের কাছে ইসলামের আহ্বান প্রচার করতেন। আবু জাহিল লোকদেরকে ডেকে বলতো, 'তোমরা এই লোকটির কথায় কান দিও না। এই লোকের প্রতারণায় তোমরা নিপতিত হবে না। এ লোক ধোকাবাজ যাদুকর'। (নাউযুবিল্লাহ)

        এসব কথা বলে আল্লাহ তা'য়ালার দুশমন আবু জাহিল লোকজনের সামনে আল্লাহ তা'য়ালার নবীর পবিত্র শরীরে নোংরা কাদা নিক্ষেপ করতো। একদিন নবী করীম (সা:) কা'বায় নামায আদায় করছিলেন। শত্রুর দল দূরে বসে তাঁকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করছিল। হঠাৎ আবু জাহিল বলে উঠলো, 'মুহাম্মাদ (সা:) যখন নামাযে সিজদা দেয় তখন তাঁর মাথার ওপর উটের নাড়ি-ভুড়ি চাপিয়ে দিলে ভালো হয়। তোমরা কি কেউ এ কাজ করতে পারবে?'

        ইসলামের দুশমন ওকবা বললো, 'তোমরা দেখো, আমিই মুহাম্মাদ (সা:) এর মাথায় উটের নাড়ি ভুড়ি চাপিয়ে দিচ্ছি'।

        এ কথা বলেই সে উটের নাড়ি-ভুড়ি এনে নবী করীম (সা:) এর মাথার ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। তিনি তখন নামাযে সিজদায় ছিলেন, মাথা উঠাতে পারলেন না। নবীর এই কষ্ট দেখে শত্রুর দল অট্ট হাসিতে হেসেছিল। পাঁচ বছরের শিশু মেয়ে ফাতিমা পিতার এই দুরাবস্থার সংবাদ পেয়ে করুণ কন্ঠে আর্তনাদ করে ছুটে এলেন। কচি হাত দু'টো দিয়ে পরম মমতায় পিতার মাথা থেকে আবর্জনা পরিষ্কার করে শত্রুদের বিরুদ্ধে মহান আল্লাহর দরবারে বিচার দিলেন।

        নবী করীম (সা:) কে নিজেরা তো ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতোই সেই সাথে মক্কায় নতুন যারা আসতো, তাদের সামনেও তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করতো আবু জাহিলের অনুসারীরা। মক্কার বাইরের একজন লোক একটি উট নিয়ে মক্কায় এসেছিল। আবু জাহিল সে উট নিয়ে উটের মালিককে অর্থ না দেয়ার ছুতো খুঁজতে থাকে। লোকটি যখন বুঝলো আবু জাহিল তাকে অর্থ না দিয়েই উট নিয়ে নেবে তখন সে কা'বাঘরে এসে উচ্চকণ্ঠে বলতে থাকে, 'আবু জাহিল আমার উট নিয়ে তার মূল্য পরিশোধ করছে না। সে আমার ওপর জুলুম করছে। আপনাদের মধ্যে এমন কেউ আছেন যিনি এই জুলুমের প্রতিকার করবেন? আমার অধিকার আমাকে আদায় করে দিবেন?'

        লোকটির কথা শুনে ইসলামের শত্রুরা নবী করীম (সা:) কে হাসির পাত্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করলো। মক্কার বাইরের ঐ লোকটির সামনে আবু জাহিল যেন আল্লাহ তা'য়ালার রাসূলকে অপমান করে, এ উদ্দেশ্যে লোকটিকে তারা ডেকে রাসূল (সা:) কে ইশারায় দেখিয়ে বললো, 'ঐ লোকটির কাছে যাও, সে তোমার অধিকার আদায় করে দিবে'।

        নবী করীম (সা:) সে সময় কা'বায় অবস্থান করছিলেন। লোকটি কাফিরদের কথায় বিশ্বাস করে নবী (সা:) এর কাছে ঘটনা বিস্তারিত বলে আবেদন করলেন, 'হে আল্লাহর বান্দাহ! আপনার প্রতি আল্লাহ তা'য়ালা রহমত নাযিল করুন, আপনি আবু জাহিলের কাছ থেকে আমার অধিকার আদায় করে দিন'।

        বিশ্বনবী (সা:) লোকটির দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তুমি আমার সাথে এসো, আমি তোমার অধিকার আদায় করে দিচ্ছি'।

        কথা শেষ করে নবী করীম (সা:) উঠে আবু জাহিলের বাড়ির দিকে গেলেন। লোকটিও রাসূল (সা:) এর সাথে গেল। আল্লাহর দুশমন আবু জাহিল কিভাবে নবী করীম (সা:) কে অপমান করে তা দেখার জন্যে ইসলামের দুশমনরা একজন লোককে পাঠালো। বিশ্বনবী (সা:) আবু জাহিলের বাড়ির দরোজায় আঘাত করলেন। সে ভেতর থেকে জানতে চাইলো আগন্তুকের পরিচয়। নবী (সা:) নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, 'আমি মুহাম্মাদ (সা:), দরোজা খুলে বাইরে এসো'।

        আবু জাহিল বাইরে এসে বিশ্বনবী (সা:) এর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই তার চেহারা এমন ভীতিগ্রস্থ বিবর্ণ হয়ে উঠেছিল যে, সে যেন তাঁর সামনে মৃত্যুদূত দেখছে। আল্লাহর নবী (সা:) কলিজায় কম্পন জাগানো কণ্ঠে আদেশ দিলেন, 'এই লোকের যে অধিকার রয়েছে তোমার কাছে, তাঁর অধিকার তাকে বুঝিয়ে দাও'।

        আবু জাহিল আতংকগ্রস্ত কন্ঠে বললো, 'এখুনি দিচ্ছি'। এ কথা বলেই সে তাঁর ঘরে গিয়ে দ্রুত অর্থ এনে লোকটিকে দিয়ে দিল। নবী করীম (সা:) কা'বায় ফিরে এলেন।

        সে লোকটি কা'বায় এসে কাফিরদেরকে বললো, 'মহান আল্লাহ মুহাম্মাদ (সা:) এর ওপর রহমত নাযিল করুন, তিনি আমার অধিকার আদায় করে দিয়েছেন'।

        আল্লাহর দুশমনরা ধারণা করেছিল তাদের নেতা আবু জাহিল বিদেশী লোকটির সামনে নবী করীম (সা:) কে অপমান করবে, তা না করে আবু জাহিল মুহাম্মাদ (সা:) এর কথায় উটের মূল্য পরিশোধ করলো, কারণ কি? ইতোমধ্যে আবু জাহিল সেখানে এলো। তাঁর চেহারা থেকে তখন পর্যন্ত ভয়ের চিহ্ন মুছে যায়নি। অন্যরা তাকে জিজ্ঞাসা করলো, 'বিষয়টি কি? তুমি মুহাম্মাদ (সা:) এর কথায় মূল্য দিয়ে দিলে যে?'

        আবু জাহিল বললো, 'মুহাম্মাদ (সা:) এর কথায় মূল্য না দিলে সে ভয়ঙ্কর উট আমাকে খেয়ে ফেলতো। আমি দরোজা খোলার পরে দেখলাম মুহাম্মাদ (সা:) এর পেছনে একটি ভয়ঙ্কর দর্শন উট দাঁড়িয়ে আছে। খোদার শপথ! তেমন উট আমি কোথাও দেখিনি। উটের চেহারা বড় ভয়ঙ্কর, আমি ঐ লোকটির উটের মূল্য না দিলে মুহাম্মাদ (সা:) এর পিছনে দাঁড়ানো উট আমাকে খেয়ে ফেলতো'। (ইবনে হিশাম)

        এভাবেই সেদিন মহান আল্লাহ তা'য়ালা নবী করীম (সা:) এর সর্বোচ্চ মর্যাদা সমুন্নত রেখে ইসলামের দুশমনদের ষড়যন্ত্র বানচাল করে দিয়েছিলেন। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা ইসলামের দুশমনরা ঘটিয়েছে। যারা প্রত্যক্ষভাবে বিশ্বনবী (সা:) এর সাথে শত্রুতা করেছে, মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে তাদের অশুভ পরিণতি সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। নবী করীম (সা:) এর চাচা আবু লাহাব এবং তাঁর স্ত্রী উম্মে জামিল নবী করীম (সা:) কে নানাভাবে অত্যাচার করেছে। তাদের পরিণতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সূরা লাহাব অবতীর্ণ করেছেন। আবু লাহাব যখন জানতে পারলো তাঁর পরিণতি সম্পর্কে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, তখন সে একটি পাথর নিয়ে নবী করীম (সা:) কে আঘাত করার উদ্দেশ্যে কা'বায় এসে বসে থাকলো।

        কিছুক্ষণ পরে নবী করীম (সা:) হযরত আবু বকর (রা:) কে সাথে নিয়ে কা'বায় এলেন। মহান আল্লাহ তা'য়ালা আবু লাহাবের চোখ থেকে বিশ্বনবী (সা:) কে অদৃশ্য করে দিলেন। আবু লাহাব হযরত আবু বকর (রা:) কে জিজ্ঞাসা করলো, 'কোথায় মুহাম্মাদ (সা:)? আমি জানতে পারলাম সে আমার সম্পর্কে শাস্তির কথা বলছে। এখন আমি কাছে পেলে এই পাথর দিয়ে তাকে আঘাত করতাম'।

        কথা শেষ করে সে চলে গেল। হযরত আবু বকর (রা:) আল্লাহর নবী (সা:) কে জিজ্ঞাসা করলেন, 'হে আল্লাহর রাসূল (সা:)! আবু লাহাব আপনাকে দেখতে পেল না কেনো?'

        নবী করীম (সা:) বললেন, 'সে আমাকে দেখতে পায়নি। আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর চোখকে আদেশ দিয়েছিলেন যেন সে আমাকে দেখতে না পায়'।

        বর্তমান যুগে একশ্রেণীর লোক যেমন নিজেদেরকে সুশিল নামে পরিচয় দিয়ে ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালায় তেমনি সে যুগেও সুশিলদের এক নেতা উমাইয়া ইবনে খালফ নবী করীম (সা:) কে দেখলেই গালাগালি ও হৈচৈ করতো। বর্তমান যুগের একশ্রেণীর ইলোক্ট্রনিক ও প্রিন্টিং মিডিয়ার মতো ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে কল্পিত অভিযোগ ও মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের মতো ভূমিকা সে যুগের উমাইয়া ইবনে খালফ এবং তার সমর্থকগণ আল্লাহ তা'য়ালার রাসূলের বিরুদ্ধে পালন করতো। ইসলামের দুশমন এ লোকটির অশুভ পরিণতি এবং তার ঘৃণিত স্বভাব সম্পর্কে মহান আল্লাহ সূরা হুমাজাহ্ অবতীর্ণ করেছেন। নবী করীম (সা:) এর মহান সাহাবী হযরত খাব্বাব (রা:) ছিলেন একজন লৌহকর্মকার। তিনি লৌহজাত অস্ত্র নির্মাণ ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাঁর কাছ থেকে তরবারী কিনেছিল আ'স ইবনে ওয়ায়েল নামক এক কাফির। সম্পূর্ণ অর্থ সে তখন পর্যন্ত পরিশোধ করেনি। হযরত খাব্বাব (রা:) তাঁর কাছে তরবারীর মূল্য চাইতে গেলেই সে বিদ্রুপ করে বলতো, 'হে খাব্বাব! তোমাদের মধ্যে মুহাম্মাদ (সা:) তো প্রচার করে জান্নাতে যারা যাবে তাঁরা ইচ্ছে অনুযায়ী স্বর্ণ রৌপ্য হিরা জহরত ও অসংখ্য দাস-দাসী পাবে। এ কথা কি ঠিক?'

        হযরত খাব্বাব (রা:) জবাব দিতেন, 'আল্লাহর নবী (সা:)-এর কথা অবশ্যই সত্য'।

        আল্লাহ তা'য়ালার দুশমন আ'স ইবনে ওয়ায়েল বিদ্রুপ করে বলতো, 'হে খাব্বাব! তাহলে আমাকে কিয়ামত পর্যন্ত সময় দাও! আমি তোমাদের ঐ জান্নাতে গিয়েই তোমার অর্থ পরিশোধ করবো। আমি খোদার শপথ করে বলছি, তুমি আর তোমার মুহাম্মাদ (সা:) আমার তুলনায় অধিক সম্মান পাবে না এবং সৌভাগ্যবানও হতে পারবে না'। (নাউযুবিল্লাহ)

            এই কাফির সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা'য়ালা পবিত্র কুরআনে সূরা মরিয়মের আয়াত অবতীর্ণ করেন। নাদার ইবনে হারেস ছিলো ইসলামের আরেক ঘৃণিত শত্রু। নবী করীম (সা:) যখন কুরআন তিলাওয়াত করতেন, লোকদেরকে ইসলামের দিকে আহবান জানাতেন, ইসলামের সাথে যারা অতীতে বিরোধীতা করে আল্লাহ তা'য়ালার গযবে পড়ে ধ্বংস হয়েছে, তাদের ইতিহাস শোনাতেন তখন এই কাফির সে সমাবেশে উপস্থিত হয়ে নীরবে বসে থাকতো। রাসূল (সা:) চলে যাবার পরে সে লোকজনকে বলতো, 'মুহাম্মাদ (সা:) যা বলে তার কোনো ভিত্তি নেই। তাঁর বলা কাহিনী সেই প্রাচীন যুগের গল্প ছাড়া আর কিছুই না। মুহাম্মাদ (সা:) এর চেয়ে ভালো কাহিনী আমি জানি'।

        মহান আল্লাহ তা'য়ালা সূরা ফুরকানের আয়াত অবতীর্ণ করে ঘৃণিত এ লোকটির পরিণতি বর্ণনা করেছেন। আরেকজন কাফির আখনাস ইবনে শুরাইক, সে ছিল তৎকালিন সুশিল সমাজের একজন গন্যমান্য ব্যক্তি। এই লোকটি নানাভাবে নবী করীম (সা:) কে অত্যাচার করতো। তাঁকে দেখলেই অশালীন ভাষায় গালাগালি দিত। মহান আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর সম্পর্কে সূরা কলমের আয়াত অবতীর্ণ করে তাঁর পরিণতি কত খারাপ হবে তা জানিয়ে দিলেন। ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা নামক কাফির বলতো, 'আমি এবং আবু মাসউদের মতো প্রভাবশালী লোক থাকতে মুহাম্মাদ (সা:) এর মতো লোকের ওপরে ওহী নাযিল হলো? আল্লাহ আর লোক পাননি বুঝি?'    (নাউযুবিল্লাহ)

        সুশিল নামধারী ইসলামের এসব দুশমনদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ সূরা যুখরূফের আয়াত অবতীর্ণ করে তাদের কথার প্রতিবাদ করে নির্মম পরিণতির কথা উল্লেখ করেছেন। কাফিরদের ভেতরে উকবা এবং উবাই ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নবী করীম (সা:) এক সমাবেশে মানুষদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানাচ্ছিলেন, সে সমাবেশে উকবা উপস্থিত ছিলো। উবাই এ সংবাদ জানতে পেরে ছুটে এসে তাঁর বন্ধু উকবাকে বললো, 'তুমি মুহাম্মাদ (সা:) এর কথা শুনছো? তুমি যদি তাঁকে অপমান না করো তাহলে তোমার সাথে আমার কোনো সম্পর্কে থাকবে না'।

        মহান আল্লাহ তা'য়ালা উকবা এবং উবাইকে জাহান্নামের অতলে নিমজ্জিত করুন। তাদের কঠিন পরিণতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ করে তাদের ভয়ংকর অবস্থা সম্পর্কে জানিয়ে দিলেন। একদিন উবাই একটি পুরোনো হাড় এনে নবী করীম (সা:) কে বললো, 'হে মুহাম্মাদ (সা:)! তোমার কি বিশ্বাস হয় এই পচা হাড়কে আল্লাহ আবার জীবিত করবে?' এ কথা বলে সে হাড়টি গুড়ো করে বাতাসে উড়িয়ে দিল।

        নবী করীম (সা:) দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, 'মহান আল্লাহ তা'য়ালা বাতাসে মিশ্রিত হাড়কে আবার জীবিত করবেন এবং জাহান্নামে প্রেরণ করবেন'। এই কাফির সম্পর্কে সূরা ইয়াছিনের আয়াত অবতীর্ণ হলো। মহান আল্লাহ বললেন, 'তাদেরকে বলে দাও, প্রথমবার যখন তাঁরা অস্তিত্বহীন ছিল তখন তাদেরকে কে অস্তিত্ব দান করেছিল? যে আল্লাহ প্রথমবার অস্তিত্বদান করেছিলেন সেই আল্লাহই যতবার খুশী অস্তিত্বদান করবেন'।

        আরেকদিন নবী করীম (সা:) কা'বাঘর তাওয়াফ করছিলেন, এ সময় কাফির নেতারা বিশ্বনবী (সা:) এর কাছে আপোষ প্রস্তাব পেশ করে বললো, 'হে মুহাম্মদ (সা:)! এসো আমরা একটি প্রক্রিয়ায় আমাদের বিরোধ শেষ করে দেই। তা হলো, আমরা তোমার আল্লাহর দাসত্ব কিছুটা করি তুমিও আমাদের প্রতিপালক দেবতাদের দাসত্ব কিছুটা করো। তাহলে আর আমাদের ভেতরে কোনো বিরোধ থাকবে না'।

        কাফিরদের কথার জবাবে মহান আল্লাহ সূরা কাফিরুন অবতীর্ণ করে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, 'হে নবী, আপনি তাদেরকে জানিয়ে দিন, আমি যার দাসত্ব করি তোমরা তাঁর দাসত্ব করো না। তোমরা যার দাসত্ব করো আমি তাঁর দাসত্ব করি না। তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন আর আমার জন্য আমার দ্বীন'।
ইসলামে বাতিল শক্তির সাথে আপোষের কোনো ব্যবস্থা নেই। ইসলামে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। যার যার ধর্ম সে সে অবশ্যই পালন করবে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার স্থান ইসলামে নেই। পবিত্র কুরআনের এই আয়াত দিয়ে যারা ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে কথা বলেন তাদের উচিত আয়াতটির পটভূমি দেখা। পৃথিবীর কোনো নবী-রাসূলগণ এবং তাঁদের সাহাবায়ে কেরাম ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে ছিলেন না। কাফির এবং ধর্মনিরপেক্ষদের সাথেই তাদের সংঘর্ষ হয়েছে। নবীগণের আগমন ঘটেছেই মহান আল্লাহর বিধান রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে। সুতরাং কুরআনের আয়াতের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে যারা পার্থিব স্বার্থে ব্যবহার করে তাদের সতর্ক থাকা উচিত। মহান আল্লাহ তা'য়ালার ক্রোধ যে কোনো মুহূর্তে অবতীর্ণ হতে পারে।

        ইসলামে শক্তি প্রয়োগের স্থান নেই। ইসলাম তার আকিদা বিশ্বাসকে গ্রহণ করতে কাউকে বাধ্য করে না। কারণ বিশ্বাস জিনিসটা কারো ওপর শক্তি প্রয়োগ করে চাপিয়ে দেয়া যায় না। একইভাবে, ইসলাম তার আকিদা বিশ্বাসের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত ইবাদাতকেও কোনো ব্যক্তির ওপর শক্তি প্রয়োগ করে চাপিয়ে দেয় না। কারণ দৃঢ় বিশ্বাস ব্যতীত ইসলামের ইবাদত সমূহ অর্থহীন। দৃঢ় বিশ্বাস অন্তরে পোষণ করেই নামায, রোযা, হজ্জ ইত্যাদী আদায় করতে হয়। এসব দিকে ইসলাম মানুষকে স্বাধীনতা দিতে চায়। পক্ষান্তরে ইসলাম এটা সহ্য করতে নারাজ যে, সমাজ ও সভ্যতা পরিচালনাকারী যে আইন ও বিধানের ওপর রাষ্ট্রের কাঠামো ও বিধিব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, তা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ব্যতীত অন্য কেউ রচনা করে দিক, আল্লাহ তা'য়ালার প্রতি বিদ্রোহী মানুষজন আল্লাহর পৃথিবীতে আইনের প্রয়োগ করুক বা বাস্ত বায়ন করুক, মুসলিম জনগোষ্ঠী তা পালন করুক এবং তাদের দাস হয়ে থাকুক। এসব ঘৃণ্য সুযোগ ইসলাম দিতে নারাজ।

        নবী করীম (সা:) যে বাড়িতে থাকতেন সে বাড়ির চারদিকে যারা বসবাস করতো অর্থাৎ আল্লাহর রাসূলের প্রতিবেশী যারা ছিল তাদের ভেতরে একমাত্র হাকাম ইবনে আ'স (রা:) ব্যতীত আর কেউ ইসলাম কবুল করেনি। রাসূল (সা:) যখন নিজের বাড়িতেই নামায আদায় করতেন তখন প্রতিবেশী উকবা, আদী এ ধরনের অনেকেই তাঁর প্রতি পশুর নাড়ি ভুড়ি ছুড়ে দিত। নবী করীম (সা:) বাধ্য হয়ে দেয়ালের আড়ালে নামায আদায় করতেন। তিনি রান্নার জন্য উনুনে হাড়ি উঠাতেন আর তারা সেই হাড়ির ভেতরেও আবর্জনা ছুড়ে দিত। বিশ্বনবী (সা:) নিজ হাতে সেসব আবর্জনা পরিষ্কার করতেন। বিশ্বমানবতার মহান মুক্তির দূত নবী করীম (সা:) এর প্রতি ইসলামের শত্রুরা নির্যাতনের চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করেছে, কিন্তু শত্রুপক্ষের শেষ রক্ষা হয়নি। তাদের নাম-নিশানা মুছে গিয়েছে। ইনশাআল্লাহ ইসলামের এ যুগের দুশমনদের অস্তিত্বও ঘৃণা ও লাঞ্ছনার অতল তলদেশে হারিয়ে যাবে।

Post a Comment

0 Comments