সমস্ত প্রশংসা একমাত্র সেই মহাবৈজ্ঞানিকের

        মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই বিশ্ব-জাহান ও এর সমস্ত জিনিসের মালিক, এ বিশ্ব প্রকৃতিতে সৌন্দর্য, পূর্ণতা, জ্ঞান, শক্তি, শিল্পকারিতা ও কারিগরির যে নিপুণতা দৃষ্টি আকর্ষণ করে, এসবের জন্য একমাত্র মহান আল্লাহ-ই প্রশংসার অধিকারী। এ পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীজগৎ যে কোন বস্তু থেকে উপকারিতা লাভ করছে, লাভবান হচ্ছে, আনন্দ ও স্বাদ উপভোগ করছে সে জন্য অন্যান্য প্রাণীসমূহ যেমন আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে, মানুষকেও আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর দাসত্ব করতে হবে। যাবতীয় সৌন্দর্যের পেছনে এক আল্লাহ ব্যতীত যখন অন্য কারো কোন ভূমিকা নেই, তখন প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা লাভ করার অধিকার একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

لْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي لَهُ مَا فِي السَّمَوتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَلَهُ الْحَمْدُ فِي الْآخِرَةِ

        সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর প্রতিটি জিনিসের মালিক এবং আখেরাতেও প্রশংসা তাঁরই জন্য। (সূরা সাবা-১)

        মহান আল্লাহর সৃষ্টিতে কারো কোন অংশ নেই, সূরা ফাতিহার প্রথম আয়াতে এ কথাটিই অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। সমস্ত কিছু সৃষ্টির ব্যাপারে একক কৃতিত্ব একমাত্র তাঁর। তিনিই আকাশসমূহ ও পৃথিবীর নির্মাতা। এ জন্য সমস্ত প্রশংসাও তাঁরই প্রাপ্য। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

الْحَمْدُ لِلَّهِ فَاطِرِ السَّمَوتِ وَالْأَرْضِ 

        প্রশংসা আল্লাহরই জন্য, যিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর নির্মাতা। (সূরা ফাতির-১)

        একশ্রেণীর মানুষ বোঝে না, না বুঝে আল্লাহর সৃষ্টি কাজে অন্যের অংশ আছে বলে বিশ্বাস করে। তারা ধারণা করে, সৃষ্টি কাজে আল্লাহকে সহযোগিতা করার জন্য স্বয়ং আল্লাহই অনেককে নিয়োগ করেছেন। তারাও স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অসীম ক্ষমতা ও শক্তির অধিকারী। এ জন্য তাদেরও পূজা-অর্চনা করতে হবে। এভাবে অজ্ঞ মূর্খ মানুষ কল্পিত শক্তির মূর্তি নির্মাণ করে তার সামনে মাথানত করে দেয়। মাটির নিষ্প্রাণ মূর্তির প্রশংসায় মুখরিত হয়ে ওঠে। এদেরকে ভ্রান্তিমুক্ত করার জন্য মহান আল্লাহ বলেন-

سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُوْنَ وَسَلِّمْ عَلَى الْمُرْسَلِينَ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

        তারা যেসব কথা তৈরী করছে তা থেকে পাক-পবিত্র তোমার রব, তিনি মর্যাদার অধিকারী। আর সালাম প্রেরিতদের প্রতি এবং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর রাব্বুল আলামীনের জন্য। 

(সূরা সাফফাত-১৮০-১৮২)

        আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, তোমরা নিজের হাতে যেসব মূর্তি নির্মাণ করো, তাদের যে কোন ক্ষমতা নেই, তা তোমরা নিজেরাই অনুধাবন করতে পারো। তাদের দেহে মাছি বসলে তারা সে মাছিকেও তাড়াতে অক্ষম তা তোমরা দেখছো। তোমরা যেসব জিনিসকে শক্তির উৎস বলে তার পূজা-অর্চনা করছো, তা ধ্বংসশীল, তারা কিভাবে ধ্বংস হয় সে দৃশ্য তোমরা নিজেদের চোখে দেখে থাকো। এসব দেখেও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো না? সুতরাং, দাসত্ব ও প্রশংসা করো ঐ আল্লাহর-যিনি অমর অক্ষয়। সূরা মুমিনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন- 

هُوَ الْحَيُّ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ فَادْعُوهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

        তিনি চিরঞ্জীব। তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তোমাদের দ্বীন তাঁর জন্য নিবেদিত করে তাঁকেই ডাকো। গোটা সৃষ্টি জগতের রব্ব আল্লাহর জন্যই সমস্ত প্রশংসা।

        প্রশংসা করো একমাত্র আমার এবং দাসত্ব করো শুধু আমারই। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণীয় নিয়ম-পদ্ধতি আমার বিধানের অনুগত করে দাও। আমার একনিষ্ঠ গোলাম হয়ে যাও। আমার গোলামীর সাথে অন্য কারো গোলামীর মিশ্রণ ঘটিয়ো না। এ আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছুই তোমরা দেখছো, এসবের মালিক আমি-আমিই এসবের রব্ব। যাবতীয় ব্যবস্থাপনা আমারই হাতে নিবদ্ধ। পবিত্র কোরআন ঘোষণা করছে-

فَلِلَّهِ الْحَمْدُ رَبُّ السَّمَوتِ وَرَبُّ الْأَرْضِ رَبِّ الْعَالَمِينَ 

        সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি যমীন ও আসমানের মালিক এবং গোটা বিশ্বজাহানের সবার রব্ব। (সূরা আল জাসিয়া-৩৬)

        এ পৃথিবীতে অসংখ্য বস্তু এমন রয়েছে, যাদেরকে জড়পদার্থ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এসব বস্তুর ভেতরে প্রাণের কোন স্পন্দন নেই। এসব প্রাণহীন বস্তুও মহান আল্লাহর প্রশংসা করে। আকাশের মেঘমালাও আল্লাহর প্রশংসা করে। ঈশান কোণে কালবৈশাখীর নিকষকালো মেঘ রুদ্র ভয়াল রূপ ধারণ করে ক্রমশঃ গোটা আকাশ ছেয়ে ফেলে। ভয়ঙ্কর গর্জন করতে থাকে। আল্লাহ বলেন-

وَيُسَبِّحُ الرَّعْدُ بِحَمْدِهِ

        মেঘের গর্জন তাঁরই প্রশংসা সহকারে পবিত্রতা বর্ণনা করে। (সূরা আর-রা'দ-১৩) আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কত যে সুন্দর, তা তাঁর সৃষ্টির দিকে দৃষ্টিপাত করলেই অনুভব করা যায়। যাঁর সৃষ্টি এত সুন্দর, তিনি কত সুন্দর হতে পারেন তা কল্পনাও করা যায় না। মনের গহীনে কল্পনার কুঞ্জবনেও মানুষ আল্লাহর রুচি ও শৈল্পিক জ্ঞান সম্পর্কে ছায়াপাত ঘটাতে সক্ষম নয়। সমুদ্রের অতল তলদেশে অসংখ্য প্রাণী বাস করে। ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ আকারের মাছের সমাহার রয়েছে সমুদ্রে। এসব মাছের দেহের সৌন্দর্য দেখলে বিস্ময়ে বিমূঢ় হতে হয়। আল্লাহভীরু লোকদের মুখ থেকে নিজের অজান্তেই উচ্চারিত হয় 'আল হাম্দুল্লিাহ'। সৌন্দর্যের পূজারীরা এসব মাছ ক্রয় করে এ্যাকুইরিয়ামে রেখে ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। অপূর্ব সৌন্দর্যমন্ডিত এসব মাছ শুধুই তাকিয়ে দেখে এক শ্রেণীর লোক। তাদের মুখ থেকে আল্লাহর প্রশংসা বাণী উচ্চারিত হয় না। কিন্তু সৌন্দর্যের পসরা নিয়ে যে মাছগুলো মানুষের চোখের সামনে বিচিত্র ভঙ্গীতে পানির ভেতরে সাঁতার কেটে ফিরছে, তারা এক মুহূর্ত নীরব নেই। সময়ের প্রতিটি মুহূর্তে তারা ঐ মহান আল্লাহর প্রশংসা বাণী উচ্চারণ করছে।

        ঐ দূর নীলিমায় পাখিরা ডানা মেলে দিয়ে মনোমুগ্ধকর ভঙ্গীতে উড়ছে। মানুষ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে কিভাবে পাখিগুলো মহাশূন্যে উড়ছে। পাখিদের ওড়ার এই দৃশ্য দেখে অকৃতজ্ঞ মানুষ হতবাক হয়ে থাকলেও উড়ন্ত পাখিগুলো কিন্তু নীরব নেই। সূরা আন্ নূর-এর ৪১ নং আয়াতে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

الَمْ تَرَ أَنَّ اللهَ يُسَبِّحُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَوتِ وَالْأَرْضِ وَالطَّيْرُ صَفْتُ

        তুমি কি দেখো না, আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছে যারা আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীতে আছে তারা সবাই এবং যে পাখিরা ডানা বিস্তার করে আকাশে ওড়ে।

        আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মহাবিজ্ঞানী, তাঁর জ্ঞানের সাথে কোন কিছুর তুলনা হয় না। তিনি আপন কুদরতে সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং এসব সৃষ্টি তাঁরই প্রশংসায় নিয়োজিত রয়েছে। পবিত্র কোরআন ঘোষণা করছে-

سبْحَ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَوتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ 

        আল্লাহর তাস্বীহ করছে এমন প্রতিটি জিনিস যা আকাশমন্ডলে ও পৃথিবীর অভ্যন্তরে বিরাজ করছে। তিনিই সর্বজয়ী ও মহাবিজ্ঞানী। (সূরা আস-সফ-১)

        আকাশমন্ডলে মহাশূন্যে অসংখ্য গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্র, অগণিত তারকারাজি এবং গ্যালাক্সি (Galaxy) রয়েছে। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এসবের রহস্য সন্ধানে ব্যপৃত রয়েছেন। তারা দূরবীক্ষণ যন্ত্রের (Telescope) সাহায্যে তা অবলোকন করছেন। মহান আল্লাহ এসব সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর এসব সৃষ্টি তাঁরই প্রশংসা করছে। পৃথিবীর পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর এবং এসবের মধ্যে যা কিছু রয়েছে, সমস্ত কিছু তাদের নিজস্ব ভাষায় মহান আল্লাহর তাসবীহ করে যাচ্ছে। মানুষকেও তাঁরই প্রশংসা করার জন্য এসব বিষয় কোরআনে তুলে ধরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

يُسَبِّحُ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَوتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ الْمَلِكِ الْقُدُّوسِ الْعَزِيزِ الْحَكِيمِ 

        আল্লাহর তাস্বীহ করছে এমন প্রতিটি জিনিস যা আকাশমন্ডলে রয়েছে এবং এমন প্রতিটি জিনিস যা পৃথিবীতে রয়েছে। তিনি রাজাধিরাজ; অতি পবিত্র, মহাপরাক্রমশালী এবং সুবিজ্ঞানী। (সূরা জুম'আ-১)

        তিনি নিরঙ্কুশ শক্তির অধিকারী, তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে সক্ষম। কোন শক্তি তাঁর এই সীমাহীন কুদরতকে সীমাবদ্ধ বা সংকুচিত করতে পারে না। এই সমগ্র বিশ্বলোক তাঁরই এক রাজত্ব ও সাম্রাজ্য। তিনি এ পৃথিবীকে একবারই পরিচালিত করে দিয়ে এর থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে যাননি। তিনিই এর ওপর নিরন্তর শাসনকার্য পরিচালনা করে যাচ্ছেন। এই শাসন-প্রশাসন চালানোর ব্যাপারে অন্য কারো এক বিন্দু অংশীদারীত্ব নেই। অন্য কারো অস্থায়ীভাবেও সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে এই বিশ্বলোকের কোন স্থানে সামান্য ক্ষমতা প্রয়োগ করা, মালিকানা ভোগ করা অথবা শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষমতা যদিও কিছুটা থেকে থাকে, তা সে স্বয়ং অর্জন করতে সক্ষম হয়নি, আল্লাহর পক্ষ থেকেই তা দান করা হয়েছে। আল্লাহ যতদিন ইচ্ছা করবেন, ততদিন এই ক্ষমতা দিয়ে রাখবেন। আর যখনই তিনি ইচ্ছা করবেন, তখনই ক্ষমতার মসনদ থেকে বিদায় করে দেবেন।

        সুতরাং, সমস্ত প্রশংসা একমাত্র তাঁরই এবং তিনিই তা লাভের যোগ্য। শুধু তিনিই প্রশংসা লাভের অধিকারী। অন্য কোন সত্তায় যদি প্রশংসার যোগ্য কোন গুণ বা সৌন্দর্য দেখা যায়, তাহলে তা তাঁরই অবদান। তিনি দান করেছেন বলেই তাতে সৌন্দর্য বিদ্যমান। অতএব কৃতজ্ঞতা লাভের প্রকৃত ও একমাত্র অধিকারী তিনিই। কারণ সর্বপ্রকার নিয়ামত তাঁরই সৃষ্ট, তাঁরই অবদান। সমগ্র সৃষ্টিজগতের প্রকৃত কল্যাণকারী তিনি ব্যতীত আর কেউ নয়। অন্য কারো কোন উপকারের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলেও তা এই হিসাবে করা যেতে পারে যে, আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর নিয়ামত আমাদের কাছে পৌছিয়েছেন যার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হচ্ছে তার মাধ্যমে। কেননা, সে নিয়ামতের প্রকৃত স্রষ্টা হলেন আল্লাহ। তাঁর অনুমতি ব্যতীত এবং তিনি সুযোগ না দিলে একজন মানুষ আরেকজন মানুষের কোনক্রমেই উপকার করতে সক্ষম হয় না। সুতরাং কোন মানুষের কাছ থেকে উপকৃত হলেও আল্লাহরই প্রশংসা করতে হবে। কেননা তিনিই সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রক। সূরা আত্ তাগাবুন-এর ১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-

يُسَبِّحُ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَوتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ 

        আল্লাহর তাসবীহ করছে এমন প্রতিটি জিনিস যা আকাশমন্ডলে রয়েছে এবং এমন প্রতিটি জিনিস যা পৃথিবীর বুকে রয়েছে। বাদশাহী তাঁরই এবং তারীফ-প্রশংসাও তাঁরই জন্য। আর তিনিই প্রতিটি জিনিসের ওপরে কর্তৃত্বের অধিকারী।

Post a Comment

0 Comments