গ্রহসমূহ কক্ষপথে সন্তরণশীল

        আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অসংখ্য জগৎ সৃষ্টি করেছেন। এসব জগৎ তিনি ঠিকানা বিহীন অবস্থায় ছেড়ে দেননি। প্রতিটি জগত-ই তার নির্দিষ্ট গতি পথে পরিভ্রমণ করছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা ইয়াছিনের ৪০ নং আয়াতে বলেন-

لا الشَّمْسُ يَنْبَغِي لَهَا أَنْ تَدْرِكَ الْقَمَرَ وَلَا الَّيْلُ سَابِقُ النَّهَارِ وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ

        সূর্যের ক্ষমতা নেই চাঁদকে অতিক্রম করে এবং রাতের ক্ষমতা নেই দিনের ওপর অগ্রবর্তী হতে পারে, সবাই এক একটি কক্ষ পথে সন্তরণ করছে।

        সুদূর অতিত থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিশ্বজগৎ সম্পর্কে মানুষ যে জ্ঞানার্জন করেছে, এটাই শেষ না এর পরেও আরো কিছু জানার অবশিষ্ট আছে? এ কথা দৃঢ়তার সাথে কারো পক্ষেই বলা সম্ভব নয় যে, জ্ঞানের শেষস্তর পর্যন্ত সে পৌছতে সক্ষম হয়েছে। চূড়ান্ত কথা তখনই বলা সম্ভব হবে, যখন বিশ্বজগতের নিগুঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে মানুষ সঠিক ও নির্ভুল জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হবে।

        পক্ষান্তরে মানুষের জ্ঞানের বাস্তব অবস্থা হচ্ছে এটাই যে, মানুষের অর্জিত জ্ঞান প্রতিটি যুগে পরিবর্তনশীল ছিল এবং বর্তমানেও মানুষ যে জ্ঞানার্জন করেছে, যে কোন সময় তা পরিবর্তন হয়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। পৃথিবী ও চন্দ্র, সূর্য সম্পর্কে মানুষ যুগে যুগে বিভিন্ন ধরনের ধারণা পোষণ করেছে। এক সময় লোকজন চাক্ষুষ দর্শনের ভিত্তিতে সূর্য সম্পর্কে এ নিশ্চিত বিশ্বাস অন্তরে লালন করতো যে, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। এ ধারণা কিছু দিন প্রতিষ্ঠিত থাকার পর বিভিন্ন গবেষণা ও পর্যবেক্ষণে এ ধারণা আবার প্রতিষ্ঠিত হলো যে, সূর্য তার নিজের অবস্থানে স্থির রয়েছে এবং গোটা সৌরজগৎ তাকে কেন্দ্র করে পরিভ্রমণ করছে।

        কালের আবর্তনে উল্লেখিত ধারণা স্থায়ী হলো না। পর্যবেক্ষণে প্রমাণিত হলো যে, শুধু সূর্যই নয়, মহাশূন্যে যা রয়েছে, তা সবই একদিকে ছুটে চলেছে। যে যার কক্ষপথে সঞ্চালনশীল। এসব কিছুর চলার গতি হলো প্রতি সেকেন্ডে সাড়ে ষোল কিলোমিটার থেকে একশত একষট্টি কিলোমিটার পর্যন্ত। আল্লাহর কিতাবের সূরা ইয়াছিনের উক্ত আয়াতে যে 'ফালাক' শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, এর অর্থ হলো গ্রহ-নক্ষত্রের কক্ষপথ এবং আকাশের অর্থ থেকে ভিন্ন। আয়াতে বলা হয়েছে, সমস্ত কিছুই কক্ষপথে সন্তরণশীল। মুফাচ্ছিরগণ এ আয়াতের চার ধরনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

        কেউ বলেছেন, শুধুমাত্র চন্দ্র, সূর্য নয়-বরং সমস্ত তারকা ও গ্রহ এবং সমগ্র আকাশ জগৎ আবর্তন করছে। আবার কেউ বলেছেন, এদের প্রতিটির আকাশ অর্থাৎ প্রতিটির আবর্তন পথ বা কক্ষপথ ভিন্ন ভিন্ন। কেউ ব্যাখ্যা দিয়েছেন, আকাশসমূহ তারকারাজিকে নিয়ে আবর্তন করছে না বরং তারকারাজি আকাশসমূহে আবর্তন করছে। কারো ব্যাখ্যা হলো, আকাশসমূহে তারকাদের আবর্তন এমনভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যে, যেমন কোন তরল পদার্থে কোন বস্তু ভেসে চলে, ঠিক তেমনি মহাশূন্যে সমস্ত কিছুই ভেসে চলছে।

        যে বা যিনি যে ধরনের ব্যাখ্যাই দিন না কেন, একটি কথা স্মরণে রেখে আল্লাহর কোরআন অধ্যয়ন করতে হবে যে, কোরআন মানুষকে সঠিক পথপ্রদর্শনের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। তাওহীদ, রেসালাত ও আখিরাতের বিষয়সমূহ উপস্থাপন করতে গিয়ে সৃষ্টির বিভিন্ন দিকের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এর ভেতর দিয়েই বিজ্ঞানের নানা তথ্য বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, কোরআন নিরেট বিজ্ঞানের কিতাব।

        বিজ্ঞানের বিষয়সমূহের প্রতি ইঙ্গিত দেয়ার অর্থ হলো, মানুষকে এ কথা বুঝানো যে, যদি সে সমস্ত কিছুর ওপরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এবং নিজের জ্ঞান, বিবেক বুদ্ধি ব্যবহার করে তাহলে পৃথিবী থেকে আকাশ পর্যন্ত যেদিকেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করবে, সেদিকেই তার সামনে আল্লাহর অস্তিত্ব এবং তাঁর একত্বের অসংখ্য ও অগণিত যুক্তি-প্রমাণের এক বিশাল সমাবেশ দেখতে সক্ষম হবে।

        এসব সৃষ্টিসমূহের ভেতরে মানুষ কোথাও আল্লাহর অস্তিত্বহীনতার ও অংশীদারিত্বের স্বপক্ষে সামান্যতম যুক্তি ও প্রমাণও অনুন্ধান করে পাবে না। তিনি অসংখ্য জগৎ সৃষ্টি করেছেন, এসব যথা নিয়মে পরিচালিত হচ্ছে, এর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ এ জন্যই করা হয়েছে যে, কোন সুদক্ষ স্রষ্টা ব্যতিত এসব কি এমনিতেই চলতে পারে? শতকোটি জগৎ একটি নিয়মের অধীনে চলছে, স্রষ্টার যদি কোন অংশীদার থাকতো, তাহলে এসব পরিচালনা করতে গিয়ে অবশ্যই মতানৈক্য ঘটতো এবং তার বহিঃপ্রকাশ অবশ্যই মানুষ দেখতে সমর্থ হতো। সুতরাং কোথাও যখন কোন অনিয়ম মানুষের চোখে পড়ছে না, তখন এ কথা কি অনুভব করতে অসুবিধা হয় যে, সৃষ্টি জগতসমূহের পেছনে একজন স্রষ্টা রয়েছেন এবং তিনি এক ও অদ্বিতীয়? সমস্ত কিছুই যখন একটি নিশ্চিত পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে, তখন কি এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয়, পৃথিবীর মানুষেরও একটি পরিণতি রয়েছে? তোমরাই বলছো, সমস্ত কিছুই একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তোমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছো, কিভাবে ধ্বংস হচ্ছে-এসব ধ্বংসের পরে তাঁর পক্ষে এসব আবার দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করা কি অসম্ভব? প্রথমবার যিনি অস্তিত্বহীন থেকে অস্তিত্বদান করেছেন, দ্বিতীয়বারও তো তিনি অস্তিত্বদান করতে সক্ষম-এই সহজ সরল কথাটি তোমাদের মাথায় প্রবেশ করে না? সুতরাং আখিরাত অবশ্যম্ভাবী-এ কথা বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয়।

Post a Comment

0 Comments