মানুষের মালিক মানুষ স্বয়ং নয়, তার মালিক হলেন আল্লাহ। এ জন্য তার অধিকার নেই যে, সে তার মালিককে অস্বীকার করে নিজের খেয়াল-খুশী অনুসারে পৃথিবীতে জীবন অতিবাহিত করে। তাঁর যে মালিক ও স্রষ্টা, তাঁরই দাসত্ব এবং যাবতীয় ব্যাপারে তাঁরই আশ্রয় গ্রহণ করতে আদেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহর কিতাব ঘোষণা করছে- - قُل أَعُوذُ بِرَبِّ الفَلَق বলা, আমি আশ্রয় চাই রাব্বুল ফালাকের কাছে। (সূরা ফালাক-১)
সূরা ফালাক আল্লাহর কিতাবের ত্রিশ পারার ছোট্ট একটি সূরা। এ সূরাটি অধিকাংশ মুসলমানের মুখস্থ রয়েছে। নামাজে এটি বার বার পাঠ করা হয়। এ সূরার প্রথম আয়াতে ফালাক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সেই সাথে রব শব্দ সহযোগে উচ্চারিত হয়েছে, 'রাব্বুল ফালাক'। রাব্বুল ফালাক কাকে বলা হয়-বিষয়টি পরিষ্কার করে বুঝতে হবে। আরবী ফালাক শব্দের ক্রিয়ামূল হলো 'ফুল্ক'। এর অর্থ হলো 'যে চিরে ফেলে।' আর ফালাক শব্দের অর্থ হলো, কোন কিছু দীর্ণ করা বা চিরে ফেলা। সূরা আল আনআ'ম-এর ৯৬ আয়াতে 'ফলিকুল ইস্নাহ" শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এবং আল্লাহ সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'তিনিই রাতের আবরণ দীর্ণ করে রঙিন প্রভাতের উন্মেষ ঘটান।' আর সূরা ফালাকের প্রথম আয়াতে ব্যবহৃত 'রাব্বুল ফালাক' শব্দের সরল অর্থ হলো, 'প্রভাত কালের রব'।
পৃথিবীতে এক একটি দেশে প্রভাত কিভাবে হয়? রাতের নিকষ কালো অন্ধকার ভেদ করে পূর্ব গগনে তরুণ তপন উদিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে প্রভাত হওয়া বলে। অর্থাৎ অন্ধকারের বুকচিরে নবারূণের আগমন ঘটে। আর এই প্রক্রিয়াকে আরবী ভাষায় বলা যেতে পারে, ফালাকুস্ সুবাহ্ অর্থাৎ প্রভাত সূর্যের উদয়। এই ফালাক শব্দের আরেকটি অর্থ করা হয়েছে 'সৃষ্টিকার্য সমাধা করা।' এই অর্থ এ জন্য করা হয়েছে যে, পৃথিবীতে যত কিছুই সৃষ্টি হয়, তা কোন না কোন জিনিস বা আবরণ ভেদ করে, দীর্ণ করেই সৃষ্টি হয়। তিমিরাবৃত রজনীর বুকচিরেই দূর নিহারিকা কুে র মিটিমিটি আলো পৃথিবীর বুকে এসে পৌঁছায়। উত্তাল সাগরের বুক চিরেই জলযানসমূহ গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যায়। খেজুর গাছে সুমিষ্ট রসের ভান্ডার মওজুদ থাকলেও তা নির্গত হয় না। খেজুর গাছকে যখন দীর্ণ করা হয়, তখনই রস বেরিয়ে আসে। রাবার গাছসমূহ দীর্ণ করা না হলে রাবার পাওয়া যায় না। ডাবের পানি পান করতে হলেও তা দীর্ণ করতে হবে। পৃথিবীর উদ্ভিদ বীজসমূহ মাটির বুকচিরেই তার অঙ্কুরোদগম ঘটে। উদ্ভিদ মাটি দীর্ণ করেই পৃথিবীর আলো বাতাসে বেরিয়ে আসে।
ডিমের মাধ্যমে বংশধারা টিকিয়ে রাখার জন্য পৃথিবীতে যেসব প্রাণী ডিম দেয়, সেই ডিম দীর্ণ করেই শাবক পৃথিবীতে বেরিয়ে আসে। কুমিরের মতো বিশাল প্রাণীর বাচ্চাও ডিম চিরেই ভূমিষ্ঠ হয়। নদী-সাগর-মহাসাগরে যেসব প্রকান্ড মাছ বাস করে, সেসব মাছের বাচ্চাও ডিম থেকেই বেরিয়ে এসেছে। মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী মাতৃগর্ভ থেকে কোন বাধা বা আবরণ দীর্ণ করেই এই পৃথিবীতে আগমন করছে। বৃক্ষের বহিরাবরণ দীর্ণ করেই শাখায় শাখায় জাগে কিশলয়। ফুলের কুড়ি দীর্ণ করেই ফুল প্রস্ফুটিত হয়ে পাঁপড়ী মেলে দেয়। অর্থাৎ পৃথিবীর সমস্ত কিছুই কোন না কোন বাধা অপসারিত করে, কোন কিছুর বুক চিরে বা কোন আবরণ দীর্ণ করেই সৃষ্টি হয়, আর এই প্রক্রিয়ায় যিনি সৃষ্টি করেন তিনিই হলেন রাব্বুল ফালাক। তিনিই মানুষের মালিক, খালিক, সম্রাট, শাসক, আইনদাতা ও জীবন বিধানদাতা। একমাত্র তাঁরই সমস্ত প্রশংসা এবং তিনিই দাসত্ব লাভের অধিকারী। কোরআনের গবেষকগণ এই ফালাক শব্দের বিস্তারিত তাফসীর করেছেন।
0 Comments