যে ব্যক্তি নামায আদায় করে না, অথচ মুখে আল্লাহ, রাসূল ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস আছে বলে দাবি করে, তার এ দাবির পক্ষে কোনো সততা নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ মানে না এবং মৃত্যুর পরের জীবনের প্রতি যার বিশ্বাস নেই, তার পক্ষে নামায আদায় করা এক দুঃসাধ্য কাজ এবং অসহনীয় বিপদ বিশেষ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلوةِ وَإِنَّمَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَشِعِينَ الَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُمْ مُّلْقُوْا رَبَّهُمْ وَأَنَّهُمْ إِلَيْهِ رجعون
নামায নিঃসন্দেহে একটি কঠিন কাজ, কিন্তু সেই অনুগত বান্দাদের পক্ষে তা মোটেও কঠিন নয়, যারা বিশ্বাস করে যে তাদেরকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করতে এবং তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। (সূরা বাকারা-৪৫-৪৬)
অর্থাৎ যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে এবং মৃত্যুর পরে পরকালীন জীবনে মহান আল্লাহর সামনে উপস্থিত হয়ে যাবতীয় কর্মকান্ডের চুলচেরা হিসাব দিতে হবে, এই বাধ্যবাধকতায় যার বিশ্বাস রয়েছে তার পক্ষে যথারীতি নামায আদায় করা সামান্যতম কষ্টের কাজ তো নয়ই বরং জ্ঞান থাকতে এক ওয়াক্ত নামায ছেড়ে দেয়াই তাদের কাছে পৃথিবীর বুকে সবথেকে কঠিন কাজ। যারা জেনে বুঝে একনিষ্ঠভাবে নামায আদায় করে তাদের হৃদয়ে এই বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে, মহান আল্লাহর দৃষ্টির বাইরে তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। তার প্রত্যেকটি গতিবিধি আল্লাহ তা'য়ালার দৃষ্টিতে ধরা পড়ছে।
আলোয়-অন্ধকারে, লোকালয়ে-নির্জনে, পানির অতল তলদেশে, মহাকাশের উচ্চমার্গে যেখানেই সে অবস্থান করুক না কেনো, সর্বত্রই আল্লাহ তা'য়ালা তাকে দেখছেন এবং সে কি বলছে তা তিনি শুনছেন। পৃথিবীর সমস্ত মানুষের দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করতে সক্ষম হলেও আল্লাহ তা'য়ালার দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করা সম্ভব নয়। অপরাধ করে গোটা দুনিয়ার মানুষের কাছ থেকে সে অপরাধ আড়াল করা গেলেও আল্লাহর কাছে তার অপরাধ অজানা থাকে না। পৃথিবীর মানুষের দন্ড থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখা গেলেও আল্লাহর দন্ড থেকে নিরাপদ রাখা যাবে না।
একনিষ্ঠভাবে নামায আদায়কারীর মধ্যে নামায এই চেতনাই জাগ্রত রাখে। ফলে তার পক্ষে কোনো ধরনের অপরাধমূলক কর্মে জড়িত হওয়া সম্ভব হয় না। নামায সৃষ্ট এই চেতনাই মানুষকে অপরাধ মুক্ত রাখে এবং সে মানুষ যে কেনো কর্মের ক্ষেত্রে বৈধ-অবৈধের সীমা অনুসরণ করে চলে। জেনে বুঝে যথাযথভাবে সঠিক অর্থে নামায আদায়কারীর নামায সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা'য়ালা সূরা আনকাবুতের ৪৫ নং আয়াতে নিশ্চয়তা দিয়ে বলেছেন-
إِنَّ الصَّلوةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ
নিশ্চিতভাবেই নামায অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। (সূরা আনকাবুত) নামাযের অসংখ্য অবদান রয়েছে, এসব অবদানের মধ্যে এটাও একটি অবদান যে- নামায মানুষকে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। উল্লেখিত আয়াতে নামাযের যে গুণ বর্ণনা করা হয়েছে তার দুটো দিক রয়েছে। এর একটি গুণ হলো অনিবার্য গুণ ও অপর গুণটি হলো কাঙ্খিত গুণ। অনিবার্য গুণ হলো, নামায মানুষকে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। আর কাঙ্খিত গুণ হলো, নামায আদায়কারী কার্যক্ষেত্রে অশ্লীল, নোংরা বা খারাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখবে- এটা কাঙ্খিত গুণ।
নামায মানুষকে অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে- অর্থাৎ নামায অবশ্যই নামায আদায়কারীকে অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখবেই। নামায আদায়ের পূর্ব প্রস্তুতি ও নামায আদায়ের পদ্ধতি সম্পর্কে চিন্তা করলে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মানুষকে অবৈধ কাজ থেকে বিরত রাখার যতগুলো হাতিয়ার রয়েছে, একমাত্র নামাযই হলো হলো সবথেকে কার্যকর হাতিয়ার।
নামায প্রতিদিন একজন মানুষকে পাঁচবার জানিয়ে দেয় যে, সে পৃথিবীতে স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী নয়। বরং সে আল্লাহর গোলাম, যিনি তাকে সর্বত্র দেখছেন, তার মনের ইচ্ছা ও সঙ্কল্প সম্পর্কেও তিনি অবহিত রয়েছেন। মৃত্যুর পরের জীবনে আল্লাহর আদালতে তাকে যাবতীয় কর্মের হিসাব দিতে হবে। এসব কথা নামায মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েই বিরত থাকে না- বরং কার্যক্ষেত্রে নামায আদায়ের প্রস্তুতি ও নামায আদায় কালে সে যেনো গোপনে আল্লাহর কোনো আদেশ অমান্য না করে, সেই প্রশিক্ষণও নামায দিচ্ছে।
নামায আদায়ের পূর্বশর্ত হলো শারীরিক পবিত্রতা, পরনের বস্ত্রের পবিত্রতা ও ওজু করা। কেনো ব্যক্তি মসজিদে নামায আদায়ের জন্য এলে সে ব্যক্তি শারীরিকভাবে পবিত্র কিনা অথবা তার পরিধানের বস্ত্র পবিত্র কিনা বা সে ওজু করেছে কিনা, তা পরীক্ষা করে দেখার কেনো উপায় নেই। কেউ এ সংক্রান্ত ব্যাপারে কেনো প্রশ্নও করে না।
তবুও যে ব্যক্তি নামায আদায় করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে, সে ব্যক্তি জেনে বুঝে অপবিত্র দেহে, অপবিত্র বন্ত্রে বা অপবিত্র স্থানে ওজু ব্যতীতই নামায আদায়ের প্রস্তুতি গ্রহণ করে না। কারণ তার চেতনার জগতে এই ভয় জাগ্রত রয়েছে যে, কেউ না দেখলেও আল্লাহ তা'য়ালা দেখেছেন সে ওজু করেছে কিনা। কেউ না জানলেও আল্লাহ তা'য়ালা জানছেন, তার দেহ ও দেহের পোষাক পবিত্র রয়েছে কিনা।
নামায আদায়কালে যথাস্থানে নিয়ম অনুসারে সে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা ও অন্যান্য সূরা এবং বিভিন্ন দোয়া-দরুদ পড়েছে কিনা, এসব জানার উপায় নেই। কেউ নামায আদায়কারীকে প্রশ্নও করে না, 'আপনি নামাযে সূবা ফাতিহার পরিবর্তে অন্য সূরা দিয়ে বা কোনো কবির কবিতা দিয়ে নামায শুরু করেননি তো? অথবা সিজদায় গিয়ে যথারীতি সিজদার তস্বীহ পড়েছেন তো?' তবুও নামায আদায়কারী জেনে বুঝে এ ধরনের কোনো কাজ করে না। যেখানে যে সূরা, দোয়া-দরুদ ও তস্বীহ্ পড়তে হবে, সেখানে সে তাই পড়ে।
এভাবে একজন মানুষ যখন প্রতিদিন আল্লাহর বিধান অনুসারে নির্ধারিত নিয়মে পাঁচবার যথারীতি নামায আদায় করে, তার অর্থ তো এটাই দাঁড়ায় যে- এই নামাযই চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে পাঁচবার তার বিবেকে প্রাণ সঞ্চার করছে, তার মধ্যে দায়িত্বানুভূতি সৃষ্টি করছে, তাকে দায়িত্ববান মানুষে পরিণত করছে। যে বিধানের প্রতি সে বিশ্বাস স্থাপন করেছে তা মেনে চলার জন্য পৃথিবীতে কোনো প্রহরার ব্যবস্থা থাক বা না থাক, বাইরের কোনো শক্তি থাক বা না থাক এবং পৃথিবীবাসী তার কাজের অবস্থা জানুক বা না জানুক, আল্লাহর ভয়ে এবং নিজের আনুগত্য প্রবণতার প্রভাবাধীনে প্রকাশ্যে ও গোপনে যে কেনো অবস্থায় সে সেই বিধানই মেনে চলবে, যার প্রতি সে ঈমান এনেছে। নামায এভাবেই একজন মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
সুতরাং নামায শুধুমাত্র মানুষকে অশ্লীল ও অসৎ-গর্হিত কাজ থেকেই বিরত রাখে না বরং প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে নামায ব্যতীত এমন কোনো দ্বিতীয় প্রশিক্ষণ পদ্ধতি নেই, যা মানুষকে যাবতীয় অসৎ, গর্হিত ও দুষ্কৃতিমূলক কাজ থেকে বিরত রাখার ক্ষেত্রে এত অধিক প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করতে পারে।
পৃথিবীতে নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য ক্ষেত্র বিশেষে কয়েক ঘন্টার বা কয়েক দিনেরও কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। অপরাধমুক্ত সমাজ ও প্রশাসন গড়ার লক্ষ্যেও কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। অপরাধ থেকে বিরত রাখার লক্ষ্যে নানা ধরনের আইন-কানুন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু কোনো ধরনের আইন বা প্রশিক্ষণ পদ্ধতিই মানুষকে অপরাধ থেকে বিরত রাখার ব্যাপারে ন্যূনতম ভূমিকা পালন করতে পারে না। কিন্তু নামায যে প্রশিক্ষণ দেয়, এই প্রশিক্ষণ এত অধিক কার্যকরী যে, মানুষকে গর্হিত কাজ থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করে।
ইসলামের সোনালী যুগের একটি ঘটনা। দিবাবসানে-গোধূলী লগ্নে একজন সুন্দরী তন্বী যুবতী নারী অলঙ্কারে সুসজ্জিতা হয়ে নির্জন পাহাড়ী পথ বেয়ে একাকী তার গন্তব্যের দিকে যাচ্ছিলো। ক্রমশ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। যুবতীর মনে ভীতির সঞ্চার হলো। সে দ্রুত পদক্ষেপে তার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো। সহসা তার দৃষ্টি পড়লো এক যুবকের দিকে। সুন্দর সুঠাম ও বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী একজন যুবক তার দিকেই এগিয়ে আসছে। অলাঙ্কারাদি লুষ্ঠিত ও ধর্ষিতা হবার ভয়ে যুবতীর চেহারা বিৰৰ্ণ হয়ে গেলো। সে কাঁপতে কাঁপতে পথের ওপরে বসে পড়লো। ধীর পদবিক্ষেপে যুবক ক্রমশ যুবতীর দিকে এগিয়ে এসে তার ভয়বিহ্বলা চোখের ওপরে চোখ রেখে পরম নির্ভরতার কণ্ঠে বললো, 'মা, আমাকে ভয় পেয়ো না, তুমি কোথায় যাবে বলো, আমি প্রহরা দিয়ে নিরাপত্তার সাথে তোমাকে তোমার গন্তব্যে পৌঁছে দেবো। আমার পরিচয় শোনো, আমি মুসলমান।' এ ধরনের অসংখ্য ঘটনায় ইতিহাসের পাতায়দ্ধ হয়ে রয়েছে। মায এভাবেই মানু কে অপরাধ থেকে বিরত রেখেছে।
0 Comments