জ্ঞান, বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন তথা সচেতন কোনো মানুষের পক্ষে উদ্দেশ্যহীন কোনো কাজ করা সম্ভব নয় এবং যে কাজে কোনো ফল পাওয়া যাবে না, এ ধরনের কোনো কাজও কেউ করবে না। অর্থাৎ মানুষ এমন কাজের পেছনেই সময় ব্যয় করে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে, অনিবার্যরূপে যে কাজের ফল লাভ করা যাবে।
সুতরাং যে উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ তা'য়ালা ও তাঁর রাসূল নামায আদায়ের ব্যাপারে এত তাগিদ করেছেন, সেই উদ্দেশ্য সম্পর্কে নামায আদায়কারীকে অবশ্যই অবগত হতে হবে। কাজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনবহিত থাকলে সেই কাজের বাঞ্ছিত ফল আশা করা বৃথা। যে ব্যক্তি নামায আদায় করছে তার অন্তত নামায সম্পর্কে এতটুকু ধারণা থাকতে হবে, কোন্ সে সত্তা যার উদ্দেশ্যে সে সিজদা দিচ্ছে। কোন্ সত্তার কাছে আবেদন-নিবেদন করছে, নামাযে সে কি পড়ছে এবং এগুলোর অর্থ কি। নামায তাকে কি শিক্ষা দিচ্ছে, নামায সংক্রান্ত এসব বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে সে নামায- নামায আদায়কারীর ওপরে কি করে প্রভাব বিস্তার করবে?
এ কারণেই দেখা যায়, নামায আদায় করে অথচ মিথ্যা কথা ত্যাগ করতে পারেনি। ওজনে কম দিচ্ছে, মানুষকে ঠকাচ্ছে, অপরের স্বার্থ আত্মসাৎ করছে এবং নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত হচ্ছে। এ জন্যই অনেককে প্রশ্ন তুলতে দেখা যায়, নামায কি সত্যই মানুষকে অপরাধ থেকে দূরে রাখে?
এই প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, নামায আদায় করায় পরও অপরাধ মুক্ত থাকা না থাকা নির্ভর করে নামাযী ব্যক্তি আত্মিক সংশোধন ও পরিশুদ্ধির লক্ষ্যে নামাযের মাধ্যমে কতটা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে তার ওপর। ব্যক্তি যদি নামায থেকে উপকৃত হবার দৃঢ় সঙ্কল্প গ্রহণ করে এবং এ জন্য চেষ্টা-সাধনা করে, তাহলে নামাষের সংশোধনমূলক প্রভাব নামাযী ব্যক্তির ওপরে পড়বে। নতুবা পৃথিবীর কোনো সংশোধন ব্যবস্থা এমন ব্যক্তির ওপর কার্যকর হতে পারে না যে ব্যক্তি সংশোধনমূলক প্রশিক্ষণের প্রভাব গ্রহণ করতে মোটেও প্রস্তুত নয় অথবা জেনে বুঝে তার প্রভাবকে দূরে সরিয়ে দিতে থাকে।
দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যেতে পারে যে, একজন ছাত্র যদি নিজেকে ভালো ছাত্র হিসাবে গড়ে তুলতে আগ্রহী হয় এবং পরীক্ষায় উত্তম ফলাফল লাভে প্রত্যাশী হয়, তাহলে সেই ছাত্রকে লেখাপড়ার পেছনে সময় ব্যয় করতে হবে। ভালো ফলাফলের জন্য শিক্ষক মন্ডলী যে ধরনের পরামর্শ দেন এবং যে পদ্ধতিতে লেখাপড়া করতে বলেন, তা ছাত্রকে অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। ছাত্র যথারীতি শিক্ষাঙ্গনে গেলো, শিক্ষক মন্ডলী যথাযথ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ দিয়ে গেলেন, কিন্তু ছাত্র তা গ্রহণ করলো না। তাহলে সে ছাত্র কি করে ভালো ফলাফল লাভ করবে? অনুরূপভাবে নামায যে শিক্ষা দেয়, সেই শিক্ষা নামাযী যদি গ্রহণ না করে শুধু নামাযের, সময় হলে মসজিদে গেলো আর নামাযের নামে ওঠা-বসা করলো। এই নামায তো ব্যক্তির ওপরে কোনো প্রভাব বিস্তার করবে না।
আরেকটি দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে, শরীরের পরিপুষ্টি ও প্রবৃদ্ধির জন্য খাদ্য গ্রহণ একান্তই অনিবার্য। খাদ্য তখনই শরীরের পুষ্টি সাধন করবে, যখন পাকস্থলীকে খাদ্য হজম করার সুযোগ দেয়া হবে। যদি কেনো ব্যক্তি খাদ্য গ্রহণ করার সাথে সাথে বমি করে গ্রহণকৃত খাদ্য উদগীরণ করে দেয়, তাহলে খাদ্য কিভাবে দেহের পরিপুষ্টি সাধন করবে? খাদ্য গ্রহণ করে সেই খাদ্য বমি করে ফেলে দিয়ে কেউ যদি খাদ্যের দোষ দেয় যে, 'এই খাদ্য দেহের পরিপুষ্টি সাধন করতে সক্ষম নয়' তাহলে সেই ব্যক্তি সম্পর্কে কি বলা যাবে? এই ব্যক্তি সম্পর্কে তো এ কথাই বলতে হবে, লোকটি খাদ্য গ্রহণ করে না।
সুতরাং নামায আদায় করার পরও যে ব্যক্তি অপরাধমূলক কর্মকান্ড থেকে নিজেকে বিরত রাখে না, সেই ব্যক্তি সম্পর্কে তো এ কথাই বলতে হবে- প্রকৃতপক্ষে ঐ ব্যক্তি নামায আদায় করে না। খাদ্য গ্রহণ করেও বমি করে ফেলে দেয়ার অনুরূপ ভূমিকা পালন করছে ঐ নামাযী ব্যক্তি, যে নামায আদায় করার পরও নিজেকে অসৎ কাজে জড়িত রাখে। এই ধরনের নামাযী ব্যক্তি সম্পর্কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ لَّمْ تَنْهَه صَلَاتِهِ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ فَلَا صَلَاةَ لَهِ
যার নামায তাকে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখেনি তার নামাযই হয়নি।
(ইবনে আবী হাতেম)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরেকটি কথা এভাবে উদ্ধৃত করেছেন-
مَنْ لَّمْ تَنْهَه صَلوتَه عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ لَمْ يَزِيدَ بِهَا مِنَ الله الا بعدًا
যার নামায তাকে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখেনি তাকে তার নামায আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। (তাবারানী)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন-
لأصلوةَ لِمَنْ لَّمْ يَطعُ الصَّلوةَ وَطَاعَةَ الصَّلوةَ إِنَّ تَنْهى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ
যে ব্যক্তি নামাযের আনুগত্য করেনি তার নামাযই হয়নি আর নামাযের আনুগত্য হচ্ছে, নামুষ অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে। (বাইহাকী)
এ জন্য ইমাম জাফর সাদিক (রাহঃ) বলেছেন, নামায আদায়কারী ব্যক্তি তার নামায কবুল হয়েছে কিনা যদি তা জানতে চায়, তাহলে তাকে দেখতে হবে, সেই ব্যক্তি অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে কতটা দূরে অবস্থান করছে। নামায তাকে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখে, তাহলে বুঝতে হবে, তার নামায কবুল হয়েছে। (রূহুল মা'আনী)
রোগ থেকে আরোগ্য লাভের আশায় রোগী চিকিৎসকের কাছে যায় এবং চিকিৎসকের ব্যবস্থা পত্রানুসারে ওষুধ সেবন করে। রোগী যদি অকাট মূর্খ হয়, তাহলে চিকিৎসকের কাছ থেকে ব্যবস্থা পত্র ভালোভাবে বুঝে নেয়, তারপরও বাড়িতে এসে ওষুধ খেতে যেনো কেনো ভুল না হয়, এ জন্য সে লেখাপড়া জানা ব্যক্তির মাধ্যমে ব্যবস্থা পত্র অনুসারে ওষুধ ব্যবহার করতে থাকে। নিজে ব্যবস্থা পত্র অনুসারে ওষুধ ব্যবহার করলে ভুল হতে পারে, এ কারণেই সে ব্যক্তি লেখাপড়া জানা ব্যক্তির সাহায্য গ্রহণ করে।
লেখাপড়া না জানার কারণে নিজে জমির দলীল বুঝে না, এ কারণে অর্থ ব্যয় করে উকিলের সাহায্য গ্রহণ করে। যেনো তার জমি কোনোভাবে অন্যের দখলে চলে না যায়। স্বার্থের কারণে একজন মূর্খ লোকও যদি লেখাপড়া জানা ব্যক্তির সাহায্য গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, তাহলে যে নামায মানুষকে যাবতীয় অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রেখে একজন আদর্শ মানুষে পরিণত করবে, সেই নামায সম্পর্কে জানার প্রয়োজনীয়তা কেনো অনুভব করা হবে না?
নানা বিষয়ে জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে বছরের পর বছর অর্থ ব্যয় করে চেষ্টা-সাধনা করা হয় পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য, কিন্তু যে নামায মানুষকে অপরাধমুক্ত রেখে পৃথিবী ও আখিরাতে মুক্তির পথ সুগম করবে, সেই নামায সম্পর্কে জানার আগ্রহ কেনো থাকবে না? আদালতে আখিরাতে এসব প্রশ্ন অবশ্যই উঠবে এবং জবাব দিতে ব্যর্থ হবার কারণে গ্রেফতার হতে হবে।
0 Comments