অপরাধিদের প্রতি দণ্ড বিধান

        মক্কা বিজয়ের পূর্বে ইসলাম বিরোধিদের মধ্যে কিছু লোকজন এমন গুরুতর অপরাধ করেছিলো, মানবতা ও আইনের দৃষ্টিতে যাদের অপরাধ ছিল মৃত্যুদণ্ড তুল্য। এদের কতজনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল, এ সম্পর্কে হাদীস ও ইতিহাসে মতপার্থক্য বিরাজমান। ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে, নবী করীম (সা:) যেদিন মক্কায় প্রবেশ করেন সেদিন তিনি ঘোষণা করেছিলেন এমন দশজন ব্যক্তি সম্পর্কে যে, তাদেরকে যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই তাদেরকে হত্যা করতে হবে। এভাবেও বলা হয়েছিল যে, তারা যদি কা'বাঘরের গিলাফের ভেতরেও লুকিয়ে থাকে তাহলেও হত্যা করতে হবে। (সীরাতে ইবনে হিশাম)

        মৃত্যুদণ্ডের আসামীদের ভেতরে বনী আমের গোত্রের আব্দুল্লাহ ইবনে সা'দ নামক এক ব্যক্তি ছিল। এই ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে মদীনায় দরবারে নববীতে ওহী লেখকের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছিল। তারপর সে পুনরায় ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে মক্কায় কুরাঈশদের কাছে ফিরে এসে নবীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে থাকে। মক্কা বিজয়ের দিনে সে পালিয়ে হযরত উসমান (রা:)-এর কাছে গিয়েছিল। তিনি ছিলেন তাঁর দুধভাই। তিনি লোকটিকে আশ্রয় দিয়েছিলেন।

        মক্কা বিজয়ের পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে হযরত উসমান (রা:) লোকটিকে সাথে করে নবীর দরবারে উপস্থিত হয়ে তার নিরাপত্তার আবেদন করেন। উসমান (রা:) বারবার আবেদন করতে থাকেন। নবী করীম (সা:) দীর্ঘক্ষণ নীরব থাকার পরে ইতিবাচক জবাব দান করেন। উসমান (রা:) লোকটিকে নিয়ে চলে যাবার পরে রাসূল (সা:) উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামকে বললেন, 'আমি যতক্ষণ জবাব না দিয়ে নীরব ছিলাম, এর মধ্যে তোমরা লোকটিকে হত্যা করতে পারতে'।

        একজন আনসারী সাহাবী বললেন, 'হে আল্লাহর রাসূল (সা:), আমাকে একটু ইশারা দিলেই পারতেন'।

        বিশ্বনবী (সা:) বললেন, 'কোনো নবীর পক্ষে এটা শোভনীয় নয় যে, তিনি ইশারা দিয়ে কাউকে হত্যা করাবেন'।

        বুখারী শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে, মক্কা বিজয়ের দিনে নবী করীম (সা:) সবেমাত্র মাথা থেকে লোহার শিরস্ত্রাণ খুলেছেন এমন সময় একজন এসে তাঁকে জানালেন, 'ইবনে খাতাল কা'বার গিলাফ ধরে আছে'।

        নবী করীম (সা:) বললেন, 'তাকে হত্যা করো'।

        এই ব্যক্তির নাম ছিল আব্দুল উজ্জা। ইসলাম গ্রহণের পরে তার নাম হয় আব্দুল্লাহ। কিছুদিন পরে সে মুরতাদ হয়ে যায় এবং কয়েকজন মুসলমানকে হত্যা করে মদীনা থেকে মক্কায় পালিয়ে আসে। তার দুইজন দাসী ছিল। তারা তার আদেশে নবী (সা:) এর কুৎসামূলক গান গাইতো। এই ব্যক্তিকে মাকামে ইবরাহীম ও যমযম কূপের মাঝামাঝি স্থানে হত্যা করা হয়। কিন্তু তাকে এ কারণে হত্যা করা হয়নি যে, সে রাসূলকে গালি দিয়েছে বা ইসলামের বিরোধিতা করেছে। বরং তাকে হত্যা করা হয়েছিল কিসাসের কারণে। কয়েকজন মুসলমানকে হত্যা করে সে মৃত্যুদণ্ডতুল্য অপরাধ করেছিল। এ কারণেই তাকে হত্যা করা হয়।

        বুখারী শরীফে মাত্র একজনকে হত্যা করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হাফেজ মোঘলতাই উল্লেখ করেছেন ১৫ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর বর্ণনা হাদীস বিশারদগণ গ্রহণ করেননি। কোনো বর্ণনায় বলা হয়েছে ১০ জন, কেউ বলেছেন ৮ জন, কেউ বলেছেন ৬ জনের কথা। পক্ষান্তরে বুখারীর বর্ণনার সামনে অন্য কোনো বর্ণনা গ্রহণ করা কঠিন। তাছাড়া তাঁরা যে যুক্তি দিয়েছেন, সে যুক্তি সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠে। কেউ বলেছেন, অমুক অমুককে হত্যা করা হয়েছিল এ কারণে যে, তারা নবী করীম (সা:) কে কষ্ট দিত বা তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করতো। এ যুক্তি এ কারণে গ্রহণযোগ্য নয় যে, এই অপরাধে মক্কার অধিকাংশ লোকই অপরাধী ছিল।

        বিশ্বনবী (সা:) ব্যক্তিগত কারণে কখনো কারো ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। ইসলামের সাথে বিরোধিতা করেছে, নবীর সাথে বিরোধিতা করেছে, এ কারণে কোনো একজন ব্যক্তিকেও হত্যা করা হয়নি। আরেকজনকে হত্যা করার কথা বলা হয়, সে ব্যক্তি হলো মিকয়াস ইবনে সাব্বাবা। এই লোকের ভাই মদীনার একজন আনসারী মুসলমানের হাতে নিহত হয়। আনসারীর অসতর্কতার কারণে সে নিহত হয়েছিল। বিশ্বনবী (সা:) এ কারণে রক্তপণ আদায় করেছিলেন।

        কিন্তু মিকয়াস ছিল হিংস্র প্রকৃতির মানুষ। ভাই নিহত হবার বিনিময়ে সে অর্থ আদায় করেছিল। তারপরও সে ইসলাম গ্রহণ করার ছলে মুসলমানদের সাথে মিশে ঐ আনসারীকে হত্যা করেছিল। এভাবে যে তিন চারজনকে হত্যা করা হয়েছিল, তারা সবাই ছিল মৃত্যুদন্ডের আসামী। যারা দশজন, ছয়জন, আটজনের কথা উল্লেখ করেছেন, যে সূত্রে উল্লেখ করেছেন সেই সূত্র ইসলামী চিন্তাবিদ ও ইতিহাস গবেষকগণ আন্তরিকভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। কারণ যারা এই হত্যা সংক্রান্ত হাদীস বর্ণনা করেছেন, বিখ্যাত হাদীস বিশারদগণের দৃষ্টিতে তাঁরা দুর্বল বর্ণনাকারী।

        ইমাম বুখারী এ কারণে এ সকল বর্ণনাকারীর বর্ণনাকৃত হাদীস তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেননি। খায়বরে নবী করীম (সা:) কে যয়নাব নামক ইয়াহুদী একজন নারী গোস্তের সাথে বিষ খাইয়েছিল। রাসূল (সা:) তাকেও ক্ষমা করেছিলেন। কিন্তু এই বিষক্রিয়ায় একজন সাহাবা নিহত হলে সে মহিলাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। বিশ্বনবী (সা:) এর গর্ভবতী কন্যা মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় যাওয়ার পথে তাকে হুরাইরেস ইবনে নুকাইয়্যাদ উটের ওপর থেকে ফেলে দিয়েছিল। এতে নবী (সা:) এর কন্যার গর্ভের সন্তান নিহত হয়। এ কারণে তাকেও হত্যা করা হয়েছিল।

        কিন্তু যারা উল্লেখ করেছেন, নবী (সা:) এর বিরুদ্ধে জঘন্য মন্তব্য করার কারণে তিনি বেশ কয়েকজনকে হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাদের বর্ণনার ভিত্তি নেই। এ কারণে তিনি যদি হত্যা করার আদেশ দিতেন তাহলে মক্কার অধিকাংশ লোককে হত্যা করা হতো। মদীনারও বহুলোক ছিল, যারা রাসূলের নিন্দা করতো। তায়েফ ও খায়বরে ছিল, এ সকল লোককেও হত্যা করা হতো। আল্লামা শিবলী নোমানী (রাহ:) এ সম্পর্কে বলিষ্ঠ যুক্তি ও ব্যাখ্যা প্রদান করে প্রমাণ করেছেন, এ সকল বর্ণনা অত্যন্ত দুর্বল। তাছাড়া যে দশজনের হত্যার কথা বলা হয়, তাদের মধ্যে সাতজন যে ইসলাম কবুল করেছিলেন এটা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। সুতরাং মক্কা বিজয়ের পরে পবিত্র মক্কার বুকে হত্যাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়েছিল, এ কথা বলা মারাত্মক অন্যায়।

Post a Comment

0 Comments