মর্যাদার অতুলনীয় নিদর্শন, কিবলা পরিবর্তন

        হিজরী প্রথম সালেই নামাজে পরিবর্তন এসেছিল। ফরজ নামাজসমূহ দুই রাকায়াত আদায় করা হতো। প্রথম হিজরী থেকে যোহর, আসর ও এশার ফরজ নামাজ চার রাকায়াত আদায়ের আদেশ বলবৎ হলো। কিন্তু মুসাফিরদের জন্য দুই রাকায়াতই স্থির থাকলো। নবী করীম (সা:) মদীনায় হিজরত করার কিছুদিন পরেই সেই মহান সাহাবী দু'জন ইন্তেকাল করেছিলেন যাদের একজন ছিলেন হযরত কুলসুম ইবনে হাদাম (রা:)। এই সাহাবী মদীনার কুবা পল্লীর বিখ্যাত নেতা ছিলেন। তাঁর বাড়িতেই আল্লাহর রাসূল (সা:) প্রথম মেহমান হয়েছিলেন। মক্কার অনেকেই তাঁর বাড়িতে ছিলেন। আর দ্বিতীয়জন ছিলেন হযরত আসওয়াদ ইবনে যুরারাহ (রা:)। প্রথম যে ছয়জন মদীনাবাসী মক্কার আকাবায় নবী করীম (সা:) এর হাত মুবারকে বাইয়াত হয়েছিলেন, হযরত আসওয়াদ (রা:) ছিলেন তাদেরই একজন।

        এ ছয় জন সাহাবীর মধ্যে বাইয়াত করার জন্য হযরত আসওয়াদ (রা:) সর্বপ্রথমে নবী করীম (সা:) এর হাতে হাত রেখেছিলেন। আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াতের সময় নবী করীম (সা:) যে ১২ জনকে আহ্বায়ক নিযুক্ত করেছিলেন হযরত আসওয়াদ (রা:) ছিলেন বনী নাজ্জার গোত্রের আহ্বায়ক। তিনিই সর্বপ্রথম মদীনায় জুমার নামাজ কায়েম করেছিলেন। তাঁর ইন্তেকালের পরে আহ্বায়কের পদ শূন্য হলে গোত্রের লোকজন আরেকজনকে মনোনীত করেছিল। অন্য কাউকে আহ্বায়ক নিযুক্ত করা হলে দলাদলি সৃষ্টি হতে পারে বিধায় নবী করীম (সা:) স্বয়ং সেই গোত্রের আহ্বায়ক হলেন। কারণ বনী নাজ্জার গোত্রে ছিল তাঁর নানার বাড়ি। অবাক হবার মত ঘটনা ছিল এই যে, এ সময় ইসলাম বিরোধিদের দু'জন নেতাও মারা গিয়েছিল। একজন ছিল হযরত খালিদ (রা:) এর পিতা ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা আরেকজন হলো হযরত আমর (রা:) এর পিতা আস ইবনে ওয়ায়েল সাহমি। এ সময় হযরত আবু বকর (রা:) এর বড় মেয়ে হযরত আসমা (রা:) ইসলামের ইতিহাসের বিখ্যাত বীর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা:) কে ভূমিষ্ঠ করেছিলেন।

        পবিত্র মক্কা থেকে মুসলমানরা মদীনায় হিজরত করার পরে কিছুদিন কারো সন্তান জন্মগ্রহণ করেনি। এ কারণে এ কথা প্রচলিত হয়ে পড়েছিল যে, ইয়াহুদীরা তন্ত্রমন্ত্র করেছে ফলে মুসলমানদের সন্তান জন্মগ্রহণ করে না। পক্ষান্তরে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা:) জন্মগ্রহণ করার সাথে সাথে সকল মুসলমান আনন্দে উচ্চকণ্ঠে 'আল্লাহু আকবার' বলে তাকবীর দিয়ে মদীনার ইয়াহুদীদের কলিজায় কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। নেতৃত্যের বৈশিষ্টসম্পন্ন দু'জন সাহাবীর ইন্তেকালে নবী করীম (সা:) অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলেন। ইয়াহুদীরা এ সময় বলেছিল, 'মুহাম্মদ (সা:) যদি প্রকৃতই নবী হতেন তাহলে তিনি এমন আঘাত পেতেন না'। তাদের এ কথার জবাবে নবী করীম (সা:) বলেছিলেন, 'আমার সাথীদের জন্য আমি আল্লাহর কাছে কোনো অধিকার রাখি না'।

        হিজরী দ্বিতীয় সালে মুসলমানদের জন্য মহান আল্লাহ কেবলা পরিবর্তন করে দিলেন। তারপরই প্রতিরক্ষা সম্পর্কে নির্দেশ দিলেন। এ পর্যন্ত মুসলমানরা নীরবে আঘাত সহ্য করেছে। এবার তাদের প্রতি আত্মরক্ষা এবং প্রতিঘাতের নির্দেশ দেয়া হলো। ইতোপূর্বে মুসলমানরা নামাজ আদায় করতেন বাইতুল মাকদিসকে কেবলা করে। এই বাইতুল মাকদিসকে ইয়াহুদী এবং খৃষ্টানরাও পবিত্র জ্ঞান করে। সে সময়ও বর্তমানের ন্যায় তাঁরা বাইতুল মাকদিসকে তাদের কেবলা মনে করতো। মক্কার ও মদীনার পৌত্তলিকরা কেবলা মনে করতো কা'বা ঘরকে। কিন্তু হযরত ইবরাহীম (আ:) যে জাতির পিতা সে জাতির জন্য আবশ্যক ছিল ভিন্ন একটি কেবলা হওয়া। যে কেবলা মুসলমানদেরকে একত্ববাদের একটি প্রতীক হিসাবে পৃথিবীতে পরিচিতি দিবে।

        * নবী করীম (সা:) মক্কায় অবস্থান করাকালে মাকামে ইবরাহীমকে সামনে রেখে নামাজ আদায় করতেন। মাকামে ইবরাহীম ছিল বাইতুল মাকদিসের দিকে। ফলে কা'বাঘর এবং বাইতুল মাকদিস উভয়টিই তাঁর সম্মুখে থাকতো। মদীনায় আসার পরে দেখা গেল ইয়াহুদীরাও বাইতুল মাকদিসকে কেবলা বানিয়ে তাদের ধর্মীয় কাজ সম্পাদন করছে। পূর্ববর্তী নবীদের প্রবর্তিত বিধানের আংশিক অনুসারী ছিল তারা। আর পৌত্তলিকরা কোনো নবীর আনীত বিধানের কিছুই অনুসরণ করতো না।

        পৌত্তলিক, ইয়াহুদী ও খৃষ্টান। এই তিন গোষ্ঠীর মধ্যে প্রাধান্য লাভ করে ইয়াহুদী খৃষ্টানগণ। কারণ তারা আল্লাহ তা'য়ালার কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস করে। এ অবস্থায় মুসলমানরা তাদের কেবলাকেই অর্থাৎ বাইতুল মাকদিসকেই কেবলা হিসাবে প্রাধান্য দিয়েছিল। পক্ষান্তরে মুসলমানদের জন্য যেমন পৃথক কেবলা নির্ধারণ হওয়া আবশ্যক ছিল এবং এ বিষয়ে নবী করীম (সা:) চিন্তার জগতে আকাংখা পোষণ করতেন। তদানীন্তন যুগে পৌত্তলিকরা স্বয়ং ইয়াহুদীদেরকে তাদের ধর্মীয় কারণে প্রধান্য দিয়ে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখতো।

        পৌত্তলিকদের সন্তান জন্মগ্রহণ না করলে বা সন্তান জীবিত না থাকলে তারা মানত করতো যে, তাদের এ সন্তান জীবিত থাকলে তারা তাকে ইয়াহুদী হিসাবে গড়বে। এরপর মুসলমানরাও বাইতুল মাকদিসের দিকে কেবলা করে নামাজ আদায় করতে থাকলে ইয়াহুদীরা বেশ গর্বানুভব করতো। কারণ পৌত্তলিকরাও তাদেরকে সম্মান করে এবং মুসলমানরাও তাদেরই কেবলাকে কেবলা বানিয়েছে।

        নবী করীম (সা:) দীর্ঘ ১৬ মাস মদীনায় অবস্থানকালে বাইতুল মাকদিসকে কেবলা হিসাবে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এ সময়ের মধ্যে ইসলামও ব্যাপকভাবে চারদিকে বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে এবং সামান্য কিছু বছরের ব্যবধানে মক্কাও মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। নবী করীম (সা:) অনুভব করতেন যে বনী ইসরাঈলের (ইয়াহুদীদের) নেতৃত্বের যুগের অবসান হয়েছে এবং সেই সাথে বাইতুল মাকদিসের কেন্দ্রীয় মর্যাদা লাভেরও অবসান ঘটেছে। এখন প্রকৃত ইবরাহীমী কেন্দ্রের দিকে মুখ ফিরিয়ে নামাজ আদায়ের সময় আসন্ন। এ ব্যাপারে নবী করীম (সা:) হৃদয় গভীরে প্রবল এক আকাংখা অণুক্ষণ গুঞ্জন সৃষ্টি করতো।

        কিন্তু নবী করীম (সা:) কখনো মহান মালিক আল্লাহর দরবারে পবিত্র হাত মুবারক দুটো তুলে ধরে এভাবে বলেননি যে, 'হে আমার মালিক, আপনি বাইতুল মাকদিসের পরিবর্তে বায়তুল্লাহকে আমার জন্যে কিবলা নির্ধারণ করে দিন'। তিনি শুধুই আকাশের দিকে পবিত্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন এ প্রত্যাশায় যে, কখন আল্লাহ তা'য়ালা এ বিষয়ে ওহী অবতীর্ণ করবেন। কিবলা পরিবর্তনের দিন নবী করীম (সা:) এক সাহাবীর বাড়িতে গিয়েছিলেন। সমবেত সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে তিনি যোহরের নামাজ আদায় করছিলেন এবং তিনিই ছিলেন ইমাম। দুই রাকায়াত আদায় করেছেন, এরই মধ্যে ওহী অবতীর্ণ হলো-

قَدْ نَرَى تَقَلُّبَ وَجْهكَ فِي السَّمَاءِ ج فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قَبْلَةٌ تَرْضَاهَا مِ فَوَلٌ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ طَ وَحَيْثُ مَا كُنتُمْ فَوَلَّوْا وُجُوْهَكُمْ شَطْرَهُ طَ

        (কিবলা পরিবর্তনের জন্যে) আপনি আকাশের দিকে তাকিয়ে (যেভাবে আমার আদেশের অপেক্ষায়) থাকতেন, তা আমি অবশ্যই দেখতে পেয়েছি, তাই আমি আপনার পছন্দমতো (দিককেই) কিবলা বানিয়ে দিচ্ছি, (এখন থেকে) তোমরা এই মর্যাদাসম্পন্ন মাসজিদের দিকে ফিরে (নামাজ আদায় করতে) থাকবে; তোমরা যেখানেই থাকো না কেনো তোমাদের মুখমণ্ডল সে দিকেই ফিরিয়ে দিবে। 
(সূরা আল বাকারা-১৪৪)

        মহান আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর প্রিয় হাবীবকে মর্যাদার কোন্ সুউচ্চ সোপানে উপনীত করেছেন যে, তাঁর হৃদয় গভীরে কোনো আকাংখা জেগে উঠলেই মহান আল্লাহ সে পবিত্র আকাংখা পূরণ করেছেন। আল্লাহ তা'য়ালা পরম মমতায় বন্ধুকে জানিয়ে দিলেন, 'আপনি মনে মনে যে আকাংখা পোষণ করছেন এবং আকাশের দিকে বার বার দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন তা আমি দেখছি। আপনার আকাংখা অনুযায়ীই কিবলা পরিবর্তন করে দিলাম'।

        পবিত্র কুরআনের উল্লেখিত আয়াত অবতীর্ণ হবার সাথে সাথেই নবী করীম (সা:) নামাজরত অবস্থায় তৃতীয় রাকায়াতেই বাইতুল মাকদিসের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বাইতুল্লাহ অর্থাৎ কা'বা শরীফের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। নামাজে উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামও আল্লাহর রাসূল (সা:) কে অনুসরণ করে যোহরের অবশিষ্ট দুই রাকায়াত নামাজ আদায় করলেন।

        কিবলা পবির্তন হবার পরে ইয়াহুদীরা প্রচার করতে থাকে যে, 'মুহাম্মদ (সা:) আমাদের সকল কাজে বিরোধিতা করেন। এ কারণেই তিনি কেবলা পরিবর্তন করেছেন। এটা শুধু বিরোধিতার কারণেই বিরোধিতা'।

        এ সময় মদীনায় মুসলমানদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক এমন ছিলো, যারা ছিলো মূলতঃ ইয়াহুদী। তারা মুসলমানের দলে শামিল হয়ে ইসলামের ক্ষতি করতে তৎপর ছিল। এদেরকেই মুনাফিক বা কপট বলা হয়েছে। এদেরকে সে সময় পর্যন্ত চেনার কোনো উপায় ছিলো না। তারা মুসলমানদের সাথে এসে নামাজও আদায় করতো। এই কিবলা পরিবর্তনের কারণে তাদের চেহারা প্রকৃত মুসলমানদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। তারা প্রকাশ্যে ইয়াহূদীদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে কিবলা পরিবর্তনের সমালোচনা করতে থাকলো। প্রকৃত মুসলমানদের জন্য সুবিধা হয়ে গেল, তাঁরা তাদের শত্রুকে চিনতে পারলো।

        নবী করীম (সা:) মদীনায় আসার পরে কোনো বিরোধিতার মুকাবিলা করেননি বা প্রকাশ্যে কেউ বিরোধিতা করেনি। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, মদীনায় ইসলাম বিরোধী শক্তির অস্তিত্ব ছিলো না। মদীনার একটি বিরাট জনগোষ্ঠী ছিলো ইয়াহুদী। পৌত্তলিকদের অস্তিত্ব ছিলো। তারা মুসলমান এবং ইসলামকে কখনোই সুনজরে দেখেনি। কিন্তু তারা প্রকাশ্যে বিরোধিতা তখন পর্যন্ত করেনি। কারা ইসলামের শত্রু তা তখন পর্যন্ত মুসলমানদের কাছে স্পষ্ট হয়নি।

        এরপর আর মাত্র কিছুদিন পরেই সত্য আর মিথ্যার প্রাকাশ্যে সসন্ত্র যুদ্ধের সূচনা ছিলো অনিবার্য। এই সংঘাত মুকাবেলার জন্য আদর্শনিষ্ঠ কর্মী এবং আনুগত্যশীল কর্মীর একান্ত প্রয়োজন ছিল। এ ধরণের কর্মী বর্তমান মুসলমানদের মধ্যে কি পরিমাণ আছে সেটাও নবী করীম (সা:) এর সামনে প্রকাশ হওয়া আবশ্যক ছিলো। ঠিক এ সময়েই মহান আল্লাহ কিবলা পরিবর্তনের আদেশ দিলেন। মদীনায় ইয়াহুদী আর মুনাফিকরা বিতর্ক শুরু করলো। তাদের তৎপরতাই প্রমাণ করে দিলো ইসলামের শত্রু কারা।

        এ অবস্থায় নবী করীম (সা:) তাঁর সাথে আদর্শনিষ্ঠ এবং আনুগত্যশীল কর্মী কতজন আছে, যাদেরকে সাথে নিয়ে তিনি ইসলামের শত্রুদের সাথে মুকাবিলায় অবতীর্ণ হবেন। শত্রুদের অপতৎপরতার জবাব দিতে ময়দানে এগিয়ে যাবেন। সুতরাং কেবলা পরিবর্তন মুসলমানদেরকে পূর্বের তুলনায় আরো বেশি সুসংগঠিত এবং আনুগত্যশীল করেছিল সন্দেহ নেই।

        হিজরী দ্বিতীয় সালেই মুসলমানগণ আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র ধারণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এরপূর্বে মুসলমানগণ শুধু আঘাতই সহ্য করেছেন। এবার তাঁরা প্রতিরোধ করতে শুরু করেছিলেন। কেউ তাদের ওপরে আক্রমণ করতে এলে তাকে প্রতিরোধ করতে হবে, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, অনায়াসে আর জুলুম করতে দেয়া যাবে না, হিজরী দ্বিতীয় সাল থেকেই মুসলমানগণ এই নীতি অবলম্বন করেছিলেন।

        হিজরী দ্বিতীয় সালেই নবী নন্দিনী হযরত ফাতিমা (রা:) এর বিয়ে হযরত আলী (রা:) এর সাথে সুসম্পন্ন হয়। কলিজার টুকরা কন্যার বিয়েতে নবী করীম (সা:) রশি দিয়ে বানানো একটি চারপায়া, দুটি মাটির কলসি, আটা পেষা দু'টো চাকি, চামড়ার একটি তোষক, যা খেজুর পাতা দিয়ে ভর্তি ছিল ও পানির একটি মশক উপহার হিসাবে দিয়েছিলেন।

        বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, দ্বিতীয় হিজরীতেই রমজান মাসের রোজা ফরজ হয়। ফিতরা আদায় করাও এ সময় থেকেও শুরু হয়। নবী করীম (সা:) সাদকায়ে ফিতরের তাৎপর্য এবং কল্যাণ সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করেন। এই বছরে ঈদুল ফিতরের নামাজ সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে ঈদগাহে জামায়াতবন্ধ হয়ে আদায় করা হয়। ইতোপূর্বে কখনো ঈদের নামাজের জামায়াত আদায় হয়নি।

        হিজরী তৃতীয় সালের ১৫ই রমজান নবী করীম (সা:) এর প্রিয় নাতী হযরত ইমাম হাসান (রা:) পৃথিবীতে আগমন করেন। এ বছরে মুসলমানদের প্রতি নির্দেশ জারি করা হয়, তাঁরা যেনো কোনো পৌত্তলিকদেরকে বিয়ে না করে। কারণ ইতোপূর্বে এই নিষেধাজ্ঞা ছিলো না। ইসলামের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত নির্দেশ এই বছরেই জারি করা হয়। ইতোপূর্বে উত্তরাধিকারে নিকট আত্মীয়দের অধিকার ছিলো না।

        হযরত উমার (রা:) এর মেয়ে হযরত হাফসা (রা:) এর স্বামী বদরের যুদ্ধে শাহাদাতবরণ করেছিলেন। এ বছরেই নবী করীম (সা:) তাঁকে বিয়ের মাধ্যমে স্ত্রীর মর্যদা দেন। হযরত উসমান (রা:) এর সাথে এ বছরেই নবী করীম (সা:) এর কন্যা হযরত উম্মে কুলসুম (রা:) এর বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।

        হিজরী চতুর্থ সালে মদ নিষিদ্ধ হওয়া সম্পর্কে ঘোষণা জারি করা হয়। অবশ্য এ সম্পর্কে মতপার্থক্য বিদ্যমান। এ বছরে নবী করীম (সা:) এর কাছে ইয়াহুদীরা ব্যভিচার সম্পর্কে একটি মামলা দায়ের করে। তিনি তাদের তাওরাতের রায় অনুযায়ীই ফায়সালা দিয়ে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করার আদেশ দেন। এ বছরেই তিনি হযরত যায়িদ ইবনে সাবিত (রা:) কে ইবরানী ভাষা শিক্ষার আদেশ দেন। তিনি মাত্র ১৫ দিনে ইবরানী ভাষা শিখেন। এই ভাষা শেখার কারণ ছিল, তাওরাত ছিলো ইবরানী ভাষায়, ইয়াহুদীরা আল্লাহর আইন সম্পর্কে অনেক কিছুই গোপন করতো।

        হিজরী চতুর্থ সালের শাবান মাসে নবী করীম (সা:) এর আরেক নাতী হযরত ইমাম হুসাইন (রা:) পৃথিবীতে আগমন করেন। রাসূল (সা:) এর জীবনে এ বছরে আরেকটি শোকের ঘটনা ঘটে। উম্মুল মুমেনিন হযরত জয়নাব বিনতে খুযাইমা (রা:) এ বছরে ইন্তেকাল করেন। এই বছরে তিনি হযরত উম্মে সালমা (রা:) কে বিয়ে করেন।

        হিজরী পঞ্চম সালে ইসলামের ইতিহাসে নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। পানি কোথাও পাওয়া না গেলে তায়াম্মুমের নির্দেশ এই সালে অবতীর্ণ হয়। যখন ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করে সে সময় কিভাবে নামাজ আদায় করতে হবে, অর্থাৎ খাওফের নামাজ সম্পর্কিত নির্দেশাবলী এই বছরে অবতীর্ণ হয়। সে সময় পর্যন্ত আরবে এক ধরনের তালাক প্রথা চালু ছিলো, যাকে বলা হতো জিহার। এই কুপ্রথা বাতিল বলে ঘোষণা করা হয় এবং এ কারণে কাফফারা আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়।

        পালক পুত্র সংক্রান্ত কুসংস্কার এ বছরেই বাতিল করা হয়। ব্যাভিচারের শাস্তি হিসাবে এ বছরে বলবৎ করা হয়। অপবাদ আরোপ সংক্রান্ত শাস্তি সম্পর্কে আইন- কানুন এ বছরেই জারি করা হয়। মুসলিম নারীদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়, তাঁরা বাইরে বের হবার সময় যেনো পর্দা অবস্থায় বের হয়। অলংকারের প্রদর্শনী না করে। চলাফেরায় মার্জিত রুচির পরিচয় দেয়। কথোপকথনের সময় অশালীন ভঙ্গির আশ্রয় গ্রহণ না করে। নিবী করীম (সা:) এর স্ত্রীদের প্রতি আদেশ দেয়া হয়, তাঁরা যেনো পরপুরুষের সামনে না আসে।

        ষষ্ঠ হিজরীর শেষ ভাগে বা সপ্তম হিজরীর প্রথমে নবী করীম (সা:) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শাসকের কাছে ইসলামের প্রতি আহ্বান সম্বলিত পত্র প্রেরণ করেন। হিজরী অষ্টম সালে উম্মুল মুমেনিন হযরত মারিয়ায়ে কিবতিয়া (রা:) এর গর্ভে হযরত ইবরাহীম (রা:) জন্মগ্রহণ করেন। নবী করীম (সা:) তাঁর এই সন্তানকে খুবই ভালোবাসতেন। হযরত ইবরাহীম (রা:) সতের বা আঠার মাস বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালের দিন সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। কুসংস্কারবাদীরা বলছিল, 'নবীর সন্তান ইন্তেকাল করেছে, এ কারণে আজ সূর্যগ্রহণ হয়েছে এবং শোকে পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে এসেছে'।

        এ কথা শুনে নবী করীম (সা:) উপস্থিত সকলকে বললেন, 'সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণ মহান আল্লাহ তা'য়ালার অগণিত নির্দশনের অন্যতম। কারো জন্ম বা মৃত্যুর সাথে এর সম্পর্ক নেই'।

        এরপর নবী করীম (সা:) কুসুফের নামাজ অর্থাৎ সূর্যগ্রহণের নামাজ মুসলমানদেরকে নিয়ে জামায়াতবদ্ধ হয়ে আদায় করেছিলেন। তাঁর মেয়ে হযরত যয়নাব (রা:) এ বছরেই ইন্তেকাল করেন।

        হিজরী নবম সালেই মুসলমানদের আর্থিক অবস্থা মহান আল্লাহ পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। কারণ, এই সময় জাকাত আদায়ের আদেশ দেয়া হয়েছিল এবং বিভিন্ন গোত্রে জাকাত আদায় করার জন্য কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছিল। এই সালে সুদ হারাম ঘোষণা করা হয়েছিল। হযরত আলী (রা:) হজ্জের ময়দানে যে ঘোষনা দিয়েছিলেন, কুরআন বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, তা অষ্টম হিজরীতেই অবতীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু কার্যকরী করা হয়েছিল নবম হিজরীতে। আল্লামা আত্ তাবারী উল্লেখ করেছেন, এই ঘোষনা জারী করার পরে অমুসলিমরা স্রোতের মতই ইসলামের দিকে এগিয়ে আসছিল।

        এত অধিক প্রতিনিধি দল এই হিজরীতে এসেছিল যে, ইসলামের ইতিহাসে নবম হিজরীকে 'প্রতিনিধি আগমনের বছর' হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এভাবেই যেনো সমগ্র ধরণীতে সত্যের আলোর প্লাবন বয়ে গিয়েছিল। মুসলমানদের বন্ধু আবিসিনিয়ার বাদশাহ এ বছরেই ইন্তেকাল করেছিলেন। তাঁর ইন্তেকালের সংবাদ নবী করীম (সা:) মুসলমানদেরকে এভাবে দিয়েছিলেন, 'হে মুসলমানগণ! আজ তোমাদের ভাই আসমাআ ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর মাগফিরাতের জন্য তোমরা দোয়া করো'। নবী করীম (সা:) তাঁর গায়েবানা জানাযা আদায় করেছিলেন। আবিসিনিয়ার বাদশাহ ছিলেন মুসলমানদের দুর্দিনের বন্ধু। তাঁর নীরব সমর্থনে ইসলাম অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছিল।

Post a Comment

0 Comments