মিরাজের সম্পর্কে উদ্ভুত প্রশ্ন ও তার জবাব

        হাদীসের গ্রন্থসমূহে নবী করীম (সা:) এর মিরাজের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ২৫ বা ২৬ জনের এক বিরাট সংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম মিরাজ সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। এদের মধ্যে হযরত আয়িশা (রাঃ), হযরত আনাস (রাঃ), হযরত আবু জার (রাঃ), হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ), হযরত উমার (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত হুজাইফা (রাঃ), হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ), হযরত মালিক (রা:) সহ সাহাবায়ে কেরাম মিরাজের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। পবিত্র কুরআনে শুধুমাত্র মক্কার বাইতুল্লাহ শরীফ থেকে জেরুজালিমের বাইতুল মাকদাস পর্যন্ত ভ্রমণের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর নবীকে নিদর্শন দেখাবেন।

        পবিত্র কুরআনে এর বেশি কিছু বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি। হাদীসে এই ঘটনার যে বিস্তারিত বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ হচ্ছে, গভীর রজনীতে হযরত জিবরাঈল (আ:) এসে তাঁকে উঠিয়ে বক্ষ বিদীর্ণ করে বুরাকে সওয়ার করিয়ে মক্কা থেকে মাসজিদুল আক্কসায় নিয়ে যান। সেখানে তিনি সকল নবী-রাসূলের সাথে নামাজ আদায় করেন। তারপর তাঁকে উর্ধ্ব জগতে নিয়ে যান। মহাকাশের বিভিন্ন স্তরে তাঁর সাথে সম্মানিত নবী-রাসূলের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে। এরপর আরো উচ্চতায় তাঁকে আরোহণ করানো হয়। সেখান থেকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ নিদের্শ গ্রহণ করেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এ সময় ফরজ করা হয়। এরপর তিনি পুনরায় বাইতুল মাকদাসে এসে পরে মক্কায় কা'বাঘরে আসেন।

        বিভিন্ন হাদীস শরীফ থেকে জানা যায়, উর্ধ্ব জগতে তাঁকে জান্নাত ও জাহান্নাম প্রদর্শন করানো হয়। তিনি জাহান্নামে অপরাধীদের নানা ধরনের শাস্তি ভোগ করতে দেখেন। পুরস্কার প্রাপ্তদের জান্নাতে বিভিন্নভাবে ভোগ বিলাসে মগ্ন দেখেন। হাদীস শরীফ থেকে এ কথাও জানা যায় যে, নবী করীম (সা:) মিরাজের ঘটনা বর্ণনা করার পরে ইসলাম বিরোধীগণ তাঁকে বিদ্রুপ করতে থাকে এবং কিছু সংখ্যক দুর্বল মুসলমানের বিশ্বাসের ভিত্তি কেঁপে ওঠে। হাদীসের এই যে বিস্তারিত বর্ণনা, তা পবিত্র কুরআনের বিপরীত নয় বরং কুরআনের বর্ণনার সম্প্রসারিত রূপ হাদীস শরীফের বিস্তারিত বর্ণনা। সুতরাং হাদীসের বর্ণনা অবিশ্বাস করে তা এড়িয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই।

        আমরা ইতোপূর্বেই আলোচনা করেছি, এ বিষয়টি ধ্যান যোগে বা স্বপ্ন যোগে ঘটেনি। সম্পূর্ণ জাগ্রত অবস্থায় শারীরিকভাবে মিরাজের ঘটনা ঘটেছে। পবিত্র কুরআনের 'সুবহান' শব্দের মধ্যেই এ কথা স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে যদি মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর একস্থান থেকে আরেক স্থানে সংবাদ প্রেরণ করা যায়, হাজার হাজার মাইল ব্যবধানে থেকে অবিকল কন্ঠে পরস্পরে কথা বলা যায়, মুহূর্তের মধ্যে একস্থান থেকে আরেক স্থানে গমন করা যায়, তাহলে হাদীসের বর্ণনাকে কিভাবে অস্বীকার করা যায়? একটি বিষয় সামনে রেখে নবীদের জীবনের অলৌকিক ঘটনাসমূহ আলোচনা করতে হবে।

          সম্ভব এবং অসম্ভব, এই দু'টো বিষয় সামনে রাখতে হবে। সম্ভব এবং অসম্ভব- এই শব্দ দু'টো কার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা প্রথমে বিবেচনায় আনতে হবে। সৃষ্টির ক্ষেত্রে এ দু'টো শব্দ প্রয়োগ করা যায়। কিন্তু স্রষ্টার ক্ষেত্রে কি এ শব্দ দু'টো প্রযোজ্য? মানুষ যদি স্রষ্টার ক্ষেত্রেও সম্ভব অসম্ভবের প্রশ্ন উঠায় তাহলে বলতে হয়, সে ব্যক্তি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী, শক্তিধর, অসীম ক্ষমতাবান বলে বিশ্বাস করে না। হযরত আবু বকর (রা:) এবং অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম যেমন বিশ্বাস করতেন, আরশে আজীম থেকে নবী করীম (সা:) এর কাছে ওহীর আগমন যদি অসম্ভব না হয়, তাহলে মিরাজ কি করে অসম্ভব হতে পারে?

        এক শ্রেণীর মানুষ প্রশ্ন তোলে হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনা সম্পর্কে। তাদের প্রথম প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহর কুদরত সর্বত্র বিরাজমান। তাঁর কুদরত সসীম নয় অসীম এবং কোথাও সীমাবদ্ধ নয়, নির্দিষ্ট কোনো স্থানে তাঁর ক্ষমতা অবস্থান করে না। কিন্তু বিশ্বনবী (সা:) কে আরশে আজীমে ডেকে নিয়ে তাঁর সাথে আল্লাহ কথোপকথন করলেন, এ থেকে তো এ কথাই প্রতীয়মান হয় আল্লাহ নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করছেন। নতুবা নবী করীম (সা:) কে আরশে আজীমে ডেকে নেয়া হলো কেনো? তিনি তো যে কোনো স্থান থেকেই নবীর সাথে কথা বলতে পারতেন? দ্বিতীয় যে প্রশ্ন করা হয়, বিশ্বনবী (সা:) কে জাহান্নামের শাস্তি প্রদর্শন করা হলো। বিভিন্ন অপরাধে মানুষ শাস্তি ভোগ করছে তা তিনি দেখে বর্ণনাও করেছেন। সৎ কাজের পুরস্কার হিসাবে জান্নাতে কে কিভাবে ভোগ বিলাসে মগ্ন আছে তা তিনি দেখে বর্ণনাও করেছেন। এখন পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হলো না, মানুষের বিচার হলো না, তাঁর পূর্বেই মানুষকে কিভাবে জান্নাতে পুরস্কার দেয়া হলো এবং কিভাবেই বা জাহান্নামে শাস্তি দেয়া হলো?

        এমন প্রশ্নকারীদের চিন্তার দৈন্যতার কারণেই তাঁরা এ ধরনের প্রশ্ন করে। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রথম প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, মহান আল্লাহর ক্ষমতা নিঃসন্দেহে অসীম। পক্ষান্তরে সৃষ্টির সাথে আচরণ করার সময় তিনি স্বীয় কোনো অক্ষমতা বা দুর্বলতার কারণে নয়, বরং সৃষ্টির দুর্বলতা বা অক্ষমতার কারণে সৃষ্টিকে বিশেষ স্থানে নিতে হয় এবং এটি সেই সৃষ্টির সর্বোচ্চ মর্যাদারই প্রমাণ বহন করে। মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির সাথে যখন কথা বলেছেন, সৃষ্টির অক্ষমতার কারণে বিশেষ সীমাবদ্ধ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়েছে, যেন তাঁর সৃষ্টি তাঁর সকল কথা শুনতে এবং বুঝতে পারে।

        আল্লাহ তা'য়ালা সৃষ্টি জগতের অনু-পরমাণু বা তার থেকেও ক্ষুদ্র যদি কিছু থেকে থাকে সকল কিছুই দেখার ক্ষমতার অধিকারী। এই দেখার জন্য তাঁকে সময় ক্ষেপণ বা পৃথকভাবে দেখার প্রয়োজন হয় না। সকল সৃষ্টি তিনি তাঁর ক্ষমতা দিয়ে একবারেই দেখতে পান। কিন্তু মানুষ এর বিপরীত। মানুষকে কোনো কিছু দেখার জন্য সে স্থানে যেতে হয় বা দূরের কিছু দেখার জন্য কোনো কিছুর সাহায্য গ্রহণ করতে হয়। মানুষ একবারে এক দৃষ্টে একশতটি জিনিস দেখতে পারে না। তাকে পৃথকভাবে দেখতে হয়। মানুষের এই অক্ষমতার জন্যই তাঁকে মহান আল্লাহর দরবারে নির্দিষ্ট স্থানে যেতে হয়েছিল। মহান আল্লাহ কিছু দেখার জন্য কোনো স্থানের মুখাপেক্ষী নন। কিন্তু মানুষ স্থানের মুখাপেক্ষী। সীমাবদ্ধ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের জন্য অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন সত্তার সাথে দেখা করা সম্ভব নয়। মানুষের এই দূর্বলতার কারণেই মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাহকে নির্দিষ্ট স্থানে আহ্বান করে বান্দাহর সাথে কথা বলেছিলেন।

        মাটিতে দাঁড়ানো তিন বছর বয়স্ক শিশুর কপালে স্নেহভরে চুমো দিতে হলে একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষকে অবশ্যই নিচু হয়ে সে শিশুর কপালের কাছে তাঁর মুখ নিয়ে যেতে হবে। নতুবা শিশুর কপালের নাগাল পাওয়া যাবে না। বয়স্ক লোককে নিচু হয়ে শিশুর কপালের কাছে মুখ নিতে হলো, এ পদ্ধতি তাঁর দূর্বলতার কারণে গ্রহণ করতে হলো না, শিশুর দূর্বলতার কারণেই বয়স্ক লোকটিকে বসে বা কুজো হয়ে শিশুর কপালের কাছে নিজের মুখ নিতে হলো। শিশুর প্রতি স্নেহের বশে বয়স্ক ক্ষমতাবান মানুষকে তাঁর ক্ষমতার পরিধি সংকুচিত করে শিশুর কপালের কাছে নিজের মুখ নিতে হলো শিশুর অক্ষমতার কারণে, নিজের অক্ষমতার কারণে নয়।

        এবার দ্বিতীয় যে বিষয়টি পুরস্কার এবং শাস্তির বিষয়। এসব বিষয়ে নবী করীম (সা:) কে যা দেখানো হয়েছিল তা প্রকৃত বিষয়ের প্রতীকী রূপমাত্র। এখানে আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর অসীম ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাঁরই সৃষ্টি মানুষের কর্মের পরিণতি কি হবে তার প্রতীকী রূপ দেখিয়েছিলেন। জান্নাতে কিভাবে মানুষ আল্লাহ তা'য়ালার নেয়ামত ভোগ করবে এর প্রতীকী রূপ এবং জাহান্নামেও বাস্তব অবস্থার প্রতীকী রূপ তাঁকে দেখানো হয়েছিল। সুতরাং এ সকল বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অবকাশ নেই। আবারও ঐ পুরোনো কথারই পুনরাবৃত্তি করতে হচ্ছে, স্রষ্টার ক্ষমতা অসীম। তাঁর কাছে অসম্ভব বলে কিছুই নেই। অম্ভব শব্দটি মানুষের জন্য প্রযোজ্য, স্রষ্টার জন্য নয়।

Post a Comment

0 Comments