আজ প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের উন্নতি দেখে মানুষ ইসলামী জীবন ব্যবস্থা এ যুগের জন্য অনুপযুক্ত বলে ভাবছে। তাই কোরআনের বৈজ্ঞানিক আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে বিজ্ঞানের সুত্রও দিয়েছেন, তাই কোরআনে বিজ্ঞানের নাম শুনে এ কথা যেন মনে না করে যে, মহান আল্লাহ বুঝি বিজ্ঞানের গ্রন্থ হিসাবেই কোরআন অবতীর্ণ করেছেন। কোরআন কোন বিজ্ঞানের গ্রন্থ নয়। যে মানুষ সর্বাঙ্গীন জীবন ব্যবস্থা অনুসরণ-অনুকরণ করে চলবে, সে ব্যক্তি এ পৃথিবীতেই শান্তির রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে এবং আখিরাতে পাবে অফুরন্ত নিয়ামত ও শান্তির জান্নাত। সে জীবন ব্যবস্থার হেদায়েত গ্রন্থই হলো পবিত্র কোরআন আমাদের বোঝার জন্যই কোরআনে বস্তুজগৎ তথা বিজ্ঞানের বহু বিষয় আলোচিত হয়েছে। এখানেই কোরআনের সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক। কোরআন প্রচলিত কোন ধর্মগ্রন্থ বা কোন বিষয়ের গবেষণামূলক গ্রন্থের ন্যায় মানব রচিত পুস্তক নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবিকল যেরূপ শিক্ষা দিয়েছেন আজও তাই আছে। পৃথিবীতে কোরআনই একমাত্র ধর্মীয় মূল গ্রন্থ যা আজও অবিকৃত, যার কোন বিকল্প অনুলিপিও নেই। যারা এটাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا سَوَاءٌ عَلَيْهِمْ أَنْذَرْتَهُمْ أَمْ لَمْ تُنْذِرْهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ
নিশ্চয়ই যারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে তাদেরকে তুমি সতর্ক করো আর না-ই করো তাদের পক্ষে উভয়ই সমান, তারা কখনই ঈমান আনবে না। (বাক্বারা: ৬)
কাফের ঐ লোকদেরকেই বলা হয় যারা আল্লাহর কোরআনকে বা কোরআনের আহবানকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। তাই মহান আল্লাহ আবু জেহেল, আবু লাহাব প্রমুখ কাফেরদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলে দিয়েছেন তারা ঈমান আনবে না; বরং তারা কাফের হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে যদি স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই ঘোষণা করেন যে, তারা আর ঈমান আনবে না, তবে তাদের দোষ কোথায়?
এ যুক্তি ঠিক নয়, কারণ আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে কাফের করেননি; বরং তারা হেদায়েতের দাওয়াত এবং প্রয়োজনীয় যুক্তি-প্রমাণ পেয়েও তা প্রত্যাখ্যান করে কাফের হয়ে গেছে। গায়েবের মালিক মহান আল্লাহ জানেন যে তারা কোনদিন ঈমান আনবে না। আবু জেহেল ও আবু লাহাব যে শেষ পর্যন্ত ঈমান আনেনি এটাও কোরআনের মুজিযা। জেনে রাখা দরকার যে, সকল কাফেরই মুসলিম তথা ইসলামের প্রকাশ্য দুশমন। তাই এদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
خَتَمَ اللَّهُ عَلَى قُلُوْبِهِمْ وَعَلَى سَمْعِهِمْ ، وَعَلَى أَبْصَارِهِمْ غِشَاوَةٌ : وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ
আল্লাহ তায়ালা তাদের অন্তরে ও কানে মোহরাংকিত করে দিয়েছেন এবং তাদের চোখের উপর আবরণ পড়েছে এবং তাদের জন্য কঠিন শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে।
আল কোরআনে পৃথিবীর বর্ণনা
মানুষ সৃষ্টির ইচ্ছায় আল্লাহ তায়ালা এই সুজলা-সুফলা নয়নাভিরাম পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং একে সম্প্রসারিত করেছেন। পৃথিবী সৃষ্টির আদি ইতিহাস মানুষ জানে না। তবে আদি অবস্থায় এ পৃথিবী যে মানুষ ও জীবজন্তুর বসবাসের উপযোগী ছিল না তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হাদীস হতে এ তথ্য সম্পর্কে কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পৃথিবী সৃষ্টি সম্পর্কে বলেন-
إِنَّ رَبَّكُمُ اللهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ
নিশ্চয়ই তোমাদের পালনকর্তা আল্লাহ যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেন। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন। (সূরা আ'রাফ: ৫৪)
যখন আল্লাহ তায়ালা এ পৃথিবী সৃষ্টি করলেন তখন তাতে ভীষণভাবে কম্পন উপস্থিত হলো, সূচনাতে পৃথিবীতে কোনো প্রাণীর অবস্থানের উপযুক্ত ছিল না। সুতরাং আল্লাহ তায়ালা পাহাড়-পর্বতসমূহকে সৃষ্টি করে যমীনের উপর বসিয়ে দিলেন। আর অমনি থেমে গেল, শান্ত হয়ে স্বস্থানে স্থিতিশীল হয়ে গেল। বিচিত্র এ পৃথিবী অপরূপ তার সৌন্দর্য সমাহার। সাগর মহাসাগর, পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, বৃক্ষ-লতা ও নানা আকৃতির এবং নানা ধরনের জীব-জন্তুতে পরিপূর্ণ এ পৃথিবী। কিন্তু বিস্তৃত মরুভূমি, গহীন অরণ্য, সুউচ্চ বরফ আচ্ছাদিত শুভ্র পর্বতচূড়া, সীমাহীন অথৈ জলরাশি, নানা স্বভাবের জীবজন্তু, নানা ধরনের কণ্ঠস্বর ও আকৃতির পাখি, অর্থাৎ মহান শিল্পীর তুলিতে আঁকা বিচিত্রময় এ পৃথিবী মানুষের সমস্ত কল্পনাকে হার মানায়, শিল্পির শিল্পকর্ম স্তব্ধ হয়ে যায়। এ বিচিত্র পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী, গাছ-পালা, পত্র-পল্লব, ফল-মূল, বিশাল সাগর-মহাসাগর, সুউচ্চ পর্বতমালা, উজ্জ্বল তারকা খচিত আকাশ, জ্যোৎস্না রাতের মায়াবিনী রূপ, সমস্তই যেন আল্লাহ তায়ালাকে চেনার, জানার ও বুঝার জন্য মানব সম্প্রদায়কে প্রতিনিয়ত হাতছানি দিচ্ছে।
হে মহান স্রষ্টা আল্লাহ! তুমি কত বড় বৈজ্ঞানিক, কত বড় কৌশলময় সৃষ্টিকর্তা, কত বড় শিল্পী, কতবড় শক্তির নিয়ন্তা। বৈচিত্র্যপূর্ণ, রহস্যপূর্ণ, মাহাত্ম্যপূর্ণ ও ঐশ্বর্যমণ্ডিত তোমার এ মহান সৃষ্টি। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন-
الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ فِرَاشَاء السَّمَاءَ بِنَاءً وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَّكُمْ : فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ (بَقَرَة)
যে পবিত্র সত্তা তোমাদের জন্য ভূমিকে বিছানা এবং আকাশকে ছাদ স্বরূপ স্থাপন করে দিয়েছেন, আর আকাশ হতে পানি বর্ষণ করে তোমাদের জন্য ফল-ফসল উৎপাদন করেছেন তোমাদের খাদ্য হিসেবে। অতএব, আল্লাহ তায়ালার সাথে তোমরা অন্য কাউকেও সমকক্ষ করো না। বস্তুতঃ এসব তোমরা জান।
পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, পৃথিবীটা অন্যান্য গ্রহের মত নয়। বিজ্ঞানীদের মতে সৃষ্টিজগতের গ্রহ, নক্ষত্রগুলোর জন্ম প্রাথমিক পর্যায়ে যদিও একইভাবে সৃষ্টি হয়েছে; কিন্তু কালক্রমে প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য আলাদা-আলাদা হয়। পৃথিবীর উত্তপ্ত পরিবেশ ধীরে ধীরে শীতল হয় এবং উষ্ণতা স্বাভাবিক হয় আর ভূ-পৃষ্ঠে নানা প্রকারের পরমাণু দ্বারা বিভিন্ন যৌগিক পদার্থ গঠিত হয়। বিজ্ঞানীরা মনে করে থাকেন, ধীরে ধীরে বিভিন্ন পরিবর্তন বা বিবর্তনের ফলে ভূ-পৃষ্ঠ হতে বায়ু মণ্ডলের বিভিন্ন গ্যাস এবং পানির বাষ্প তৈরী হয়ে বায়ুমণ্ডল গঠিত হয়। অতঃপর উক্ত বাষ্প হতে মেঘ ও বৃষ্টি হয় এবং ভূ-পৃষ্ঠে পানির উদ্ভব হয়।
বিজ্ঞানীদের মতে, ভূ-পৃষ্ঠে জীবের উৎপত্তি ও বিকাশের জন্য সঠিক অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পর কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন ইত্যাদি পরমাণু মিলে যৌগিক অণু গঠিত হয় এবং তা হতেই কালক্রমে সাগরে বা পানিতে জীবের আবির্ভাব ঘটে। পবিত্র কালামে আল্লাহ তায়ালা এ পৃথিবীকে সকল প্রকার জীবের তথা মানুষের জন্য উপযোগী করে সৃষ্টি করার কথা বলেছেন-
أمَّنْ جَعَلَ الْأَرْضِ قَرَارًا
তিনি যমীনকে স্থিতি ও বসবাসের উপযোগী জায়গা বানিয়েছেন। (নামল: ৬১)
মানুষ ও জীবজন্তুর বসবাসের জন্য পৃথিবীর উপর বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে সূরা ত্ব-হার ৫৪ নং আয়াতে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-
الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ مَهْدًا وَسَلَكَ لَكُمْ فِيهَا سُبُلًا وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِّنْ نَّبَاتِ شَتَّى (طه)
0 Comments