নামায মুসলমানদের মধ্যে একতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করার বাস্তব প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এ কথা অনস্বীকার্য যে ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ শক্তিশালী না হলে পৃথিবীতে কোনো জাতি সুখী-সমৃদ্ধশালী ও উন্নতির শিখরে পৌছতে পারে না এবং নিজেদের স্বকীয়তা নিয়ে পৃথিবীতে প্রাধান্য বিস্তারও করতে পারে না। ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের অভাবে পৃথিবীর বহু শক্তিশালী জাতি পরাধীনতার অভিশাপে গোলামীর জীবন বরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী, মুসলমানদের মধ্যে যখন ঐক্য, সংহতি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত ছিলো, তখন সারা দুনিয়ার নেতৃত্বের আসন ছিলো তাদের পদতলে।
পৃথিবীতে এমন কোনো জাতির অস্তিত্ব ছিলো না যে, তারা মুসলমানদের দিকে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে বা তাদের প্রতি নির্দেশের স্বরে কথা বলে। কিন্তু সেই মুসলমানই বর্তমানে রয়েছে বরং অতীতের তুলনায় বর্তমানে তাদের সংখ্যা সর্বাধিক। তবুও তারা গোলামী, লাঞ্ছনা আর অবমাননাকর জীবন-যাপনে বাধ্য হচ্ছে। সারা দুনিয়ার অন্যান্য জাতির কাছে কুকুরের মতো প্রাণীর যে মূল্য রয়েছে, মুসলমানদের সেই মূল্য নেই। পাশ্চাত্য দুনিয়া স্বদম্ভে ঘোষণা করছে, পাশ্চাত্যের জাতিসমূহের জন্য যে মানবাধিকার প্রযোজ্য, তা মুসলমানদের জন্য প্রযোজ্য নয়।
ঐক্য, সংহতি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের অভাব কতটা নির্মম পরিণতি ডেকে আনতে পারে, তার বাস্তব প্রমাণ হলো বর্তমানের মুসলিম দুনিয়া। সারা দুনিয়া ব্যাপী তারা নির্যাতিত হচ্ছে, তাদেরকে বন্য প্রাণীর মতো নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে, মুসলিম নারী ধর্ষিতা হচ্ছে, তাদের সহায়-সম্পদ ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে, একটির পর একটি মুসলিম দেশ অমুসলিম শক্তি দখল করে নিচ্ছে, মসজিদসমূহ অস্ত্রের আঘাতে ধূলিস্মাৎ করে দেয়া হচ্ছে, পবিত্র কোরআন জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, অসহায় মুসলিম নারী, শিশু, তরুণ-যুবক ও বৃদ্ধদের ধরে কারাবদ্ধ করে কারাগারে অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হচ্ছে, কিন্তু প্রায় দেড় শত কোটি মুসলমান নীরবে দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ সামান্য মৌখিক প্রতিবাদও করছে না।
এর একমাত্র কারণ হলো, তাদের মধ্যে একতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ নেই। ঐক্য ও সংহতি মুসলমানদের মধ্যে থেকে বিদায় নিয়েছে। নামাযের অন্যতম শিক্ষা হলো ঐক্য, সংহতি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে যারা নামায আদায় করেন, তারা নামায কে এই শিক্ষা গ্রহণ করেন না।
মুসলিম উম্মাহ্ পৃথিবীতে নেতৃত্ব দিবে, এ জন্য নামাযের মাধ্যমে তাদেরকে ঐক্য, সংহতি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ শিক্ষা দেয়ার যে ব্যবস্থা মহান আল্লাহ তা'য়ালা করেছেন, মুসলিম উম্মাহ্ নামায থেকে সে শিক্ষা গ্রহণ করছে না। এই নামাযই মুসলমানদেরকে একমুখি হওয়ার শিক্ষা দিয়ে থাকে। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে যেখানে যে অবস্থায় মুসলমান বাস করুক না কেনো, তাদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তারা যেন নিজেদের চেহারা মক্কায় অবস্থিত বায়তুল্লাহ্ তথা কা'বাঘরের প্রতি স্থির করে নামায আদায় করে। মহাসাগরের মাঝখানে জলযানে অথবা মহাশূন্যে যন্ত্রযানে কোনো মুসলমান একাকী অবস্থায় যখন অবস্থান করবে, তখন নামাযের সময় উপস্থিত হলে, তাকে অবশ্যই নিজের চেহারা বায়তুল্লাহর প্রতি স্থির করে নামায আদায় করতে হবে। মুসলমান যেখানে অবস্থান করছে, সেখান থেকে বায়তুল্লাহ্ কোন্ দিকে তা নির্ণয়ে যদি সে ব্যর্থ হয়, তাহলে বায়তুল্লাহর অবস্থান মন যে দিকে সাক্ষ্য দিবে সেদিকেই চেহারা স্থির করে নামায আদায় করতে হবে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قِبْلَةً تَرْضِهَا فَوَلَ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الحرام
মসজিদুল হারামের দিকে মুখ ফিরাও। তুমি যেখানেই থাকো না কেনো, এর দিকেই মুখ করে তুমি নামায আদায় করতে থাকবে। (সূরা বাকারা-১৪৪)
মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস্ সালাম যখন বায়তুল্লাহ শরীফ পুনঃনির্মাণ করলেন, তখন মক্কা নগরী সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা'য়ালার কাছে। বিশেষ দোয়া করেছিলেন। আল্লাহ তা'য়ালা এ সম্পর্কে সূরা বাকারার ১২৫ আয়াতে বলেছেন-
وَإِذْ جَعَلْنَا الْبَيْتَ مَثَابَةً لِلنَّاسِ وَأَمْنًا وَاتَّخِذُوا مِنْ مقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلَّى
আর এ কথাও স্মরণ করো, আমি এই কা'বাঘরকে মানুষের জন্যে কেন্দ্র, শান্তি ও নিরাপত্তার স্থান হিসেবে নির্দিষ্ট করেছিলাম এবং লোকদের এই নির্দেশ দিয়েছিলাম যে, ইবরাহীম যেখানে নামাযের জন্য দাঁড়ায়, সেই স্থানকে স্থায়ীভাবে নামাযের স্থান হিসেবে গ্রহণ করো।
মুসলমানদের নানা ধরনের পথ, মত ও নানা কেন্দ্রের অনুসারী হওয়ার সুযোগ নেই। মুসলমানদের একমাত্র কেন্দ্র হলো কা'বাঘর এবং এই ঘরকে কেন্দ্র করেই মুসলিম মিল্লাত নিজেদেরকে ঐক্যবদ্ধ করবে। নামায যেমন একমাত্র কা'বাঘরের দিকে মুখ করে আদায় করতে হবে, তেমনি সারা দুনিয়ার মুসলমান নিজেদেরকে একদেহের ন্যায় মনে করবে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন-তোমরা মুমিনদেরকে পারস্পরিক সহৃদয়তা, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা এবং পারস্পরিক দুঃখ-কষ্টের অনুভূতিতে এমনই দেখতে পাবে, যেমন একটি দেহ। যদি তার একটি অঙ্গ রোগাক্রান্ত হয় তো তার সাথে গোটা দেহ জ্বর ও রাত্রি জাগরণের মাধ্যমে তাতে অংশ গ্রহণ করে থাকে। (বোখারী, মুসলিম)
আরেক বর্ণনায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সমাজে একজন মুমিনের অবস্থান হচ্ছে গোটা দেহে মস্তকের সমতুল্য। মাথায় ব্যথা হলে যেমন গোটা দেহ কষ্টানুভব করে, তেমনি একজন মুমিনের কষ্টে সমস্ত মুমিনই কষ্টানুভব করতে থাকে।
সাম্য, মৈত্রী, একতা ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী বাহক নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন-এক মুসলমান অপর মুসলমানের জন্যে ইমারতের মতো হওয়া উচিত এবং তাদের একে অপরের জন্যে এমনই দৃঢ়তা ও শক্তির উৎস হওয়া উচিত, যেমন ইমারতের একটি ইট অপর ইটের জন্যে হয়ে থাকে। এরপর তিনি হাতের আঙ্গুলিসমূহ অন্য হাতের অঙ্গুলির মধ্যে স্থাপন করলেন। (বোখারী-মুসলিম)
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম মিল্লাতকে একটি ইমারতের অনুরূপ হতে বলেছেন। সারা পৃথিবীর মুসলিম জনগোষ্ঠীকে একটি ইমারতে পরিণত করার লক্ষ্যে নামায তাদেরকে কা'বা কেন্দ্রিক করে দেয়। সমস্ত মুসলমান যেমন কা'বাঘরের দিকে নিজের চেহারা স্থির করে নামায আদায় করবে, তেমিন তারা যে কোনো সমস্যার মোকাবেলায় একতাবদ্ধ হয়ে সমস্যার সমাধান করবে। যে আল্লাহ তা'য়ালার নির্দেশে তারা কা'বাঘরের দিকে নিজের চেহারা স্থির করছে, সেই আল্লাহর বিধান অনুসারেই তারা সামগ্রিকভাবে নিজেদের জীবন পরিচালিত করবে। প্রত্যেক দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে গিয়ে আদায় করার আদেশ দেয়া হয়েছে।
এভাবে একটি এলাকার লোকজন যখন পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাআতে আদায় করার জন্য মসজিদে আসে, তখন এলাকার অন্যান্য লোকদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও পারস্পরিক কুশল বিনিময়ের সুযোগ হয়। এলাকার একজনকে মসজিদে অনুপস্থিত দেখলে তার অনুপস্থিতির কারণ জানার জন্য স্বাভাবিক উৎসুক্য অন্যের মনে সৃষ্টি হয়।
জামাআতে দাঁড়ানোর ব্যাপারে ধনী-গরীব, সাদা-কালো বা শিক্ষিত-অশিক্ষিতের মধ্যে পার্থক্য করার অবকাশ নেই। যিনি মসজিদে প্রথমে আসবেন, তিনিই সামনের কাতারে বসার সুযোগ পাবেন।
দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন লোকটির বাড়ির বাগানের মালী কম মূল্যের পোষাক পরিধান করে প্রথমে মসজিদে এসে সামনের কাতারে বসেছে। এরপর তার মনিব বহু মূল্যবান পোষাক পরিধান করে মসজিদে এসে তারই বেতনভুক্ত মালীকে একথা বলতে পারবে না যে, তুমি আমার বেতনভুক্ত চাকর, আমি তোমার মনিব। আমার সামনে বসার অধিকার তোমার নেই।
যে মনিবকে দেখলে তার চাকর তটস্থ হয়ে পড়ে, বার বার সালাম জানায়, মনিবের সামনে যেন কোনো ধরনের বেয়াদবি না হয় সে ব্যাপারে সজাগ থাকে, মনিবের দেহের সাথে যেন নিজের দেহের স্পর্শ না ঘটে এ জন্য শঙ্কিত থাকে।
কোনো কারণে যদি মনিবের পায়ের সাথে নিজের পায়ের স্পর্শ তার অজান্তেই ঘটে যায়, তাহলে চাকরী যাবার ভয়ে চেহারা রক্তশূন্য হয়ে যায়। সেই চাকরই যখন. মনিবের আগে মসজিদে এসে সামনের কাতারে বসে যায়, পরে মনিব এসে ঐ চাকরের পেছনে বসে।
এরপর নামাযে সিজদা দেয়ার সময় চাকরের পা যদি মনিবের মাথায় লেগে যায়, মনিবের এ কথা বলার সাহস নেই যে, নামাযে সিজদা দেয়ার সময় তোমার পা আমার মাথায় লেগেছে। এ জন্য তোমাকে এই শাস্তি গ্রহণ করতে হবে এবং আজ থেকে তোমাকে চাকরিচ্যুত করা হলো।
একমাত্র নামাযই মানুষের মধ্যে থেকে উঁচু-নীচু, ধনী-গরীব, সাদা-কালো, শিক্ষিত-অশিক্ষিত তথা যাবতীয় ভেদাভেদ মুছে দিয়ে সাম্যের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। নামায মানুষে মানুষে কোনো ধরনের ভেদাভেদ রাখে না। ডক্টর আল্লামা ইকবাল (রাহঃ) কত সুন্দর কথাই না বলেছেন-
একহি স্যফ মে খাড়ে হো গ্যায়ে মাহমুদ ও আয়ায
না কোই বান্দা রাহা না কোই বান্দা নাওয়ায।
সম্রাট মাহমুদ আর তাঁর ভৃত্য একই সাথে কাতারে দাঁড়িয়ে গিয়েছে, কে সম্রাট আর কে ভৃত্য কোনো ভেদাভেদ থাকেনি।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে নামাযের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়েই এমন এক অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত করেছিলেন যে, সারা দুনিয়া তাঁদের সামনে মাথানত করতে বাধ্য হয়েছিলো। নামায থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে তাঁরা নিজেদের মধ্যে যে সাম্য আর ঐক্য সৃষ্টি করেছিলো, এই সাম্য আর ঐক্যের কারণেই ইসলামী আদর্শ সারা দুনিয়ার আনাচে-কানাচে তওহীদের আলো প্রজ্জ্বলিত করেছিলো।
পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক Philip K. Hitty তাঁর History of the Arabs নামক গ্রন্থে নামায প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, As a disciplinary measure this congrational prayer must have had great value for the proud indivisualistic sons of the desert. It developed in them the sense of social equality and the consciousness of solidarity. It promoted that brotherhood of community of believers which the religion of Mohammad had theoretically Substituted for blood. relationship. The prayer ground thus became the first drill ground of Islam.
অর্থাৎ শৃঙ্খলা অনুশীলনের একটি ব্যবস্থা হিসেবে মরুভূমির উদ্যত ও আত্মকেন্দ্রিক সন্তানদের ক্ষেত্রে জামাআতের নামায অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নামায তাদের মধ্যে সামাজিক সাম্য এবং উদ্দেশ্যের প্রতি দৃঢ়তা ও একনিষ্ঠতার চেতনার সৃষ্টি করেছে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ তাত্ত্বিকভাবে রক্ত সম্পর্কের স্থলে অভিন্ন জীবন ব্যবস্থায় বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিস্থাপন করেছিলো এই নামায তাকে উৎসাহিত করেছে। নামাযের ময়দান এভাবে ইসলামের প্রথম কুচকাওয়াজের ময়দানে পরিণত হয়েছে।
J. H. Dennisson কর্তৃক রচিত Emotion as the Basis of Civilization নামক গ্রন্থটি বিশ্ব সভ্যতার ক্রমবিকাশ এবং তার উপসর্গ বিশ্লেষণে সহায়ক একটি অমূল্য প্রামাণ্য গ্রন্থ। এই গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন, Mohammad had created a religion which had none of the features of the ancient cults, no priesthood, and no ceremonial, which was based on no form, but upon a spiritual relationship to, an unseen God. It was not designed to give prestige to a special group but to creat a universal brotherhood composed of all men of every race who would accept this God and promise loyalty to his prophet.
The vast difficulty of creating any sense of unity of solidarity in such a group is apparent. All historians declare that the amazing success of Islam in dominating the world lay in the estounding coherence or sense of unity in the group. But they do not explain how this miracle was worked. There can be little doubt that one of the most effective means was prayer. The five daily prayers when all the faithful, wherever they were, alone in the grim solitude of the desert or in vast assemblies in crowded city knelt or prostated themvelves towards Mecca, uttering the same words of adoration for the one true God and of loyalty to His prophet, produce an overwhelming effect even upon the spectators, and the psychological effect of thus fusing the minds of the worshippers in a common adoration and expression of loyalty is certainly stupendous. Mohammad was the first one to see the tremendous power power of public prayer as a unification culture and there can be little doubt that the power of Islam is due to a large measure to the obedience of the faithful to this inviolable rule of the five prayers.
অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন যার সাথে প্রাচীন ধর্ম পদ্ধতিসমূহের কোনোটিরই সাদৃশ্য ছিলো না। এতে কোনো পুরোহিততন্ত্র নেই, নেই কোনো আনুষ্ঠানিকতা। মূর্তিহীন নিরাকার অদৃশ্য এক স্রষ্টার সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক হচ্ছে এই ধর্মের ভিত্তি। একটি বিশেষ শ্রেণীকে প্রতিপত্তি প্রদানের কোনো অভিসন্ধি এর নেই, বরং বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষ যারা এই স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং তাঁর প্রেরিত রাসূলের প্রতি আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তাদের সকলের জন্য সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করাই এর লক্ষ্য।
এ ধরনের লোকদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির চেতনা সৃষ্টি করা কত কঠিন তা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। সকল ঐতিহাসিক ঘোষণা করেছেন যে, বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারে ইসলামের বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে ছিলো মুসলমানদের আশ্চর্যজনক সংঘবদ্ধতা বা দলীয় শৃঙ্খলা। কিন্তু তাদের কেউ এই মু'যিযা কিভাবে কাজ করেছে, তার ব্যাখ্যা দেননি। এ ব্যাপারে নূন্যতম সন্দেহ থাকতে পারে না যে, এই ঐক্য ও সংহতির পেছনে ফলপ্রসূ যেসব ব্যবস্থা কাজ করেছে তার মধ্যে নামায হচ্ছে অন্যতম।
মরুভূমির ভয়ানক নিঃসঙ্গতার মধ্যে একা অথবা জনবহুল নগরীতে যেখানেই বিশ্বাসী মুসলমানরা অবস্থান করুক না কোনো, যখন তারা একত্রিত হয়ে মক্কার দিকে কেবলা করে জানু পেতে বসে অথবা ভক্তিভরে অবনমিত হয়ে রুকু সিজদায় গিয়ে এক স্রষ্টার আরাধনা ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যে লিপ্ত হয়, তখন এমনকি দর্শকবৃন্দও অভিভূত হয়ে পড়ে। নামাযী লোকদের বিগলিত মনের এই সম্মিলিত আরাধনা ও আনুগত্যের মনস্তাত্বিক প্রভাব নিঃসন্দেহে অত্যন্ত বিস্ময়কর।
ঐক্যের সংস্কৃতি হিসেবে জামাআতের নামায তথা প্রকাশ্যে ঐক্যবদ্ধ প্রার্থনার শক্তি কত বিশাল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই প্রথম তা প্রত্যক্ষ করেছেন। এতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের অলঙ্ঘনীয় নিয়মের প্রতি মুসলমানদের আনুগত্যই হচ্ছে ইসলামের শক্তি অর্জনের জন্য বিরাট অংশ দায়ী।
যে জাতির মধ্যে ঐক্য, স্বকীয়তা, কেন্দ্রমুখিতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ নেই, সেই জাতির পক্ষে সারা পৃথিবীতে নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করা যেমন সম্ভব নয় তেমনি সম্ভব নয় তাদের পক্ষে নেতৃত্বের আসন নিয়ন্ত্রণ করা। একমাত্র নামাযই মুসলমানদের মধ্যে এই একতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টির প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে তাদেরকে নেতৃত্বের উপযোগী করে গড়ে তোলে। এ জন্যই জামাআতে নামায আদায় করার ব্যাপারে 'স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিক গুরুত্ব প্রদান করেছেন। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-
وأَقِيمُوا الصَّلوةَ وَاتَوُ الزَّكوةَ وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ -
নামায প্রতিষ্ঠা করো, যাকাত প্রদান করো এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু করো। (সূরা বাকারা-৪৩)
শুধুমাত্র নামায প্রতিষ্ঠার কথাই বলা হয়নি, যেখানে সকলে একতাবদ্ধ হয়ে তথা জামাআতে নামায আদায় করে, সেখানে তাদের সাথে গিয়ে নামায আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জামাআতে নামায আদায় করার ব্যাপারে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত কড়াকড়ি আরোপ করে বলেছেন-যে ব্যক্তি আযান শুনলো এবং এর অনুসরণের পথে অর্থাৎ জামাআতে উপস্থিত হবার ব্যাপারে কোনো ওযরই প্রতিবন্ধক হিসেবে না দাঁড়ায় তার ঘরে আদায় করা কোনো নামায কবুল হবে না। প্রকৃত ওযর কি- এ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ভয় অথবা রোগ। (আবু দাউদ)
যারা জামাআতে উপস্থিত হয় না, তাদের ব্যাপারে নবীজী ক্রোধ প্রকাশ করে বলেছেন- আমার ইচ্ছা হয় এই নির্দেশ জারী করতে যে, এক ব্যক্তি ইমাম হয়ে নামায আদায় শুরু করুক, আর আমি লাকড়ী বহনকারী একদল সাথীসহ ঐসব লোকদের ঘর-বাড়িতে গিয়ে আগুন লাগিয়ে দিই যারা নামাযের জামাআতে উপস্থিত হয় না। (বোখারী-মুসলিম)
প্রশ্ন ওঠে, যারা জামাআতে নামায আদায় করে না, তাদের ব্যাপারে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে ক্রোধ প্রকাশ করেছেন কেন। এর কারণ হলো, পৃথিবীতে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে বিরত রাখার জন্য মুসলমানদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন, সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রচার-প্রসার সর্বোপরি তাদের টিকে থাকা না থাকা নির্ভর করে জামাআতী জিন্দেগী তথা সাংগঠনিক জীবনের ওপর। আর জামাআতে নামাযই মুসলমানদের একতাবদ্ধ করে, সাংগঠনিক জীবনের প্রশিক্ষণ দেয়, নেতা নির্বাচন, নেতার আনুগত্য, নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার বাঁস্তব প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
জামাআতে নামায মুসলমানদের প্রথমে এই শিক্ষা দিয়ে থাকে যে, তাদেরকে একতাবদ্ধ হতে হবে। সংগঠন ভুক্ত হয়ে তাদের জীবন পরিচালিত করতে হবে। সংগঠন থেকে কোনো মুসলমান বিচ্ছিন্ন থাকতে পারবে না। কোনো মুসলমান বিপদগ্রস্থ হলে গোটা সংগঠন তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাবে। অর্থাৎ একজন মুসলমান যে কোনো সমস্যায় নিপতিত হলে সে নিজেকে কখনো অসহায় বোধ করবে না। কারণ সে জানে, তার বিপদে সে একা নয়- গোটা সংগঠন তার পাশে এসে দাঁড়াবে। আর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে হলে সাংগঠনিক শক্তি ব্যতীত কখনোই সম্ভব হয় না। মুসলমানদের প্রধান যে দায়িত্ব অর্থাৎ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ, এই দায়িত্ব পালন করা কোনো মুসলমানের পক্ষে একা সম্ভব নয়- সাংগঠনিক শক্তি অপরিহার্য। এই অপরিহার্য প্রয়োজন পূরণের জন্যই জামাআতে নামায মুসলমানদের সাংগঠনিক জীবন গঠনের প্রশিক্ষণ দেয়।
عَنِ الْحَارِثِ الأَشْعَرِى قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَام أَنَا أَمُرُكُمْ بِخَمْسِ وَاللَّهُ أَمَرَنِي بِهِنَّ الْجَمَاعَةِ والسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَالْهِجْرَةِ وَالْجِهَادِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَإِنَّهُ مَنْ خَرَجَ مِنَ الْجَمَاعَةِ قَدْرَ شِبْرٍ فَقَدْ خَلَعَ رَبْقَةَ الإِسْلَامِ مِنْ عُنُقِهِ إِلَّا أَنْ يُرَاجِعَ وَمَنْ دَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ فَهُوَ مِنْ جُشَىءٍ جَهَنَّمَ وَإِنْ صَامَ وَصَلَّى وَزَعَمَ أَنَّهُ مُسْلِمٌ
হযরত হারেসুল আশ'আরী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বর্ণনা করেছেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি তোমাদেরকে পাঁচটি কাজের আদেশ দিচ্ছি। যা আল্লাহ আমাকে আদেশ করেছেন- সে কাজগুলো হলো, জামাআতবদ্ধ (সাংগঠনিক) জীবন, (নেতার) আদেশ শ্রবণে প্রস্তুত থাকা ও (সংগঠনের নিয়ম-কানুন) মেনে চলা, (প্রয়োজনে) হিজরত করা, আল্লাহর পথে জিহাদ করা এবং নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি জামাআত (সংগঠন) থেকে এক বিঘত পরিমাণ দূরে সরে গেল, সে ইসলামের রশি তার গলদেশ থেকে খুলে ফেললো- যতক্ষণ না সে পুনরায় জামাআতের (সংগঠনের) মধ্যে শামিল হবে। আর যে ব্যক্তি জাহিলিয়াত যুগের কোনো মতবাদ ও আদর্শের দিকে (লোকদের) আহ্বান জানাবে, সে জাহান্নামের ইন্ধন হবে, যদিও সে রোযা রাখে, নামায পড়ে এবং নিজেকে মুসলিম বলে মনে করে। (মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ (رضى ) قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ مَنْ خَرَجَ مِنَ الطَّاعَةِ وَفَارَقَ الْجَمَاعَةَ فَمَاتَ مَاتَ مَيْتَة جاهلية
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বর্ণনা করেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহ ওয়াসাল্লামকে এ কথা বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি দল নেতার আনুগত্যকে অস্বীকার করে দল পরিত্যাগ করলো এবং সেই অবস্থায়ই সে মারা গেল, সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করলো। (মুসলিম)
মানব সমষ্টির এমন একটি দলকে জামায়াত বলা হয়, যারা একটি বৈজ্ঞানিক কর্মসূচীর মাধ্যমে বিশেষ কোন একটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংঘবদ্ধ বা দলবদ্ধ হয়। দলবদ্ধতার জন্য চারটি জিনিস অপরিহার্য। যেমন- উদ্দেশ্য, কর্মসূচী, নেতৃত্ব ও সংগঠন। এই চারটির যে কোন একটির অভাবে দল গঠন পূর্ণ হবে না। এ কারণেই হাট-বাজারের সংঘবদ্ধ লোকদেরকে জামায়াত বা দলভুক্ত বলা হয় না। কারণ উপরোক্ত শর্তগুলোর একটিও এর মধ্যে পাওয়া যায় না। পক্ষান্তরে ঈদগাহ ও জুমুয়ার মসজিদের দলবদ্ধ লোকদেরকে জামায়াত বা দলবদ্ধ বলা হয়। কারণ, উপরোক্ত শর্তসমূহের সবকটিই তার মধ্যে বিদ্যমান।
পৃথিবীর বড় বড় ইমারত বা রাজপথ নির্মিত হয়েছে ইট বা পাথর দিয়ে। এসব ইট বা পাথর বিচ্ছিন্ন অবস্থায় যেখানে সেখানে ফেলে রেখে দাবী করা যায় না যে, এসব একটি ইমরাত বা মজবুত পথ। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ইট-পাথরগুলো একটির সাথে আরেকটি সাজানো হলে তবেই তা ইমারত বা পথের আকৃতি ধারণ করবে। যেসব শলাকা একত্রিত করে আবর্জনা পরিষ্কার করার জন্য ঝাড়ু প্রস্তুত করা হয়, সেসব শলাকা বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকলে তা আবর্জনা পরিষ্কার করার ক্ষমতা অর্জন না করে- বরং স্বয়ং শলাকাই আবর্জনায় পরিণত হয়। অনুরূপভাবে সংগঠন বহির্ভূত মুসলমান নিজেই বাতিল শক্তির শিকারে পরিণত হতে বাধ্য। শয়তানের আক্রমণ তথা বাতিলের আবর্জনা মুক্ত থাকার জন্যই প্রত্যেক মুসলমানকে সাংগঠনিক জীবনের আওতায় আসতে হবে।
হাদীসে জামায়াত বা দলকে ইসলামী জামায়াত বা দল অর্থে বুঝানো হয়েছে। আর ইসলামী জামায়াত বা দল বলা হয় এমন একটি দল বা জামায়াতকে যে দলটি আল্লাহ ও রাসূলের তথা কোরআন-হাসীদের প্রদত্ত আইনের মাধ্যমে আল্লাহর বিধান প্রচার ও প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কোন একজন নেতার (ইমামের) নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয়। মহান আল্লাহ তা'য়ালা বাতিলকে ধ্বংস করে ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠার যে দায়িত্ব মুসলমানদেরকে দিয়েছেন, তার জন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী দল। বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন, পরস্পর সংযোগহীন একক প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাতিলকে ধ্বংস করে ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠা করা কোনক্রমেই সম্ভব নয়।
এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব মহান আল্লাহ তা'য়ালা মুসলমানদের জামায়াত বা দলের উপর অর্পণ করেছেন- কোন একক ব্যাক্তির প্রতি নয়। কারণ এতবড় গুরুত্বপূর্ণ কাজ এক ব্যক্তির চেষ্টায় সাফল্য লাভ করা সম্ভব নয়। তা সে একক ব্যাক্তি যতবড় জ্ঞানী-গুণী বা ক্ষমতাশালী লোক হোক না কেন। নবী-রাসূলের মতো বিরাট ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষের পক্ষেও একটি সংগঠিত জামায়াত বা দলের সাহায্য ব্যতীত আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। এ জন্যই হাদীসে জামায়াত বা দলের সাথে একত্রিত থাকার জন্য অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং জামায়াত বা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াকে মুর্খতা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
عَنْ مُعَادُ ابْنِ جَبَلٍ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ الشَّيْطَانَ ذئبُ الإِنْسَانِ كَذِئْبِ الْغَنَمِ يَأْخُذُ الشَّاةَ القاصية النَّاحِيَةَ وَإِيَّاكُمْ والشَّعَابَ وَعَلَيْكُمْ بِالْجَمَاعَةِ والعامة - (احمد)
হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (মেষ পালের মধ্য থেকে) বাঘ সেই মেষটিকে ধরে নিয়ে যায়, যে একাকী বিচরণ করে। অথবা (খাদ্যের অন্বেষণে) পাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা হয়ে যায়। সাবধান, তোমরা (দল ছেড়ে) দুর্গম গিরি পথে একা যাবে না। এবং তোমরা অবশ্যই দলবদ্ধভাবে সাধারণের সাথে থাকবে। "আরব এবং তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর কিছু লোক পশু পালনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতো। চারণভূমি এবং পর্বতের পাদদেশে তারা তাদের পশুগুলোকে দলবদ্ধভাবে চরাতো। বাঘ বা অন্য কোনো হিংস্র প্রাণী কোন পশুকে ধরে নিয়ে যেতে না পারে, এ জন্য তারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতো। ফলে রাখালদের অস্ত্রের ও পণ্ডদলকে পাহারা দেয়ার শিকারী কুকুরের ভয়ে কোন বাঘই পণ্ডদলকে আক্রমণ করার সাহস পেত না। কিন্তু রাখালদের অগোচরে কোন পশু যদি ঘাস খেতে খেতে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো, তখনই নিকটবর্তী পর্বতের গুহা বা জংগল থেকে বাঘ এসে তাকে ধরে নিয়ে যাবার সুযোগ পেত।
এই দৃষ্টান্তের মাধ্যমে আল্লাহর রাসূল মুসলমানদেরকে সাবধান করে দিয়েছেন যে, দলছাড়া পশু যেমন বাঘের শিকার হয় তেমনি জামায়াত বা দল ছাড়া মুসলমানও শয়তানের শিকার হয়, তা সে যত বড় ঈমানদার মুসলমানই হোক না কেন। সারা বিশ্বে বর্তমানে মুসলমানদের যে দুর্দশা ও দুর্ভোগ তার একমাত্র কারণ হলো মুসলমানদের পরস্পর পরস্পরের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও অনৈক্য। মুসলিম দেশগুলোর অনৈক্যের কারণেই গুটি কয়েক ইয়াহুদীর হাতে প্রতি মুহূর্তে মুসলিম নারী, শিশু, যুবক-বৃদ্ধের রক্ত ঝরছে। ঈমানহারা মুসলিম মিল্লাতের কোনো সম্মান-মর্যাদা পৃথিবীতে অবশিষ্ট নেই।
অমুসলিমের মধ্যে কতিপয় রক্ত লোলুপ হায়েনা বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে আসীন হয়ে গোটা দুনিয়া ব্যাপী এক নির্মম তান্ডব শুরু করেছে। বর্তমানে যদিও মুসলিম সম্প্রদায় কোথাও দলবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু সে দলবদ্ধতা ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের ভিত্তিতে নয়; বরং ভাষা বর্ণ অথবা আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে, যাকে আল্লাহর নবী স্পষ্ট ভাষায় জাহেলিয়াত বলে আখ্যায়িত করেছেন।
عَنْ عَبْدِ اللهِ ابْنِ عُمَرَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ اللَّهَ لَا يَجْمَعُ أُمَّتِي أَوْ قَالَ أُمَّةٌ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلى ضَلَالَةٍ وَمَنْ شَدْ شُنَّ فِي النَّارِ. (ترمذی)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মহান আল্লাহ তা'য়ালা আমার উম্মতকে কখনও ভুল সিদ্ধান্তের উপর সংঘবদ্ধ করবেন না। আর জামায়াত বা দলের উপরই আল্লাহ তা'য়ালার রহমত। সুতরাং যে জামায়াত বা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে সে জাহান্নামে পতিত হবে। (তিরমিযী)
এই হাদীসে আল্লাহর হাবীব সুসংবাদ প্রদান করেছেন যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লামের প্রকৃত উম্মতেরা কখনও কোন ভুল সিদ্ধান্তের ওপর ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। আর এরই কারণে ইজমায়ে উম্মতের (সংঘবদ্ধ সিদ্ধান্তকে) শরীয়তের দলীল হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
عَنْ أَنَس (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ شِبْرًا فَقَدْ خَلَعَ رِبْقَةَ الإِسْلَامِ مِنْ عُنُقِهِ. (ابوداؤد)
হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি জামায়াত বা দল ত্যাগ করে এক বিঘত পরিমাণ দুরে সরে গেল সে যেন ইসলামের রশি থেকে তার গর্দানকে আলাদা করে নিলো। (আবু দাউদ)
ব্যক্তিগত জীবনে একটি লোক যতই আল্লাহভীরু হোক না কেন, যদি সে আল্লাহর দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠিত মুসলমানদের কোন জামায়াত বা দলে নিজেকে শামিল না করে, তাহলে ইসলামের দৃষ্টিতে সে পরিপূর্ণভাবে ইসলামে শামিল হলো না। এখানে একটি কথা বিশেষভাবে স্মরণে রাখতে হবে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে যে জামায়াত বা দল গঠিত হয়েছিল তার নাম ছিলো আল জামায়াত।
অর্থাৎ মুসলমানদের একমাত্র জামায়াত বা দল। তখন প্রত্যেকটি লোকের উপর উক্ত জামায়াত বা দলে যোগ দেয়া ফরয ছিলো এবং উক্ত দলের বাইরে থাকা ছিল কুফরী। কিন্তু আল্লাহর রাসূলের বিদায়ের পর তাঁর উম্মতের মধ্যে একাধিক লোকের নেতৃত্বে একাধিক জামায়াত বা দল হতে পারে। তবে তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হবে এক ও অভিন্ন এবং সে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহর রাসূলের প্রদর্শিত পন্থায় আল্লাহর দ্বীনের প্রচার-প্রসার ও প্রতিষ্ঠা করা।
ফলে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের অভিন্নতা একাধিক দলও পরস্পর পরস্পরের সাহযোগিতা করবে কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিদায়ের পর মুসলমানদের বিশেষ কোন একটি জামায়াত বা দল নিজেদের জামায়াত বা দলকে সমগ্র বিশ্বের জন্য একমাত্র জামায়াত বা দল বলে দাবী করতে পারে না, যার বাইরে থাকা কুফরী। পক্ষান্তরে আল্লাহ তা'য়ালার দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচীর ভিত্তিতে মুসলমানদের কোন একটি দলে অংশগ্রহণ না করে নিজেকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের একজন সদস্য মনে করে আত্মতৃপ্তি লাভ করা বোকামী বৈ আর কিছু নয়।
0 Comments