নবী করীম (সা:) এর মর্যাদা ও ওহী আয়ত্বকরণ

        নবী করীম (সা:) এর কত বিশাল মর্যাদা, সম্মানের কোন্ উচ্চ শিখরে আল্লাহ তা'য়ালা তাঁকে বসিয়েছেন তা কল্পনাও করা যায় না। অন্যান্য নবী-রাসূলদের যখন আল্লাহ তা'য়ালা ওহী দান করেছেন তখন তাঁদেরকে বিশেষ স্থানে ডেকে নিয়ে তারপর ওহী দিয়েছেন। হযরত মূসা (আ:) কে মিসরের যে সিনাই উপত্যকায় ডেকে নিয়ে ওহী দিয়েছিলেন আমার মিশর সফরের সময় সে উপত্যকায় আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর এই নগণ্য গোলামকে নিয়েছিলেন। মূসা (আ:) মহান মালিক আল্লাহর ডাক শুনে নিজেকে স্থির রাখতে না পেরে পায়ের জুতা খোলার কথা ভুলে গিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিলেন। আল্লাহ তা'য়ালা তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, 'জুতা পায়ে এখানে আসা যাবে না, জুতা খুলে এসো'।

         আমিও ঐ উপত্যকায় জুতা খুলে গেলাম। ঐ স্থান দেখলাম যেখানে মূসা (আ:) কে ওহী দেয়ার জন্যে ডাকা হয়েছিলো। অপরদিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, নবী করীম (সা:) কে যখন ওহী দেয়ার প্রয়োজন হয়েছে তখন তিনি যেখানে যে অবস্থায় থেকেছেন সেই অবস্থাতেই তাঁর ওপর ওহী অবতীর্ণ করা হয়েছে। বিশেষ কোনো স্থানে তাঁকে ডেকে নেয়া হয়নি। সুউচ্চ মর্যাদার কারণেই স্বয়ং আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর ওপর ওহী অবতীর্ণের এ ব্যবস্থা করেছিলেন।

        শুধু তাই নয়, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত জিবরাঈল (আ:) যখন ওহী এনে নবী করীম (সা:) কে পড়ে শুনাতেন তখন তিনিও তাঁর সাথে সাথে পড়তেন। নবী করীম (সা:) পড়ার এই কষ্টটুকু করবেন এটাও মহান আল্লাহ বরদাস্ত করলেন না। তিনি তাঁর প্রিয় হাবীবকে পরম মমতায় জানিয়ে দিলেন-

لا تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ ط إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَه جِ فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَه ج ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَه ط

        আপনি দ্রুত আপনার জিহ্বা নাড়াবেন না, এর একত্র করা ও আপনাকে পড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমার ওপর, অতএব আমি (জিবরাঈলের মাধ্যমে আপনার কাছে) যখন কুরআন পড়তে থাকি, তখন আপনি সে পড়ার (দিকে মনোযোগ দিন এবং এর) অনুসরণ করার চেষ্টা করুন, অত:পর আপনাকে এর ব্যাখ্যা বলে দেয়ার দায়িত্বও আমার ওপর। (সূরা কিয়ামাহ্-১৬-১৯)

        'আপনার ওপরে যে ওহী অবতীর্ণ করা হচ্ছে, তা মুখস্থ করার ব্যাপারে আপনি অস্থিরতা প্রকাশ করবেন না। ওহী আপনার মানসপটে অঙ্কিত করে দেয়ার দায়িত্ব আমার। ওহীর এই মণিমুক্তাগুলো আপনার ভেতরে একটির পর একটি সজ্জিত করার দায়িত্ব আমার। আপনার ভেতরে ওহীর প্রতিটি শব্দ স্মরণ রাখা ও সংরক্ষিত রাখা আপনার নিজস্ব কোনো যোগ্যতার বিষয় নয়। এটা একান্তই আপনার প্রতি আমার অনুগ্রহ'।

        এই আয়াত থেকে স্পষ্ট অনুধাবন করা যায় যে, এই আয়াত যখন অবতীর্ণ হয়েছিল তখন পর্যন্তও নবী করীম (সা:) ওহী ধারণে অভ্যস্থ হননি। এ জন্য তিনি ওহী অবতীর্ণের সময় হযরত জিবরাঈল (আ:) এর সাথে সাথে অতি দ্রুত আবৃত্তি করতে থাকতেন- যেন কোনো একটি শব্দও তিনি ভুলে না যান।

        রাসূল (সা:) অতি দ্রুত ওহী আবৃত্তি করছেন ভুলে যাওয়ার আশঙ্কায়, এতে তাঁর মানসিক অস্থিরতার প্রকাশ ঘটছে, তিনি কষ্ট অনুভব করছেন। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বন্ধুর এই সামান্য কষ্টটুকুও সহ্য করতে পারলেন না। সাথে সাথে তাঁকে জানিয়ে দিলেন, আপনি অস্থির হবেন না, আপনি নীরবে শুনতে থাকুন- আপনার হৃদয়ে ওহী অঙ্কন করে দেয়ার দায়িত্ব আমার। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন, 'কুরআনের কোনো একটি শব্দ ভুলে যেতে পারেন, এ জন্য আল্লাহর রাসূল বার বার তা আবৃত্তি করছিলেন'।

        আরেক হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে, হযরত জিবারঈল (আ:) ওহী শুনিয়ে শেষ করার পূর্বেই আল্লাহর রাসূল ওহীর প্রথমাংশ আবৃত্তি শুরু করতেন। রাসূলের এভাবে আবৃত্তি করার উদ্দেশ্য ছিল, যেন তিনি ভুলে না যান। রাসূলের এই ব্যস্ততা দেখে মহান আল্লাহ তাঁকে গভীর মমতায় জানালেন-

فَتَعَالَى اللَّهُ الْمَلِكُ الْحَقُّ ج وَلَا تَعْجَلْ بِالْقُرْآنِ مِنْ قَبْلِ أَنْ يُقْضَى إِلَيْكَ وَحْيُهِ رَ وَقُل رَّبِّ زِدْنِي عِلْمًا -

        আল্লাহ তা'য়ালা অতি মহান, তিনিই (সৃষ্টিকুলের) প্রকৃত বাদশাহ (তিনিই কুরআন নাযিল করেছেন, হে নবী), আপনার কাছে তাঁর ওহী নাযিল পূর্ণ হওয়ার আগে কুরআনের ব্যাপারে কখনো তাড়াহুড়ো করবেন না, (তবে জ্ঞান বৃদ্ধি করতে চাইলে) বলুন, হে আমার মালিক, আমার জ্ঞান (ভান্ডার) আপনি বৃদ্ধি করে দিন। (সূরা ত্বাহা-১১৪)

        এসব আয়াতে আল্লাহর রাসূলের অতুলনীয় মর্যাদার দিকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। রাসূল (সা:) পবিত্র কুরআন স্মরণে গেঁথে নেয়া এবং হৃদয়পটে অঙ্কিত করার উদ্দেশ্যে তাঁর পবিত্র জিহ্বা দ্রুত সঞ্চালন করছিলেন, রাসূলকে সামান্য এই কষ্টটুকুও আল্লাহ করতে দেননি। তাঁকে জানিয়ে দিলেন, 'হে রাসূল! আপনার কোনো কষ্ট করার প্রয়োজন নেই। যখন আপনার প্রতি ওহী অবতীর্ণ হয়, আপনি মনোযোগ সহকারে তা শুধু শুনতে থাকুন। আপনার মানসপটে ওহীর প্রতিটি শব্দ একটির পরে আরেকটি গেঁথে দেয়ার দায়িত্ব আমার। শুধু তাই নয়, যে ওহী আপনার প্রতি অবতীর্ণ করা হচ্ছে, তার প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্যও আমি আপনাকে বুঝিয়ে দেবো'। মহান আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

سَنُقْرِئُكَ فَلَا تَنْسى لا

        আমি যে ওহী পাঠাবো তা আমিই আপনাকে পড়িয়ে (অন্তরে গেঁথে) দেবো, অত:পর আপনি আর তা ভুলবেন না। (সূরা আ'লা-৬)

        মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর রাসূলকে নিশ্চয়তা দিলেন, 'ওহী মুখস্থ করার ব্যাপারে আপনি কেনো এত ব্যস্ত হচ্ছেন তা আমার অজানা নয়। কারণ আমার কাছে অপ্রকাশিত কিছুই থাকে না। প্রকাশ্য বিষয়ও যেমন আমার গোচরে রয়েছে তেমনি অপ্রকাশিত গোপন বিষয়সমূহও আমার জ্ঞানের আওতায় রয়েছে। অতএব আপনি ব্যস্ততা পরিহার করে একাগ্রচিত্তে ওহী শুনতে থাকুন। আপনি এই ওহী কখনোই ভুলবেন না। আপনি কখনো স্থায়ীভাবে আপনার ওপরে অবতীর্ণ করা কুরআন ভুলে যাবেন না। আপনি যেন তা ভুলে না যান সে দায়িত্ব আমি আল্লাহ গ্রহণ করলাম'। রাসূলের সম্মান- মর্যাদা আল্লাহ তা'য়ালা এভাবেই প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চে পৌছে দিয়েছেন। অপরদিকে আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর নবীকে মানবীয় দুর্বলতার ঊর্ধ্বেও রাখেননি। মানুষের জীবনে যা ঘটা স্বাভাবিক রাসূলের ক্ষেত্রেও গোনাহ্ ব্যতীত স্বাভাবিক দুর্বলতা প্রকাশ করিয়ে এ কথা প্রমাণ করা হয়েছে যে, রাসূলও মানুষ এবং মানব জাতির ভেতর থেকে রাসূল নির্বাচিত করে মানুষের সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধিই করা হয়েছে।

        বুখারী শরীফের একটি বর্ণনায় দেখা যায়, একদিন ফজরের নামাজ আদায়কালে আল্লাহর রাসূল কুরআনের একটি আয়াত বাদ দিয়েই তার পরবর্তী আয়াত পড়তে থাকলেন এবং এভাবে নামাজ শেষ করলেন। সাহাবী হযরত উবাই ইবনে কা'য়াব (রা:) জানতে চাইলেন, 'হে আল্লাহর রাসূল (সা:)। ঐ আয়াতটি কি মনসুখ (রহিত) হয়ে গিয়েছে? রাসূল (সা:) জবাবে বললেন, মনসুখ হয়নি- বরং আয়াতটি আমার তখন স্মরণ হয়নি'। (বুখারী)


Post a Comment

0 Comments