নামাযে কি বলা হচ্ছে?

        এরপর নামায শুরু করা হচ্ছে 'আল্লাহু আকবার' অর্থাৎ আল্লাহ মহান তথা আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ কথাটি উচ্চারণ করে। আল্লাহু আকবার বা আল্লাহই একমাত্র সর্বশ্রেষ্ঠ সত্তা- এই কথাটি মুসলমানদের জীবনের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। মুসলিম শিশু পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হবার সাথে সাথে তার কানে শোনানো হয় আল্লাহু আকবার তথা আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ। পৃথিবী থেকে একজন মুসলমান যখন বিদায় গ্রহণ করে অর্থাৎ যখন তার জানাযা আদায় করা হয়, তখনও বার বার উচ্চারণ করা হয় আল্লাহ আকবার।

        অর্থাৎ মুসলিম জীবনের সূচনাও হয় আল্লাহু আকবার শব্দটি শোনার মধ্য দিয়ে এবং পৃথিবীর জীবনের শেষও হয় আল্লাহু আকবার উচ্চারণের মধ্য দিয়ে। পৃথিবীতে জীবিত থাকতে সে মুখে বার বার এই কথাটি উচ্চারণ করে।

        নামায আদায়কালে নামায শুরুই করতে হয় আল্লাহু আকবার শব্দটি উচ্চারণ করে এবং প্রত্যেক দিন ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত ও নফলসহ পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায়কালে প্রায় দুই শতেরও অধিক বার এই শব্দটি উচ্চারণ করতে হয়। অর্থাৎ মুসলিম জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রেই মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিতে হয়।

         স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, আল্লাহু আকবার শব্দটি কেনো বার বার উচ্চারণের ব্যবস্থা করা হয়েছে? এই শব্দ দুটোর গুরুত্ব ও তাৎপর্য কি? আল্লাহু আকবার- কথাটি শুধুমাত্র দুটো শব্দের সমষ্টি না অসংখ্য শব্দের সমষ্টি? এই শব্দ দুটো উচ্চারণের মধ্য দিয়ে কি অগণিত বাক্যাবলীর সমষ্টি বা সারমর্ম উচ্চারণ করা হয়? অথবা সেই অসংখ্য বাক্য একজন মানুষের পক্ষে উচ্চারণ করা কখনো সম্ভব নয় বিধায় সমস্ত কথার সমষ্টি এই দুটো মাত্র শব্দের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা লাভ করার মাধ্যম হিসেবে আল্লাহু আকবার শব্দ দুটো মানুষকে উচ্চারণ করার আদেশ দেয়া হয়েছে?

        যেমন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সবটুকু প্রশংসা কখনো কোনো মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয় বিধায় আল্লাহ তা'য়ালা একান্ত অনুগ্রহ করে তাঁর বান্দাকে শিখিয়েছেন, তুমি বলো 'আল হাম্দুলিল্লাহ্' অর্থাৎ সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর। কোনো মানুষকে যদি কিয়ামত পর্যন্ত হায়াত দেয়া হয় এবং সেই সাথে তাকে শতকোটি মুখ দেয়া হয়, শতকোটি মুখে সেই মানুষ যদি মহান আল্লাহর প্রশংসা করতে থাকে তবুও আল্লাহ তা'য়ালার যতটুকু প্রশংসা প্রাপ্য, তার শতকোটি ভাগের এক ভাগও আদায় করা সম্ভব নয়। মানুষের পক্ষে মহান আল্লাহর প্রশংসার হক আদায় করা সম্পূর্ণ অসাধ্য ও অসম্ভব।

         কারণ মহান আল্লাহর প্রশংসার ক্ষেত্র অত্যন্ত ব্যাপক আর মানুষের সাধ্য ও ক্ষমতা খুবই সীমাবদ্ধ। সীমিত ক্ষমতা দিয়ে ঐ মহান আল্লাহর প্রশংসার হক আদায় করা সম্ভব নয়। মানুষকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, সেই আল্লাহ তা'য়ালা তাঁরই সৃষ্টির অক্ষমতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ রয়েছেন। এ জন্যই তিনি তাঁর বান্দাকে একান্ত অনুগ্রহ করে শিখিয়েছেন, বান্দা! তোমার পক্ষে আমার প্রশংসার হক আদায় করা কখনো সম্ভব হবে না। এ জন্য তুমি শুধুমাত্র এই কথাটি উচ্চারণ করো, আল হাম্মদুলিল্লাহ্।

        একই বিষয় নিহিত রয়েছে আল্লাহু আকবার শব্দ দুটোর মধ্যে। উচ্চারণ করা হচ্ছে, আল্লাহ-ই সর্বশ্রেষ্ঠ। যদি প্রশ্ন করা হয়, কেনো আল্লাহ তা'য়ালা সর্বশ্রেষ্ঠ? এই প্রশ্নের উত্তর যদি কেউ লেখার চেষ্টা করে, তাহলে পৃথিবীর গোটা জীবনকালও যদি সেই ব্যক্তি এই প্রশ্নের উত্তর লেখার কাজে ব্যয় করে, তবুও কি আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের শতকোটি ভাগের একভাগও লিখে শেষ করতে সক্ষম হবে?

        মানুষের ক্ষমতা সসীম এবং আল্লাহ তা'য়ালার শ্রেষ্ঠত্বের হক আদায় করা কোনো মানুষের পক্ষে কখনো সম্ভব হবে না- এ কথা মহান আল্লাহ অবগত আছেন। এ জন্যই তিনি বান্দাকে শিখিয়ে দিয়েছেন, তোমরা মাত্র দুটো শব্দ উচ্চারণ করে আমার শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষনা দাও।

        অসংখ্য অগণিত বাক্যাবলীর সারমর্ম ও সমষ্টি হলো আল্লাহু আকবার শব্দ দুটো। এই দুটো শব্দের মধ্য দিয়ে অগণিত বাক্য উচ্চারিত হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কে, তিনি কোন্ ধরনের গুণাবলীর অধিকারী এবং তাঁর ক্ষমতা কি ধরনের- অর্থাৎ আল্লাহ তা'য়ালার সম্পূর্ণ পরিচয় প্রকাশ করা হয়েছে এই আল্লাহু আকবার শব্দ দুটোর মাধ্যমে।

        আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এক ও একক, তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। তিনি সমস্ত সৃষ্টির রব, মালিক, ইলাহ্, তিনি আত্কামুল হাকিমীন ও আরহামুর রাহিমীন, তিনিই যাবতীয় সম্মান মর্যাদার অধিকারী। যাবতীয় প্রশংসা শুধুমাত্র তাঁরই জন্য এবং হাম্দ ও ভাস্ট্রীহ শুধুমাত্র তাঁরই জন্য হওয়া উচিত, আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় বস্তু তাঁরই তাস্বীহ করছে, তিনি উত্তম নামের অধিকারী, তিনি উচ্চ মর্যাদাশালী, তিনি চিরঞ্জীব চিরস্থায়ী, তিনি গোপন ও প্রকাশ্য সম্পর্কে জ্ঞাত, তিনি তওবা কবুলকারী, তিনি দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী, তিনি যাবতীয় কিছু শ্রবণকারী, তিনি প্রবল ক্ষমতাশালী, তিনি কঠোর শাস্তিদানকারী, তিনিই আকার-আকৃতি রচনাকারী, তিনি প্রশস্ততা বিধানকারী, তিনি অপরিসীম বরকতশালী, তিনি উত্তম প্রতিফল দানকারী, তিনি সকল দোষ-ত্রুটি ও দুর্বলতা অক্ষমতা থেকে পবিত্র, তিনি বড়ই অনুগ্রহশীল,

        আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় কিছু তাঁর সম্মুখে সিজদাবনত। তাঁর থেকে বড় ওয়াদা পূরণকারী আর কেউ নেই, তিনি অঙ্গীকারের বিপরীত কাজ করেন না, তিনিই সহায় ও আশ্রয়, তিনিই সর্বোত্তম পৃষ্ঠপোষক ও সাহায্যকারী এবং সর্বোত্তম রক্ষক, তিনি দোয়া শ্রবণকারী ও গ্রহণকারী, তিনি বান্দার অতি নিকটবর্তী, তাঁর থেকে পালিয়ে বাঁচার কোনো উপায় নেই, আস্থা স্থাপনের জন্য তিনিই যথেষ্ট, তিনিই একমাত্র আশ্রয়দাতা, যাবতীয় ব্যাপারে চূড়ান্ত পরিণতি তাঁরই হাতে, তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ক্ষমতা কারো নেই, কেউ তাঁর অংশীদার হওয়া থেকে তিনি পবিত্র, তিনিই দাসত্ব-ইবাদাত লাভের অধিকারী, তিনিই বিশ্বলোকের সবকিছুর পথনির্দেশ দানকারী এবং সঠিক পথ প্রদর্শনকারী, প্রতিটি জিনিসের ওপর তাঁর রহমত পরিব্যপ্ত, সমস্ত সৃষ্টি তাঁর কাছে জবাবদিহী করতে বাধ্য, তাঁর কাছেই প্রত্যেককে প্রত্যাবর্তন করতে হবে, তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ, তিনিই প্রকাশমান এবং তিনি প্রচ্ছন্ন, তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন, তিনিই প্রাণ দানকারী, তিনিই নিষ্প্রাণকে জীবন দান করেন এবং জীবন্ত থেকে মৃতকে বের করে আনেন, তিনিই সমস্ত সৃষ্টির তত্ত্ববধানকারী, তিনিই সব জিনিসের ভান্ডারের মালিক, তিনিই সব জিনিসের তকদীর নির্ধারণকারী, জীবন ও মৃত্যু একমাত্র তাঁরই আয়ত্বে, তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারে না।


        কোনো কিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়, তাঁর সিদ্ধান্ত অটল ও অপরিবর্তনীয়, তিনি মুখাপেক্ষিহীন, মানুষ তাকে স্রষ্টা মানলে তবেই তিনি স্রষ্টা হবেন- এ প্রয়োজন তাঁর নেই, তাঁর কাছে অসম্ভব বলে কোনো কিছু নেই, তাঁর সকল ইচ্ছা শুধুমাত্র তাঁর একটি আদেশের মাধ্যমেই পূর্ণ হয়ে যায়, তাঁর পরিকল্পনায় কোনো ব্যর্থতা নেই, তিনি যার সাথে রয়েছেন, কেউ তার মোকাবেলা করতে পারে না, তাঁর সামনে কথা বলার সাহস কারো নেই, বিজয় ও সফলতা তাঁর অনুগ্রহেই অর্জিত হয়, তিনি তাঁর কাজ সম্পূর্ণ করেই থাকেন, তাঁর অনুমতি ব্যতীত কেউ কোনো নি'মাত লাভ করতে পারে না, তিনি মানুষের অবোধগম্য পন্থায় নিজ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন, তিনি যাকে চান তাঁর যমীনের উত্তরাধিকারী বানান, তিনি যাকে চান নিজের রহমত দানে ধন্য করেন, আনন্দ-বেদনা তাঁরই করায়ত্বে, যে বান্দাকে তিনি চান আপন অনুগ্রহ দ্বারা ভূষিত করেন, যাকে চান উচ্চ মর্যাদা দান করেন, তিনি যাকে লাভবান অথবা ক্ষতিগ্রস্থ করতে চান, তা প্রতিরোধ করার শক্তি কারো নেই, তিনিই সবচেয়ে ভালো জানেন যে, কল্যাণ কোন্ জিনিসে আর কোন্ জিনিসে নয়। সৃষ্টি জগতের কোনো কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়। তিনি কারো কৃতজ্ঞতার মুখাপেক্ষী নন, তাঁর ফয়সালা অত্যন্ত বিজ্ঞতা ও সুবিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তাতে ভুল ভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই, তাঁর পক্ষে সকল মানুষকে সৃষ্টি এবং পুনরায় জীবিত করে উঠানো কিছুমাত্র কঠিন ব্যাপার নয়।

        এ ধরনের যাবতীয় অসংখ্য বাক্যাবলী আল্লাহু আকবার শব্দ দুটোর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। এই কথা উচ্চারণকারীকে অনুধাবন করতে হবে, সে মুখে কোন্ কথা উচ্চারণ করছে। উচ্চারণকারী যদি জেনে বুঝে এই কথা উচ্চারণ করে, তাহলে তার ওপর উচ্চারিত কথার প্রভাব অবশ্যই বিস্তার করবে। একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি উপলব্ধি করা যেতে পারে। যেমন দেশের কোনো নাগরিককে যদি প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিজের চেম্বারে ডেকে নিয়ে ধমকের সুরে বলে, 'তুমি যদি তোমার নীতি পরিবর্তন না করো, তাহলে তোমাকে সমুচিত শিক্ষা দেব।' প্রধানমন্ত্রীর বলা এই কথাটি উক্ত ব্যক্তির সমগ্র সত্তার ওপর কি ধরনের প্রভাব বিস্তার করবে তা সহজেই অনুমেয়। অনুরূপভাবে আল্লাহু আকবার শব্দটি উচ্চারণকারী ব্যক্তি যদি জেনে বুঝে তা উচ্চারণ করে, তাহলে তার ওপর এই শব্দ এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করবে যে, সেই ব্যক্তির জীবনধারা আমূল পরিবর্তন হতে বাধ্য।

        মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী এবং তিনিই সমস্ত কিছুর মালিক, এই অনুভূতি জাগ্রত রেখে উচ্চারণ করতে হবে- আল্লাহু আকবার। শুধু মুখেই উচ্চারণ করেই ক্ষান্ত থাকা যাবে না, তাঁর বিধানকে জীবনের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করে এ কথা প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি যেমন সর্বশ্রেষ্ঠ তেমনি তাঁর বিধানও সর্বশ্রেষ্ঠ এবং এর মোকাবেলায় অন্য কোনো বিধান অনুসরণের যোগ্য নয়। আল্লাহ তা'য়ালা ও তাঁর বিধানকেই সর্বাবস্থায় সর্বোচ্চে স্থান দিতে হবে।

        আল্লাহু আকবর- বলে নামাযে দাঁড়ানোর অর্থই হলো, আল্লাহ তা'য়ালা এবং মহান আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান ব্যতীত এই পৃথিবীতে যত মতবাদ-মতাদর্শ, নিয়ম-নীতি, প্রথা-পদ্ধতি, আইন-কানুন, বিধি-বিধান যেখানে যা কিছু রয়েছে এবং আল্লাহ ব্যতীত ইলাহ ও মা'বুদের দাবীদার যে যেখানে আছে, সবই আমার পায়ের নীচে। আল্লাহ তা'য়ালাই আমার একমাত্র মা'বুদ ও ইলাহ এবং তাঁর দেয়া জীবন বিধানই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

علمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ الْكَبِيرُ الْمُتَعَالِ

        গোপন ও প্রকাশ্য সবই তাঁর জ্ঞাত। তিনি মহান, সর্বাবস্থায় তিনি সর্বোচ্চে অবস্থান করেন। 
(সূরা আর রা'দ-৯)

ذلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ هُوَ الْبَاطِلُ وأنَّ اللهَ هُوَ الْعَلِيُّ الْكَبِيرُ

        আল্লাহই সত্য এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে এরা যাদেরকে ডাকে তারা সবাই মিথ্যা। আর আল্লাহই পরাক্রমশালী ও সর্বশ্রেষ্ঠ। (সূরা আল হজ্জ-৬২)

        বর্তমানে মুসলিম পরিচয় দানকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তিই নামাযের ব্যাপারে উদাসীন। আবার যারা নামায আদায় কবেন, তাদের মধ্যেও অধিকাংশ ব্যক্তিই জানেন না, নামাযে তারা কি বলছেন এবং জানার চেষ্টাও করেন না। নামাযের সূচনাতে বলা হচ্ছে আল্লাহু আকবার অর্থাৎ আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ, তিনিই সর্বোচ্চে তথা তাঁর দেয়া জীবন বিধান, আইন কানুনই সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর বিধানের মোকাবেলায় অন্যান্য যাবতীয় বিধি-বিধান একেবারেই নগণ্য, তুচ্ছ বা অকল্যাণকর। কিন্তু নামায থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েই মৌখিক ও বাস্তব কার্যাবলীর মাধ্যমে এ কথারই সাক্ষ্য দেয়া হচ্ছে যে, আল্লাহ তা'য়ালা বা তাঁর বিধান শ্রেষ্ঠ ও সর্বোচ্চে নয়- বরং মানুষের বানানো আইন-কানুন বিধানই সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোচ্চে।

        একশ্রেণীর নামাযী লোক, নামায আদায় করছেন- কিন্তু এমন মতবাদ-মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন-সংগ্রাম করেন, যে মতবাদ-মতাদর্শ ইসলামকে বরদাস্ত করতে মোটেও রাজী নয়। অর্থাৎ এসব নামাযী লোক শুধুমাত্র মুখেই উচ্চারণ করছে আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ। কিন্তু বাস্তব কর্মের মাধ্যমে তারা এ কথারই সাক্ষী দিচ্ছে যে, মসজিদ বা নামাযের স্থানেই আল্লাহ তা'য়ালা সর্বশ্রেষ্ঠ, কিন্তু আমার সমাজ, দেশ তথা রাজনীতি, অর্থনীতি তথা দেশের সামগ্রিক আইন-কানুন ও বিধানের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা'য়ালা সর্বশ্রেষ্ঠ নন- মানুষের বানানো বিধানই সর্বশ্রেষ্ঠ। এই শ্রেণীর লোক- যারা নামাযের আদর্শ বাস্তবে অনুসরণ করছে না, তাদের সম্পর্কেই পবিত্র কোরআন ঘোষণা করেছে-

فَوَيْلٌ لِلْمُصَلِّينَ الَّذِينَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ

         ধ্বংস সেই মুসল্লীদের জন্য, যারা নিজেদের নামাযের ব্যাপারে অবজ্ঞা দেখায়, যারা প্রদর্শনীমূলক কাজ করে। (সূরা আল মাউন-৪-৫)

        এই শ্রেণীর লোক ঈমানের স্বাদ থেকে বঞ্চিত এবং ঈমানের দাবীর ব্যাপারে এরা মিথ্যাবাদী। এদের সম্পর্কে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ آمَنَّا بِاللَّهِ وَبِالْيَوْمِ الآخِرِ وَمَاهُمْ بمؤمنين

        এমনও কিছু লোক রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছি, অথচ প্রকৃতপক্ষে তারা ঈমানদার নয়। (সূরা আল বাকারা-৮) 

        এই আয়াতে আল্লাহ তা'য়ালা এমন দুটো বিষয়ের উল্লেখ করেছেন, যে দুটো বিষয়ই অদৃশ্য। এই আয়াতে এ কথা বলা হয়নি যে, এরা বলে আমরা কোরআন ও রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছি। বরং বলা হয়েছে, আমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছি।

        মুনাফিকরা সাধারণত প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে এবং তাদের কথার ধরনও হয় কৌশলপূর্ণ। তারা যদি কোরআন ও রাসূলকে অস্বীকৃতি জানাতো, তাহলে তারা নিজেদেরকে মুসলিম সম্প্রদায় ভূক্ত বলে দাবী করার কোনো সুযোগ পেত না। কারণ, কোরআন ও রাসূল ছিলেন দৃশ্যমান। এই দুটো জিনিসের প্রতি তাদের অন্তরে অবিশ্বাস থাকলেও মুখে তারা স্বীকৃতি দিয়েছিলো যে, আমরা কোরআন ও রাসূলের প্রতি বিশ্বাসী। এ জন্য স্বয়ং রাসূল ও কোরআনের পক্ষে তাদের কাছে প্রশ্ন তোলার সুযোগ ছিলো না যে, তোমরা আমাদের প্রতি বিশ্বাসী নও। এজন্য তারা এমন দুটো বিষয়ের প্রতি নিজেদের বিশ্বাসের কথা ঘোষণা করে, যে দুটো বিষয়ের একটিও দৃশ্যমান নয় এবং এ দুটোর একটিও এই পৃথিবীতে তাদেরকে প্রশ্ন করবে না। অর্থাৎ তারা দাবী করে আমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী। কিন্তু আল্লাহ তা'য়ালা এই পৃথিবীতে তাদের সম্মুখে দৃশ্যমান হয়ে এ কথা বলবেন না যে, প্রকৃতপক্ষে তোমরা বিশ্বাসী নও। পরকালের বিষয়টিও অনুরূপ।

        এ কারণেই তারা অদৃশ্য দুটো বিষয়ের প্রতি নিজেদেরকে বিশ্বাসী বলে ঘোষণা করে, লোক দেখানো নামায আদায় করে, সেই সাথে বাস্তবে এমন কর্ম করে থাকে- যে কাজের মাধ্যমে তারা এ কথাই প্রমাণ করে, নামাযে তারা যা বলছে, সেই বলা কথার প্রতি তাদের অন্তরে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। অর্থাৎ পৃথিবীতে তারা ঈমানদারদের সাথে ধোকাবাজী করে থাকে। নিজেদেরকে মুসলিম পরিচয় দিয়ে তারা মুসলিম মিল্লাতের নেতৃত্বের আসন দখল করে, ইসলাম ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্বার্থ বিরোধী কাজ করে।

Post a Comment

0 Comments