পৃথিবীর কোন বৈজ্ঞানিকের কোন ক্ষমতা নেই তারা নিজের শক্তি প্রয়োগে আল্লাহর সৃষ্ট বস্তুর সহযোগিতা ব্যতীত ভিন্ন কিছু সৃষ্টি করে প্রশংসা লাভের অধিকারী হতে পারে। তারা যা কিছুই করতে অগ্রসর হবেন, প্রতি মুহূর্তে-প্রতি পদক্ষেপে তাকে মহান আল্লাহর মুখাপেক্ষী হতে হবেই। এ জন্য আল্লাহ ব্যতীত যেমন দাসত্ব লাভের অধিকারী আর কেউ নেই, তেমনি তাঁর প্রশংসা ব্যতীত আর কারো প্রশংসা করা যেতে পারে না। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
وَهُوَ اللهُ لا إِلَهَ إِلا هُوَ لَهُ الْحَمْدُ فِي الأولى وَالْآخِرَةِ وَلَهُ الْحُكْمُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
তিনিই এক আল্লাহ যিনি ব্যতীত দাসত্ব লাভের অধিকারী আর কেউ নন। তাঁরই জন্য প্রশংসা পৃথিবীতেও এবং আখিরাতেও। শাসন কর্তৃত্ব তাঁরই এবং তাঁরই দিকে তোমরা ফিরে যাবে। (সূরা কাসাস)
একশ্রেণীর লোক রয়েছে যারা নিজেদেরকে প্রকৃতি প্রেমিক বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। এরা বিশ্বপ্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যরাশি অবলোকন করে মুগ্ধ হয়ে তার গুণ বর্ণনা করে থাকে। রাতের নির্জনতায় কৌমুদী স্নাত পুষ্প উদ্যানে সুধাকরের স্নিগ্ধ সৌরভে মন-প্রাণ আমোদিত হয়ে ওঠে, সৌন্দর্য পিয়াসী মানুষ আবেগে উদ্বেলিত হয়ে সৌন্দর্যের স্রষ্টা আল্লাহর প্রশংসার পরিবর্তে চাঁদকেই সমস্ত সৌন্দর্যের আধার মনে করে তার গুণ-বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে থাকে। প্রখর সূর্য কিরণে পথ-প্রান্তর যখন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, উদ্ভিদরাজি শ্যামলিমা হারিয়ে হরিদ্রাভা ধারণ করে, নির্জীব ভূমি ফসল উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে মৃতপ্রায় হয়ে যায়, প্রচন্ড দাবদাহে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে, তখন হঠাৎ করেই আকাশ থেকে এক পশলা বৃষ্টি যদি নেমে আসে তখন অজ্ঞ মানুষ আল্লাহর প্রশংসা না করে বৃষ্টির প্রশংসা করতে থাকে। মায়াবী চাঁদের আলো নিয়ে প্রশংসামূলক অসংখ্য পংক্তি মালা রচনা করে। মেঘমালা আর প্রশান্তিদায়ক বৃষ্টির প্রশংসায় কবিতা রচনা করে থাকে। কিন্তু এদেরকে যদি প্রশ্ন করা হয়, এই চাঁদের আলোর স্রষ্টা কে? এই বৃষ্টি কে বর্ষালেন? এরা তখন বলতে বাধ্য হয়, এসবের পেছনে একজন মহাশক্তিধর স্রষ্টা আছেন। এ সমস্ত তথাকথিত প্রকৃতি প্রেমিকদের লক্ষ্য করেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مِّنْ نَّزَّلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ مِنْ بَعْدِ مَوْتِهَا لَيَقُولُنَّ اللَّهُ قُلِ الْحَمْدُ للهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ
আর যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, কে আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন এবং তার সাহায্যে মৃত পতিত ভূমিকে সঞ্জীবিত করেছেন, তাহলে তারা অবশ্যই বলবে আল্লাহ। বলো, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য কিন্তু অধিকাংশ লোক বোঝে না। (সূরা আল 'আনকাবুত-৬৩)
আল্লাহর সৃষ্টির অপরূপ সৌন্দর্য রাশি ও সৃষ্টির নিপুণতা দেখে, তাঁর অসংখ্য নিয়ামত ভোগ করে শুধু মুখে মুখে আল্লাহর প্রশংসামূলক বাণী উচ্চারিত করলেই হবে না, তাঁর সামনে দাসত্বের মস্তক অবনত করতে হবে। আল্লাহর প্রশংসা করার সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম হলো নামাজ আদায় করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
فَسُبْحَانَ اللهِ حِينَ تُمْسُونَ وَحِينَ تُصْبِحُونَ وَلَهُ الْحَمْدُ فِي السَّمَوتِ وَالْأَرْضِ وَعَشِيًّا وَ حِيْنَ تُظْهِرُونَ
সুতরাং, আল্লাহর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করো যখন তোমাদের সন্ধ্যা হয় এবং যখন তোমাদের প্রভাত হয়। আকাশসমূহে ও পৃথিবীতে তাঁর জন্যই প্রশংসা এবং (তাঁর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করো) তৃতীয় প্রহরে এবং যখন তোমাদের কাছে এসে যায় যোহরের সময়। (সূরা রুম)
কোরআনই বিজ্ঞানের উৎস
প্রসঙ্গক্রমে এখানে একটি কথা উল্লেখ করা একান্ত প্রয়োজন। তাহলো বর্তমান যুগকে অত্যাধুনিক যুগ বলে দাবি করা হয়। বিজ্ঞান দিয়েই সমস্ত কিছুর সত্যতা নির্ধারণ করা হয়। যে বিষয়টি বৈজ্ঞানিক গবেষণা-পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার মানদন্ডে উত্তীর্ণ হবে তাকেই একমাত্র ও চূড়ান্ত সত্য বলে গ্রহণ করার এক অযৌক্তিক মানসিকতা জড়বাদ আর বস্তুবাদী জীবন দর্শনের ওপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত এক শ্রেণীর লোকদের মধ্যে জন্মলাভ করেছে।
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কিতাব এই কোরআনই হলো বিজ্ঞানের মূল উৎস। বিজ্ঞানের নবতর আবিষ্কারের জন্য কিয়ামত পর্যন্ত বিজ্ঞান কোরআনের কাছে ভিক্ষার হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকবে। কোরআন যে কথা প্রায় পনের শত বছর পূর্বে পৃথিবীর মানুষের সামনে পেশ করেছে বিজ্ঞান সে কথাই নতুন করে পৃথিবীবাসীকে শোনাচ্ছে। বিজ্ঞান বলছে, জগৎ একটি নয় অসংখ্য জগৎ বিদ্যমান। অথচ বহুমাত্রিক জগতের ধারণা আল্লাহর কোরআন বহুপূর্বেই পৃথিবীবাসীকে দিয়েছে। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-উপগ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি এবং ব্লাকহোল ইত্যাদি সম্পর্কে বিজ্ঞান মাত্র কিছুদিন পূর্বে ধারণা দিয়েছে, পৃথিবী ব্যতীতও অন্য কোথাও প্রাণের উৎস থাকতে পারে এ ধারণা আল্লাহর কোরআন বহুপূর্বেই দিয়েছে।
সুতরাং, আল্লাহর কোরআনের সত্যতা বিজ্ঞান প্রমাণ করবে না, বিজ্ঞানের সত্যতাই আল্লাহর কোরআন প্রমাণ করবে। একটি মাত্র কোষ থেকে মানুষ সৃষ্টি লাভ করেছে। আলো, তাপ, বাতাস ব্যতীত উদ্ভিদ বীজের অঙ্কুরোদগম ঘটে না, ফুলের পরাগায়ন পদ্ধতি, মৌমাছীর কলা-কৌশল, মরুজাহাজ উটের পানি ধারণ ক্ষমতা, মাতৃগর্ভে ভ্রূণের বিকাশ সাধন, সৃষ্টির সমতা, প্রতিটি গ্রহের আবর্তন-বিবর্তন, যার যার কক্ষপথে পরিভ্রমণ ইত্যাদি সম্পর্কে বিজ্ঞান স্বল্প কিছুদিন পূর্বে ধারণা পেশ করেছে। আর এসব তথ্য আল্লাহর কোরআন সপ্তম শতাব্দীতেই মানুষকে অবহিত করেছে এবং এসব বিষয় নিয়ে গবেষণা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে। অতএব বিজ্ঞানের আবিষ্কার যত বৃদ্ধি লাভ করবে ততই বিজ্ঞান কোরআনের কাছে ঋণের জালে বন্দী হবে।
0 Comments