আল্লাহর গোলামী ও নামায

        প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামায একজন মানুষকে এ কথা পাঁচবার স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সে ব্যক্তি মহান আল্লাহর গোলাম এবং তাকে মহান আল্লাহর আদেশ অনুসারে জীবন-যাপন করতে হবে। শুধু মাত্র নামাযের সময়ই মানুষ আল্লাহর গোলাম নয়- নামাযের বাইরের জীবনেও সে আল্লাহর গোলাম, এ কথাটিই নামায মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلوةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

        তারপর নামায যখন সম্পূর্ণ হয়ে যায় তখন পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো আর আল্লাহকে খুব বেশী পরিমাণে স্মরণ করতে থাকো। সম্ভবত তোমরা সাফল্য লাভ করতে পারবে। (সূরা জুম'আ-১০)

        আল্লাহ তা'য়ালার একনিষ্ঠ গোলাম হওয়ার জন্য এবং একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদাত করার জন্য যেসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য অর্জন করা অপরিহার্য, নামায সেসব অপরিহার্য গুণ-বৈশিষ্ট্য কিভাবে মানুষের ভেতরে সৃষ্টি করে দেয়, তা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। উল্লেখিত আয়াতে এ কথা বলা হয়েছে যে, নামায আদায় হয়ে গেলে নামাযের স্থানে নীরবে বসে না থেকে পৃথিবীতে জীবন ধারনের উপকরণ যোগাড় করার জন্য কর্মক্ষেত্রে যাও এবং নিজের মনিব আল্লাহ তা'য়ালাকে বেশী বেশী স্মরণ করতে থাকো, তাহলে তোমরা সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হবে তথা নিজেকে মালিকের অনুগত গোলাম হিসাবে গড়তে সক্ষম হবে।

        নামায আদায় করার জন্য যখন একজন মানুষ দন্ডায়মান হয়, তখন তার মনে এ কথা স্মরণে রাখতে হবে যে, সে গোটা সৃষ্টি জগতের স্রষ্টা ও প্রতিপালক মহাশক্তিধর আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়েছে এবং তাঁর উদ্দেশ্যে সে সিজদা নিবেদন করছে। যা কিছুই সে মুখে আবৃত্তি করছে, তা সবই মহান মালিকের উদ্দেশ্যে। নামাযে সে উঠা-বসা, রুকু-সিজদা দেয়া ইত্যাদি যা করছে, তার সবটাই মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে।

        অর্থাৎ নামাযের মধ্যে সে সময়ের প্রত্যেক মুহূর্তে আল্লাহকেই স্মরণে রাখছে। এভাবে নামায মানুষকে এ কথাই জানিয়ে দিলো যে, সে নামাযের মধ্যে যেমন আল্লাহকে স্মরণ করেছে, অনুরূপভাবে নামাযের বাইরের জীবনে প্রত্যেক মুহূর্তে শত ব্যস্ততার মধ্যেও আল্লাহর কথা স্মরণ রাখবে। মানুষকে তার মনিব মহান আল্লাহর গোলামী থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য শয়তান ও তার অনুচরবৃন্দ সক্রিয় রয়েছে, অনুরূপভাবে মানুষের মনের মধ্যে যে কুপ্রবৃত্তি নামক শয়তান রয়েছে, সে শয়তানও মানুষকে তার আপন স্রষ্টা আল্লাহর দাসত্ব থেকে দূরে নিক্ষেপ করার জন্য সক্রিয় রয়েছে।

        সময়ের প্রত্যেক মুহূর্তে শয়তানি শক্তি মানুষকে তার মনিব আল্লাহর দাসত্বের পথ থেকে বিচ্যুত করার লক্ষ্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করে চেষ্টা-সাধনা করে যাচ্ছে। শয়তানের এই সমস্ত চেষ্টা-প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেয়ার লক্ষ্যে আল্লাহ তা'য়ালা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায মানুষের প্রতি ফরজ করে দিয়েছেন।

        অর্থাৎ নামায এ কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, 'শয়তান তোমাকে প্ররোচনা দিচ্ছে তোমার মালিক আল্লাহ তা'য়ালার অপছন্দনীয় কাজ করার জন্য, কিন্তু তুমি এ কথা স্মরণে রাখো যে, তুমি একমাত্র আল্লাহর গোলাম। তাঁর অপছন্দের কোনো কাজে তুমি নিজেকে জড়িত করবে না।'

        একজন মানুষ গোটা রাত ব্যাপী নিদ্রা মগ্ন রইলো, প্রত্যুষে নিদ্রা ভঙ্গ হতেই দিনের শুরুতে সমস্ত কাজের পূর্বে ফজরের নামায তাকে স্মরণ করিয়ে দিলো, 'তুমি আল্লাহর গোলাম।' দিনের আলোয় মানুষ যখন নানা ধরনের কাজে ব্যস্ত থাকে, কাজের ঝামেলায় মন-মানসিকতা বিষিয়ে ওঠে। শত ব্যস্ততার মধ্যেও যোহর, আসর ও মাগরিবের নামায মানুষকে আল্লাহর গোলামীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

        এরপর গোটা দিনের কর্মক্লান্ত শরীর বিশ্রাম পিয়াসী হয়ে ওঠে। নিরবচ্ছিন্ন নিদ্রার কোলে দেহ এলিয়ে পড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। তখনও ইশার নামায মানুষকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, তুমি মহান আল্লাহর গোলাম। এভাবে নামাযই মানুষকে এ কথা বার বার আল্লাহর গোলামীর কথা স্মরণ করাতে থাকে এবং এই পদ্ধতিতেই একজন মানুষকে নামায আল্লাহর ইবাদাতের যোগ্য করে গড়ে তোলে। এ কারণেই পবিত্র কোরআনে সূরা জুমআ'র নামাযকে যিকর নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

        মহান আল্লাহ তা'য়ালা হলেন মনিব আর মানুষ হলো তাঁর গোলাম, গোলামকে মনিবের আদেশ পালন করতে হবে- এই দায়িত্বানুভূতি নামায মানুষের ভেতরে সৃষ্টি করে। প্রত্যেকটি কাজের জন্যই প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়, প্রশিক্ষণ ব্যতীত কোনো কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। বৈদেশিক শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা ও অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য প্রত্যেক দেশেরই নানা ধরনের বাহিনী রয়েছে। এসব বাহিনীকে যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ না দিলে তারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে কেউ যদি অনিচ্ছুক হয় বা প্রশিক্ষণ গ্রহণে অবহেলা প্রদর্শন করে, তাহলে তার পক্ষে দায়িত্ব পালন করা কেনোক্রমেই সম্ভব হবে না।

        অনুরূপভাবে নামায হলো একজন মানুষের জন্য প্রশিক্ষণ বিশেষ। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একজন মানুষকে আল্লাহর আইন-বিধান মেনে চলার উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। নামাযের মাধ্যমে কেউ যদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে অস্বীকার করে বা অবহেলা প্রদর্শন করে, তাহলে তার পক্ষে মহান আল্লাহর গোলাম হওয়া কোনোক্রমেই সম্ভব নয়।

        এ জন্যই হাদীসে নামায আদায় করাকে কুফর ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্যের প্রধান চিহ্ন হিসাবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে এবং এভাবে সাবধান বাণী উচ্চারণ করা হয়েছে- যে ব্যক্তি নামায ছেড়ে দেয় সে ব্যক্তি মুসলমানই নয়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পরে কয়েক যুগব্যাপী এ সত্যই প্রতিষ্ঠিত ছিলো যে, যারা নামায আদায় করে না অথচ নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দেবে- এমন কথা কল্পনাও করা যেতো না।

        শুধু তাই নয়, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে আযান শোনার পরে যারা মসজিদে নামাযের জামাআতে শামিল হতো না, তাদেরকে মুসলমান হিসাবে গণ্য করা হতো না। স্বার্থের কারণে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলো, ঐসব মুনাফিকের দলও আযান শোনার পরে মসজিদে নামাযের 'জামাআতে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হতো। কারণ তাদের মধ্যে এই চেতনা জাগ্রত ছিলো যে, মসজিদে এসে নামায আদায় না করলে মুসলমানদের দলে অবস্থান করা যাবে না।

        মহাগ্রন্থ আল কোরআনে রাসূলের যুগের মুনাফিকদের নানা ধরনের খারাপ গুণের কথা আলোচিত হয়েছে। এসব আলোচনা একত্রিত করলে এমন একটি আয়াতও পাওয়া যাবে না, যে আয়াতে বলা হয়েছে- মুনাফিকরা নামায পড়ে না। বরং এ কথা বলা হয়েছে যে, তারা নামায পড়ে বটে কিন্তু মনোযোগ দিয়ে নামায আদায় করে না। মুসলমানদের দলে শামিল থেকে স্বার্থোদ্ধার করার জন্য একান্ত অনিচ্ছা ও অবহেলার সাথে নামায পড়ে। নামায পড়বে না- অথচ বর্তমান যুগের ন্যায় বেনামাযীকে মুসলমান বলা হবে, এমন কথা সে যুগে কারো চিন্তার জগতেও আশ্রয় পেতো না।

        একজন মানুষের চব্বিশ ঘন্টার জীবনে নিজেকে অসংখ্য কাজের সাথে জড়িত হতে হয় এবং নানাবিধ আচরণ করতে হয়। এই নানাবিধ আচরণ ও অসংখ্য কাজ তাকে করতে হবে মহান আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে। সুতরাং আল্লাহর নির্দেশ পালন করার প্রশিক্ষণ না থাকলে কোনো মানুষের পক্ষে চব্বিশ ঘন্টার জীবনে আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করা কিছুতেই সম্ভব হতে পারে না। চব্বিশ ঘন্টার জীবনে কোনো মানুষ যদি মাত্র পাঁচবার আল্লাহর আদেশে নামাযই আদায় না করে, তাহলে তার পক্ষে কি করে মহান আল্লাহর অন্যান্য আদেশ পালন করা সম্ভব? 

        এজন্যই একজন মানুষের চব্বিশ ঘন্টার জীবনে পাঁচবার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যেনো তার ভেতরে আল্লাহ তা'য়ালার অন্যান্য আদেশ-নিষেধ পালন করার অভ্যাস গড়ে ওঠে। একনিষ্ঠভাবে যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করে, সেই ব্যক্তি আল্লাহর অন্যান্য আদেশ-নিষেধও একনিষ্ঠভাবে পালন করার জন্য তৎপর হবে। আর আযান শোনার পরে যে ব্যক্তি নামাজের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ না করে, তাহলে এ কথাই প্রমাণিত হবে যে, ঐ ব্যক্তি আল্লাহ তা'য়ালাকে নিজের মনিব হিসাবে মানে না, নিজেকে সে আল্লাহর দাস হিসাবে গড়তে ইচ্ছুক নয় এবং আল্লাহর দাসত্ব করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

Post a Comment

0 Comments