তাবুক অভিযান



        আরব দেশকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার অভিলাষ রোমকদের বহু দিনের। বিশেষ করে উদিয়মান মুসলিম শক্তিকে রোমের খৃষ্টানরা ভয়ের চোখেই দেখছিল। গোটা আরব যখন ইসলামের ছায়াতলে এসে গেল, তখন রোমের খৃষ্টান শাসক বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের ওপরে আধিপত্য বিস্তারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। ইয়াহুদীরাও তাকে আরবের ওপরে আক্রমন করে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার লক্ষ্যে উস্কানী দিয়ে যাচ্ছিল। তারপর মৃতার যুদ্ধে তাদের শোচনীয় পরাজয় তাদেরকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। এ জন্য প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে রোমের সম্রাট হোরাক্লিয়াস মুসলমানদের বিরুদ্ধে লক্ষাধিক সৈন্য প্রেরণ করেছিল। মদীনা এবং সিরিয়ার মাঝখানে তাবুক প্রান্তর অবস্থিত। সিরিয়ায় সে সময় গাচ্ছানী বংশ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। তারা ছিল রোমকদের আশ্রিত। রোম সম্রাট এদেরকেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাজে লাগালো। সিরিয়ার নাবতী বংশের লোকজন মদীনায় যয়তুন তেলের ব্যবসা করতো। তারা এসে মদীনায় জানিয়েছিল, 'রোম সম্রাট এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মুসলমানদের ওপরে আক্রমন করার জন্য যাত্রা করেছে। আরবের খৃষ্টান গোত্রসমূহ তাদের সাথে যোগ দিয়েছে। তাদের বাহিনীর প্রথম ভাগ বলকা নামক স্থান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।'

         রোমকদের যুদ্ধ যাত্রার এত উৎসাহের পেছনে খৃষ্টানদের একটা ভিত্তিহীন সংবাদ ক্রিয়াশীল ছিল। আরবের খৃষ্টান নেতৃবৃন্দ রোমের সম্রাট হোরাক্লিয়াসের কাছে একটা মিথ্যা সংবাদ দিয়ে পত্র প্রেরণ করেছিল। তারা লিখেছিল, 'আরবের নবী মুহাম্মাদ ইন্তেকাল করেছে। গোটা আরবের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে ফলে প্রতিদিন মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করছে। আরব জয় করার এখনই উপযুক্ত সময়।' আল্লাহর নবী বাধ্য হয়েই তাদেরকে মোকাবেলা করার লক্ষ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। ত্রিশ হাজার পদাতিক সৈন্য ও দশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য যোগাড় হলো। এদের ভেতরে দশ হাজার ছিল অশ্বারোহী। তাবুকের এই যুদ্ধ ছিল আরবের এক চরম দুঃসময়ে। গরমের অবস্থা এমন ছিল যে, গোটা আরব যেন আগুনে ঝলসিত হচ্ছিল। দেশেও চলছিল অভাব অনটন। মানুষের জন্য নিজের ঘর বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাত্রা করা ছিল এক কঠিন বিষয়। গাছের খেজুর কাটা সবেমাত্র শুরু হবে। এখনই খেজুর না কাটলে তা নষ্ট হয়ে যাবে। আরবের প্রধান অর্থকরী ফসল হলো খেজুর। এমনিতেই অভাব বিরাজ করছিল, তারপরে যদি খেজুর কেটে ঘরে উঠানো না যায়, তাহলে গোটা বছর অনাহারে কাটাতে হবে। এই অবস্থায় যুদ্ধে গমন করার প্রশ্নই ওঠে না।

        তবুও সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে আল্লাহর নবীর আহ্বানে যুদ্ধে বের হয়ে পড়লেন। এই যুদ্ধ ছিল ইসলামী রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ। সুতরাং আল্লাহর নবী আরবের সমস্ত মুসলমান এবং মিত্র গোত্রের ভেতরে ঘোষনা করে দিলেন যে, যার যতটুকু ক্ষমতা আছে, সে যেন তাই দিয়ে সাহায্য করে। যুদ্ধ তহবিল খোলা হলো। গোটা আরব থেকে প্রচুর সাহায্য এলো। মদীনার আনসাররা অবারিত হস্তে যুদ্ধ তহবিলে দান করলেন। তাদের মহিলাগণ হাতের চুড়ি, কণ্ঠহার, জমানো অর্থ দান করলেন।

        হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বনবী বসেছিলেন আর মদীনার মানুষ তাঁর সামনে নগদ অর্থ ও অলংকার দান করছিলেন। তাঁর সামনে অর্থ এবং অলংকার এতটা উচ্চতা লাভ করেছিল যে, আল্লাহর নবী অর্থ ও অলংকারের স্তূপের আড়াল হয়ে পড়েছিলেন।

        হিজরী নবম সালের রজব মাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাবুকের দিকে অগ্রসর হলেন। ত্রিশ হাজার পদাতিক আর দশ হাজার অশ্বারোহীর বিশাল এক বাহিনী আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে এগিয়ে চললো। ইতোপূর্বে মুসলমানগণ এতবড় বিশাল বাহিনী নিয়ে আর অগ্রসর হতে পারেনি। বিপদ সঙ্কুল পথ অতিক্রম করে এই বিশাল বাহিনী যখন তাবুকের প্রান্তরে পৌঁছলো, তখন খৃষ্টানদের বিস্ময়ে হতবাক হবার পালা। কারণ তাদেরকে আরবের খৃষ্টানরা সংবাদ প্রেরণ করেছিল, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম জীবিত নেই এবং মুসলমানদের যুদ্ধ করার বর্তমানে কোন ক্ষমতা নেই। এখানে স্বয়ং মুহাম্মাদকে বিশাল এক বাহিনীসহ উপস্থিত হতে দেখে তাদের যুদ্ধ করার বাসনা বাতাসের সাথে 'মিশে গেল।

        মুসলমানদের বাহিনী একের পরে এক আসছেই। এই বাহিনীর যেন শেষ নেই। খৃষ্টানরা মুসলমানদের দুর্বল ভেবে আক্রমনের পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু মুসলমানরা দুর্বল কোথায়? তারা সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শত শত মাইল দুর্গম পথ অতিক্রম করে যুদ্ধ করতে উপস্থিত হয়েছে। এদের ৩১৩ জন যোদ্ধার সাথে যুদ্ধ করে কুরাইশরা শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছে। মৃতার প্রান্তরে মাত্র ৩০০০ সৈন্য তাদের ত্রিশ হাজার সৈন্যকে পর্যদুস্ত করেছে। আর আজ স্বয়ং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সেনাপতি হিসাবে জগণিত বাহিনী নিয়ে উপস্থিত। মুহাম্মাদ ইশারা করা মাত্র এই বাহিনী প্রাণ দান করবে নতুবা বিজয় অর্জন করবে। সুতরাং কোন ক্রমেই এদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া যাবে না।

        রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে মুসলিম বাহিনী সম্পর্কে বিস্তারিত সংবাদ পৌঁছে গেল। ভয়ে সে এবং তার বাহিনী সিরিয়া ত্যাগ করে হিমসে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। তাবুকের আশে পাশের খৃষ্টান শাসকগণ ভয়ে প্রাণহীনের মত হয়ে পড়েছিল। বিশ্বনবী তাদেরকে কিছুই বললেন না। তাদেরকে কোন কিছুই বলতে হলো না। স্বয়ং তারাই দলে দলে এসে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। আর যারা নিজের ধর্মের ওপরে বহাল থাকলো, তারা আল্লাহর নবীর সাথে সন্ধিতে আবদ্ধ হলো। সন্ধির শর্তে উল্লেখ করা হলো, তারা সব ধরণের স্বাধীনতা ভোগ করবে। শুধুমাত্র বছরে সামান্য কর দান করবে।

Post a Comment

0 Comments