নবী করীম (সা:) এর জীবনে কখন মিরাজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল এ সম্পর্কে ইতিহাসে মত পার্থক্য লক্ষ্য করা য়ায়। মদীনায় হিজরতের পূর্বে মক্কায় মিরাজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল এ সম্পর্কে মতপার্থক্য নেই। সে সময় নির্দিষ্ট কোনো বছর বা সনের প্রচলন ছিল না বিধায় কোন্ মাসের কোন্ তারিখে মিরাজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা নিয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। তবে কুরআন ও হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী মিরাজ রাতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মাস সম্পর্কে কেউ বলেছেন রমজান মাসের ১৭ তারিখ, কেউ বলেছেন রবিউল আউয়াল, আবার কেউ বলেছেন রজব মাসের ২৭ তারিখ বা শাওয়াল মাসে।
বছর সম্পর্কে বলা হয়েছে হিজরতের তিন বছর পূর্বে। হযরত আবু তালিব এবং হযরত খাদিজা (রা:) এর ইন্তেকালের পরে যে মিরাজ হয়েছিল এ কথার সমর্থন পাওয়া যায় হযরত আয়িশা (রা:) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীসে। তিনি বলেছেন 'পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হবার পূর্বেই হজরত খাদিজা (রা:) ইন্তেকাল করেছিলেন এবং হিজরতের তিন বছর পূর্বে মিরাজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল'।
হাদীস ও সিরাতের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে এটা বুঝা যায়, হিজরতের এক বছর পূর্বে মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল। এ ধরণের আরো কিছু বর্ণনা থেকে জানা যায় হিজরতের পূর্বেই মিরাজ হয়েছিল। আর এই সময় মিরাজ হওয়াও ছিল সময়ের দাবী। কারণ আর মাত্র এক বছর বাকী ছিল ইসলামকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার। রাষ্ট্র প্রধানের কি দায়িত্ব এবং কর্তব্য তা নবী করীম (সা:) কে শিক্ষা দেয়ার প্রয়োজন ছিল। ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার মত লোক মক্কাতেই নানা ঘাত- প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রস্তুত হচ্ছিল। নবী করীম (সা:) জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সাড়ে বারো লক্ষ বর্গ মাইল এলাকা ব্যাপী বিস্তৃত একটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ছিলেন।
হিজরতের পরপরই তাঁর জীবন ধারায় মহান আল্লাহ তা'য়ালার পক্ষ থেকে বিরাট পরিবর্তন আসবে, দীর্ঘ তেরো বছর ধরে তিনি নির্মম নির্যাতন সহ্য করেছেন, তাঁর চোখের সামনে তাঁরই প্রাণ প্রিয় সাহাবায়ে কেরাম নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতিত হয়েছে, প্রতিকার করতে পারেননি, এ সবের অবসান ঘটবে এবং এবার আঘাত এলে প্রতিঘাত করা হবে, বিশাল একটি রাষ্ট্রের যে রাষ্ট্রে নানা রঙের, বর্ণের, ভাষার, ধর্মের, জাতির লোক বাস করবে, এমন একটি রাষ্ট্রের খুটিনাটি আইন-কানুনের প্রয়োজন। এ সকল দিক সামনে রেখেই তাঁর মিরাজ যথা সময়েই মহান আল্লাহ সংঘটিত করেছিলেন। বিশাল সে রাষ্ট্রের মূলনীতি কি কি, মহান আল্লাহ তাঁকে জানিয়ে দিলেন।
নবী করীম (সা:) এবং মুসলমানগণ যে চরম সমস্যার মুকাবিলা করছিলেন এবং সে সমস্যা অচিরেই দূরীভূত হয়ে সৌভাগ্য- শশী উদিত হবে, তারই শুভ ইঙ্গিত ছিল পবিত্র মিরাজ। হিজরতের পর হতে সার্বিক কল্যাণ, শান্তি ও নিরাপত্তার এক নতুন পৃথিবীর দ্বার উদ্ঘাটন হবে, ঠিক সে সময়েই এমন এক মহিমান্বিত রাতের আগমন ঘটলো, যে রাত ছিল মহান আরশে আজীমে পৌঁছার গৌরবময় রাত। এ রাতে মহান আল্লাহ পৃথিবীতে যত কার্যকরী উপাদান রয়েছে সে সব উপাদানসমূহকে নির্দেশ দিলেন, আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় নিয়ম পদ্ধতি যেন পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় থাকে। জান্নাতের দ্বাররক্ষীকে আদেশ করা হলো, সম্মানিত মেহমান আগমন করবেন, সকল কিছুই নবসাজে সজ্জিত করা হোক। যে পথে মেহমান আগমন করবেন এবং যে সকল এলাকা পরিদর্শন করবেন, সে পথসমূহ এবং এলাকাসমূহ সজ্জিত করা হোক। হযরত জিবরাঈল (আ:) কে আদেশ করা হলো, দ্রুতগামী যা কিছু সৃষ্টি করা হয়েছে তার তুলনায়ও অধিক দ্রুতগামী বাহন মেহমানের জন্য প্রস্তুত করে যথাস্থানে প্রস্তুত রাখা হোক।
মহামান্য অতিথিকে স্বাগত জানানোর জন্য উর্ধ্ব জগতের সকল কিছু প্রস্তুত হয়ে গেল। যাত্রা পথে জান্নাতি সুরের তরঙ্গ সৃষ্টি করা হলো। সর্বত্র জান্নাতের আনন্দ সমিরণ প্রবাহিত হতে থাকলো। মানুষ যে জগতের স্পর্শ সহ্য করতে সক্ষম সে শক্তি নবী করীম (সা:) কে দান করার জন্য হযরত জিবরাঈল (আ:) মর্ত্যধামে পবিত্র মক্কায় উপস্থিত হলেন। বুখারী, মুসলিম হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে, হযরত আবুজার (রা:) বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা:) যে গৃহে অবস্থান করছিলেন সে গৃহের ওপরের আবরণ উন্মুক্ত করা হলো। জিবরাঈল (আ:) প্রবেশ করে রাসূল (সা:) এর বক্ষ বিদীর্ণ করলেন। প্রয়োজনীয় কাজ সমাপ্ত করে তাঁর বুকের ভেতরে পবিত্র জমজমের পানি দিয়ে পরিষ্কার করলেন। তারপর বিশ্বাস এবং যাবতীয় জ্ঞান তাঁর ভেতরে প্রবেশ করানো হলো। এরপর নেয়া হলো মাসজিদুল আকসায় এবং সেখান থেকে হযরত জিবরাঈল (আ:) তাঁকে নিয়ে প্রথম আকাশে এসে দ্বার রক্ষককে বললেন, 'দ্বার উন্মুক্ত করো'।
রক্ষী জানতে চাইলেন, 'কে?' জিবরাঈল (আ:) নিজের পরিচয় দিলেন। তাঁকে আবার প্রশ্ন করা হলো, 'আপনার সাথীর পরিচয় দিন?' উত্তর দেয়া হলো, 'আমার সাথী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা:)'।
এভাবে বিশ্বনবী (সা:)-এর পরিচয় জানার পরে দ্বার উন্মুক্ত করা হলো। এরপর তাঁকে নিয়ে জিবরাঈল (আ:) প্রথম আকাশে আরোহণ করলেন। সেখানে তিনি একজন মানুষকে বসে থাকতে দেখলেন, তাঁর দক্ষিণ পাশে একদল মানুষ এবং তিনি তাদেরকে দেখে হাসেন এবং তাঁর বাম পাশে একদল মানুষ তিনি তাদেরকে দেখে কাঁদেন। রাসূল (সা:) কে দেখে তিনি বললেন, 'হে মর্যাদাবান সন্তান! সম্মানিত নবী! স্বাগতম!'
নবী করীম (সা:) সঙ্গীকে সে ব্যক্তির পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন, সঙ্গী তাঁকে জানালো তিনি হযরত আদম (আ:)। তাঁর ডানদিকে যাদেরকে দেখলেন তাঁরা জান্নাতি আর বামদিকে যাদেরকে দেখলেন তারা জাহান্নামী। এ কারণে তিনি ডানদিকে তাকিয়ে হাসেন আর বাম দিকে তাকিয়ে কাঁদেন। এরপর তাঁকে দ্বিতীয় আকাশে আরোহণ করানো হলো। সেখানেও তাঁর সাথে নবীদের সাক্ষাৎ ঘটলো। এভাবে একটির পরে আরেকটি আকাশ পার হয়ে তিনি ষষ্ঠ আকাশে কতক নবীদের সাক্ষাৎ পেলেন। সকল নবী-রাসূল তাঁকে স্বাগত জানালেন। এরপর আকাশের সকল স্তর অতিক্রম করে জিবরাঈল (আ:) তাকে আল্লাহর আরশে আজীমের কাছে পৌঁছে দিলেন। মহান আল্লাহর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় উপহার নিয়ে তিনি নিচের দিকে এলেন।
নবী করীম (সা:) তাঁর উম্মতের জন্য দিনে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজসহ ফিরছিলেন। হযরত মূসা (আ:) এর সাথে সাক্ষাৎ ঘটলে তিনি জানতে চাইলেন, 'আপনার উম্মতের জন্য কি উপহার দেয়া হলো?' তিনি জানালেন নামাজের কথা। মূসা (আ:) বললেন, 'আপনি আল্লাহর কাছে ফিরে যান, আপনার উম্মত পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে পারবে না'।
নবী করীম (সা:) আল্লাহর কাছে ফিরে গিয়ে আবেদন জানালেন, মহান আল্লাহ অনুগ্রহ করে নামাজ কমিয়ে দিলেন। মূসা (আ:) তাঁকে পরামর্শ দিলেন, 'আপনার উম্মত নামাজের এই সংখ্যাও আদায় করতে পারবে না। আপনি ফিরে গিয়ে আরও কমিয়ে আনুন'। এ ধরনের ঘটনা কয়েকবার ঘটলো। শেষে যখন মাত্র পাঁচ ওয়াক্ত অবশিষ্ট রইলো তখন মহান আল্লাহ জানালেন, আমার আদেশের পরিবর্তন হয় না। এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করলেই পঞ্চাশ ওয়াক্তের সওয়াব দেয়া হবে। এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও মূসা (আ:) পরামর্শ দিলেন কমিয়ে আনার জন্য। নবী করীম (সা:) তাঁকে জানালেন, 'আল্লাহ তা'য়ালাকে এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কমিয়ে দেয়ার কথা বলতে আমি ভীষণ লজ্জা অনুভব করছি'।
এবার তাঁকে সুসজ্জিত সিদরাতুল মুনতাহা পরিদর্শন করানো হলো। জান্নাত দেখানো হলো, জান্নাতে মোতির তৈরী প্রাসাদসমূহ দেখলেন এবং সেখানের মাটি ছিল মিল্ক দিয়ে নির্মাণ করা।
একটি বিষয় উল্লেখ করা আবশ্যক যে, মিরাজের পূর্ণাঙ্গ ঘটনা কোনো একটি হাদীসেও উল্লেখ করা হয়নি। অনেকগুলো হাদীস একত্রিত করলে তারপর সম্পূর্ণ ঘটনা একত্রিত করা যায়। এর কারণ হলো, বর্ণনাকারীদের ভেতরে যিনি ঘটনার যতটুকু শুনেছেন ততটুকুই বর্ণনা করেছেন। কোনো বর্ণনায় আছে, নবী করীম (সা:) কা'বাঘরের হাতিম এলাকায় ঘুমিয়ে ছিলেন। কুরাইশরা যখন কা'বা মেরামত করেছিল সে সময় তারা অর্থের অভাবে একটি অংশ বাদ রেখে কা'বার পুনঃনির্মাণ করেছিল। ঐ বাদ দেয়া অংশকেই হাতিম বলে। বর্তমানেও সে অংশ রয়েছে। এখানেই তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। আরেক বর্ণনায় রয়েছে, তিনি হযরত উম্মে হানি (রা:) এর ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন।
হজরত জিবরাঈল (আঃ) নবী করীম (সা:) কে ঘুম থেকে জাগিয়ে তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করলেন। তারপর প্রয়োজনীয় কাজ সেরে তাঁকে একটি অদ্ভুত দর্শন পশুর ওপরে আরোহণ করালেন। পশুটি ছিল গাধা এবং ঘোড়ার আকৃতির মাঝামাঝি এবং দু'পাখা বিশিষ্ট। যার নাম বর্ণনা করা হয়েছে বুরাক। আরবী বুরাক শব্দ বারকুন শব্দ থেকে এসেছে। এ শব্দের অর্থ হলো, বিদ্যুৎ। এই পশুটির রং ছিল সাদা। হযরত জিবরাঈল (আ:) এর ইশারায় উক্ত বুরাক মুহূর্তের মধ্যে বাইতুল মাকদিসে এসে উপনীত হলো। সেখানে বিশ্বনবী (সা:) অসংখ্য নবী-রাসূল ও ফেরেশতা দেখলেন, সন, তাঁরা তাঁকে স্বাগত জানালেন। তিনি তাদের সাথে কুশল বিনিময়ের পরে তাঁরা সকলেই নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন। ইমামের স্থান ছিল শূন্য, বিশ্বনবীকে সেখানে এগিয়ে দেয়া হলো। এভাবে সকল নবী-রাসূল এবং ফেরেশেতাগণ বিশ্বনবীর নেতৃত্বে নামাজ আদায় করলেন।
আরেক বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে, বাইতুল মাকদিসে নামাজ আদায় করা হয়েছিল মিরাজ থেকে প্রত্যাবর্তনের সময়। উর্ধ্ব জগতে যাবার সময় বাইতুল মাকদিসে তাঁর সামনে দু'টো পানীয় পূর্ণ পাত্র উপস্থিত করা হলো। একপাত্রে ছিল শরাব অন্যটিতে দুধ। নবী করীম (সা:) দুধের পাত্র উঠিয়ে পান করলেন। হযরত জিবরাইল (আ:) বললেন, 'হে আল্লাহর রাসূল! উন্নত চরিত্র আপনার মধ্যে বিদ্যমান। আপনার উম্মতের মধ্যেও এমন হবে। শরাব আপনার জন্য নিষিদ্ধ'।
আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাঁকে উর্ধ্ব জগতে উঠানো হয়। আকাশের বিভিন্ন স্তরে সম্মানিত নবী-রাসূলদের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। এরপর তাঁকে উপস্থিত করা হয় সিদরাতুল মুনতাহায়। এখানে পৌঁছার পরে হযরত জিবরাইল (আ:) তাঁকে বিনীতভাবে অবগত করেন, 'আমাদের জন্যে এই সীমা অতিক্রম করার অনুমতি নেই'।
প্রমাণ হয়ে গেল যেখানে হযরত জিবরাঈল (আ:) যেতে পারেন না, সেখানে নবী করীম (সা:) এর অবাধ পদচারণা। তারপর তিনি বাইতুল মামুরে পৌঁছলেন। এই বাইতুল মামুর হলো কা'বার মৌলিক ভবন। এখান থেকে তাঁকে মহান আল্লাহ নিজের সান্নিধ্যে ডেকে নেন। তিনি মহান আল্লাহকে দেখেছিলেন কিনা এ সম্পর্কে আলোচনা না করাই উত্তম। তাঁর দেখা না দেখার সাথে পৃথিবীর মানুষের জীবনের কোনো সমস্যা জড়িত নয়। সুতরাং বিষয়টি নিয়ে কল্পকাহিনী রচনা করা বা তা নিয়ে মস্তিষ্ক উত্তপ্ত করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ব্যাপার। আল্লাহ তা'য়ালা পবিত্র কুরআনে নিজের সম্পর্কে ঘোষণা করেছেন, 'কোনো মানব চক্ষু আমাকে দেখতে পারে না'। নবী করীম (সা:) ও মহান আল্লাহর ঘোষণা অনুযায়ী মানুষ ছিলেন, তবে তিনি আমাদের মতো মানুষ ছিলেন না। তিনি ছিলেন মহান মালিক আল্লাহ তা'য়ালার বিশেষ সৃষ্টি মহামানব। আল্লাহ তা'য়ালার ঘোষণা তাঁর জন্যেও প্রযোজ্য।
এরপর জান্নাত- জাহান্নাম এবং মহান আল্লাহর নানা কুদরত তাঁকে পরিদর্শন করানো হলো। সৎ কর্মের কি পুরস্কার এবং আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করলে কি ধরনের শাস্তি ভোগ করতে হবে তা দেখানো হলো। মহান আল্লাহ যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে তাঁকে নিজের সান্নিধ্যে আহ্বান করেছিলেন তা পূর্ণ হবার পরে তাঁকে পুনরায় এই পৃথিবীতে প্রেরণ করা হলো। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে কতটুকু সময়ের প্রয়োজন হয়েছিল তা মহান আল্লাহই অবগত আছেন। তবে বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখা যায়, রাতের কিছু অংশে তা সংঘটিত হয়েছিল। অনেকের কাছে বিষয়টি বোধগম্য নয়, রাতের সামান্য অংশে এতকিছু পরিদর্শন করা কি করে সম্ভব?
নবী করীম (সা:) কে মিরাজে নেয়ার সময় যদি পৃথিবীর গতি হরণ করা হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই এটা সম্ভব। একটি ঘড়িকে যদি রাত বারোটার সময় বন্ধ করে রাত চারটায় পুনরায় চালু করা হয়, তাহলে ঘড়ির কাঁটা ঐ রাত বারোটার স্থান থেকেই ঘুরতে থাকবে, রাত চারটার স্থান থেকে ঘুরবে না। তিনি যদি রাত একটার সময় যাত্রা আরম্ভ করে থাকেন আর সে সময়েই যদি সকল সৃষ্টির গতি মহান আল্লাহ বন্ধ করে দিয়ে থাকেন, তাহলে পৃথিবীর সময় তো স্থির হয়েছিল। সময় সামনের দিকে এগিয়ে যায়নি। তিনি যখন পৃথিবীতে পদার্পণ করেছেন তখন পুনরায় পৃথিবীকে গতিদান করা হয়েছে, স্থির সময় পুনরায় সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছে। বিষয়টি যদি এমনই হয়ে থাকে তাহলে অবাক হবার কিছুই নেই। সে সময়ে কি ঘটেছিল মহান আল্লাহ তা'য়ালাই ভালো জানেন।
আজ থেকে শতকোটি বছর পূর্বে মহাকাশে, সাগরের অতল তলদেশে তথা পৃথিবীর কোথায় কি ঘটেছিল, গবেষণায় তা উদ্ঘাটন হচ্ছে। মিরাজ সংঘটিত হবার কালে পৃথিবীর সময় স্থির হয়ে পড়েছিল কিনা তা হয়তঃ একদিন গবেষণায় জানাও যেতে পারে। চাঁদে কবে কোন্ দিন কোন্ সময় ফাটল ধরেছিল তা যদি বর্তমানে বলে দেয়া সম্ভব হয়, তাহলে পৃথিবীর সময় কোনো এক শুভ মুহূর্তে স্থির হয়েছিল কিনা তা বলে দেয়া অসম্ভবের কিছুই নেই।
নবী করীম (সা:) মানুষকে মিরাজের কথা শোনানোর পরে ইসলাম বিরোধী গোষ্ঠী তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচারের নতুন খোরাক পেয়েছিল এতে সন্দেহ নেই। কতক দুর্বল মুসলমানের ঈমান নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা:) শোনার সাথে সাথেই মন্তব্য করেছিলেন, 'আল্লাহর রাসূল যদি এ কথা বলে থাকেন যে তাঁর মি'রাজ হয়েছিল, তাহলে তা অবশ্যই সত্য'। এ কারণেই নবী করীম (সা:) হযরত আবু বকর (রা:) কে সিদ্দীক-এ আকবার উপাধী দান করেছিলেন।
সে সময় মক্কা থেকে জেরুজালিমে আসার যেসব বাহন ছিল, সেসব বাহন ব্যবহার করেও বাইতুল মাকদিসে আসতে কয়েক দিনের রাস্তা অতিক্রম করতে হতো। রাসূল (সা:) ইতোপূর্বে কখনো বাইতুল মাকদিস দেখেননি। তাঁকে যখন বাইতুল মাকদিস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি বাইতুল মাকদিস সম্পর্কে এমনভাবে বর্ণনা করেছিলেন যে, তিনি বোধহয় সে ভবনটির সামনে দাঁড়িয়ে ভবনটির খুটিনাটি দিক সম্পর্কে বর্ণনা করছেন। ভবনটির কোথায় কি আছে না আছে সম্পূর্ণ তিনি বলেছিলেন। তিনি যাত্রা পথে ব্যবসায়ীদের কিছু কাফেলাকে দেখেছিলেন, তাদের সম্পর্কে তিনি যা বলেছিলেন ব্যবসায়ী কাফেলা মক্কায় এলে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁর বর্ণনা আর তাদের বলা কথার ভেতরে পার্থক্য সূচিত হলো না। সুতরাং মিরাজের ঘটনা সে সময়েই ছিল প্রমাণীত সত্য। বর্তমানে মিরাজের বিষয় নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে তা একান্তই উদ্দেশ্যমূলক।
মিরাজ সম্পর্কে যে বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে এর জন্য দায়ী আমরা মুসলমানরাই। কারণ আমরা গাছের শিকড় না ধরে তার শাখা প্রশাখা ধরে টানা হেঁচড়া করতে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি। কি উদ্দেশ্যে তাঁর মিরাজ হলো, এর কেন্দ্রীয় লক্ষ্য কি, এর শিক্ষা কি, মিরাজ থেকে নবী করীম (সা:) মানব জাতির জন্য কি কল্যাণ বহন করে এনেছিলেন, এ সম্পর্কে লেখনিতে বা বক্তৃতায় আলোচনা না করে, মিরাজে তিনি কি কি দেখলেন, কোন্ পথে গেলেন, কার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটলো এসব গৌণ বিষয় নিয়ে আলোচনায় সময় অতিবাহিত করা হয়। ফল যা হবার তাই হয়েছে। এসব অলৌকিক বর্ণনা আধুনিক নাস্তিক্যবাদী শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ গ্রহণ করতে আগ্রহী হয়নি। মিরাজের মূল লক্ষ্যও অধিকাংশ মানুষ জানতে পারেনি। শোষিত বঞ্চিত মানুষের জন্য মিরাজ থেকে নবী করীম (সা:) মুক্তির কোন্ উপহার বহন করে আনলেন তা সাধারণ মানুষ জানতে পারেনি। বিষয়টি চিন্তাবিদ, গবেষক ও উচ্চ পর্যায়ের আলেমদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
0 Comments