মহাকাশের সূর্যের সাথে বাসযোগ্য ক্ষুদ্রগ্রহ এ পৃথিবীর বন্ধন রজ্জু অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। কিন্তু ধরা না পড়লেও সূর্য তাপেই পৃথিবী ফলে ফুলে সুশোভিত হয়। যে স্থান থেকে সূর্য উদিত হয় সে স্থান মেঘমালা আচ্ছাদিত থাকলেও সূর্যের উদয় পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। আপন গতি পথেই সূর্য এগিয়ে যেতে থাকে। পূর্বাকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে পশ্চিমাকাশে সূর্য আপন প্রভা বিকিরণ করে। মদীনার সাথে বুঝি নবী করীম (সা:) এর নাড়ির সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। তিনি মক্কায় জন্মগ্রহণ করে মক্কায় অবস্থান করেন কিন্তু তাঁর সে সম্পর্ক কারো দৃষ্টিতে ধরা না পড়লেও তাঁরই প্রভাবে মদীনার আনসাররা আলোকিত হয়ে উঠেছিল। মক্কা থেকে তিনি মহাসত্যের যে তাপ বিকিরণ করতেন, সে তাপে মদীনা ফলে ফুলে সুশোভিত হয়েছিল।
মক্কার আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন, মহাসত্যের সূর্য উদিত হলো কিন্তু সে সূর্য ঘন নিকষ কালো মেঘের কারণে মক্কার আকাশে স্বাধীনভাবে তাঁর তাপ বিকিরণ করতে সক্ষম হলো না। দুর্ভাগ্য মক্কাবাসীর। তারপর কালক্রমে মক্কার সে সূর্য মদীনার আকাশে এসে উদিত হয়েছিল। মদীনার মেঘমুক্ত আকাশে মহাসত্যের সে সূর্য স্বাধীনভাবে তাপ বিকিরণ করেছিল। সময়ের ব্যবধানে সে তাপ সমগ্র পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল।
আজ নবী করীম (সা:) শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে নেই, তিনি আর কোনোদিন এ পৃথিবীতে মানুষের সামনে শারীরিকভাবে মানুষের জাগ্রত অবস্থায় সবার সামনে আসবেন না। কিন্তু তিনি যে তাপ বিকিরণ করেছেন, তাঁর অবর্তমানে তাঁরই অনুসারীগণ শত সহস্রগুণ শক্তিশালী করে পৃথিবীময় বিকিরণ করেছিল। ইতিহাসের ধারা পরিক্রমায় `সে তাপ ছড়িয়ে পড়ার গতি কিছুটা হ্রাস পেলেও মহাসত্যের তাপের গতি যে পুনরায় বৃদ্ধি লাভ করবে তার সকল নিদর্শন পৃথিবীব্যাপী সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সে শুভ মুহূর্ত আগত প্রায় যখন হেরার রাজ তোরণ পুনরায় বিশ্বব্যাপী প্রজ্জ্বলিত হবে। সাম্প্রতিককালে মধ্যপ্রাচ্যে ও আফ্রিকার অন্তর্ভুক্ত লিবিয়ার ঘটনাবলী এ কথারই স্বাক্ষর বহন করছে।
হিজরতকালে দীর্ঘ চৌদ্দদিন কুবায় অবস্থান করে একটি মসজিদ নির্মাণের পরে বিশ্বনবী (সা:) মদীনা শহরের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। তিনি যে পথ দিয়ে শহরের দিকে যাচ্ছেন সে পথের দু'ধারে উৎসুক জনতা আল্লাহর নবীর পবিত্র চেহারা মুবারক একটি বার দেখার জন্য গভীর আগ্রহে দাঁড়িয়েছিল। তাঁকে দেখার সাথে সাথে জনতা আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলছিল। নবী করীম (সা:) উটের পিঠে, ধীর মন্থর পায়ে উট এগিয়ে যাচ্ছে মদীনার দিকে, রাসূলের শেষ বিশ্রামস্থলের দিকে।
সেদিন ছিল পবিত্র জুমুয়াবার। পথে জুমা নামাজের সময় হলে নবী করীম (সা:) বনী সালেম গোত্রে জুমা নামাজ আদায় করলেন তাঁর অনুসারী মুসলমানদের জীবনে এটাই ছিল প্রথম জুমা নামাজ। এখানেই তিনি জুমার প্রথম খুত্বাদান করেছিলেন। এই মসজিদের নাম হয়েছে বাতনুল ওয়াদির মসজিদ বা ওয়াদিয়ে রানুনার মসজিদ। নবী করীম (সা:) এর প্রথম জুমা নামাজ আদায়ের স্মৃতি বিজড়িত মসজিদ।
বনী সালেম গোত্রের আবাল বৃদ্ধ বনিতাদের হৃদয়ের স্বপ্ন, যদি আল্লাহর রাসূল তাদের মাঝে থাকতেন! তাঁরা দলবদ্ধভাবে এসে নবীর সামনে নিবেদন করলেন, 'হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমাদের যা কিছু আছে সবই আপনার পবিত্র কদমে উৎসর্গিত। আপনি যদি সন্তুষ্ট হয়ে আমাদের মধ্যে চিরদিনের জন্য থাকতেন'!
দুর্ভাগ্য তৎকালীন মক্কাবাসীর, কি অমূল্য রত্ন তারা হারালো বুঝতে পারলো না। যখন বুঝলো তখন সে রত্ন হাতছাড়া হয়ে গেছে। তখন সে অমূল্য সম্পদের অধিকারী মদীনাবাসী। আল্লাহর রাসূলের মুখে মধুর হাসি। তিনি বললেন, 'আমার উটকে তোমরা যেতে দাও, মহান আল্লাহ এই উটকে নির্দেশ দান করেছেন কোথায় আমাকে নিয়ে যেতে হবে'।
মহান আল্লাহ তা'য়ালাই এই ব্যবস্থা করেছিলেন। এই ব্যবস্থা অবলম্বন না করলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও রাসূল (সা:) কে নিজেদের অধিকারে রাখার জন্যে গোত্রে গোত্রে দাঙ্গা সৃষ্টি হতো। উট এগিয়ে যাচ্ছে, পথে যে গোত্রই পড়ছে সেই গোত্রই ঐ একই আবেদন পেশ করছে। নবী করীম (সা:) মুখে চাঁদের হাসি ফুটিয়ে সবাইকে একই কথা বলছেন। অবশেষে উট তাঁকে বহন করে মদীনা শহরে পৌঁছলো।
পূর্বেই শহরে সংবাদ এসেছিল, ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মাদ (সা:) আজ এই শহরে তাঁর পবিত্র কদম রাখবেন। মদীনার আনাচে কানাচে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছিল। কুবা থেকে মদীনা শহর পর্যন্ত কোনো একটি স্থান শূন্য ছিল না। পথের দু'পাশে ছিল মানব বন্ধন আর অগণিত জনতার ভীড়। মানুষ উঁচু স্থানে আরোহন করে প্রতিযোগিতা করছিল, কে আগে আল্লাহর নবীকে দেখে নিজের তৃষ্ণার্ত নয়ন সার্থক করবে।
মদীনার অবরোধপুরবাসিনী নারী গোষ্ঠী, শিশু, বালক-বালিকারা গৃহের ছাদে উঠে মধুর কন্ঠে তালে তালে তাদের স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করছিল। এ সকল কবিতা ছিল রাসূলের প্রশংসায় নিবেদিত। কিয়ামত পর্যন্ত মানুষ সে কবিতা আবৃত্তি করতে থাকবে। তাঁরা মধুর কন্ঠে আবৃত্তি করছিল-
طَلَعَ الْبَدْرُ عَلَيْنَا - مَنْ ثَنِيَاتِ الْوَدَاعِ وَجَبَ الشَّكْرُ عَلَيْنَا - مَادَ عَى لِلَّهِ دَاع '
চন্দ্র হয়েছে উদয় বিদা পর্বতের ঘাঁটি হতে, মোদের প্রতি আল্লাহর প্রশংসা করা বাধ্যতামূলক, যে পর্যন্ত প্রার্থনাকারী প্রার্থনা করবে'।
মদীনার বালিকাগণ বিশেষ এক প্রকার বাদ্যযন্ত্র যাকে বলা হয় 'দক্', এই দফ বাজিয়ে কোরাশ কণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি করছিল-
نَحْنُ جَوَارِ مِنْ بَنِي النَّجَّارِ - يَا حُبَدًا مُحَمَّدًا مِنْ جَارٍ -
'নাজ্জার বংশের বালিকা আমরা, মুহাম্মাদ (সা:) আমাদের সর্বোত্তম প্রতিবেশী'।
আল্লাহর নবী (সা:) পরম মমতাভরা দৃষ্টিতে শিশু মেয়েদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। মধুর কন্ঠে তাদেরকে বললেন, 'আমাকে কি তোমরা চাও?'
শিশু মেয়েরা আত্মহারা হয়ে উঠলো। তাঁরা সমবেত কণ্ঠে খুশীর আবেগ প্রকাশ করলো, 'হে আল্লাহর রাসূল (সা:) আপনাকে আমরা চাই'।
বিশ্বনবী (সা:) তাদের প্রতি স্নেহ প্রকাশ করে বললেন, 'আমিও তোমাদেরকে চাই'।
উট এগিয়ে গেল, সামনে পড়লো বিশ্বনবী (সা:) এর মামাদের পরিবার বনী আদী নাজ্জারের গোত্র। এই গোত্রেরই মেয়ে ছিলেন নবী করীম (সা:) এর দাদার মাতা সালামা বিনতে আমর। এই গোত্রের লোকজন নবীর উটের সামনে দাঁড়িয়ে করুণ কন্ঠে আবেদন পেশ করলো, 'হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমাদের সবকিছুই আপনার, আপনি আমাদের সাথে অবস্থান করুন!'
নবী করীম (সা:) তাদেরকেও বললেন, 'উটের প্রতিই আল্লাহ তা'য়ালা আদেশ করেছেন, সে আমাকে যথাস্থানে নিয়ে যাবে। তোমরা উটকে পথ করে দাও'।
উট এবার এগিয়ে গিয়ে বনী মালিক ইবনে নাজ্জারের বাসস্থানের সামনে এসে আস্তে আস্তে হাঁটু ভাঁজ করে বসলো। মসজিদে নববীর প্রবেশ দ্বার এখানেই বানানো হয়েছিল। সে সময় ঐ স্থানটি ছিল বনী নাজ্জার গোত্রের সাহল ও সুহাইল নামক দু'জন ইয়াতিম শিশুর। তাদেরকে লালন পালন করতো হযরত মায়াজ ইবনে আকরা। এ স্থানে বাচ্চা দু'টো তাদের খেজুর শুকাতো।
উট বসে পড়লেও নবী করীম (সা:) উট থেকে অবতরণ করলেন না। কিছুক্ষণ পরে উট উঠে কিছুদূর এগিয়ে গেল। তারপর উট সেখান থেকে পেছনের দিকে তাকালো যেখানে সে প্রথম বসেছিল। তারপর পুনরায় সে পূর্বের স্থানে ফিরে এসে বসে পড়লো। এবার সে একটু শব্দ করে তার গলা এবং বুক মাটির সাথে স্পর্শ করলো। আল্লাহর রাসূল (সা:) অনুভব করলেন, মহান আল্লাহ উটকে এই স্থানেই থেমে যেতে আদেশ করেছেন।
সামনেই ছিল হযরত আবু আইউব আনসারী (রা:) এর বাড়ি। তাঁর প্রকৃত নাম আবু আইউব খালিদ ইবনে যায়িদ আনসারী (রা:)। তিনি দ্রুত এগিয়ে এসে নবী করীম (সা:) এর সামান্য আসবাব-পত্র নামিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। মহাসৌভাগ্যবান ব্যক্তি তিনিই হলেন যার ঘরে মেহমান হলেন সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী স্বয়ং আল্লাহ তা'য়ালার রাসূল বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সা:)।
আরেক বর্ণনায় এসেছে, বর্তমানে যেখানে মাসজিদে নববী অবস্থিত সেখানেই ছিল হযরত আবু আইউব (রা:) এর ঘর। এখানে উট এসে পৌঁছলে রাসূল (সা:) কার মেহমান হবেন তা নিয়ে বেশ বিতর্কের সৃষ্টি হলো। শেষ পর্যন্ত সমাধান করা হলো এভাবে যে, উট যার ঘরের সামনে থামবে রাসূল (সা:) তাঁরই মেহমান হবেন। উট এসে থেমেছিল হযরত আবু আইউব (রা:) এর ঘরের সামনে।
পক্ষান্তরে মুসলিম শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মদীনার আনসারদের মধ্যে রাসূলের মেহমানদারী করা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিলে নবী করীম (সা:) স্বয়ং বলেছিলেন, 'আমি বনী নাজ্জার গোত্রে থামবো। কারণ তাঁরা আমার দাদার মামা'।
সুতরাং নবী করীম (সা:) তাঁর আত্মীয়তার সূত্র ধরেই বনী নাজ্জার গোত্রের মেহমান হয়েছিলেন। হযরত আবু আইউব (রা:) বনী নাজ্জার গোত্রের একজন ছিলেন। ইমাম বুখারী তাঁর তারিখে ছগীরে লিখেছেন, নবী করীম (সা:) তাঁর দাদার আত্মীয়তার কারণে হযরত আবু আইউব (রা:) এর মেহমান হয়েছিলেন।
এই বাড়িতে বিশ্বনবী (সা:) প্রায় সাত মাস অতিবাহিত করেন। তাঁরপর মাসজিদে নববী এবং উম্মাহাতুল মুমেনিনের জন্য বাসগৃহ নির্মাণ করা হলে তিনি সেখান থেকে মাসজিদে নববীর পাশে চলে আসেন।
হযরত আবু আইউব (রা:) এর বাড়িটা ছিল দোতলা। সে সময় একতলা আর দোতলার মধ্যবর্তী অংশ বর্তমানের দোতলা বাড়ির মত ছিল না। হয়তঃ কাঠ দিয়ে মাঝের অংশ প্রস্তুত করে তার ওপরে মাটির প্রলেপ দেয়া হত। এ কারণে ওপরের অংশে পানি পড়লে সে পানি গড়িয়ে নিচের তলায় পৌঁছতো। হযরত আবু আইউব (রা:) বিশ্বনবী (সা:) এর মর্যাদার দিক লক্ষ্য করে তাঁর কাছে আবেদন করলেন, 'হে আল্লাহর রাসূল (সা:)! আমার মাতা-পিতা আপনার কদম মুবারকে উৎসর্গিত হোক, আপনি ওপরের তলায় অবস্থান করুন!'
নবী করীম (সা:) তাঁকে বললেন, 'আমার সাথে লোকজন দেখা সাক্ষাৎ করতে আসবে, দোতলায় থাকলে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করা অসুবিধা হবে। আমি নিচের তলাতেই অবস্থান করি'।
এভাবে তিনি সে বাড়ির নিচের তলাতেই অবস্থান করতে থাকলেন। হযরত আবু আইউব (রা:) তাঁর নিজের অনুভূতির কথা এভাবে বলেন যে, 'আমরা তাঁর জন্য খাবার প্রস্তুত করে সবটুকু খাবারই তাঁর কাছে প্রেরণ করতাম। আল্লাহর রাসূল আহার করে অবশিষ্টাংশ ফেরৎ পাঠাতেন। আমরা লক্ষ্য করতাম খাদ্য পাত্রের কোনো কোনো স্থানে রাসূলের পবিত্র আঙ্গুলের চিহ্ন পাওয়া যায়। যেসব স্থানে চিহ্ন দেখতাম সে স্থান থেকেই আমরা আহার করতাম। আমরা অধিক বরকতের আশায় এমন করতাম। একদিন আমরা খাবার প্রস্তুত করার সময় একটু রসুন বা পিঁয়াজ দিয়েছিলাম। সে খাবার রাসূলের কাছ থেকে যখন ফেরৎ এলো তখন দেখলাম, রাসূলের পবিত্র আঙ্গুলের চিহ্ন নেই খাদ্য পাত্রে। আমরা অনুভব করলাম তিনি খাদ্য আহার করেননি। আমরা অস্থির হয়ে পড়লাম। জানি না আমাদের দ্বারা এমন কী ভুল হয়ে গেল যে, তিনি আহার করলেন না?
আমি দ্রুত তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে আবেদন করলাম, 'হে আল্লাহর রাসূল (সা:)! আপনার জন্য আমাদের মাতা-পিতা কুরবান হোক। আপনি খাদ্য ফেরৎ পাঠিয়েছেন অথচ আপনার হাতের চিহ্ন নেই। আমরা বরকতের আশায় আপনার হাতের চিহ্ন দেখে সেখান থেকে আহার করতাম। হে আল্লাহর রাসূল! আমরা বুঝতে পারছি না আমাদের কি অপরাধ!'
নবী করীম (সা:) তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে পরম স্নেহের স্বরে বললেন, 'অন্য কোনো কারণ নয়, আমি আজ খাবারের মধ্যে একটি গাছের গন্ধ পেয়েছি। তা আহার করলে মুখে গন্ধ হয়। অনেকের সাথে আমাকে কথা বলতে হয়, মুখ থেকে গন্ধ বের হবে। এ কারণে আমি আহার করিনি। তোমরা আহার করতে পারো'।
হযরত আবু আইউব (রা:) জবাবে বলেছিলেন, 'হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ)! আপনি যা পছন্দ করেন না, আমরাও তা পছন্দ করবো না'। (উসুদুল গাবা, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা নং-৮১, মুসলিম শরীফ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা নং-১৯৮, সীরাতে ইবনে হিশাম, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা নং-৪৯৯)
নবী করীম (সা:) জিবরাঈল (আ:) সহ অন্যান্য ফেরেশতাদের সাথে ক্ষেত্র বিশেষে মহান আল্লাহ তা'য়ালার সাথে কথা বলতেন। এ কারণে তিনি কোনো গন্ধযুক্ত খাবার পছন্দ করতেন না। এই ঘটনার পর থেকে তাঁর কাছে কোনো ধরনের গন্ধযুক্ত খাদ্য প্রেরণ করা হতো না। কোনো বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে, এই ঘটনার পর থেকে হযরত আবু আইউব (রা:) ও তাঁর পরিবার পরিজন রসুন বা পিঁয়াজ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
হযরত আবু আইউব আনসারী (রা:) বলেন, 'তখন আমরা বাধ্য হয়েই ওপর তলায় অবস্থান করি। একদিন রাতে হঠাৎ করেই পানির পাত্রটা ভেঙ্গে গেল। নিচের তলায় রাসূল (সা:) অবস্থান করছেন। পানি এখন গড়িয়ে নিচের তলায় চলে যাবে। আমরা বিচলিত হয়ে পড়লাম। অবশেষে আমাদের শোবার মত যে কম্বলটা ছিল তা পানির ওপর বিছিয়ে দিয়ে সে পানি শোষণ করালাম। তারপর আমরা ঘরের এক কোণে সমগ্র রাত ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে অতিবাহিত করলাম। সকালে নবী করীম (সা:) এর সামনে উপস্থিত হয়ে আমরা আমাদের অনুভূতির কথা ব্যক্ত করে তাঁকে অনুরোধ করলাম তিনি যেন ওপর তলায় চলে যান। আমাদের অনুরোধে তিনি আমাদের অনুভূতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ওপরে চলে গেলেন'। (উসুদুল গাবা, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা নং-৮১, হায়াতুস সাহাবা, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা নং-৩২৮-৩২৯, সীরাতে ইবনে হিশাম, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা নং-৪৯৮)
বিশ্বনবী (সা:) ইসলামের প্রথম শিক্ষক, মুবাল্লিগ, প্রথম দূত হযরত মুসআব ইবনে উমায়ের (রা:) এর সাথে হযরত আবু আইউব (রা:) এর ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন করে দেন। ইতিহাসে বর্ণনা করা হয়েছে, তাদের উভয়ের চরিত্রে অপূর্ব সাদৃশ্য ছিল। উভয়ের মধ্যেই প্রাণ প্রাচুর্য এবং উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল অদ্ভুত ধরনের। (তাবাকাতে ইবনে সাআদ, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা নং-৪৮৪)
বিশ্বনবী (সা:) মদীনায় আগমন করেই হযরত যায়েদ (রা:) কে দু'টো উট এবং পাঁচশত দেরহাম দিয়ে মক্কায় প্রেরণ করলেন পরিবারের সদস্যদের মদীনায় নিয়ে আসার জন্য। হযরত আবু বকর (রা:) ও পত্র প্রেরণ করেছিলেন তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মদীনায় চলে আসার জন্য। তাঁর সন্তান হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবু বকর (রা:) পরিবারের সকল সদস্যদের নিয়ে হযরত যায়েদ (রা:) এর সাথেই অর্থাৎ নবী পরিবারের সদস্য এবং হযরত আবু বকর (রা:) এর পরিবারের সদস্যগণ একত্রেই মদীনায় আগমন করেন। পক্ষান্তরে নবী করীম (সা:) এর এক কন্যা সে সময় আসতে পারেননি। তিনি তাঁর স্বামী হযরত উসমান (রা:) এর সাথে সে সময় হাবশায় অবস্থান করছিলেন।
নবী করীম (সা:) কে ঘীরে মদীনার বালক-বালিকাগণ যে কবিতা আবৃত্তি করছিলো, তার মধ্যে 'বদর' শব্দ উল্লেখ রয়েছে। পূর্ণীমার পূর্ণ শশীকে আরবী ভাষায় 'বদর' বলা হয়। সাধারণত চন্দ্রকে আরবী ভাষায় 'ক্বামার' বলা হয়। মদীনায় হিজরতকালে নবী করীম (সা:) কে শুধু চাঁদের সাথে তুলনা না করে তাঁরা পূর্ণীমার পূর্ণ চন্দ্রের সাথে তুলনা করে আবৃত্তি করছিলো, 'আজ আমাদের ওপর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক হয়েছে'। মদীনায় হিজরতকালে নবী করীম (সা:) কে দেখে মদীনার শিশু-কিশোররা যে কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলো তা কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীব্যাপী প্রতিদিন কোথাও না কোথাও আবৃত্তি হতে থাকবে, এটি কখনো পুরনো হবে না।
পূর্ণীমা ব্যতীত চাঁদকে কখনোই পূর্ণ অবয়বে দেখা যায় না, পূর্ণীমার তিথীতেই চাঁদকে পৃথিবীর মানুষ পূর্ণ অবয়বে দেখে থাকে। এ সময় চন্দ্রের কিরণচ্ছটা পূর্ণরূপে বিকশিত হয়। মক্কার একশ্রেণীর মানুষ সে সময় নবী করীম (সা:) এর মর্যাদা উপলব্ধি করতে না পারলেও মদীনার ঐ মানুষগুলো ঠিকই উপলব্ধি করেছিলো, এই মহামানবের অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন, গৃহযুদ্ধ ও সকল প্রকার লাঞ্ছনা, অবহেলা, অমর্যাদা এবং অপমান থেকে মুক্তি। কেবলমাত্র তাঁর অনুসরণই মর্যাদার সুউচ্চ স্থানে আরোহণের সোপান। ইতিহাস কথা বলে, নবী করীম (সা:) কে ঘীরে তাঁদের উপলব্ধি, তাঁদের মায়া- মমতা, প্রেম-ভালোবাসা, ত্যাগ-তিতীক্ষা, উৎসর্গ কল্পনার কোনো বিষয় ছিলো না, পৃথিবীর ইতিহাসে সকল মানব গোষ্ঠীর মধ্যে মদীনার আনসারগণ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে অতুলনীয় সম্মান অর্জন করেছে, সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে এর একটি দৃষ্টান্তও নেই।
মদীনার হিজরতপূর্ব ইতিহাস যাঁরা জানেন, তাঁরা অবশ্যই অবগত রয়েছেন যে, গৃহযুদ্ধ আর ইয়াহুদীদের নির্যাতন মদীনার অধিবাসীদের প্রায় নিঃশেষ করে এনেছিলো। নবী করীম (সা:) এর আগমন তাঁদের নিঃশেষিত ক্ষয়িষ্ণু অস্তিত্বে প্রাণের সঞ্চার করেছিলো ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে চিরতরে মুছে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছিলো। আর এ জন্যেই বোধহয় তাঁরা সেদিন নবী করীম (সা:) কে পূর্ণীমার পূর্ণ শশীর সাথে তুলনা করে কবিতা আবৃত্তি করেছিলো।
মহান আল্লাহ তা'য়ালা মদীনার আনসারদের ওপর রহম করুন, তাঁরা শুধুমাত্র নবীপ্রেম ও আদর্শের কারণে যে ত্যাগ স্বীকার করেছে এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোনো একটি জাতির মধ্যে নেই। মক্কা থেকে যেসব অসহায় মুসলমান শূন্য হাতে তাদের কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল, তাঁরা এসব অসহায় মানুষদের জন্য নিজেদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে দিয়েছে। যে জাতি নিজের অধিকার ব্যতীত অন্যের অধিকারের ব্যাপারে এক মুহূর্তের জন্য মাথা ঘামাতে প্রস্তুত ছিল না, সেই জাতি ইসলামের সংস্পর্শে এসে নিজে অনাহারে থেকে অপরিচিত ব্যক্তিকে খাদ্য দিয়েছে। অন্যের সুবিধার জন্য নিজের বাড়ি-ঘর ছেড়ে দিয়েছে। নিজের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জন করা অর্থ-সম্পদ আরেকজনকে দিয়ে দিয়েছে। এমনকি নিজের দুইজন স্ত্রী থাকলে একজনকে তালাক দিয়ে তাঁর দ্বীনি ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছে।
ত্যাগের এই মহান দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অন্য কোনো জাতির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে? ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী অমুসলিম বন্ধুগণ মুসলিম ব্যতীত অন্য কোনো জাতির ইতিহাস থেকে এ ধরনের একটা দৃষ্টান্ত উপস্থিত করতে পারবেন? গর্ভধারিণী মায়ের জন্য রেষ্টুরেন্টে মাত্র একটি ডলার ব্যয় করার মত হৃদয় যাদের নেই, তাদের পক্ষে এমন ধরণের দৃষ্টান্ত উপস্থিত করা কষ্টকরই বৈকি। 'ইসলাম শক্তি প্রয়োগ করে এবং তরবারীর জোরে বিস্তার লাভ করেছে' এ সব কথা যারা বলেন এবং লিখেন, তাঁরা যে লজ্জার শেষ আবরণ, বিবেকের অবগুণ্ঠন ছুড়ে ফেলেই তা বলেন তাতে সন্দেহ নেই। অপরের সম্পদ ছিনিয়ে নেয়ার মধ্যেই যাদের গৌরব নিহিত ছিল, সেই জাতি কোন্ যাদুর স্পর্শে ত্যাগের অনুপম মহিমায় এমন তুলনাহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, এ সম্পর্কে অমুসলিম বন্ধুদেরকে ক্ষণিকের জন্য হলেও চিন্তা করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
0 Comments