প্রতীমা মুক্ত কা'বা
পৃথিবীর বুকে পবিত্র কা'বা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অংশীবাদীর অমানিশা দূর করার লক্ষ্যে। কিন্তু সেই কা'বাতেই অংশীবাদীর আখড়া স্থাপন করা হয়েছিল। মূর্তির কালিমা লেপন করা হয়েছিল পবিত্র কা'বায়। মুসলিম বাহিনী মক্কায় প্রাবেশ করে বিশ্বনবীর আদেশের অপেক্ষায় ছিলেন, সিপাহসালার কখন নির্দেশ দিবেন, পবিত্র কা'বাকে মূর্তিমুক্ত করো।
বোখারী শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বনবী কা'বাঘরের আঙ্গিনায় উট থেকে অবতরণ করেন। তারপর ওসমান ইবনে তালহাকে কা'বাঘরের চাবী আনতে বললেন.। চাবী দিয়ে আল্লাহর ঘর খোলা হলো। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর ঘরে প্রবেশ করলেন। তিনি উচ্চ কণ্ঠে তাকবির দিলেন। তাঁর সাথে ছিলেন হযরত বিলাল, হযরত উসামা ও হযরত ওসমান ইবনে তালহা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুম আজমাঈন।
তিনি দীর্ঘক্ষণ কা'বার ভেতরে অবস্থান করলেন। সে সময় কা'বার ভেতরে এবং তার চার পাশে ৩৬০ টি মূর্তি ছিল। আল্লাহর নবী তাঁর হাতের লাঠি দিয়ে মূর্তিগুলোকে আঘাত করছিলেন আর বলছিলেন, সত্যের আগমন ঘটেছে মিথ্যা পলায়ন করেছে। সত্য এসেছে বাতিল আর আসবে না।' পবিত্র কা'বা দীর্ঘ দিন পরে কালিমা মুক্ত হলো। সমস্ত মূর্তি ধূলিস্মাৎ করে দেয়া হলো। এই কা'বায় প্রাণহীন পাষাণ প্রতীমার পূজা হয়েছে শতাব্দীর পরে শতাব্দী ধরে। আজ সেখানে হযরত বিলাল রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর বজ্রকণ্ঠে তাওহীদের বিপ্লবী বাণী দিকদিগন্ত মুখরিত করে তুললো। আল্লাহর নবী সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে পবিত্র কা'বায় মহান আল্লাহর কুদরতী পদপ্রান্তে সিজদা করলেন। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু কা'বায় প্রবেশ করে কা'বার দেয়ালে যত দেবদেবীর ছবি ছিল তা মুছে দিলেন।
আজ প্রতিশোধের দিন নয়
এক সময় যারা ছিলেন জালিম অত্যাচারী তাদের আঙ্গিনায় করুণার সিন্ধু প্রবাহিত হলো। যারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করার জন্য তাঁর ঘর পরিবেষ্টন করেছিল, তারাও আজ সেই করুণার সাগরে অবগাহন করার সুযোগ লাভ করলো। তিনি জুম্মা নামায আদায় করলেন। মক্কার শত্রু মিত্র সবাই এসেছে তাঁর পবিত্র মুখের ঘোষনা শুনতে।
তিনি ঘোষনা করলেন, 'এক আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। তিনি একক এবং অদ্বিতীয়, তাঁর কোন অংশীদার নেই। আজ তিনি তাঁর অঙ্গিকার পূর্ণ করেছেন। তিনি তাঁর গোলামকে সাহায্য করেছেন এবং সত্যের শত্রুদেরকে স্তব্ধ করেছেন। সমস্ত অহংকার এবং পূর্বের সমস্ত রক্তের বদলা, সমস্ত রক্তের বাঁধন সবই আমার পায়ের নীচে দলিত হলো। কেবল মাত্র কা'বাগৃহের যারা অভিভাবক এবং যারা হাজীদেরকে পানি পান করায় তাঁরা ব্যতিক্রম। হে কুরাইশ গোত্র! অন্ধকার যুগের অমানিশা এবং বংশের অহংকার, সমস্ত কিছুই মহান আল্লাহ নিশ্চিহ্ন করে দিলেন। সমস্ত মানুষ আদম থেকে সৃষ্টি এবং আদম মাটি থেকে সৃষ্টি।
আরবে একটা ঘৃণ্য প্রথা শতাব্দী ব্যাপী প্রতিষ্ঠিত ছিল, কোন ব্যক্তি যদি নিহত হত, তাহলে তার গোত্রের লোকজন মনে করতো যে, হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করা অবশ্য কর্তব্য। নিহত ব্যক্তির হত্যাকারীকে যদি তারা ধরতে না পারতো, তাহলে তার নাম পরিচয় তারা লিখে রাখতো। ক্ষেত্র বিশেষে তারা প্রতীজ্ঞা করতো, হত্যাকারীর মাথার খুলিতে তারা মদ পান করবে। বংশের লোকদেরকে তারা প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করে যেত। আরবদের বিশ্বাস ছিল, কেউ কাউকে হত্যা করলে সেই হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ গ্রহণ না করলে নিহত ব্যক্তির আত্মা সাদা রংয়ের পাখি হয়ে পাহাড়-পর্বতে উড়তে থাকে আর বলতে থাকে, 'আমাকে পান করাও! আমাকে পান করাও!' আবার কারো ধারণা ছিল, যে ব্যক্তি নিহত হয় তার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করলে সে ঐ জগতে জীবিত থাকে। আর প্রতিশোধ গ্রহণ না করলে ঐ জগতে সে মরে যায়। আবার কারো ধারণা ছিল, হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ না করলে নিহত ব্যক্তির কবর অন্ধকারে ছেয়ে থাকে। প্রতিশোধ গ্রহণ করা হলে তার কবর আলোকিত হয়। এই সমস্ত অমূলক বিশ্বাসের কারণে যুদ্ধের আগুন কখনো নির্বাপিত হয়নি। এভাবে যুদ্ধ করা বা প্রতিশোধ গ্রহণ করা ছিল তাদের কাছে এক সম্মানজনক ব্যাপার। আল্লাহর নবী আরবের এ ধরণের অহংকার, যাবতীয় কুসংস্কার এবং অন্যায় সম্পর্কে ঘোষনা করলেন, 'আজ এসব কিছুই আমার পায়ের নীচে কবর দিয়ে দিলাম।'
তিনি আরো ঘোষনা করলেন, 'সমস্ত মানুষ আদম থেকে সৃষ্টি এবং আদম মাটি থেকে সৃষ্টি।' অর্থাৎ কোন ভেদাভেদ নেই। সবাই এক ও অবিচ্ছিন্ন। কেউ কারো ওপরে শ্রেষ্ঠ দাবী করতে পারবে না। তবে ঐ ব্যক্তি হবে বেশী সম্মানিত এবং মর্যাদাবান, যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশী পরহেজগার। আল্লাহকে যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশী ভয় করে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর ভাষনের সমাপ্তিতে সামনে বিশাল জনসমুদ্রের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তিনি দেখলেন, ঐ লোকগুলো তাঁর মুখের দিকে আজ অসহায়ের মতই তাকিয়ে আছে। তাদের চোখের ভাষায় ফুটে উঠেছে অসহায়ত্ব আর ক্ষমার আকুতি।
নির্যতিত আল্লাহর নবী দেখছেন, ঐ তো-ঐ লোকগুলোর সাথেই তারা মিলে মিশে আজ একাকার হয়ে তাঁর সামনে বসে আছে, যে লোকগুলোকে সত্য গ্রহণের অপরাধে তারা জ্বলন্ত আগুনের ওপরে চিৎ করে শুইয়ে বুকের ওপর পাথর চাপা দিয়েছে। হযররত বিলালের গলায় রশি বেঁধে কাঁটা ও পাথরের ওপর দিয়ে টেনে হিচড়ে নিয়ে গেছে, বিলালের শরীরের গোস্ত চামড়া ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। খাব্বাবের শরীরে এখনো সে ক্ষত দগদগ করছে। শিয়াবে আবু তালিবে দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতে বাধ্য করেছে। ঐ তো সেই লোকগুলো। অনাহারের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তাঁর প্রিয় খাদিজা ঐ যে ভেঙ্গে পড়লেন, তাঁর আশ্রয়দাতা চাচা আবু তালিব ঐ যে ভেঙ্গে পড়লেন, আর উঠতে পারলেন না। আবু জাহিলের সাথে 'মিলে সুমাইয়াকে যারা হত্যা করেছিল, তারাও তো বসে আছে।
তাঁর প্রিয় চাচা হামজার কলিজা যারা চিবিয়ে ছিল, তারাও আছে। তাঁর গর্ভবতী মেয়ে যয়নবকে আঘাত করে উটের ওপর থেকে নীচে ফেলে দিয়ে গর্ভের সন্তানকে হত্যা করেছিল, তারাও বসে আছে। তাঁকে যারা সীমাহীন কষ্ট দিয়েছে তারাও মাথা নীচু করে বসে আছে। তাঁকে যারা হত্যা করার জন্য অগ্রসর হয়েছিল, তাঁর সেই প্রাণের শত্রুও অবনত মস্তকে বসে আছে। বদর, ওহুদ ও খন্দকে যারা রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল, তারাও তাঁর সামনে বসে আছে। তিনি গম্ভির কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,'তোমাদের কি জানা আছে, আজ আমি তোমাদের সাথে কেমন ব্যবহার করবো তা কি তোমরা জানো?' এক সময়ের বিরোধিগণ সমস্বরে বলে উঠলো, 'আপনি আমাদের সম্মানিত ভাই, আমাদের মর্যাদাবান ভাতিজা!'
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ঘোষনা করলেন, 'আজ আমার কোন অভিযোগ তোমাদের বিরুদ্ধে নেই। আজ তোমরা সবাই মুক্ত।'
0 Comments