নামায কি ও কেন

        সকল নবী ও রাসূলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও আদর্শ একই ছিলো এবং মহান আল্লাহর গোলামী করার লক্ষ্যে তাঁরা যখন মানুষকে আহ্বান করেছেন, তখন প্রথমেই নামায আদায়ের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। কারণ এই নামাযই মানুষকে আল্লাহর গোলামীতে অভ্যস্থ করে তোলে। পবিত্র কোরআনে নামায বুঝানোর জন্য صلوة 'সালাত' শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আরবী অভিধানে সালাত অর্থ কোনো জিনিসের প্রতি লক্ষ্য আরোপ করা, অগ্রসর হওয়া ও নিকটবর্তী হওয়া।

        কোরআনের পরিভাষায় সালাত শব্দ দিয়ে আল্লাহর দিকে লক্ষ্য আরোপ করা, তাঁর দিকে অগ্রসর হওয়া ও তাঁর একান্ত নিকটবর্তী হওয়া বুঝানো হয়। নামায তাওহীদের অবশ্যম্ভাবী বহিঃপ্রকাশ এবং ঈমানের স্থায়ী নিদর্শন। আকীদা-বিশ্বাসের দিক দিয়ে তাওহীদ যদি পূর্ণ দ্বীনের মূল উৎস হয়, তাহলে আমলের দিক দিয়ে নামায পূর্ণ দ্বীনের আমলী মূলভিত্তি। এর বাস্তবায়ন পূর্ণ দ্বীনেরই বাস্তবায়ন ধরা যায়। তা মু'মিনের কেবল একটি উত্তম আমলই নয় বরং সমস্ত নেক আমলের ভিত্তিমূল।

        এই গুরুত্বের প্রতি লক্ষ্য রেখেই কোরআনে নামায আদায় করার ভাষা প্রয়োগ না করে নামাযের হেফাযত করা ও কায়েম করার ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছে। এর তাৎপর্য হচ্ছে নামায অবহেলিতভাবে আদায় করাই ফরজ নয়, বরং পূর্ণ গুরুত্বের সাথে, একাগ্রচিত্তে এর আদব রক্ষা করে যাবতীয় অনুষ্ঠানগুলো যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

فَاقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا - فطْرَتَ اللهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللهِ ذَالِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لا يَعْلَمُونَ مُنِيبِينَ إِلَيْهِ وَاتَّقُوهُ وَأَقِيمُوا الصَّلوةَ وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ

        অতএব (হে নবী ও নবীর অনুসারীগণ!) একমুখী হয়ে নিজেদের সমস্ত লক্ষ্য এই দ্বীনের দিকে কেন্দ্রীভূত করে দাও। দাঁড়িয়ে যাও সেই প্রকৃতির ওপর যার ওপর আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর তৈরী কাঠামো পরিবর্তন করা যায় না। এটাই সর্বতোভাবে সত্য নির্ভুল দ্বীন। কিন্তু অনেক লোকই তা জানে না। তোমরা আল্লাহর দিকে রুজু হয়ে তাঁকে ভয় করো নামায কায়েম করো এবং মুশরিকদের দলে শামিল হয়ো না। (সূরা আর রুম-৩০-৩১)

        মানুষকে আসলেই আল্লাহর বান্দা বা দাস হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই একমুখী হয়ে তার স্রষ্টার বন্দেগীর ওপর দৃঢ় থাকাই তার স্বাভাবিক প্রকৃতি। এই স্বাভাবিক প্রকৃতির ওপর তার মন-মস্তিষ্ক ও আচার আচরণ একনিষ্ঠভাবে একাধারে দৃঢ় রাখার জন্য আল্লাহ তা'য়ালা বান্দার ওপর নামায ফরয করেছেন। বান্দার এ নামায কায়েম করা মানে সেই স্বাভাবিক প্রকৃতির ওপর তার প্রতিষ্ঠার বাস্তব অনুশীলন। বান্দা দিনে বার বার হাত বেঁধে মহান আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে এর শুকরিয়া জ্ঞাপন করে তাঁর বন্দেগীর স্বীকৃতি দেয়, তাঁর সামনে ঝুঁকে পড়ে সিজদায় গিয়ে ঘোষণা করে যে, আমি সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে একাগ্রচিত্তে একমাত্র এক আল্লাহর দাসত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছি। হযরত শু'আইব আলাইহিস্ সালাম যখন তাঁর জাতিকে সমস্ত কিছুর দাসত্ব পরিত্যাগ করে এক আল্লাহর গোলামী করার জন্য তাদেরকে নামায আদায়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তখন তারা বিদ্রুপ করে বলেছিলো-

قَالُوا يَشْعَيْبُ أَصَلوتُكَ تَأْمُرُكَ أَنْ نَّتْرُكَ مَا يَعْبُدُ آبَاؤُنَا أَوْ أَنْ نَّفْعَلَ فِي أَمْوَالِنَا مَا نَشَؤُا إِنَّكَ لَأَنْتَ الْحَلِيمُ الرَّشِيدُ

        তারা জবাব দিল, হে শু'আইব! তোমার নামায কি তোমাকে এ কথা শেখায় যে, আমরা এমনসব মাবুদকে পরিত্যাগ করব, যাদেরকে আমাদের পূর্ব পুরুষরা পূজা করত? অথবা নিজেদের ধন-সম্পদ থেকে নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী খরচ করার ইখতিয়ার থাকবে না? নিশ্চয় তুমিই রয়ে গেছে একমাত্র উচ্চ হৃদয়ের অধিকারী ও সদাচারী। (সূরা হুদ-৮৭)

        হযরত শু'আইব আলাইহিস্ সালাম নিজের জাতির বাতিল মা'বুদদের সমালোচনা করে জাতিকে এক আল্লাহর দাসত্বের দিকে আহ্বান জানান এবং বলেন যে, এক আল্লাহর ওপর ঈমান এনে তাঁর বন্দেগী করার পদ্ধতি হচ্ছে, তোমরা জীবনের সকল ব্যাপারে আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী চলবে; তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, লেন-দেন ইত্যাদিকে পূর্ণ সততা ও ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। জীবনের কোন ক্ষেত্রেই আল্লাহর বিধানের বিপরীত আচরণ করা যাবে না।

        আল্লাহর নবীর মুখে দ্বীনের এই ব্যাপক দাওয়াত শুনে তার জাতির লোকেরা বললো, হে শু'আইব! তুমি আমাদের এ কোন ধরনের দাসত্বের দিকে আহ্বান করছো এবং কেমন নামায আদায়ের কথা বলছো? আচ্ছা, আল্লাহকে রাজি করতে কি আমাদের কপোলদেশ ঝুকিয়ে দিলেই চলে না? তোমার নামাযের দাবী কি এত ব্যাপক যে, আমাদের পূর্বপুরুষদের যাবতীয় রীতি-নীতিকেই একেবারে বিসর্জন দিতে হবে এবং দেশের চলমান জীবন ধারার সার্বিক পরিবর্তন সাধন করতে হবে?

        নামায যে, মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের কার্যকরী মাধ্যম এ আয়াতগুলো সে কথাই ব্যক্ত করে। বস্তুত নামায মানুষকে সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর সার্থক গোলাম বানানোর জন্য প্রস্তুত করে থাকে। এ কথা মনে রাখতে হবে, ঈমানের পরে নামাযই সর্বাগ্রগণ্য দাবী। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

 إِنَّنِي أَنَا اللهُ لا إلهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي وأقم الصلوةَ لِذِكْرِى

        আমি আল্লাহ, আমি ছাড়া আর কেউ ইলাহ নেই। অতএব তুমি আমার বন্দেগী করো এবং আমার স্মরণে নামায কায়েম করো। (সূরা ত্বাহা-১৪)

 قُلْ إِنْ هُدَى اللَّهِ هُوَ الْهُدى وَأُمِرْنَا لِنُسلِمَ لِرَبِّ الْعَلَمِينَ وَأَنْ أَقِيمُوا الصَّلوةَ وَاتَّقُوْه وَهُوَ الَّذِي إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ

        হে নবী বলুন, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর হিদায়েতই সত্যিকারের হিদায়াত। তাঁর নিকট হতে আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, সারা জাহানের মালিকের সম্মুখে আনুগত্যের মস্তক অবনত করে দাও। নামায কায়েম করো, তাঁর নাফরমানী হতে দূরে থাকো। তোমরা সকলে পরিবেষ্টিত হয়ে তাঁরই নিকট একত্রিত হবে?। (আনয়াম-৭১-৭২)

ذلك الكتب لا رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِلْمُتَّقِينَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلوةَ

        এই কিতাব ঐ সব মুত্তাকীদের জন্য হিদায়াত, যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস রাখে ও নামায কায়েম করে। (সূরা আল বাকারা-২)

        কোরআনের বর্ণানানুযায়ী এক ব্যক্তির ঈমান গ্রহণ করার পর আমলের মধ্যে সর্বপ্রথম তার থেকে নামাযকেই দাবী করা হয়। এটা এমন এক আমল যার জন্য শুধু ঈমানই শর্ত হিসেবে রয়েছে। এ জন্য ঈমান গ্রহণের সাথে সাথে ধনী-গরীব, রাজা-প্রজা ও নারী-পুরুষ প্রত্যেকের ওপরই দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ করা হয়েছে। নামায ঈমান থাকা না থাকার প্রমাণ। মহান আল্লাহ বলেন-

فَلَا صَدَّقَ وَلَا صَلَّى - وَلَكِنْ كَذَّبَ وَتَوَلَّى

        কিন্তু না সে সত্য মেনে নিল, না সালাত আদায় করলো, বরং সত্যকে মিথ্যা মনে করলো এবং ফিরে গেল। (সূরা আল কিয়ামাহ-৩১-৩২)

        কোরআনের এ আয়াতগুলোর বাচনভঙ্গীর প্রতি গভীর মনোনিবেশ করলে অবশ্যই প্রতীয়মান হয় যে, মানুষের ঈমান ও নামায পরস্পর ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত বিষয়। অর্থাৎ কেউ ঈমান গ্রহণ করলে সে অবশ্যই নামায কায়েম করবে, অপরদিকে কারো বে-নামাযী হওয়াই প্রমাণ করে যে, তার অন্তর বে-ঈমানী, দুনিয়া পূজা ও অহংকারে পূর্ণ। পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে-

فِي جَنَّت يَتَسَاءَ لُوْنَ عَنِ الْمُجْرِمِينَ مَا سَلَكَكُمْ فِي سَقَرَ قَالُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ

        জান্নাতীরা অপরাধী লোকদের জিজ্ঞেস করবে, কোন্ জিনিসটি তোমাদেরকে জাহান্নামে নিয়ে গেছে? তারা বলবে, আমরা সালাত আদায়কারীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলাম না। (সূরা মুদ্দাসির-৪০-৪৩)

        আল্লাহ তায়ালা জান্নাত-জাহান্নাম এই দুটি ঠিকানা যথাক্রমে মু'মিন ও কাফিরদের জন্য প্রস্তুত করেছেন। জান্নাত ও জাহান্নামে যাবার কারণ মানুষের ঈমান ও কুফরী। আখিরাতের জিন্দেগীতে সমস্ত গায়েবী বিষয় যখন মানুষের সামনে পূর্ণভাবে উন্মুক্ত হয়ে পড়বে, তখন জাহান্নামীদের এ জবাব যে আমরা নামাযী ছিলাম না বিধায় জাহান্নামের ইন্ধন হয়েছি- মূলতঃ এ কথাই প্রকাশ করে যে, নামায ও ঈমান প্রকৃতপক্ষে একই জিনিস। একই জিনিসের দু'টি বিশেষ দিক। আকীদাগত দিক থেকে ঈমান হলো তাওহীদের স্বীকৃতি, আর আমলের দিক থেকে নামায হলো-তাওহীদের বহিঃপ্রকাশ। জাহান্নামীদের নামাযী না হবার অর্থ তারা ঈমানদার ছিল না। বস্তুত নামায বঞ্চিত লোক ঈমান থেকেও বঞ্চিত হয়ে থাকে। এজন্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন-

الْعَهْدُ الَّذِي بَيْنَنَا وَبَيْنَهُمْ الصَّلاةُ فَمَنْ تَرَكَهَا فَقَدْ كَفَرَ 

        আমাদের এবং অমুসলিমদের মধ্যে (পার্থক্য সূচিত করে) নামাযের প্রতিশ্রুতি, যে নামায পরিত্যাগ করেছে সেই কুফুরী অবলম্বন করেছে। (মুসলিম, আবু দাউদ)

بَيْنَ الْعَبْدِ وَ بَيْنَ الْكُفْرِ تَرْكُ الصلوة

        মুমিন বান্দা আর কাফিরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে নামায। (মুসলিম, আবু দাউদ) প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের জীবনের সবটুকুই নামাযের বাস্তব অনুশীলন। এই নামাযই মুসলমানদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এ জন্যই পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে-

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَلَمِينَ لَا شريك له

        বলো আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু সব কিছুই সারা জাহানের রব আল্লাহর জন্যই, তাঁর শরীক কেউ-ই নেই। (আনয়াম-১৬২-১৬৩) উল্লেখিত আয়াতে চারটি বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে-নামায, কুরবানী, জিন্দেগী ও মৃত্যু। ধারাবাহিকতায় নামাযের মোকাবেলায় জিন্দেগী এবং কুরবানীর মোকাবেলায় মৃত্যুকে রাখা হয়েছে। এভাবে ক্রমিক সাজানোর মধ্যে একটি নিগুঢ় তত্ত্বের দিকে সূক্ষ ইঙ্গিত রয়েছে। তা হচ্ছে, নামাযই মূলতঃ জিন্দেগী। যেভাবে আল্লাহর জন্য আমাদের মৃত্যু যা হল কুরবানী, তেমনি আল্লাহরই জন্য আমাদের জিন্দেগী অর্থ আল্লাহর জন্য আমরা নামায কায়েম করবো। যে নামায আদায় করবে না, সে ইসলামের মধ্যে শামিল নেই, এ কথা পবিত্র কোরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلوةَ وَاتَوُا الزَّكَوةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدين

        এখন যদি তারা তাওবা করে, নামায কায়েম ও যাকাত দেয় তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই। 
(সূরা তাওবা-১১)

        সূরা তওবার এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মুশরিক, ইয়াহুদী ও মুনাফিকদের থেকে সম্পর্কচ্ছেদ ও অসন্তুষ্টির ঘোষণার পাশাপাশি ও মু'মিনদেরকে তাদের থেকে নিজেদের সমাজকে পাক-পবিত্র করে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের ভ্রান্ত চিন্তা-দর্শন ও কলুষিত ধ্যান-ধারণা মুসলিম সমাজের ওপর কোনরকম প্রভার ফেলতে পারে এমন কোন সুযোগ তাদেরকে না দেয়ার তাকীদ করা হযেছে। কিন্তু এর সাথে সাথে একথাও বলা হয়েছে যে, এখনো যদি তারা নিজেদের কুফরী জিন্দেগী হতে তাওবা করে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে তাহলে তাদের কেবল জান-মালের নিরাপত্তাই প্রদান করা হবে না- উপরন্তু তারা মুসলমানদের দ্বীনি ভাই হয়ে যাবে। মুসলিম সমাজ তাদেরকে নিজেদের সমাজে মিলিয়ে নেবে। অন্যান্য মুসলমানদের ন্যায় তাদেরও এ সমাজে সব রকমের সামাজিক অধিকার সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। সকলক্ষেত্রে উন্নতির সুযোগ সুবিধার সব পথ তাদের জন্যেও উন্মুক্ত থাকবে।

        উল্লেখ্য যে, তাদের ঈমানের যথার্থতা প্রমাণের জন্য অবশ্যই তাদের কার্যতঃ নামায কায়েম করতে হবে ও যাকাত দিতে হবে। এর মাধ্যমে তাদের ঈমানের সাক্ষ্য পেশ করা হবে। বস্তুত নামায ও যাকাত ব্যতীত তাদের ঈমান কিভাবে গ্রহণযোগ্য' বিবেচিত হতে পারে? কেননা ঈমান তো মৌলিক কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় না বরং ঈমান ঐ বিপ্লবাত্মক বাস্তবতা যে, যখন এর শিকড় মানুষের অন্তরের যমীনে মজবুতভাবে প্রোথিত হয়, তখন তার চরিত্রে এমন এক বৃক্ষের জন্ম হয় যার শাখা-প্রশাখা চতুর্দিকে প্রসারিত হয়ে মানুষের গোটা জীবনের ওপর ছায়া ফেলে এবং এর সুমিষ্ট ফলরাজি দ্বারা সার্বিকভাবে সব সময় গোটা: সমাজ উপকৃত হতে থাকে।

        এমতাবস্থায় কারো ঈমানের যথার্থতা কিসের ভিত্তিতে প্রমাণ করা যাবে যার ঈমান বৃক্ষের দু'চারটি শাখা, জীবন ও সমাজের ওপর ছায়া ফেলেনি? বস্তুত কাফির মুশরিকদের কুফরী জিন্দেগীর বুনিয়াদী ভ্রষ্টতা হচ্ছে যে, তাদের মধ্যে ঐ নামায থাকে না, যা বান্দাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে ও আল্লাহর সার্থক বান্দায় পরিণত করে। এভাবে তাদের জিন্দেগীতে যাকাতও থাকে না যা মানুষের মনে আল্লাহর প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করে আল্লাহর বান্দাদের অধিকার ও দাবী পূরণের অনুভূতি জন্মায়।

        মুসলমানরা রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভ করলে তাদের সর্বপ্রথম কাজ হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে নামায ও যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা করা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে এ কথা বলা যায় যে, ইসলামে ক্ষমতা গ্রহণের মৌলিক উদ্দেশ্য হলো নামায কায়েম করা। মহান আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

الَّذِينَ إِنْ مَّكَّنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلوةَ وَاتَوُ الزكوة

        মুমিনরা সেই লোক যে, তাদেরকে আমি যদি যমীনে ক্ষমতা দান করি তবে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে। (সূরা আল হাজ্জ-৪১)

        সমাজে নামায ও যাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন করাই যে ইসলামী ক্ষমতার মূল উদ্দেশ্য উল্লেখিত আয়াত তা অতি পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করেছে। আর নামায ও যাকাত ব্যবস্থা চালু হবার তাৎপর্য হলো, আল্লাহর বান্দারা আল্লাহকে জেনে তাঁর দাসত্বের জীন্দেগীতে অভ্যস্ত হবে এবং দুনিয়া পূজার মত জঘন্য অপতৎপরতা থেকে পাক-পবিত্র হয়ে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক দায়িত্ব ও অধিকার সচেতনার ব্যাপক বিকাশ ঘটাবে।

        মুসলিম শাসক গোষ্ঠী নিজেদের জারি করা আইন বিধানের শুধুমাত্র অনুসরণই করবে না রবং সে আইন পালনের ব্যাপারে তারা নিজেদেরকে এমন পূর্ণাঙ্গ নমুনা পেশ করবে, যাতে গোটা জাতীর মধ্যে ঐ আইন পালনের সার্থক প্রেরণার উদ্রেক হয়।

        মুসলিম শাসিত রাষ্ট্রে সরকারী সমস্ত ক্ষমতা নামায কায়েম ও সমাজে যাকাতভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে ব্যয়িত হবে এবং সৎকাজের আদেশ দেবে ও অসৎকাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখবে। এ কথা মনে রাখতে হবে যে, একমাত্র নামাযই মানুষকে মহান আল্লাহর সাহায্য লাভের উপযুক্ত পাত্র হিসেবে গড়ে তোলে। পবিত্র কোরআনে সূরা মায়িদার ১২ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

وَلَقَدْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ بَنِي إِسْرَائِيلَ وَبَعَثْنَا مِنْهُمُ اثْنَى عَشَرَ نَقِيبًا - وَقَالَ اللهُ إِنِّى مَعَكُمْ لَئِنْ أَقَمْتُمُ الصَّلوةَ وَاتَيْتُمُ الزكوة

        আল্লাহ বনী ইসরাইলের নিকট হতে দাসত্বের পূর্ণ ওয়াদা নিয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে বারজন নকীব নিযুক্ত করেছিলেন। তাদেরকে তিনি বলেছিলেন, আমি তোমাদের সাথেই রয়েছি যদি তোমরা নামায কায়েম করো ও যাকাত দাও।

        বনী ইসরাইলের বারটি গোত্র ছিল। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক গোত্রের জন্য স্ব-স্ব গোত্র হতে একজন করে নকীব নিযুক্ত করেছিলেন। নকীবের কাজ ছিল নিজ গোত্রের লোকদেরকে ইসলাম প্রদর্শিত পথের দিকে আহ্বান করা তথা মহান আল্লাহর গোলামী করার ব্যাপারে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা। আর বনী ইসরাইলদের কর্তব্য ছিল এই নকীবদের অনুসরণের ব্যাপারে আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পুরাপুরিভাবে প্রতিপালন করা। আল্লাহ তাদেরকে পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছিলেন যে, আমার সাহায্য সহযোগিতা তোমাদের প্রতি তোমাদের নামায কায়েম রাখা অবধি অবশ্যই বলবৎ থাকবে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, যে ব্যক্তি জেনে বুঝে নামায আদায় ত্যাগ করবে, আল্লাহ তায়ালার সাথে তার কোনো সম্পর্ক থাকবে না।

        নামায আধ্যাত্মিক শক্তির উৎস তথা একমাত্র নামাযই মানুষকে মহান আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি করে দেয়। এ জন্যই আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বলেছেন-

يأَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ قُمِ اللَّيْلَ إِلَّا قَلِيلًا نَصْفَهُ أَوِ انْقُصْ مِنْهُ قَلِيلاً أَوْزِدْ عَلَيْهِ وَرَتِّلِ الْقُرْآنُ تَرْتِيلاً إِنَّا سَنُلْقِى عَلَيْكَ قَوْلاً ثَقِيلاً

        হে কম্বল আচ্ছাদনকারী। রাত্রিকালে সালাতে দণ্ডায়মান হয়ে থাকো। কিন্তু কম অর্ধেক রাত্রি কিংবা তা হতে কিছুটা কম করে দাও, অথবা তা হতে কিছু বেশি বৃদ্ধি করে। আর কোরআন থেমে থেমে পড়ো। আমি তোমার ওপর এক দুর্বহ ফরমান পালনের দায়িত্ব অর্পণ করবো। (সূরা আল মুয্যাম্মিল-১-৫)

        "ভারী ফরমান পালনের দায়িত্ব" বলে উল্লেখিত আয়াতে ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজ বুঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই দায়িত্ব পালন পৃথিবীর সমস্ত দায়িত্ব পালনের চেয়ে ভারী এবং কঠিন। মহান আল্লাহর বিশেষ সাহায্য সহযোগিতা ব্যতীত এই গুরু দায়িত্ব যথাযথভাবে প্রতি পালন করা করো পক্ষে সম্ভব নয়। 

        এ জন্য গভীর রাতে একাকী আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে বিনয় নম্রতা সহকারে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে নামায আদায় করাই এর জন্য শক্তি সঞ্চয়ের একমাত্র মাধ্যম। এতেই মানুষের মধ্যে ঐ রুহানী শক্তির সৃষ্টি হতে পারে যাতে সে সকল বাতিল শক্তির মোকাবেলায় দৃঢ়পদে আল্লাহর পয়গাম পৌছাতে পারে এবং সর্বপ্রকার নাজুক ও কঠিন মুহূর্তেও দ্বিনী আন্দোলনের কাজ যথাযথভাবে আন্‌ন্জাম দিতে পারে। নামায ধৈর্য ও দৃঢ়তার একমাত্র উৎস এবং এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তা'য়ালা ঘোষণা করেছেন-

        হে রাসূল! তুমি ও তোমার সাথীরা, যারা কুফরী ও বিদ্রোহ থেকে ঈমান ও আনুগত্যের দিক ফিরে এসেছে সত্য ও সঠিক পথে অবিচল থাকো, যেমন তোমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে এবং বন্দেগীর সীমা অতিক্রম করো না। তোমরা যা কিছু করছো তার ওপর তোমাদের রব দৃষ্টি রাখেন। এ জালিমদের দিকে মোটেই ঝুঁকবে না, অন্যথায় জাহান্নামের গ্রাসে পরিণত হবে। তোমরা এমন কোনো পৃষ্ঠপোষক পাবে না যে আল্লাহর হাত থেকে তোমাদের রক্ষা করতে পারে। আর কোথাও থেকে তোমাদের কাছে কোনো সাহায্য পৌঁছুবে না। আর দেখ, নামায কায়েম করো দিনের দু'প্রান্তে এবং রাতের কিছু অংশ অতিবাহিত করার পথ। আসলে সৎকাজ অসৎ কাজকে দূর করে দেয়। এটি একটি স্মারক, তাদের জন্য যারা আল্লাহকে স্মরণ রাখে। আর সবর করো, কারণ আল্লাহ সৎকর্মশীলদের কর্মফল নষ্ট করেন না। 
(সূরা হুদ-১১২-১১৫)

        সূরা হুদ মুসলমানদের মক্কার জিন্দেগীর শেষ পর্যায়ে অবতীর্ণ সূরা সমূহের একটি। এ সময়টা মুসলমানদের জীবনে চরম পরীক্ষার সময় ছিল। মুসলমানগণ এ সময় নিদারুন অসহায় অবস্থায় জুলুম-নির্যাতন ভোগ করছিল। মক্কার কাফির মুশরিকরা এই হকপন্থী লোকদের ওপর মক্কার বিস্তীর্ণ এলাকা সংকীর্ণ করে রেখেছিল।

        এই অসহায়ত্ব ও জুলুমের নাজুক অবস্থায় আল্লাহ মুসলমানদের হিদায়াত প্রদান করে বলেন- দেখ, তোমরা যে সত্য দ্বীন গ্রহণ করেছো, তা ঐ আল্লাহর দ্বীন, যার কর্তৃত্বে নিখিল জাহানের সবকিছুই রয়েছে। যিনি সকল শক্তির উৎস। তোমরা সে শক্তিধর মহান আল্লাহর অনুগত সিপাহী। দেখ, ঐ জালিমদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ঘাবড়ে গিয়ে কল্যাণের খাতিরে কোনো সমঝোতার জন্য তাদের প্রতি ঝুঁকবে না। অন্যথায় মনে রেখ, কঠোর নীতিধর আল্লাহর আঘাত হতে তোমাদের রক্ষা করার কেউ নেই। এই আল্লাহ-ই তোমাদের সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষক। তিনি তোমাদের প্রকৃত বন্ধু ও ব্যবস্থাপক। একমাত্র তাঁরই ওপর ভরসা রাখো। তাঁর প্রেরিত দ্বীনে হকের ওপর একাগ্রচিত্তে মজবুত হয়ে থাক। তাঁরই কাছে ধৈর্য ও দৃঢ়তার জন্যে দোয়া করো নামাযের মাধ্যমে, তাঁর কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করো। সম্পর্ক তার সাথেই মজবুতভাবে গড়ো যথাযথভাবে নামায আদায়ের মাধ্যমে। বস্তুত দ্বীনে হকের অনুসরণই উভয় জাহানের কল্যাণের নিশ্চয়তা। অবশ্য এপথ নানা ধরনের কষ্ট-ক্লেশ ও পরীক্ষার দুর্গম পথ। কিন্তু আল্লাহর অনুগত ধৈর্যশীল বান্দারা পথের এই দুর্গমতা দেখে কখনো হক থেকে ঘাড় ফিরিয়ে নেয় না। এ জন্যই আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন, তোমরা দ্বীনি আন্দোলনের পথের এসব নাজুক অবস্থা ও কাঠিন্য বরদাশত করার শক্তি লাভের উদ্দেশ্যে নামায কায়েম করো। এই নামাযই ধৈর্য ও দৃঢ়তা সঞ্চয়ের উৎস। এর মাধ্যমেই বান্দার মধ্যে ঐ শক্তি অর্জিত হয় যা তাকে বিরোধিতার তীব্র ঝড় ঝঞ্ঝায় পাহাড়ের মত অনড় অটল করে রাখে।

        অতএব তোমরা সকাল-সন্ধ্যা ও রাতের কিছু অংশ অতিবাহিত হবার পর নামায আদায়ে দাঁড়িয়ে যাও যেন তোমাদের মাঝে ধৈর্য ও দৃঢ়তা অবলম্বনের ঐ অসীম শক্তি সঞ্চিত হয়। ফলে কঠিনতম অবস্থায়ও তোমরা অনঢ়-অটল থাকতে পারো। আল্লাহভীতি ও নামায প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই মানুষের মধ্যে উপদেশ গ্রহণ করার যোগ্যতা সৃষ্টি হয়। তাকে সত্যানুসন্ধানী বানায় এবং দৃষ্টিভঙ্গীতে স্বচ্ছতা আনে। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

إِنَّمَا تُنْذِرُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَيْبِ وَأَقَامُوا الصَّلوةَ

হে নবী! তুমি কেবল তাদেরকে সতর্ক করতে পারো যারা তাদের রবকে না দেখে ভয় করে এবং সালাত কায়েম করে। (সূরা আল ফাতির-১৮)

Post a Comment

0 Comments