মদীনায় হিজরতকালে বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে সন্ত্রাসীদের দৃষ্টি এড়িয়ে নবী করীম (সা:) এবং হযরত আবু বকর (রা:) সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। সে পথ ধরেই হযরত যুবাইর (রা:) সিরিয়া থেকে ব্যবসায়িক পণ্যসহ মক্কায় ফিরছিলেন। নবী করীম (সা:) এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটলো। হযরত যুবাইর (রা:) তাঁদেরকে কয়েকটি কাপড় উপহার দিলেন। সেই দুঃসময়ে অসহায় অবস্থায় ঐ সামান্য কাপড় যেন অসামান্য হয়ে দেখা দিয়েছিল। কিছুদূর এগিয়ে যাবার পরে পুনরায় নবী করীম (সা:) বাধার মুখোমুখি হলেন। মক্কার ইসলাম বিরোধিরা বিশ্বনবী (সা:) কে গ্রেফতার করতে পারলে কি পুরস্কার পাওয়া যাবে তা দূর-দূরান্তেও প্রচার করে দিয়েছিল। পুরস্কারের লোভে অনেকেই ননবী করীম (সা:) এর সন্ধানে বের হয়েছিল। আসলাম গোত্রের প্রধান বারিদা তাঁর অনুগত ৭০ জন সাহসী যোদ্ধাসহ অবরোধ করেছিলো। নবী করীম (সা:) সে পথেই মদীনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।
সামনে একদল অস্ত্রে সজ্জিত লোক দেখে নবী করীম (সা:) মধুর কন্ঠে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াৎ করতে থাকলেন। পবিত্র কুরআনের জান্নাতি সুরের তরঙ্গ সম্মুখে দণ্ডায়মান মানুষগুলোর কানে প্রবেশ করে তাদের ভেতরের জগৎ সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দিল। যেখানে ছিল অন্ধকার সেখানে পবিত্র কুরআনের সুর মুহূর্তে তাওহীদের পবিত্র উজ্জ্বল শিখা জ্বালিয়ে দিল। আসলাম গোত্র প্রধান বারিদা বিনয়ের ভঙ্গিতে রাসূল (সা:) এর দিকে এগিয়ে এলেন।
নবীর পবিত্র মুখমণ্ডলের প্রতি কিছুক্ষণ নির্নিমেষে তাকিয়ে রইলেন। এই মানুষটি সম্পর্কে মক্কার আবু জাহিল আর তার দলবল যে মিথ্যে অপবাদ প্রচার করেছে তা যেন গোত্র প্রধান বিশ্বনবী (সা:) এর পবিত্র চেহারায় অনুসন্ধান করতে লাগলেন। দীর্ঘক্ষণ তিনি দেখলেন। পবিত্র চেহারা দেখে তাঁর যেন সাধ আর মিটে না। মানুষটির মুখে সামান্যতম কলংকের আঁচড় নেই। তাহলে আবু জাহিলরা যা প্রচার করেছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা! আকাশের চাঁদেও সামান্য কালো দাগ আছে, কিন্তু আল্লাহর নবীর চেহারায় তা-ও নেই।
বারিদা নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না। দীন ভিখারীর মতই বিশ্বনবীর কাছে আত্মসমর্পণ করে জানালেন, 'হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমাদের ক্ষমা করুন! অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে আমরা আপনার বিরুদ্ধে এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাদের আপনি মুসলমানদের দলে স্থান করে দিন'।
একথা বলেই আসলাম গোত্র প্রধান বারিদা কালিমা পাঠ করে মুসলমান হয়ে গেলেন। তাঁর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে তাঁর সকল সাথী বজ্রকণ্ঠে কালেমা পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করলেন।
মহান আল্লাহর কি অদ্ভুত ব্যবস্থা! কোথায় নবী করীম (সা:) একাকী ছিলেন। মানুষের পক্ষ থেকে তাঁর কোনো নিরাপত্তার সামান্য ব্যবস্থা ছিল না। আর এখন তাঁর নিরাপত্তায় ৭০ জন বীর যোদ্ধা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাঁকে প্রহরা দিচ্ছে। বারিদা (রা:) এর সাথের যোদ্ধারা তাদের শিরস্ত্রাণ বর্শার অগ্রভাগে বেঁধে পতাকা বানিয়ে নিয়ে সে পতাকা উড়িয়ে সামনে অগ্রসর হলো। এক বিশাল মিছিল মহাসত্যের বিজয় কেতন উড়িয়ে আল্লাহর নবীকে পরিবেষ্টন করে মদীনা অভিমুখে এগিয়ে চললো।
ইসলামপন্থীদের প্রাণপ্রিয় শ্লোগান 'আল্লাহু আকবার' ধ্বনীতে দিকদিগন্ত মুখরিত হয়ে উঠলো। মহাত্রাসে বাতিল শক্তি থরথর করে কেঁপে উঠলো। ইসলাম বিদ্বেষী বন্ধুরা দেখুন, ইসলাম তরবারীর শক্তিতে নয়, কোন্ শক্তির কারণে ইসলাম পৃথিবী ব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা অনুধাবন করে অনুগ্রহ পূর্বক সত্য উপলব্ধি করে উদারতার পরিচয় দিন।
৭০ জন রক্ত পিপাসু ভয়ংকর সন্ত্রাসী কিভাবে কোন্ মায়াবলে মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানবে পরিণত হলো! যারা নবী করীম (সা:) কে হত্যা করে ১০০ উট পুরস্কার গ্রহণ করবে, তাঁরাই তাঁর সামনে এসে নিজেদের ঘৃণ্য সন্ত্রাসী প্রবৃত্তিকে হত্যা করে এমন এক জীবন গ্রহণ করলো, পৃথিবী ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে শতকোটি মানুষ পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।
৭০ টি ঘোড়ার পিঠে ৭০ জন বীর যোদ্ধা, তাদের হাতের সুতীক্ষ্ম তরবারী সূর্য কিরণে ঝলসে উঠে ইসলামের বিজয় ঘোষণা করলো। বারিদা (রা:) সামনে অগ্রসর হচ্ছেন আর কবিতা আবৃত্তি করছিলেন। তাঁর সে কবিতার অর্থ হলো, 'শান্তির সম্রাটের আগমন ঘটেছে। মুক্তিদাতা আগমন করছেন। যিনি সন্ধি স্থাপন করবেন তিনি আগমন করছেন। যিনি সত্য এবং ন্যায় স্থাপন করে পৃথিবীতে জান্নাতের শান্তি প্রতিষ্ঠিত করবেন তিনি আগমন করছেন। পৃথিবীবাসীর কাছে আজকের এটাই শুভ সংবাদ'। (ইবনে জওযী, আল ইসাবা, মাদারেজ)
বিশ্বনবী (সা:) মদীনা যাওয়ার সহজ পথ পরিহার করে গোপন পথে যাত্রা করেছিলেন। সে পথ ছিল বড় বন্ধুর। পথ প্রদর্শক তাদেরকে নিয়ে মক্কার নিম্ন অঞ্চল দিয়ে প্রথমে উপকূল এলাকায় গিয়েছিল। সেখান থেকে উসফান এলাকার নিম্ন অঞ্চল দিয়ে আমাজের নিম্ন এলাকা হয়ে কুসাইদ এলাকা অতিক্রম করে খাররার নামক স্থানে এসে থেমে ছিল। তারপর লেকফ এবং মাদলাজ লেকফ এলাকা অতিক্রম করে মাদলাজ মাহাম নামক স্থানে উপনীত হয়েছিল।
0 Comments