নামাযের প্রথম শর্ত আদায় হবার পর নামায আদায়ের স্থানে দাঁড়িয়ে প্রথমেই পাঠ করা হয়-
إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِي لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَوتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ
আমার মুখমন্ডলকে আমি ফিরিয়ে সেই মহান সত্তার দিকে কেন্দ্রীভূত করছি, যিনি আকাশমন্ডল ও ভূ-মন্ডল সৃষ্টি করেছেন, আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। (সূরা আন'য়াম-৭৯)
নামায আদায়ের সূচনাতেই সর্বপ্রথম পবিত্র কোরআনের এই আয়াত তিলাওয়াত করে তারপর নামাযের জন্য হাত বাঁধা হয়। যদিও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ বা তাবে-তাবেঈগণ কোরআনের এই আয়াত নামায আদায়ের পূর্বে নামাযের স্থানে দাঁড়িয়ে তিলাওয়াত করেছেন বলে জানা যায় না। কোরআনের যে আয়াত তিলাওয়াত করে নামাযের সূচনা করা হয়, এই আয়াতে বলা কথাগুলো মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস্ সালামের। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত ইবরাহীমের ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে এই কথাগুলো পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেছেন।
আল্লাহ তা'য়ালা হযরত ইবরাহীমকে যে জাতিকে সঠিক পথপ্রদর্শনের লক্ষ্যে প্রেরণ করেছিলেন, সেই জাতি ছিলো পথভ্রষ্ট। তারা মহান আল্লাহর গোলামী ত্যাগ করে আল্লাহর সৃষ্ট আগুন, পানি, মাটি, বৃক্ষ, পাথর, আকাশের চন্দ্র-সূর্য ও তারকামালার পূজা উপাসনা করতো। এসবকেই তারা অসীম শক্তিশালী কল্পনা করে নিজেদের আবেদন-নিবেদন পেশ করতো। আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত দেশের নেতৃবৃন্দের চিন্তা ও কল্পনা প্রসূত নীতি আদর্শের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিতিমালা পরিচালিত হতো। এক কথায় জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে যেসব নিয়ম-নীতি ও আইন-কানুন অনুসরণ করা হতো, তা ছিলো মানুষের বানানো। আর ধর্মীয় দিক থেকে অনুসরণ করা হতো ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ কর্তৃক প্রবর্তিত নীতি-পদ্ধতি।
১৯০৩ সনের পরে C. H. W. John কর্তৃক লিখিত The oldest code of Law নামক গ্রন্থ পাঠে জানা যায়, হযরত ইবরাহীম যে জাতির মধ্যে আগমন করেছিলেন, সেই জাতির মধ্যে শির্ক একটি ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূর্তি পূজা সমন্বিত আরাধনা -উপসানার সমষ্টিই শুধু ছিলো না, বরং তা ছিলো সেই জাতির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সভ্যতা-সংস্কৃতিক জীবনাদর্শের ভিত্তি। আল্লাহর নবী হযরত ইবরাহীম আলাইহিস্ সালাম এসবের মোকাবেলায় এক নির্ভেজাল ও অকৃত্রিম তাওহীদের দিকে জাতিকে আহ্বান জানাচ্ছিলেন। তিনি মানুষকে একমাত্র মহান আল্লাহর গোলামী কবুল করার দাওয়াত পেশ করছিলেন। মূর্তি, গাছ-পাথর, নদী-সাগর, চন্দ্র-সূর্য ও তারকামালাকে সর্বশক্তির কেন্দ্র কল্পনা করে যারা এসবের পূজা করতো, তাঁর দাওয়াতের আঘাত শুধুমাত্র তাদের ওপরই পড়ছিলো না, রাজবংশের একজন হওয়ার কারণে যারা নিজেদেরকে পূজ্য মনে করতো, সার্বভৌমত্বের অধিকারী মনে করতো, ধর্মীয় নেতা হওয়ার কারণে সব ধরনের আইন-কানুনের ঊর্ধ্বে মনে করতো, দেশের উচ্চ শ্রেণীর লোকদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা তথা সারা দেশের সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থার ওপরও হযরত ইবরাহীম আলাইহিস্ সালামের এই দাওয়াত প্রত্যক্ষভাবে আঘান হানছিলো।
তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয়ার অর্থ ছিলো, সমাজের তৃণমূল থেকে দেশের দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে যারা শির্ক ভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলো, তাদের গড়া সেই শিরকের প্রাসাদকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়ে মহান আল্লাহর দেয়া জীবন বিধানের ভিত্তিতে সমাজ ও দেশকে নতুনভাবে সাজানো। শিরকে নিমজ্জিত এই জাতি ও তাদের শাসকদের সম্মুখে মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস্ সালাম যখন ঘোষণা দিলেন, 'আমার মুখমন্ডলকে আমি ফিরিয়ে সেই মহান সত্তার দিকে কেন্দ্রীভূত করছি, যিনি আকাশমন্ডল ও ভূ-মন্ডল সৃষ্টি করেছেন, আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।' তখন সেই জাতি স্পষ্ট অনুভব করতে পেরেছিলো, ইবরাহীম কি বলছে এবং তাঁর এই ঘোষণার অর্থ কি। এ জন্যই সেই জাতির ও জাতির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, সমাজের এলিট শ্রেণী ও জাতির শাসক শ্রেণী- সকলে একযোগে হযরত ইবরাহীমের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য সম্মিলিতভাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলো।
একটি প্রতিষ্ঠিত সরকার ও শক্তিশালী জাতির বিরুদ্ধে মাত্র একটি কণ্ঠ ঘোষণা করলো, তোমরা যাদেরকে সর্বশক্তির অধিকারী কল্পনা করে পূজা ও আরাধনার আসনে বসিয়েছো, আমি তাদেরকে মিথ্যা মনে করি। তোমরা যাদেরকে নিজেদের মাবুদ মনে করো, আমি তাদেরকে মাবুদ মনে করি না- বরং তারা সবাই আমার মাবুদ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সৃষ্টি। তোমরা যাদেরকে আইন-কানুন প্রণেতা বলে পূজা করো এবং তাদের প্রণীত আইন-বিধান অনুসরণ করো, আমি তাদেরকে মানি না এবং তাদের প্রণীত বিধানের আনুগত্যও করি না। বরং আমার বিশ্বাস হলো, আইন-কানুন প্রণয়ন করার ক্ষমতা কেবলমাত্র মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এবং তিনিই একমাত্র সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। কারণ তিনিই এই বিশাল আকাশমন্ডলী ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। সমস্ত জগৎ ও এর মধ্যে যা কিছু রয়েছে, এসব কিছুর তিনিই প্রতিপালক, পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক। সুতরাং সৃষ্টি যার, আইন চলবে তাঁর এবং তিনিই কেবলমাত্র দাসত্ব লাভের অধিকারী।
প্রতিষ্ঠিত সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি দেশের মধ্য থেকে মাত্র একটি কন্ঠ এই ঘোষণা উচ্চারণ করলো, একটি মাত্র কন্ঠের উচ্চারণে দেশের প্রতিষ্ঠিত সরকারের গদি থর থর করে কেঁপে উঠলো। অবশেষে সে দেশের সরকার প্রধান জুতা পেটা খেয়ে অপমানিত ও লাঞ্ছিত অবস্থায় পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করতে বাধ্য হলো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে, মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস্ সালামের একক কণ্ঠে যে ঘোষণা উচ্চারিত হয়েছিলো, সেই একই ঘোষণা সম্পূর্ণ অপরিবর্তনীয় ভাষায় বর্তমানে প্রতিদিন শত-কোটি কণ্ঠে নামাযের সূচনাতে উচ্চারিত হচ্ছে, কিন্তু ইসলাম বিরোধী শক্তির মসনদে কম্পন সৃষ্টি হচ্ছে না। অযূত কণ্ঠে সেই একই উচ্চারণ শুনেও দ্বীনের দুশমনরা সামান্যতম বিচলিত হচ্ছে না। এর অর্থ হলো, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস্ সালাম যখন এই ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন সেই ঘোষণার মধ্যে যে প্রাণশক্তি বিদ্যমান ছিলো, বর্তমানে সেই ঘোষণা ঠিকই রয়েছে বটে, কিন্তু এর মধ্যে নেই কোনো প্রাণশক্তি। ফলে অযূত কন্ঠের ঘোষণা বাতিল শক্তির মসনদে আঘাত হানতে সমর্থ হচ্ছে না।
0 Comments