পাহাড়-পর্বতসমূহের উৎপত্তি কি ভাবে ?

        এ কথা আমরা সবাই জানি যে, এই পৃথিবীর পৃষ্ঠ অসমান। পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর ইত্যাদি থাকার কারণে এই ভূ-পৃষ্ঠ সমান নয়-অসমান। কিন্তু বিছানা তো অসমান হয় না-তাহলে আল্লাহ এই ভূ-পৃষ্ঠকে বিছানা বলে কোরআনে কেন উল্লেখ করেছেন? এ প্রশ্নের উত্তর হলো, বিছানা বা কার্পেট এ দুটো জিনিস ব্যবহার করা হয় কোন কিছুকে ঢেকে বা আবৃত করার জন্য। বিজ্ঞানীগণ বলেন, এই পৃথিবীর ভেতরের অংশ উত্তপ্ত কঠিন এবং গলিত অবস্থায় রয়েছে। এই উত্তপ্ত গলিত অংশ উপযুক্ত পরিবেশের ভূ-পৃষ্ঠ দিয়ে আল্লাহ ঢেকে দিয়েছেন বা আবৃত করে দিয়েছেন বলেই এই যমীনের ওপরে বসবাস করা সম্ভব হয়েছে। ভোগবহুল জীবন ব্যবস্থার যাবতীয় উপকরণ বা জিনিস যমীন নামক এই ঢাকনার ওপরে বিদ্যমান। এ কারণেই এই ভূ-পৃষ্ঠকে বিছানার সাথে তুলনা করা হয়েছে। মানুষ আকারে খুবই ছোট, এ কারণে তার চারদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে সে পৃথিবীকে অসমতল দেখতে পায়। আসলে বিশাল এই পৃথিবীর আকারের তুলনায় এই পৃষ্ঠদেশের অসমতলতা অত্যন্ত নগণ্য। ছোট্ট প্রাণী পিঁপড়ার কাছে তার ঘরের মেঝে অসমতল হলেও আমরা আমাদের চোখ দিয়ে দেখতে পাই যে, পিঁপড়ার ঘর সমতল। তেমনি এই বিশাল পৃথিবীও আমাদের কাছে অসমতল বলে মনে হয়।

        পৃথিবীর ভূ-বিজ্ঞানীগণ (Geologists) পাহাড়-পর্বতসমূহের উৎপত্তি ও গঠন সম্পর্কে গবেষণা করে দেখেছেন যে, স্মরণাতীত কাল থেকে একটি বিরাট সময় পর্যন্ত পৃথিবী পৃষ্ঠে বিবর্তন হওয়ার কারণেই এসব পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর অধিক সংখ্যক পাহাড়-পর্বত বিচ্ছিন্নভাবে আল্লাহ তা'য়ালা সৃষ্টি না করে শ্রেণীবদ্ধভাবে (In ranges) সৃষ্টি করেছেন। কোন কোন পাহাড়কে ভূ-পৃষ্ঠে নিঃসঙ্গভাবে দৃষ্টি গোচর হলেও মাটির তলদেশ দিয়ে দূরে-অনেক দূরে অন্য পাহাড়ের সাথে যোগসূত্র থাকতে দেখা যায়। বিজ্ঞানিগণ পাহাড়-পর্বতগুলোর আকার-আকৃতি পর্যবেক্ষণ করে শিলা, বালু ও মাটি প্রভৃতি পরীক্ষা করে এবং অন্যান্য নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা বলেছেন, পৃথিবী প্রাথমিক পর্যায়ে ভয়ংকর ধরনের উত্তপ্ত ছিল। পর্যায়ক্রমে বির্বতনের ফলে কালক্রমে তাপ বিকিরণের কারণে পৃথিবী ঠান্ডা হয়ে সংকুচিত হতে থাকে। ভূ-পৃষ্ঠের ভিতরের অংশের অতিরিক্ত চাপের কারণে তার কিছু অংশ ওপরের দিকে ভাঁজ হয়ে ফুলে উঠতে থাকে এবং এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি হয়। একটি কমলা লেবু শুকিয়ে গেলে যেমন তার ওপরের বাকলের ওপরে যে ধরনের ভাঁজ সৃষ্টি হয়, তেমনিভাবে পৃথিবীর বুকে ভাঁজের সৃষ্টি হয়।

        বিজ্ঞানীগণ বলেন, পৃথিবীর ভিতরের অংশে অতিরিক্ত উত্তপ্ত থাকার ফলে সেখানে অস্থিরতা (Unstability) বিরাজ করছে। ভূ-পৃষ্ঠের ভেতরে প্রতি মুহূর্তে প্রচন্ড আলোড়ন হচ্ছে। এই আলোড়নের কারণে কখনো কখনো পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ বা ওপরের স্তরটি ফেটে যায় এবং সেই ফাটল দিয়ে ভূ-পৃষ্ঠের ভেতরের গলিত পদার্থ প্রচন্ড বেগে বেরিয়ে আসতে থাকে। এভাবে গলিত পদার্থগুলো ভূ-পৃষ্ঠের ওপরে জমা হয়ে কালক্রমে পাহাড়-পর্বতের সৃষ্টি হয়।

        বিজ্ঞানীগণ আরো বলেন, কোটি কোটি বছরের সময়ের বির্বতনেও ভূ-পৃষ্ঠের পরিবর্তন হয়ে কিছু সংখ্যক পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ এই তিন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি হয়েছে। মহান আল্লাহ পাহাড়-পর্বতসমূহ এ পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠের অনেক গভীরে প্রোথিত করেছেন এবং অধিক সংখ্যক পাহাড়-পর্বত শ্রেণীবদ্ধভাবে মাটির তলদেশ দিয়ে একটির সাথে আরেকটির সংযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। আর এ জন্যই ভূ-পৃষ্ঠ স্থিরতা (Stability) লাভ করেছে। ভূ-পৃষ্ঠের সুস্থিরতার ব্যাপারে পাহাড়-পর্বতের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এটা এক সাধারণ সূত্র যে, বস্তুর উষ্ণতা বৃদ্ধি পেতে থাকলে বস্তুটির অণু-পরমাণুগুলোর গতি শক্তি বৃদ্ধি লাভ করতে থাকে এবং উত্তপ্ত জিনিসের আলোড়নও বৃদ্ধি লাভ করে।

        একটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে, কোন তরল পদার্থ যেমন পানি, উত্তপ্ত করলে পানির ভেতরে অস্থিরতা বা আলোড়ন বৃদ্ধি পায় এবং এ কারণে পানির ওপরের পৃষ্ঠে নানা ধরনের স্রোত বা ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়। অবশেষে উত্তাপে পানি ফুটতে থাকে। তেমনিভাবে পৃথিবীর ভেতরের অংশও উত্তপ্ত হওয়ার কারণে গলিত পদার্থগুলোর উত্তপ্ততার জন্য এক প্রচন্ড অস্থির অবস্থায় বিরাজ করছে সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত। এই উত্তপ্ত গলিত আলোড়িত পদার্থের ওপরে পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠের ওপরি ভাগ বা মাটির স্তর বিদ্যমান।

        এই মাটির সুস্থিরতা আনয়নে পাহাড়-পর্বত ভূমিকা পালন করছে। পাহাড়-পর্বত ভূ-পৃষ্ঠের অনেক গভীর পর্যন্ত প্রোথিত থাকায় এবং বিস্তীর্ণ আয়তন জুড়ে মাটির নিচে পরস্পর সংযুক্ত থাকায় এই পৃথিবী পৃষ্ঠ স্থিরতা লাভ করেছে। পাহাড়-পর্বতগুলো মাটির নিচ দিয়ে একটির সাথে আরেকটি সংযুক্ত রয়েছে অর্থাৎ টানাটানি অবস্থায় আল্লাহ রেখেছেন। এটা এ জন্য রেখেছেন যেন পৃথিবী পৃষ্ঠের কোথাও সহজে ফাটল ধরে প্রাণী জগৎ ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। পাহাড়গুলো একটির সাথে আরেকটি বিচ্ছিন্নও হতে পারে না। পাহাড়গুলোকে আল্লাহ যদি এভাবে না রাখতেন, তাহলে পৃথিবীর এই ভূ-পৃষ্ঠ কখনও সুস্থির হতো না এবং এখানে মানুষ বসবাস করতে সক্ষম হতো না। এটা যিনি করেছেন তিনিই হলেন রাব্বুল আলামীন। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

وَالْقَى فِي الْأَرْضِ رَوَاسِيَ أَنْ تَمِيدَ بِكُمْ 

        এবং তিনি ভূ-পৃষ্ঠে পর্বতসমূহ সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যেন তোমাদের নিয়ে ভূ-পৃষ্ঠ কাঁপতে না পারে। (সূরা নাহল-১৫)

পৃথিবীর সৃষ্টি-দুর্ঘটনার ফসল নয়

        নাস্তিকদের ধারণানুযায়ী এ পৃথিবী কোন দুর্ঘটনার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়নি। এ পৃথিবী সৃষ্টির পেছনে রয়েছেন একজন মহাবিজ্ঞানী-যাঁর নাম হলো আল্লাহ। তিনি এ পৃথিবীকে পরিকল্পনা ভিত্তিক সৃষ্টি করেছেন। সূরা হিজর-এ আল্লাহ বলেন-

وَمَا خَلَقْنَا السَّمَوتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا إِلَّا بِالْحَقِّ

        আমি যমীন ও আকাশমন্ডলকে এবং এই দু'য়ের মধ্যবর্তী ঐ মহাশূন্যে যা কিছু রয়েছে, তা মহাসত্য ব্যতিত অন্য কোন ভিত্তির ওপর সৃষ্টি করিনি। 

        খেল-তামাসার বিষয়বস্তু করে এ পৃথিবী সৃষ্টি করা হয়নি। উদ্দেশ্যবিহীনভাবে কোন কিছুই এ পৃথিবীতে সৃষ্টি করা হয়নি। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

وَمَا خَلَقْنَا السَّمَاءِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا لَعِبِينَ

        আমি এই আকাশ ও যমীন এবং এর ভেতরে যা কিছুই রয়েছে, তার কোন কিছুকেই খেল-তামাসার ছলে সৃষ্টি করিনি। (সূরা আম্বিয়া-১৬)

পবিত্র কোরআন ঘোষণা করছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অবিশ্বাসীদেরকে লক্ষ্য করে বলেন-

وَمَا خَلَقْنَا السموت والأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا لعِبِينَ مَا خَلَقْنَهُمَا إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ هُمْ لَا يَعْلَمُونَ 

        এই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল এবং এর ভেতরে অবস্থিত জিনিসগুলো খেল-তামাসার ছলে সৃষ্টি করিনি। এগুলোকে আমি সত্যতা সহকারে সৃষ্টি করেছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা অবগত নয়।
 (সূরা দুখান-৩৮-৩৯)

        আল্লাহ বলেন, আমি কোন কিছুই বৃথা সৃষ্টি করিনি এবং অসুন্দর করেও সৃষ্টি করিনি। গোটা পৃথিবীর চারদিকে এবং নিজের দেহের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখো, আমার সৃষ্টির নৈপূন্যতা লক্ষ্য করো-কোথাও কোন ভুল-ত্রুটি তোমার চোখে পড়বে না। কোরআন চ্যালেঞ্জ করছে-

الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَوتِ طِبَاقًا - مَا تَرَى فِي خَلْقِ الرَّحْمَنِ مِنْ تَفُوتِ فَارْجِعِ الْبَصَرَ - هَلْ تَرَى مِنْ فُطُورٍ ثُمَّ ارْجِعِ الْبَصَرَ كَرَّتَيْنِ يَنْقَلِبْ إِلَيْكَ الْبَصَرُ خَاسِئًا وَهُوَ حَسِيرٌ - 

        তিনিই স্তরে স্তরে সজ্জিত সপ্ত আকাশ নির্মাণ করেছেন। তোমার মহাদয়াবানের সৃষ্টিকর্মে কোন ধরনের অসংগতি দেখতে পাবে না। দৃষ্টি আবার ফিরিয়ে দেখো, কোথাও কোন দোষ-ত্রুটি দৃষ্টিগোচর হয় কি? বার বার দৃষ্টি নিক্ষেপ করো, তোমাদের দৃষ্টি ক্লান্ত-শ্রান্ত ও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসবে। 
(সূরা মুলক-৩-৪) 

Post a Comment

0 Comments